জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৬২



সম্পাদকীয়,
ছোটোবেলায় শীতকাল অনুচ্ছেদ লিখতে দিলে, তার শুরুটা হতো এই রকম, পৌষ - মাঘ এই দুইমাস শীতকাল। সেই অনুযায়ী শীতকাল চলে এসেছে। শীতকালে  চিড়িয়াখানা ঘুরতে যাওনি এমন কেউ আছো নাকি! কোন চিড়িয়াখানা? আলিপুর। সেটা কোথায়? কলকাতায়। কলকাতায় আরো অনেক কিছু দেখার আছে। সায়েন্স সিটি, ভিক্টোরিয়া, যাদুঘর, আরো অনেক কিছু। কলকাতায় মেট্রো রেল যেমন চলে তেমনই এখনও ট্রাম চলে। ট্রাম কলকাতার ঐতিহ্য। এবারের সংখ্যায় সেই ঐতিহ্যকে ক্যামেরায় বন্দী করে পাঠিয়েছে মৃণাল আঙ্কেল। শুধু কলকাতাই নয় ঝাড়খন্ডের রাজধানী রাঁচির অনেক অনেক ঐতিহ্যের কথা তোমাদের জানাচ্ছে বাসবদত্তা আন্টি গত দু সপ্তাহ ধরে। ঐতিহ্যের কথা বলতে শুরু করলে সহজে শেষ হবার নয়। তাই বলি কি, আজ রতনতনু জেঠু তোমাদের কৃষিমেলার প্রসঙ্গে কত কত আনাজপাতির কথা বলেছেন সেটা পড়ে দেখো কিন্তু। শুধু কি আনাজ, হযবরল! তার কথাও জেনে নাও। এবার আসি, প্রবাহনীলের দোয়েল আর সুধাংশু জেঠুর ছাতার পাখির কথায়। এই রে আমি যদি সব কথা বলে দিই তোমরা তাহলে কি পড়বে? তোমরা পড়ো, পড়ে সহজ ভাবে লিখে জানাও তোমাদের মতামত। লিখে জানাও শ্রীপর্ণা আন্টির সহজপাঠ  আর শিবরাম চক্রবর্তীর কথা, তোমাদের কেমন লাগল? আর জানাতে ভুল না তোমাদের বন্ধুদের আঁকা তোমাদের কেমন লাগল।
সবশেষে, বড়দিনের আগাম শুভেচ্ছা জানাই। --- মৌসুমী ঘোষ


ছাতার থেকে খরগোশ     
সুধাংশু চক্রবর্তী 


একটা চাঁদোয়াল ঘুড়ি চাইতেই বাবা খুব বকাঝকা করে বাবলাকে বললেন, স্কুল নেই বলে সারাদিন কেবল ঘুড়ি এবং ঘুরি? হয় ঘুড়ির জন্য ছুকছুক করছো, নয়তো বন্ধুদের বাড়ি যাবার জন্য ছোঁকছোঁক করেই চলেছো। কেন, ঘরে বসে গল্পের বই পড়া যায় না? আঁকাজোকা করা যায় না? 

বকা খেয়ে বাবলা মুখ ভার করে এসে এসলো খোলা বারান্দায়। সহসা ওর বন্ধু ছাতারপাখিদুটো এসে বেদম ক্যাঁচরম্যাচর জুড়ে দিলো বারান্দয় । বাবলা গম্ভীর গলায় ওদের বললো, তোরা এখন যা। আমার মন ভালো নেই। 

তোর মন খারাপ হবে কেন? বরং আমাদেরই তো মন খারাপ হবার কথা। পোকামাকড় ধরে খাবো তার কোনো উপায় রেখেছিস তোর? যত্রতত্র ফোঁসফোঁস করে কীসব ধোঁয়াটোয়া ছড়িয়ে দিচ্ছিস। পোকামাকড়গুলো তাতেই দুমদাম মরে যাচ্ছে। আমরাও না খেতে পেয়ে... কথাগুলো বলে শেষ করে একটা ছাতারপাখি ফুচ্‌ করে কেঁদে ফেললো। 

বাবলা ওকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললো, আমরা নিজেদের কথা না ভেবে খামোখা পোকামাকড়দের কথা ভাবতে যাবো কেন? বাবা বলেছে, কি একটা মারণ ব্যাধি নাকি মানুষের শরীরে বাসা বাঁধার তালে রয়েছে। তাই তো সর্বত্র ওষুধ ছিটোনো হচ্ছে জীবাণুমুক্ত করার জন্য। 

তা’বলে আমাদের কথা একবারও ভাববি না তোরা? 

আমার কথাই বা কে ভাবে বল?

কেন? তোর বাবা, মা, দাদাই, ঠাম্মি – সবাই ভাবে। তোকে না খুব ভালোবাসে ওরা? 

ভালোবাসে না ছাই। বাবার কাছে চেয়েছিলাম একটা চাঁদিয়াল ঘুড়ি। বাবা কিছুতেই দিলো না। উপরন্তু বকাঝকা করেছে আমাকে। 

আমরা ভাই অতশত বুঝি না। শুধু জানি, বেঁচে থাকতে হলে পোকামাকড় খুঁটে খেতে হবে আমাদের। অথচ সেই গুড়েও যে বালি দিয়েছিস তোরা!   

এবার বল দেখি, তোরা দুটিতে মিলে খামোখা ক্যাঁচরম্যাচর করছিস কেন? 

জবাবে অন্য ছাতারপাখিটা বললো, আমি আগে মরতে চাইছি, কিন্তু ও যে আমার আগে মরতে চায়। 

সেকি? আমরা বাঁচতে চাইছি অথচ তোরা কিনা মরার জন্য ঝগড়া করছিস! কেন রে? 

আমরা তো না খেতে পেয়ে এমনিতেই মরে যাবো। তাতে অবশ্য একটা লাভ হবে আমাদের। পক্ষীশাস্ত্রে লেখা আছে, পাখিরা মরে গিয়ে খরগোশ হয়ে জন্মায়। তখন ওড়াউড়ির বদলে বেশ লাফিয়ে লাফিয়ে চলা যাবে।  সে ভারি মজার ব্যাপার হবে, তাই না বাবলা?

সহসা প্রথম ছাতারপাখিটা বারান্দায় মুখ থুবড়ে পড়ে ছটফট করতে করতে মরে গেল বাবলারই চোখের সামনে। সেই দেখে অপর ছাতারপাখিটা বেদম কান্নাকাটি জুড়ে দিলো ক্যাঁচরম্যাচর করে। বাবলারও খুব মন খারাপ হয়ে গেল। 

বিষণ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো শোকাতুর ছাতারটার দিকে। তারপর মৃত ছাতারটার দিকে তাকিয়েই চমকে গেল। মরা পাখিটা দুম করে একটা সাদা খরগোস হয়ে গিয়ে, বারান্দা থেকে নেমে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে গেল বাগানের ভিতর!

