জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা- ২/প্রীতম সেনগুপ্ত


শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ২

স্বামী অদ্ভুতানন্দ

                          

শ্রীরামকৃষ্ণের ষোলোজন সন্ন্যাসী সন্তানদের মধ্যে একমাত্র অবাঙালি ছিলেন স্বামী অদ্ভুতানন্দ বা লাটু মহারাজ। বাকিদের বাঙালি শরীর। সাধারণভাবে তাঁকে সকলে লাটু মহারাজ নামেই চিনতেন, বাল্যকালে নাম ছিল রাখ্তুরাম। রাখ্তুরাম থেকে লাটু-- কেমনভাবে নামের এই রূপান্তর সাধিত হল সেই বিষয়ে ক্রমশ আসব। বিহারের ছাপরা জেলার এক ছোট গাঁয়ে তাঁর জন্ম। পিতা ছিলেন মেষপালক। তাঁরা অত্যন্ত দরিদ্র ছিলেন। দু’বেলা ঠিকমতো খাবার জুটতো না।

   কোনওরকমে দারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করতে করতে দিন অতিবাহিত হত। অন্নবস্ত্রের কোনওরকম সংস্থান করার জন্য তাঁর পিতা-মাতা দু’জনকেই আমানুষিক পরিশ্রম করতে হত। যার ফল হয় মর্মান্তিক। খুব অল্প বয়সেই দুজনের জীবনাবসান হয়। বালক রাখ্তুরামের বয়স তখন মাত্র পাঁচ বছর। নিতান্ত শৈশবাবস্থায় পিতৃমাতৃহীন অনাথ হন। বস্তুতপক্ষে বিহারের ছাপরা জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে পিতৃমাতৃহীন দরিদ্র পরিবারের এক অনাথ বালকের ক্রমে ভারতীয় নবজাগরণের কেন্দ্রবিন্দু কলকাতা শহরে যুগপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে আসা এক অলৌকিক কাহিনি। চলচ্চিত্র-উপন্যাসের কাহিনিকেও হার মানিয়ে দেয়। আধ্যাত্মিকতার দিক দিয়ে দেখলে শুরুর পর্বে মাধবানন্দজীকে উদ্ধৃত করে যে কথা বলেছি সে কথারই পুনরাবৃত্তি ঘটাতে হয়। অর্থাৎ শ্রীভগবান যখন জগতে অবতীর্ণ হন তখন তাঁর কাজের সহায়ক হিসেবে বিশেষ বিশেষ যোগ্য পাত্রকে এই ধরাধামে নিয়ে আসেন। এঁরা বিভিন্ন স্থানে জন্মগ্রহণ করলেও যথাসময়ে তাঁর সঙ্গে মিলিত হন। এ যেন এক পূর্বপরিকল্পিত যাত্রাপথ। যে পথের স্বরূপ উন্মোচনে জ্ঞানী বা ভক্ত সততই সাধনপ্রয়াসী হয়ে ওঠেন।

         যুগপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ সন্নিধানে কীভাবে এসে পৌঁছলো রাখ্তুরাম (পরবর্তীকালে লাটু) সেই বিষয়ে যেতে গেলে অবশ্যই রামকৃষ্ণভক্তশিরোমণিগনের অন্যতম শ্রীরামচন্দ্র দত্তের কথা স্মরণ করতে হবে। তাঁর বিষয়ে ভক্তমালিকা গ্রন্থে গ্রন্থকার স্বামী গম্ভীরানন্দজী লিখছেন--“তীক্ষ্ণবুদ্ধি রামচন্দ্র বিদ্যালয়ে পাঠাভ্যাস করিতে লাগিলেন এবং যথাসময়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলেন। কিন্তু পিতার তখন ঘোর দারিদ্র্য। পিতামহ প্রচুর সম্পত্তি রাখিয়া গেলেও পিতা তাহা ব্যয় করিয়া তখন পরমুখাপেক্ষী। সুতরাং রামচন্দ্র এক আত্মীয়ের বাটীতে থাকিয়া ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে চিকিৎসাবিদ্যা শিখিতে লাগিলেন। যথাসময়ে ইহারও শেষ পরীক্ষায় সুখ্যাতির সহিত উত্তীর্ণ হইয়া তিনি প্রতাপনগরে কিছুকাল চাকরি করার পর কলিকাতায় চল্লিশ টাকা বেতনে গভর্ণমেন্টের অধীনে কুইনাইন পরীক্ষকের সহকারী শ্রেণীর মধ্যে নিয়োজিত হইলেন। সি.এইচ.উড সাহেব তখন কুইনাইন পরীক্ষক। তিনি রামচন্দ্রের নিকট শুধু দৈনন্দিন কাজ আদায় করিয়াই সন্তুষ্ট ছিলেন না, অবসরমত তাঁহাকে রসায়নশাস্ত্র শিখাইতে লাগিলেন। সাহেব অল্পকাল পরেই স্বদেশ ফিরিয়া যাইবার কালে প্রীতির চিহ্নস্বরূপ একটি ঘড়ি ও অনেকগুলি পুস্তক প্রিয় ছাত্র ও সহকারীকে প্রদান করেন। কিন্তু রামচন্দ্র এই সামান্য উপহার অপেক্ষাও আর একটি মূল্যবান দান পাইলেন-- সাহেবের একনিষ্ঠ বিদ্যানুরাগ। সাহেব তাঁহার হৃদয়ে যে বিদ্যোৎসাহের বীজ বপন করিয়াছিলেন, তাহারই ফলে রামচন্দ্র রসায়ন-শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়া অচিরে খ্যাতি ও প্রচুর অর্থ-উপার্জনে সমর্থ হইলেন। তাঁহার পিতার অবস্থা বিপর্যয়ের ফলে নারিকেলডাঙ্গার পৈতৃক ভবন বহু পূর্বে হস্তচ্যূত হইয়া গিয়াছিল। এখন রামচন্দ্র সিমুলিয়া-পল্লীর মধু রায়ের গলিতে নতুন বাটী নির্মাণ করিলেন।

    রামচন্দ্রের পাণ্ডিত্য ক্রমে এত সুবিদিত হইয়াছিল যে, অনেক বি.এ, এম.এ উপাধিধারী ও ডাক্তার তাঁহার নিকট শিক্ষা করিতে আসিতেন। ক্রমে তিনি ইংলণ্ডের রাসায়নিক সভার সভ্য হন এবং কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজের মিলিটারী ছাত্রদের অধ্যাপক ও সহকারী রাসায়নিক পরীক্ষক নিযুক্ত হন। এতদ্ব্যতীত নানা সভা-সমিতিতে তিনি রসায়ন বিষয়ে বক্তৃতা করিতেন। রসায়নে অদ্ভুত ব্যুৎপত্তির ফলে তিনি কুর্চির ছাল হইতে ‘কুর্চিসিন’ নামক একটি আমাশয়-প্রতিষেধক ঔষধ আবিষ্কার করেন। ইহাতে দেশবিদেশে তাঁহার সুখ্যাতি হয় এবং প্রচুর অর্থাগমও হয়। ক্রমে সরকারী কার্যেও বেতনবৃদ্ধি হইয়া ২০০ টাকায় উঠে। এতদ্ব্যতীত স্বাধীনভাবে বিবিধ পদার্থের রাসায়নিক পরীক্ষা করিয়া তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করিতেন; এমন কি কোন সময়ে মাসিক সহস্র মুদ্রা গৃহে আসিত।” (শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা, দ্বিতীয় খণ্ড,স্বামী গম্ভীরানন্দ)