 

 সহজপাঠ

 শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

বাস ভাড়াতেও ছাড়খানা চাই ইস্কুলেতে পড়ি
বড়লোকের বাহন তখন ট্যাক্সি কখন চড়ি?
স্কুলটা সেরেই বিকেল জুড়ে খেলার পরে খেলা
একটুখানি দেরি মানেই বাড়িতে কানমোলা।
মচ্‌কে গেলে পায়ের পাতা মায়ের হলুদ চূন
নিজের দোষের সঙ্গে শোনা পাশের ছেলের গুণ।
ঘরে বাইরে সবার বকায় সায় থাকত বাবার
বাড়িতে ঠিক খবর যেত সিনেমা হলে যাবার।
কারোর বাড়ি ষষ্ঠী পুজো কারোর নারায়ণ
প্রসাদ পেতে সদাই হাজির কীসের নিমন্ত্রণ?
পড়ার ফাঁকে আনন্দলোক এক চড়ে গাল লাল
কলকাতা ক’য় খবর পড়েন নীলিমা সান্যাল।
পুরো পাড়ায় একটা বাড়ি রাখত টেলিফোন
দূরের খবর আনত বয়ে অন্তু ডাকপিওন।
অ্যান্টেনাদের মিলত দেখা গুটি কয়েক ছাদে
খেলার দিনে ফাটল কেবল উচ্ছ্বাসেরই বাঁধে।
একটুখানি হাওয়ার দোলায় পর্দাতে ঝিরঝির
ছাদে উঠে ডান্ডাখানা রাখতে হোত স্থির।
তখন একা দূরদর্শন – দর্শকে ঘর ভরা।
এখন একা শত চ্যানেল বোতাম টিপে ঘোরা।


 


বড়োবাবুর মনের কথা
প্রবাহনীল দাস, সপ্তম শ্রেণী
বিদ্যাসাগর শিশু নিকেতন, পশ্চিম মেদিনীপুর

শরীরটা যেন বেশিই ম্যাজম্যাজ করছিল। বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, দুষ্টু দোয়েল পাখি দুটো এখনও আসেনি। তার মানে এখনও ভোর হয়নি। সারাদিন শুয়ে থেকে আর ঘুমিয়ে ক্লান্ত লাগছিল, তাই আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে যখন ঘুম ভাঙল, তখন পেটে খুব যন্ত্রণা শুরু হল। দোতলার ঘর থেকে ছাদটা নীচে, একটা ছোট্ট তিন ধাপ সিঁড়ি পেড়িয়ে নামতে হয়। সিঁড়ির নীচে ঢুকে পড়লাম, যাতে কেউ বুঝতে না পারে আমি অসুস্থ। আসলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ল দাদা আর দিদান খুব ব্যস্ত হয়ে যায়।

এই তো সেদিন, মুখে একটা মাছের কাঁটা ঢুকে গেলো। আসলে বাটা মাছ খেয়ে এমন অভ্যাস করে ফেলেছি, কিছুতেই রুই মাছের বড়ো কাঁটা চিবোতে পারি না। মা তো সারাদিন থাকে না, তাই মা দিদান বাড়ি এলে আমি মায়ের পায়ে পায়ে ঘুরি। মা আমার অবস্থা দেখে বকাঝকা করলেও, পরে আদর করে দিল। দাদু ব্যাপারটা আন্দাজ করেছিল, দাদা বাড়ি আসতেই দাদাকে বলল, “দেখ, তোর বোন আবার মুখে কাঁটা ঢুকিয়েছে।” দাদা যত্ন করে আমার মুখে ওষুধ লাগিয়ে দিল। দিদা গরম দুধ বাটিতে ঢেলে দিল, দাদা আমাকে খাইয়ে দিল।

ভালই দিন কাটছিল, কিন্তু পেটে ব্যাথাটা বাড়তে আমাকে সিঁড়ির নীচে আশ্রয় নিতে হল। কিছুক্ষণ পরে অসম্ভব যন্ত্রণা শুরু হল, আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম। জ্ঞান ফিরতে দেখলাম, আমার কোলে শুয়ে আছে দুটো বাচ্ছা, আমার ফুটফুটে ছানারা। আমি বেশ ভালো আছি এরকম ভান করে বেরিয়ে এলাম সিঁড়ির তলা থেকে। সারাদিন কেটে গেলো। সেদিন দাদু অসুস্থ ছিল, তাই আমাকে কেউই অতটা খেয়াল করেনি।

পরের দিন দাদু সকালবেলা ছাদে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল। এদিক ওদিক তাকাতে গিয়ে দাদুর চোখ পড়ল আমার ছানাদের উপর। সঙ্গে সঙ্গে দাদাকে ফোন। দাদা তো আনন্দে আত্মহারা। বেলায় পরীক্ষা ছিল, পরীক্ষা দিয়েই চলে এলো আমার ছানা দেখতে। কী খুশি দাদার! বিকেলে বৃষ্টি শুরু হল, দিদান ছাদের সিঁড়ির উপরের একটা ফুটো বন্ধ করতে এলো। কিন্তু তাঁর আগেই আমি ছানাদের মুখে নিয়ে একটা ঘরের ফাঁকা কুলুঙ্গিতে রেখে দিয়েছি। সবাই নিশ্চিন্ত হল।

কয়েকদিন পর ছানাদের চোখ ফুটল। মাঝখানে আমার শরীর ভালো লাগছিল না, তাই কয়েকদিন আমি ছানাদের খাওয়াতে পারিনি। দিদান খুব রাগ করলেও, আমি দিদানকে আমার অসুস্থতার কথা বোঝাতে পারিনি। তবে দাদা যত্ন নিয়ে আমার ছানাদের দিয়ে সিরিঞ্জে করে গরম দুধ খায়িয়ে দিয়েছিল। ভালই সময় কাটছিল, আমার ছানারাও দাদার ছায়ায় বেড়ে উঠছিল।

হঠাৎ এক বিকেলে দেখলাম, দাদা আমার ছানাদের নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। আমি পিছু নিলাম। দেখলাম দাদা কাজলপিসির বাড়িতে দিয়ে এলো ছানা দুটো। আমি এমনিতেও ওদের বাড়িতে রোজই যাই, কিন্তু দাদা, যে কিনা আমার ছানাদের এত ভালবাসে, সে তো আমার ছানাদের অন্য বাড়িতে রাখতে যাবে না। দেখলাম, দাদা ফেরার পথে হাত দিয়ে চোখ মুছল। কিছু বুঝতে পারলাম না।

ঘরে এসে তার পর শুনলাম, দাদারা নাকি অন্য কোথাও চলে যাবে। সঙ্গে দাদু-দিদানকেও নিয়ে যাবে। আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। কিন্তু সত্যি দাদা চলে গেলো! আজ দুদিন হয়ে গেলো, দাদা আসেনি। ছুটে এসে কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করেনি। মা বাবা ও আসেনি। দাদু-দিদানকেও হয়ত ওরা কিছুদিন পরে নিয়ে চলে যাবে। আমার খুব কষ্ট হল। আমার একবার অসুখ করেছিল, দাদু আমাকে দুদিন ঘরে ঢুকতে দেয়নি। আমি ছাদের পাঁচিলে বসে দেখেছি, দাদা একা একা কাঁদছিল। হয়ত দাদা এখনও কাঁদছে। আমি তো কাঁদতে পারি না। আমি তো একটা মেনি বেড়াল। আমার নাকের তলার কালো ছোপটার জন্য দাদা আমার নাম রেখেছিল ‘বড়োবাবু’।





স্মরণীয়
( শিবরাম চক্রবর্তী) 
কলমে - পীযূষ প্রতিহার
 
তাঁর বাহুল্য বর্জিত অনাড়ম্বর জীবনযাপন নিয়ে জিজ্ঞেস করলে বলতেন 'মুক্তারামের তক্তারামে শুক্তোরাম খেয়ে আরামে আছি'। তিনি আর কেউ নন, শিবরাম চক্রবর্তী। ১৯০৩ সালের ১৩ডিসেম্বর কলকাতার দর্জিপাড়ায়, নয়নচাঁদ দত্ত লেনে, মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর বাবা শিবপ্রকাশ ছিলেন মালদহের চাঁচল রাজপরিবারের উত্তরাধিকারী। মা শিবরানি ছিলেন সাদাসিধে ধর্মপ্রাণা গৃহবধূ। কিশোর শিবরামের মন বসত না বাড়িতে। নিজের খেয়াল খুশিমতো বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতেন পাহাড় বা সমুদ্র দেখতে। স্কুলে পড়ার সময় একবার চাঁচলে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ভাষণ শুনে এমন উদ্বুদ্ধ হলেন যে ঠিক করলেন দেশসেবা করবেন। রেলের যে কামরায় দেশবন্ধু উঠেছিলেন সেই কামরাতেই চড়ে বসলেন তিনি। কলকাতা চলে আসলেন স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দিতে। কলকাতায় মেসের ব্যবস্থা করে দিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। ম্যাট্রিক পাস করে পুরোপুরি স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিলেন। জেলও খাটলেন এই সময়। তিনি তখন কাজ করতেন বিজলী ও ফরোয়ার্ড পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে ও যুগান্তর পত্রিকার প্রকাশক হিসেবে।

ছোটদের ভীষণ ভালোবাসতেন তিনি। তাদের জন্য লিখেছেন প্রচুর লেখা। তাঁর মন ছিল শিশুর মতোই নিষ্পাপ ও সরল। ছোটদের জন্য তার লেখা হর্ষবর্ধন ও গোবর্ধন তো বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা আকর্ষণ। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য তাঁর তৈরি বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র কল্কেকাশি, যা শিশু সাহিত্যিক মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য সৃষ্ট হুকাকাশির আদলে তৈরি বলে তিনি বলেছেন।

তিনি প্রথমদিকে কবিতা রচনা করলেও( প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'মানুষ', ১৯২৯ সালে) পরবর্তীতে রম্য রচনা নিয়েই মেতে উঠেছিলেন। কথার পিঠে কথা বসিয়ে বা শব্দ নিয়ে ভেঙেচুরে সরস পান(Pun) রচনার ধারা তিনি বাংলা সাহিত্যে নিয়ে আসেন। এজন্য অনেকেই তাঁকে হাসির রাজা শিবরাম বলেও অভিহিত করেন। তাঁর  রচিত উল্লেখযোগ্য আলোচিত উপন্যাস হল 'বাড়ি থেকে পালিয়ে', 'ভালবাসা পৃথিবী ঈশ্বর', 'ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা', 'বাড়ি থেকে পালিয়ের পর', 'কলকাতার হালচাল', 'বর্মার মামা', 'মনের মতো বউ', 'মস্কো বনাম পন্ডিচেরী', 'ফানুস ফাটাই' সহ অসংখ্য গ্রন্থ। তাঁর রচিত বিখ্যাত নাটক হল 'যখন তারা কথা বলবে'।
আর্থিক ভাবে কোনদিনই সচ্ছ্বল ছিলেন না তিনি। গোছানোও ছিলেন না। তাঁর অসংখ্য লেখা হারিয়ে গেছে অবহেলায়। কোনদিন কারো নিন্দা করতেন না, শুনতেনও না কারও নিন্দা। লিখে যেটুকু টাকা পেতেন সেটুকু শেষ না হওয়া পর্যন্ত চপ-কাটলেট-রাবড়ি-রসগোল্লার দোকানে দেদার খাওয়া এবং খাওয়ানো ছিল তাঁর নেশা। তাঁর কথায়- 'নেশা করলে রাবড়ির নেশা করাই ভালো'।

এহেন মানুষটির শেষ জীবনে প্রবল আর্থিক অনটনে ও শারীরিক রুগ্নতা দেখা দিয়েছিল। শুকনো,রিক্ত চেহারার শিবরামকে কেউ কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করলে বলতেন- 'খাসা আছি,ফাইন আছি'। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না কোনোদিনও। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর শেষ জীবনে মাসিক ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯৮০ সালের ২৮ আগষ্ট এই মহান স্রষ্টার জীবনাবসান হয়।


ধারাবাহিক ভ্রমণ
চলো যাই
রাঁচি ( পর্ব ৩)

বাসবদত্তা কদম

 কাকুর সেই গল্প চললো।
-ওনারা কি করেন জানিস? নদীর ধারের সেই বালি ছেঁকে সোনা উদ্ধার করবার চেষ্টা করেন। ছোটনাগপুর মালভূমির থেকে এই নদীর উৎপত্তি তা ভূগোলেই আছে। জানবি তোরা। এই নদী তার আসবার রাস্তায় পিসকা গ্রামের পাশ দিয়ে যখন আসছিল, পিসকার সোনার খনী থেকে খানিক সোনার রেনু এ নদী গায়ে মেখে ফেলেছিল। সেই থেকে এখানকার মানুষের বিশ্বাস, এর জলে সোনার কণা মিশে আছে। তাই তারা নদীর জলেভেজা বালি ছেঁকে, ছেঁকে সোনা উদ্ধার করবার চেষ্টা করেণ সারাবছর ধরে। 
আমাদের সেই বাচ্চা নদীটার অবশ্য এত ঝামেলা ছিল না। সে তো পথ ভুলে চলে এসেছিল ঐখানে। সে শুধু রঙ বেরঙের পাথরের মাঝখান দিয়ে ঝুমঝুম, নূপুর বাজিয়ে বয়ে চলেছিল। মাঝে মাঝে, একটা দুটো পাথর ওর পথ আটকাতে চাইলে খিলখিল হেসে তার গা ভিজিয়ে, পাশ দিয়ে পালাচ্ছিল।

এর পরদিন আমরা গেলাম দশম জলপ্রপাত দেখতে। রাঁচি শহরের কাছেই আছে বেশ কটা  জলপ্রপাত। হুড্রু, জোনা, দশম, সীতা। আরো আছে হয়তো। ছোট ছোট। আর একটু দূরে রাজরাপ্পা। এত্তগুলো জলপ্রপাত, নদী, জঙ্গল এই শহরটাকে এত সুন্দর করে ঘিরে আছে বলে ব্রিটিশ আমলে বিহার রাজ্যের গরমকালের রাজধানী ছিল এই রাঁচি। অনেকটা যেমন আমাদের পশ্চিমবাংলার গরমকালের রাজধানী ছিল শৈলশহর দার্জিলিং। দশম যাবার দিন সকাল বেলা আমাদের উঠিয়ে স্নান সেরে নিতে বলা হল। মায়ের বেতের ব্যাগে কেক পাউরুটি বিস্কিট জেলি আর ডিমসেদ্ধ ঢুকল। কাকিমার ব্যাগে দু-দুটো ফ্লাস্ক ভর্তি কফি। বেড়াতে গেলে আমরা ছোটরাও কফি। শুধু টুকুনের ভাই মুকুটের দুধের জন্য গরমজল, সেরেল্যাক ইত্যাদি সব আরেকটা ব্যাগে। আর অনেকগুলো জামা প্যান্ট ওর জন্য। বুঝতেই পারছ তোমরা ও ভিজিয়ে ফেলত জামা প্যান্ট। আর তখন হাগিস ইত্যাদি আসইনি। ও তো খুবই ছোট ছিল কিনা। 