          এদিকে পিতৃমাতৃহীন অনাথ রাখ্তুরাম পিতৃব্যের সংসারে এসে পড়ল। সেখানে পিতৃব্যের স্নেহচ্ছায়ায় রাখ্তুরামের শৈশব অতিবাহিত হতে লাগল। কিন্তু সবদিন সমান যায় না। বিপর্যয় এল। সাঙ্ঘাতিকভাবেই এল। ঋণজালে জর্জরিত হয়ে পড়লেন রাখ্তুরামের পিতৃব্য। নিজের যথাসর্বস্ব মহাজনের হাতে সমর্পণ করে ঋণমুক্ত হয়ে তিনি গ্রাম ছাড়লেন। সেখান থেকে এসে পৌঁছলেন কলকাতায় বহু পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে। সঙ্গে রাখ্তুরাম। কলকাতায় এসে পড়লেন রুটি রুজির তাগিদে তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু কলকাতা মহানগরীও সোজা জায়গা নয়। সৌভাগ্যক্রমে খোঁজ পেলেন এক স্বগ্রামবাসীর। ফুলচাঁদ। এই ফুলচাঁদ তখন কলকাতা মেডিকেল কলেজে রামচন্দ্র দত্তের আরদালি ছিল। মনিবকে বলে কয়ে সে বালক রাখ্তুরামের একটি কাজের সংস্থান করে দিল। রামচন্দ্র দত্ত মহানুভব ছিলেন। তাঁর আশ্রয়ে বালককে প্রতিষ্ঠিত করে পিতৃব্য নিশ্চিন্ত হলেন। এইখানেই পিতৃব্যের সঙ্গে বালক রাখ্তুরামের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, রাখ্তুরামের পিতা-মাতা বা পিতৃব্য কারোরই নাম বা বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া সম্ভব হয় নি। একইভাবে রাখ্তুরামের সঠিক জন্মস্থান, জন্মসময়, সাল, তারিখ বিষয়েও কিছু জানা যায় না। যে রাখ্তুরাম পরবর্তীকালে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের অন্তরঙ্গ পার্ষদ, সন্ন্যাসী সন্তান স্বামী অদ্ভুতানন্দ, লাটু মহারাজ হিসেবে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকলেন। যাই হোক আশ্রিতবৎসল রামচন্দ্র দত্তের গৃহে বালক ভৃত্য রাখ্তুরাম ঈশ্বরেচ্ছায় অনুকূল পরিবেশ পেয়েছিল। এই সুবাদেই সে একদিন উপস্থিত হল তাঁর জীবনদেবতার কাছে।

        বিজ্ঞানী,মেডিকেল কলেজের ডাক্তার রামচন্দ্র দত্ত ১৮৭৯ সালে শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আসেন। তখন তাঁর মন অত্যন্ত অশান্ত, সংশয়াচ্ছন্ন। তিনি যুগপুরুষের কাছে নিবেদন করেছিলেন সেই সংশয়। বস্তুতপক্ষে এই পরমপুরুষের স্মিত হাস্য তাঁর মনের যাবতীয় সংশয় এক লহমায় দূরীভূত করেছিল। তাঁকে দেখামাত্রই তিনি বিশ্বাসের বটপত্রে দরিয়ায় ভেসেছিলেন। গুরুকরণের ঘোর বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে দর্শন করে তাঁকে গুরুরূপে পাওয়ার বাসনা তাঁর মধ্যে প্রবলভাবে জাগ্রত হয়। ঠাকুরের কাছে বারবার আবেদন নিবেদন জানানোর পর কোনও এক শুভ লগ্নে একান্ত নিভৃতে দীক্ষালাভ হয় তাঁর। রামচন্দ্র দত্তের প্রবল শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তির সংক্রমণে পরিবারের সকলেই সংক্রমিত হলেন, বালক ভৃত্যটিও বাদ যায় নি। ততদিনে বাড়ির সকলে এই বালকটিকে পছন্দ করতে শুরু করেছে কর্মঠ,অনুগত ও কর্তব্যপরায়ণ হওয়ার কারণে। রাখ্তুরামের পরিবর্তে আদরের নাম হয়েছে লালটু। শৈশবে এই বালক গ্রামে পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষক, শিক্ষা সম্বলিত কোনও পাঠশালা বা শিক্ষালয়ে যায় নি। সে তাঁর খর্বাকৃতি হৃষ্টপুষ্ট শরীর নিয়ে প্রকৃতির পাঠশালায় মেতে থাকত রাখালদের নিয়ে। এহেন তথাকথিত শিক্ষার সংস্পর্শবিহীন বালক ভৃত্যটির কানে এল পরমের আহ্বান। মনিব রামচন্দ্র দত্তের বাড়িতই তিনি শুনলেন ঠাকুরের কথা--“ ভগবান মন দেখেন। কে কি কাজে আছে, কোথায় পড়ে আছে তা দেখেন না।... যে ব্যাকুল,ঈশ্বর বই আর কিছু চায় না, তারই কাছে ঈশ্বর প্রকাশ হন।... সরল ও অকপট হোয়ে তাঁকে ডাকতে হয়, আন্তরিক ব্যাকুল হোয়ে তাঁকে ডাকতে না পারলে তিনি দেখা দেন না।... নির্জনে তাঁর জন্য প্রার্থনা করতে হয়, তাঁর জন্য কাঁদতে হয়, তবে ত তাঁর দয়া হয়।” ( শ্রীশ্রী লাটু মহারাজের স্মৃতিকথা, শ্রী চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায় )


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

আরও পড়ুন

http://www.jaladarchi.com/2021/11/atheist-religion-28.html




 

Post a Comment

0 Comments