আমাদের যাবার জন্য একখানা স্টেশন ওয়াগন ভাড়া করা হয়েছিল। আমি সেই প্রথম স্টেশন ওয়াগন দেখলাম। স্টেশন আর ওয়াগন শব্দ শুনে আমার ধারনা হয়েছিল সেটা রেলগাড়ির নিজের না হোক জেঠতুতো, খুড়তুতো, নিদেন মামাতো, পিসতুতো বা মাসতুতো ভাই হবে। কিন্তু আসলে দেখলাম, সে বেশ লম্বা একখানা গাড়ি। নেহাতই গাড়ি। পিছনে, মাঝখানে আবার ড্রাইভারের পাশে, এরকম তিনটে সারিতে সিট। অনেকটা আজকালকার ইনোভা বা টাটাসুমো জাতীয় বলতে পারো। 

তারপর সে স্টেশন ওয়াগন খানা রওয়ানা হলো। আমি আর বুটুন পালা করে বাবা বা কাকুর সঙ্গে সামনে বসলাম। সামনে বসলে যে রাস্তাখানা সোজা সরল দেখা যায় এ আর কে না জানে। আমি তো মিনিবাসের সামনে বসার সুযোগ এখনো পেলে, কখনোই ছাড়ি না। গাড়ি চলছে, দুদিকে হলুদ আর হলুদ ফুলে ভর্তি ক্ষেত। কাকিমা বলে উঠল সূর্যমুখী। সত্যিই মাঠ ছুঁয়েছে আকাশ, আর সেই আকাশ পর্যন্ত ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলেছে সূর্যমুখী। এর বীজ থেকে তেল হবে।  ধানের ক্ষেতও আছে। ভুট্টা আছে। বাবা চিনিয়ে দিল, গমের আর ভুট্টার ক্ষেত। বাবার ছোটবেলাও বিহারে কেটেছে কিনা, তাই বাবা ওই গাছগুলো চেনে। আমরাও চিনলাম। একখানা ক্ষেতের পাশে গাড়ি দাঁড় করানো হোল। ক্ষেতের কিষাণ দাদার সাথে একটুকরো হাসি বিনিময় হলো।পাশেই চায়ের দোকান থেকে চা বিস্কিট, তাও হলো। মাঝে আরেকবার দাঁড়িয়ে ব্যাগের খাবারগুলোর সদ্ব্যবহার হলো। যতদূর মনে পড়ছে রাস্তায় এরকম দু-একবার থেমে, প্রায় ঘণ্টা তিনেক পরে আমরা দশম জলপ্রপাতের কাছে পৌঁছলাম। চারিদিক বেশ ফাঁকা ফাঁকা তবে আশেপাশে গ্রাম আছে। ঝরনার পাশের গ্রামের লোকজনকে দেখে খুব সচ্ছল মনে হয়নি আমার। সেটা দশম হুড্রু জোনা সব জায়গাতেই। বাবা মায়ের কাছেও শুনেছিলাম ওদিককার আসল অধিবাসীরা বেশ গরীব। পয়সা বানিয়ে নিতে ওদের খাটিয়ে নিয়ে বিভিন্ন ব্যবসাদারেরা আসেন। ওরা কাজ করেন; কিন্তু যে গরীব সেই গরীবই থেকে যান। 
সে যাই হোক এখন আবার বেড়ানোর গল্পে ফেরা যাক। আমি এটা জানি তোমরা অনেকেই অনেক জলপ্রপাত দেখেছ। আমার কিন্তু ওটাই প্রথম। অনেক অনেক সিঁড়ি পেরিয়ে নীচে নামলাম। বাবা আমার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিল, বুটুনকে কাকিমা। মুকুট কাকুর কোলে।  তারপর যেখানে পৌঁছলাম সেখান থেকে দেখছি সাদা জলের ফেনা ধাপে ধাপে নেমে আসছে নীচে। ঠিক যেন কাঞ্চী নদীটা পাথরের টুকরোর ওপর নাচ প্র্যাকটিস করতে করতে ছড়িয়ে পড়ছে অনেকগুলো ধারায়। একে বলে cascade waterfall দশম হচ্ছে এক natural cascade waterfall মানে প্রকৃতি যেখানে পাথরগুলো এভাবেই সাজিয়ে দিয়েছে, ধাপে ধাপে। এটা কৃত্রিমও হয়। যেভাবে অনেক পার্কে বা রক গার্ডেনে থাকে। জলের সেকি স্রোত, পাথরের ছোট, মাঝারি টুকরোগুলো লাফাতে লাফাতে জলের সঙ্গে চলেছে আর জলের সোঁ সোঁ, ঝমঝম, কলকল টুংটুং ঠন্‌ কত রকমের যে শব্দ। এরপর সিঁড়ি দিয়ে উঠে জল যেখান থেকে নেমেছে, সেই জায়গায় যাওয়া হোল, অনেক, অনেক সিঁড়ি ভেঙে। সে কি জলের শব্দ আর স্রোত। 
সেই যে আমরা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলাম, কাঞ্চি নদীর দশম হওয়া দেখতে, বিশাল জায়গা জুড়ে নদীটা এসে পাথরের ওপর থেকে ঝাঁপ দিয়েছে। সেখানে তখন অনেক লোক, ঐ যাকে বলে লোকেলোকারণ্য, সেরকম না হলেও অনেক। মুকুটের মতন ছোট ছোট কয়েকটা বাচ্চাও আছে তাদের মা/বাবার কোলে। সোয়েটার পরাতে গিয়ে সম্ভবত, বাচ্চাটা স্লিপ করে পড়ে যাচ্ছিল; ‘গেল, গেল’ করে একটা আওয়াজ উঠলো ভয়ানক জোরে। একটা মুহুর্ত। বাচ্চাটাকে ধরে ফেলেছে একটা হাত। সোয়েটার টা গড়িয়ে গড়িয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে। চীৎকার করে কাঁদছে বাচ্চাটা, আর ওকে শক্ত করে ধরে কাঁপতে কাঁপতে, ওর বাবা বসে পড়েছেন। ওখানেই একটা পাথরের ওপর। এর পর আর দেখিনি। আমরা নেমে এলাম। মা আমাদের প্রায় তাড়িয়ে নিয়ে এলো নীচে। সোজা গাড়িতে। এখনো আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। কি হতে পারতো ভেবে।

তার পরদিন আমরা গেলাম টেগোর হিল।  নামটার মধ্যে কিরকম রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ গন্ধ পাচ্ছ না? হু হু ঠিক ধরেছ তোমরা। রবীন্দ্রনাথের জ্যোতি দাদা, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর রাঁচিতে কিনেছিলেন বেশ অনেক জমি আর আস্ত একখানা পাহাড়। টেগোর হিলের ওপর থেকে পুরো রাঁচি শহরটাকে দেখতে পাওয়া যায়। আমরাও দেখলাম। এ পাহাড় একেবারেই বেশি উঁচু নয়। এই পাহাড়ের কোলে শান্তিধাম বলে একখানা বাড়ি বানিয়েছিলেন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। আর উপাসনার জন্য ব্রহ্মস্থল। শোনা যায় এই জায়গা কবির খুব পছন্দের ছিল। পাহাড়ের এক গুহায় পাথরের টেবিল দেখিয়ে গাইড বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ এখানে বসে লিখতেন। আমার কিরকম রোমাঞ্চ হচ্ছিল। তোমাদেরও নিশ্চয়ই হচ্ছে আমি জানি। এই পাহাড়টা একেবারেই বেশি উঁচু না। এক দৌড়ে উঠে পড়া যাবে। তবে দৌড়িও না কিন্তু। এই দৌড়াতে গিয়ে সেবার যে মহা বিপদ ডেকে আনছিলাম আমি (ক্রমশঃ)


ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস
ফুলকুসুমপুর খুব কাছে 
পর্ব ২৮

রতনতনু ঘাটী

চওড়া পিচ রাস্তাটা চলে গেছে জেলা শহরের দিকে। ঘনঘন বাস-ট্রাক চলাচল করে। টোটো, অটো, ট্যাক্সি, ভ্যানরিকশা, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল, কী নেই? ফুলকুসুমপুর গ্রাম থেকে পিচরাস্তা হাঁটাপথে মিনিট দশেকের পথ। প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনার টাকায় অহেতুকপুর পঞ্চায়েত অফিস উদ্যোগ নিয়ে ঢালাই রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে। সেই ঢালাই রাস্তাটা পিচের রাস্তা থেকে নেমে হারিয়ে গিয়েছে গ্রামের মধ্যে। বাঁ দিকের ঢালাই রাস্তা এঁকেবেঁকে গিয়ে মিশেছে ফুলকুসুমপুর নৈবেদ্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে। ফুলকুসুমপুর গ্রামীণ কৃষিমেলা যেখানে বসে সেই পর্যন্ত গিয়ে একটা ঢালাই রাস্তা থমকে থেমে পড়েছে। এখান থেকে যেদিকে যাও, মোরাম বিছানো রাস্তা ছাড়া আর কিচ্ছু পাবে না। 
   ফুলকুসুমপুর গ্রামীণ কৃষিমেলা আজ শুরু হবে। বিকেল পাঁচটায় রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী আসবেন মেলা উদ্বোধন করতে। ডি এম সাহেব আসবেন। অহেতুকপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অঞ্চলপ্রধান উপস্থিত থাকবেন। সব স্টল বাঁধার কাজ ফিনিশ। 

   মেলার মেন গেটের ডান দিকে হযবরল চিড়িয়াখানার বড়সড় স্টল। সকাল থেকে মেলায় মাইক বাজছে। ইচ্ছেদাদু মেলা কমিটিকে বলে দিয়েছেন, মাইকে শুধু দেশাত্মবোধক গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতিই বাজবে। এ ছাড়া অতুলপ্রসাদের গান বা দ্বিজেন্দ্রগীতি বাজলেও বাজতে পারে। মাইকে সেরকমই গান বাজছিল। 

   মাঝে-মাঝে মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে---‘অহেতুকপুর গ্রামীণ কৃষিমেলায় এসে দেখে যান কুড়ি কেজি ওজনের বেগুন, তিরিশ কেজি ওজনের ফুলকফি, দেড় ফুট লম্বা ঢেঁড়শ, চল্লিশ কেজি ওজনের বাঁধাকফি! আরও কত কী!’ 
   একটু থেমে-থেমে ঘোষণা করা হচ্ছে---‘আজই কৃষিমেলার প্রথম দিন। পাঁচটায় মেলার গেট খুলে দেওয়া হবে। এবারের মেলার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ‘হযবরল চিড়িয়াখানা’! আসুন। দেখে যান---টিয়াপাখি, কুকুর, বিড়াল, খরগোশ কেমন একসঙ্গে একটা স্টলের ভিতরে নিজের মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে! দেখবেন আর অবাক হয়ে যাবেন!’
   ‘মেলার মাঝে হযবরল চিড়িয়াখানায় দারুণ মজা! দেখে যান! টিয়াপাখি কথা বলবে। আপনাকে দেখলেই জিজ্ঞেস করবে, ‘কেমন আছেন’?’ 
   ‘দেখুন, কুকুর আর বিড়ালের একই চেয়ারে বসে ভাবভালবাসার কাণ্ডকারখানা! নড়ছে না, কিন্তু পালিয়েও যাচ্ছে না। আপনাদের সামনে নানারকম পোজ দেবে। দেখলে আপনাদের মন ভাল হয়ে যারে। দেখবেন, দুষ্টুমিও করছে না, মারামারিও করছে না! দেখে যান--এক  আজব চিড়িয়াখানা অহেতুকপুরের গ্রামীণ মেলায়।’
  ‘মেলায় এসে দেখে যান---ফুলকুসুমপুর গ্রামের ত্রিপাঠীবাড়ির আজব হযবরল চিড়িয়াখানা! খরগোশ বই পড়ার ভঙ্গিতে বসে আছে। ঘাসের উপর শুয়ে ডিগবাজি খাচ্ছে। বিড়াল ভাবুক ভঙ্গিতে ফিরেও তাকাচ্ছে না মাছের টুকরোর দিকে। দেখতে হলে আজই চলে আসুন গ্রামীণ কৃষিমেলার হযবরল স্টলে। এ এক আজব ভেজিটেরিয়ান বিড়াল! দেখে যান!’
   বাড়িতে ইচ্ছেদাদু অস্থির হয়ে পায়চারি করছিলেন। শুনতে পাচ্ছিলেন কৃষিমেলার মাইক। হঠাৎ অনিচ্ছে ঠাকুরমাকে গলা তুলে ডাকলেন, ‘অনিচ্ছে, শিগগির এদিকে এসো তো!’
   ঠাকুরমা হন্তদন্ত হয়ে এসে দাঁড়ালেন দাদুর সামনে। আমি এখনই মেলায় যাব ঠিক করেছি। তাই তো তাড়াতাড়ি লাঞ্চ খেয়ে নিয়েছি। শুধু আমি কেন, তিন্নি, বিন্নি আর বুম্বাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে তো। বিলম্ব আমার সঙ্গে যাবে। তুমি মাধুরী বউমার সঙ্গে করবী আর বকুলবউমাকেও নিয়ে এসো।’
   অনিচ্ছে ঠাকুরমা বললেন, ‘জয়তী তো বলে রেখেছে, সে আমার সঙ্গেই যাবে।’
   ইচ্ছেদাদু মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে বললেন, ‘জয়তী মানে কুয়াশামাসি তো? এরকম একটা দিনে মেলায় তোমার লটবহর না নিয়ে গেলে চলছিল না? কেন, কুয়াশামাসি একা মেলায় যেতে পারবে না?’
   ঠাকুরমা গলার স্বর নরম করে বললেন, ‘পারবে না কেন? এতদিন ধরে আমাদের বাড়িতে কাজ করছে, ওর তো বিয়েথা হয়নি। কার সঙ্গেই বা মেলায় যাবে? কাজের লোকদের ভালবাসলে, ওরাও ভালবাসে।’
   ‘তাই যেও। তবে দেরি কোরো না! আজ মনে হয়, টিভির লোকজন আসবে। খবরের কাগজের রিপোর্টার আসবে। তোমাকেও তো থাকতে হবে? বড়বাবু, গল্পকাকা, শুধুকাকারা মেলায় চলে গেছে তো?’
   ঠাকুরমা বললেন, ‘ক-খ-ন! পরিপালনকাকু যখন চিড়িয়াখানার মিঁউ-বিংগোদের সকলকে নিয়ে যাবে মেলায়, তার আগে সব কিছু দেখে নিতে ওরা আগেভাগেই চলে গেছে।’
   খাওয়ার পর-পরই নীচে এসে হাঁক পাড়লেন বিপদভঞ্জনস্যার, ‘কই ইচ্ছেকুমার? তুমি এখনও রেডি হওনি? মেলায় কাতারে কাতারে লোকজন আসতে শুরু করে দিয়েছে। ডি এম-এর গাড়ি এসে গেছে। মন্ত্রী আসবেন, তাই আগে এসে ডি এম সাহেব সব ঠিক আছে কিনা দেখে নিচ্ছেন। পঞ্চায়েত প্রধান ফুলের তোড়া আনিয়ে নিয়েছেন।’
   ইচ্ছেদাদু পায়ে জুতো পরতে পরতে সিঁড়ি দিয়ো নামছিলেন। বাড়ির ভিতরের দিকে তাকিয়ে ডাক দিলেন, ‘কই বুম্বা, তিন্নি আর বিন্নি... তোরা নীচে চলে আয়।’ একটু থেমে অনিচ্ছে ঠাকুরমার দিকে তাকালেন জিজ্ঞাসু চোখে। বললেন, ‘কই, অনিচ্ছে,  তোমার স্নেহের বিলম্বকুমার কোথায় গেল? তাকে তো দেখছি না? তারও তো আমার সঙ্গেই মেলায় যাওয়ার কথা?’
   ঠাকুরমা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলেন, ‘বিলম্ব শুধু আমার একারই বা কেন হবে? বিলম্ব তো এ বাড়ির সকলের।’ বলে ঠাকুরমা বাগানের দিকে মুখ তুলে ডাক দিলেন, ‘বিলম্ব, ও বিলম্ব...বিলম্বকুমার... কোথায় গেলি? শিগগির এদিকে আয়! মেলায় যেতে হবে তো? বড়বাবু দাঁড়িয়ে আছেন।’
   কোন তেপান্তর থেকে যেন থেকে দৌড়ে এল বিলম্বকুমার, ‘আমি তো পরিপালনকাকার সঙ্গে রাধাগোবিন্দকে মেলায় নিয়ে যাব! আপনি যান বড়বাবু! আমি পিচরাস্তা থেকে এক্ষুনি একবার ঘুরে এলাম! এখনও টিভির লোকের গাড়ি আসেনি তো!’
   দাদু বললেন, ‘টিভির লোকরা তোর ছবি তুলবে নাকি? তুই যে অত ব্যস্ত হয়ে চরকির মতো দৌড়ে বেড়াচ্ছিস?’
   অনিচ্ছে ঠাকুরমা গলা নামিয়ে ইচ্ছেদাদুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি রাধাগোবিন্দকে সোনার শেকলটা পায়ে পরিয়ে নিয়ে যাব কি? লোকে দেখত তা হলে? পৃথিবীতে ক’টা টিয়াপাখির আর সোনার শেকল আছে বলো?’
   দাদু বললেন, ‘তোমার কি মাথার গোলমাল দেখা দিয়েছে নাকি অনিচ্ছেরানি? মেলায় ভিড়ের মধ্যে কেউ সোনাদানা নিয়ে যায় নাকি?’
   ঠাকুরমা বললেন, ‘না না, মানে টিভিতে রাধাগোবিন্দকে দেখাবে তো, অথছ সোনার শেকলটা পায়ে থাকবে না, তাই কি হয়? কেমন আলগা-আলগা লাগবে না? তুমিই বলো?’
   দাদুর মুখে এবার চাঁদের জ্যোৎস্নার মতো হাসি ছড়িয়ে পড়ল, ‘ও নিয়ে তুমি কিচ্ছু ভেবো না অনিচ্ছে। আমি রিপোর্টারদের সক্কলকে বলে দেব, আমাদের রাধাগোবিন্দর কিন্তু একটা খাঁটি সোনার শেকল আছে। আপনারা নোট করে রাখুন। খবরে রাধাগোবিন্দকে দেখানোর সময় মনে করে সংবাদপাঠিকা যেন উল্লেখ করেন, বলে দেব!’
   ইচ্ছেদাদুর কাছে এসে দাঁড়াল দারুণ রংচঙে জামা পরে বুম্বা, বিন্নি আর তিন্নি। বিন্নির মাথায় আবার হলদে রঙের হেয়ার ব্যান্ড। দাদু নীচে নেমে বললেন, ‘চলো হে, বিপদভঞ্জন!  মেলা উদ্বোধন করবেন মন্ত্রীমশাই। তাঁর আসার কিন্তু আর দেরি নেই।’
   ওঁরা রওনা হয়ে গেলেন মেলার মাঠের দিকে। 
   এবার পরিপালনকাকু বিংগো, কুমি আর মিঁউকে নিয়ে রেডি। বিলম্বদাদু ওদের খাবার আর জলের ক্যান নিয়ে নিয়েছে। রাধাগোবিন্দকে নিজের কাঁধের উপর একটা ছোট তোয়ালে পেতে তার উপর বসিয়ে নিল বিলম্বদাদু। তক্ষুনি দেখা গেল অনিচ্ছে ঠাকুরমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কুয়াশামাসি। মাধুরীজেম্মা, করবীকাকি আর বকুলকাকিও সেজেগুজে চলে এলেন। সকলকে আজ দারুণ মানিয়েছে। আজ যেন রঙে-রঙে ঝলমল করছে গোটা ত্রিপাঠীবাড়িটা।
   জলের ক্যানটা রেখে বিলম্বদাদু রাধাগোবিন্দকে কাঁধে নিয়েই ছুটল। মনে হয় রাধাগোবিন্দকে কাঁধ থেকে নামাতে ভুলে গেল বিলম্বকুমার। ঠাকুরমা চেঁচালেন, ‘তুই আবার এখন কোথায় দৌড়লি রে বিলম্ব? তুই কি কিছু ভুলে গেলি? তোর আবার ঠিক সময়ে কোনও কিছু ঠিকঠাক মনে পড়ে না।’
   কোনও উত্তর এল না বিলম্বদাদুর কাছ থেকে। একটু পরে দুটো টোটো ধরে নিয়ে এল বিলম্বকুমার। ঠাকুরমার দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত গলায় বলল, ‘বড়মা, আপনারা এতখানি পথ কি আর হেঁটে-হেঁটে যাবেন? সে কি খুব একটা ভাল দেখাবে বড়মা? আপনারা সকলে এই টোটোটায় উঠে পড়ুন। আমি আর পরিপালনকাকা বিংগোদের সকলকে নিয়ে পরের টোটোয় বসছি!’
   হযবরল চিড়িয়াখানার মেম্বারদের নিয়ে পরিপালনকাকা পৌঁছল মেলার গেটে। সঙ্গে-সঙ্গে ইচ্ছেদাদু আর বুম্বা এগিয়ে এলেন। ওঁদের পিছনে তিন্নি আর বিন্নি। স্টলের গেটে এগিয়ে এলেন শুধুকাকা, গল্পকাকা আর বড়বাবু। যে-যার পোষ্যকে কোলে করে নিয়ে এগিয়ে গেলেন স্টলের ভিতরে। ইতিমধ্যেই মেলায় ভিড় শুরু হয়ে গেছে। বেশি ভিড় বিংগোদের দেখার জন্যে, হযবরল চিড়িখানার গেটের সামনে।
   বিলম্বদাদু দাঁড়িয়ে রইল ইচ্ছেদাদু আর বিপদভঞ্জনস্যারের পাশে। রাধাগোবিন্দ তার কাঁধে বসে-বসে মেলার চারপাশটা তাকিয়ে দেখছে। দেখে মনে হল, রাধাগোবিন্দ যে কাঁধে চড়ে বসে আছে, তার কথা ভুলেই গেছে বিলন্বদাদু। 

   ইচ্ছেদাদু বললেন, ‘বিলম্বকুমার, রাধাগোবিন্দকে নিয়ে স্টলের ভিতরে চলে যাও। ওকে এবার কাঁধ থেকে নামাও! সারা জীবন সব কাজেই তো বিলম্ব করে একের পর এক রেকর্ড করে চলেছ। আজ অন্তত ঠিক সময়ে স্টলের ভিতরে যাও!’
   বুম্বা, বিন্নি আর তিন্নিরা এগিয়ে গেল হযবরল স্টলের কাছে। এমন সময় সাইরেন বাজার শব্দ ভেসে এল দূর থেকে। বিপদভঞ্জনস্যার ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘ইচ্ছেকুমার, মনে হয় মন্ত্রীমশাইয়ের গাড়ির সাইরেন। আমি এগিয়ে গিয়ে ওঁকে রিসিভ করে আনি? তুমিও আমার সঙ্গে এসো!’ 
   তারপর স্যার বুম্বাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তিন্নি, বিন্নি আর বুম্বা, তোমরা মঞ্চের পাশে চলে যাও। তোমাদের এক্ষুনি দরকার পড়বে।’ বলে স্যার এবং ইচ্ছেদাদু মেলার মেন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন।


পাঠ প্রতিক্রিয়া
( কবি অসীম হালদার ছোটোবেলা ৬০ তম সংখ্যা পড়ে যা লিখলেন)

কয়েক সপ্তাহ ধরে চিত্রগ্রাহক অপু পালের সৌজন্যে আমরা জ্বলদর্চিকে উপভোগ করি ভিন্ন ভিন্ন স্বাদে। ছবিগুলো প্রত্যেকটি জীবন্ত হয়ে ধরা দেয়, মনের আবেগকে নাড়া দেয়। এবারের সংখ্যায় পেলাম দুটি ছেলের নৌকোয় বসে থাকার দৃশ্য। তাদের একজনের হাতে বৈঠা। তবে বৈঠার মতো বৈঠা নয়, একটা মোটা লাঠি। মনে হয় এটি খুব একটা গভীর নয়, তাই। সান্ধ্যকালীন মুহূর্তে দুই বন্ধু বা ভাইএর এখন ঘরে ফেরার পালা। এরপরেই চোখে পড়ার মতো মৌসুমী আন্টির ব্রতচারীর কথা। এসবের কথা তো অনেকে জানোই না এখন বোধহয়। অজানা অনেক কিছু নিয়েই তো তাঁর সম্পাদকীয় সকল পাঠকের কাছে আদরনীয় হয়। এখন দেখা যাক সমস্ত সৃজনগুলো।

বিলম্বদাদু, পরিপালনকাকু, অহেতুকপুর পঞ্চায়েত ... এই নামগুলো মানেই রতনতনুবাবুর গল্প, "ফুলকুসুমপুর খুব কাছে"। ধারাবাহিক উপন্যাসটির প্রতি সংখ্যাতেই কাহিনীর বুনন অসম্ভব রকম মনকাড়া। কারণ একটাই, একটি পরিবারের মধ্যের সাবেকিয়ানা। বাড়ির সর্বোচ্চ কর্তা হলেন ইচ্ছেদাদু, যাঁর গিন্নী হলেন অনিচ্ছে ঠাকুমা। সাথে সন্তান, নাতি নাতনী। ত্রিপাঠি পরিবারের সকল সদস্যরা এখন তাঁদের হযবরল চিড়িয়াখানার সদস্যদের নিয়ে  আগামী গ্রামীণ কৃষিমেলাতে স্টল দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। অনেকের বাড়িতেই একটা সময়ে বাজতো অন্তরা চৌধুরীর ছোটবেলার ক্যাসেটের গানগুলো। যেমন - অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা "তেলের শিশি ভাঙ্গলো বলে..." সেসব হয়তো তোমরা ছোটরা অনেকেই শোন নি বা শোন না। তিন্নি বলে উঠলো যতীন্দ্রমোহন বাগচীর "বাঁশবাগানের মাথার ওপর...", বিন্নি বলে উঠলো রবি ঠাকুরের "শর ভাবে ছুটে চলি..." কবিতা। তার ওপর 'একটা' আর 'একটি' তার শ্রুতিবৈষম্য নিয়ে আলোচনা, যা গল্পের মধ্যেও নতুন পাঠ পাঠকের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করতে সার্থক। ইচ্ছেদাদুও যোগ দিলেন কবিতা আবৃত্তিতে। সব মিলিয়ে পুরো বিষয়টির মধ্যেই কেমন সুন্দর একটি পরিবেশ তৈরী হয় যে তা যেকোন পাঠকের মন আকৃষ্ট করে। এরই মধ্যে আবার নাকি গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম উঠতে চলেছে এই বাড়ির নাম। তাই নিয়ে তিন্নি বিন্নি বুম্বার আনন্দ তো আর ধরে না। এদের আনন্দ দেখে রাধাগোবিন্দ টিয়াও তাদের সঙ্গ নিলো! লাইনে লাইনে সুখের অনুভূতিতে পাঠক শেষে হঠাৎ পড়া থামাতে বাধ্য হয়, কারণ এই সংখ্যার সমাপ্তি এখানেই। অগত্যা তাকিয়ে থাকা আগামি সংখ্যার জন্য। 

'প্রাণায়াম আর পানিপুরি' দুটো ভিন্ন স্বাদের কথা পেলাম মৌসুমীদির (রায়) কলমে। কপালভাতি, ভস্ত্রিকা টস্ত্রিকা না কি সব যোগবিয়োগের কথা ঋভু মামমামকে যতোই বলুক, ওসবে যে রসনা তৃপ্ত নয়, তোমরাও জানো, আমিও এক আধটু বুঝি। আলু কাঁচালঙ্কা মটর তেঁতুল জল গন্ধলেবু সবকিছু মিলেমিশে যে শিল্পের সৌন্দর্য্য তারিয়ে তারিয়ে আমরা উপভোগ করি, তাকে কি আর অত সহজে দূরে সরানো সম্ভব ঐসব অনুলোম টোম দিয়ে! এইতো ধরো না, একটু সব্জি আনতে গেলাম। মোড়ে যেই দেখা গোলগাপ্পা স্টল ঘিরে গোল হয়ে সবাই মাথা নিঁচু করে আস্বাদন লাভ করছে, নিয়ে নিলাম সামান্য একটু নিদেনপক্ষে চুরমুর! তেঁতুল আর গন্ধলেবুর যে কি মাহাত্ম্য, তা কি আর অন্যে বুঝবে! তবে ছোট্ট ঋভুর কাছ থেকে সমস্ত কিছু জেনে আমাদেরও শেখা দরকার যে ওসব খাবার রসনাকে তৃপ্ত করতে পারলেও শরীরকে ঠিক রাখতে ঐসব আসনের জুরি মেলা ভার। অতএব চলো, আমরা ঋভুর কথামতোই একটু চলি। বেশ লাগলো মৌসুমীদির লেখা।

না, তোমরা যারা রাঁচি যাও নি এখনও, আমিও তাদের দলে। অতএব মন খারাপ করার কিচ্ছু নেই। রাঁচি যাওয়ার কথা উঠলেই মনে হয় যেন ওখানে নাকি পাগল হওয়ার পর পাঠানো হয়! না, ঠিক তা ভেবে নয়, যাই নি বলেই যাই নি। ব্যস্ কোন কারণ টারণ নয়। কিন্তু তাই বলে তো আর বাসবদত্তা আন্টি আমাদের নিরাশ করেন নি! বরং তাঁর লেখা পড়ে মনে হচ্ছে, কেন এখনও সেখানে গেলাম না! যদিও এ ঘটনা প্রায় চল্লিশ বছর আগেকার, অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। তবু শাল সেগুন মহুয়ায় ভরা প্রকৃতির সবুজ সৌন্দর্য্য দেখতে মন তো চাইবেই সেখানে একটিবার বেরিয়ে আসতে। তোমরা নিশ্চয়ই দেখেছো এখানে খরগোশেরা কথা লেখা আছে। লাল লাল চোখের এদের দেখলেই তো ধরে কোলে নিতে ইচ্ছে করছে। তাই না! বড্ড তাড়াতাড়ি যেন শেষ হলো প্রথম সংখ্যা! কি আর করা...দেখাই যাক আগামী সংখ্যার কাহিনীতে কি অপেক্ষা করছে!

আবার পেয়ে গেলাম পীযূষবাবুর কলমে একটি বিশেষ রচনা শহীদ ক্ষুদিরাম বসু নিয়ে। পৃথা নস্করের আঁকা ক্ষুদিরামের ছবিটি এই কাহিনীর অপরিহার্য উপাদান। গত ৩রা ডিসেম্বরই তো ছিল তাঁর জন্মদিন। ক্ষণস্থায়ী এই বীরকে নিয়ে লতাজীর গান আজও স্বাধীনতা দিবসে বা প্রজাতন্ত্র দিবসে বাজে বিভিন্ন স্থানে। কতো বিপ্লবীবন্ধুর রক্তে রাঙা হয়েছে আমাদের দেশের অলিগলি রাস্তা, তার ইতিহাস আমরা কতজন মনে রেখেছি! আজকের ডিজিটাল দুনিয়ায় কত ব্যস্ততা ঘরে ঘরে; নিউক্লিয় পরিবারে আত্মীয় স্বজনদের সাথে বন্ধুবান্ধবদের সাথেই যোগাযোগ শুধুমাত্র স্বার্থ ছাড়া আর কিচ্ছু নয়, সেখানে তাঁদের প্রাণের মূল্য কতখানি দিতে পারি আমরা...কতখানি স্মরণ করি আবেগের সাথে, আন্তরিকতার সাথে! তাই যখন এমন মানুষদের কথা লেখার আকারে নেমে আসে, মনে প্রশ্ন জাগে, আমরা স্বাধীন হয়েছি তো! চলুক লেখনী পীযূষবাবু এমন আরও। 

ভানুপ্রিয়া মাহাতোর 'ঘোষ স্যার' কবিতাখানি যেন আমাদের সকলের প্রিয় স্যার রাজীব ঘোষকে মনে করায়। তাঁর উপদেশও হলো ডায়েরী লেখা, টাইম মেশিন বানানো। কোঁকড়ানো চুল আর মোটা চশমার সেই ঘোষ স্যারের উপদেশ অবশ্যই তোমরা পালন করবে, বিশ্বাস রইলো। এই শিক্ষার মূল্য নিশ্চয়ই আগামীদিনে বুঝবে, তোমরাও শেখাবে তোমাদের ছাত্র ছাত্রীদের। সুন্দর শিক্ষিত পরিবেশ তৈরীর কারিগর হওয়ার দায়িত্বে এই কবিতার মূল্য অনেক। 

খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের জন্যই তো বেঁচে থাকার লড়াই মানুষের জীবনে। একটু ভাল করে থাকার শখ ছোট্ট খোকার; সে দেখেছে তার বাবাকে কষ্ট করে মাছ ধরে সংসার চালাতে। নামতা পড়তে পড়তে ভাবুক মন ভাবে স্বপ্নে এমনই এক দিন সূ্য্যিমামা তার বাসনাকে পূর্ণ করবে, তাদের দুঃখের দিন শেষ হবে। 'খোকার সাধ'পূরণে পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা প্রশংসনীয় হয়েছে। 

তুলিকা, অনুশ্রুতি, অসিতাভ জ্বলদর্চির এবারের সংখ্যাকে বর্ণময় করে তুলেছে। রংমাখা বৈচিত্র্যই তো জীবনে প্রাণদান করে। আর তাইতো তোমাদের সৃষ্টির পিছনে যে কল্পনা কাজ করে, সেই ভাবনার সুতোর নাগাল পাওয়া আমাদের দুঃসাধ্য। এমনই সৃজনে কাটুক তোমাদের সময় আগামিতে, কামনা রইলো।

দেখতে দেখতে আরও একটা বছর পার হলো। গত বছরের সাথে এবছরের একটাই তফাৎ, স্কুলমুখে তোমরা অনেকে যেতে পারছো। নয়তো আর পারা যাচ্ছিল না, কি বলো! ওমিক্রন ভয় ধরাতে চাইছে বটে, তাই সাবধানতা অবলম্বন করতেই হচ্ছে। তবে যাইহোক, ওসব থাকুক, না থাকুক; জ্বলদর্চির পাতা রং বেরংএ সেজে উঠবেই,মৌসুমী আন্টি যখন আছেই সাথে, কোন চাপ নেই। আর তাই তোমাদের সকলের লেখা / আঁকা অনন্ত ধারায় চলতে থাকুক, নির্মল ভাবনাকে স্বাগত জানাই, শুভকামনা জানাই।


আরও পড়ুন 

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

0 Comments