জ্বলদর্চি

পদ্মপাতায় শিমুল/ সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়


পদ্মপাতায় শিমুল 

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়


কী বাসনা গো

একটানা বৃষ্টি পড়েই চলেছে। বিদ্যুত ও গলার শির ফুলিয়ে ডেকে মাঝে মাঝে আলো ছিটিয়ে দিচ্ছে। সেই আলোতে ঘরগুলো চমকে উঠছে। আবার বিশ্রাম নিচ্ছে। জীবনের ঘটনা পরম্পরায় অকস্মাৎ বিদ্যুৎবিকাশের মত জীবনসত্যের উন্মেষই অনিবার্যতায় আত্মপ্রকাশ করেছে।

--এই শিমু কাঁদছিস কেন রেকী হয়েছেবলবি নাএদিকে তাকা সোনা বোন আমার।

মেয়ের মুখ দিয়ে তো কথাই বেরোয় না। কিন্তু মেজদিদিয়া যে স্পষ্ট শুনলেন ফুঁফিয়ে কান্নার আওয়াজ।

আবার গায়ে হাত দিয়ে “এই শিমু কাঁদছিস কেনওওশরীর খারাপ লাগছেএই তো আমি আছিবলে মেজদিদিয়া শিমুকে নিজের দিকে টেনে নিলেন। শিমু যে তার মেয়েছোটবেলা থেকেই 'দিদিয়াবলতে অজ্ঞান। আর দুই বোনের মধ্যে ছোট্ট বোনটিকে আঁকড়িয়ে থাকেন সব সময় মেজদিদিয়া।

মনে পড়ে গেল মেজদিদিয়ার কথা... সকালের এই সময়টায় বড্ড মনে পড়ে ছোট্ট বেলার কথা...

হঠাৎ শিমুউউউল...শিমু...কোথায় তুমিতু্ম কহা গয়া শিমুলঅন্ধকার দেখতা হায় সিঁড়িতে পায়ের চটির ধপাস ধপাস শব্দ শোনা যাচ্ছে পলাশের আর সাথে তার গমগমে আওয়াজ।

--এই তো ও ও...। পিছনের ব্যালকনিতে। সকাল সকাল কি ব্যা...পারবাংলা তায় আবার মিষ্টি মধুর হিন্দিপিছনদিকে মুখ ফিরিয়ে মৃদু আদরের ভৎর্সনা দিয়ে বলে উঠল শিমুল।

--হা হাএই তো পায়া হায়। কি যে করতা হায় ভোরে ভোরহিন্দি বলে ভাবলামবিহারী তো। বাংলা বুঝতে পারছে নাবোধহয়। এইবার দেশে গিয়ে দেখলে না সবাই কেমন 'বাহিংজি' -(বাংলাহিন্দিইংরাজি মিশিয়েভাষায় কথা বলছে। আমি তো কিছুই বুঝছিলাম না। কি করো কিচা হাতে এ বারান্দা ও বারান্দা করতা হায় জ্বী...মুখে দুষ্টুমি হাসি নিয়ে হাজির হল পলাশ।

এইবার বুড়ো হচ্ছি গো। আঠারো খানা সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠকে ক্লান্ত হয়ে পড়তা আজকাল। শিমুলের সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল পলাশ। বুঝলেরিটায়ার্ড করে অন্য জায়গায় চলে যাব আমরা। ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট থাকবে একেবারে ছিমছাম। সামনে -পিছন দিকে থাকবে ছোট্ট ব্যালকনি। তাই তোএ বাড়িতে আর থাকা যাবে না। সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে নামতেই আজকাল বেশ ভয় লাগে। পড়ে গেলে আর রক্ষে নেই-কার্পেটই তো লাগান ছিল। কিন্তু বাড়ি রিমডেলের সময় তুমি বল্লে, “সাদা টাইল লাগানো হবে পুরো বাড়িতে।” সেটা ভুল ডিসিশন নেওয়া হয়েছে। মানুষ ভুল তো করেইতাই নাসে যাই হোকএবার ফ্ল্যাট বাড়ি দেখতে হবে।

--তুমি এ বাড়ি ছেড়ে যেতে পারবেসন্দেহ আছে। বারণ করলাম কত যে রিমডেলিং করিও না। শুনলে কথাশুধু আমার নাকারুর কথাই শোনোনি। এখানে তো বাঙালি ফ্যামিলি একটাও নেই। এই সময়টায় মনে হয় এক দুজন বাঙালি কাছাকাছি থাকলে বেশ ভালো হত। একসাথে চা খাওয়া আর ছোটখাটো কথাবার্তায় বেশ সময় কাটানো যেত। আমি তো খুব একটা সাংসারিক ছিলাম নাঅন্য কেউ হলে এসেই পাল্টিয়ে ফেলত বাড়ি।

আর অ্যাই 'বিহারী তোমানে টা আবার কিতুমি তো ভোঁস ভোঁস করে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছিলে। এই তো দেখে এলাম। বাপরে কী নাক ডাকার আওয়াজ। ভুঁড়ি উঠছে আবার নামছে। আজ ঘুমটা ভেঙ্গে গেল হঠাৎ। মাথার কাছের জানলা দিয়ে দেখলাম বাইরে একটু ফর্সা হয়েছেতাই দরজা খুলে বাইরে চলে এলাম। আজকাল উইকডেজ এ তো সকালে দৌড়তে যাই একাই। বেশ ফ্রেশ লাগে। আজ যাই নি। ব্রেকফাস্ট খেয়ে দুজনে বেড়ুব একেবারেবুঝেছ। আর আজ তো ছুটির দিন। এমনি আমার সকালবেলাটা খুউব ভালো লাগে। কি সুন্দর রাতের অন্ধকারকে ঠেলে পূবদিকের কোণে ওঠে গেড়ুয়া রঙের একখানা বল। তারপর সইয়ে সইয়ে সেই লাল রং ছড়িয়ে দেয় আকাশের চারিদিকে। আহাসারা বাড়িতে রোদের সোনালী আলোর খেলায় মন মজে যায়। কী তার রূপ। শুরু হয়ে যায় আশেপাশের মানুষের নিত্য দিনের কাজ। সাঁ সাঁ করে গাড়ির চলাচল। পাখিদের কলকলানি। কয়েকটা ছোট ছোট পাখি ব্যালকনিতে এসেও আমাকে দেখে উড়ে গেল। আর এইভাবে আমার শুরু হয় স্মৃতির মঞ্চে ঘুর ঘুর করা। মানুষ তো বেঁচে থাকে স্মৃতিতে। স্মৃতি কখনো থাকে বিলীনকখনো ভাস্বর

--বাব্বা কি দারুন কাব্যি। চোখ বড় বড় করে বলল পলাশ। তবে কোন এক রহস্যময় কারণে প্রকৃ্তি কাউকেই পরিপূর্ণভাবে স্বাদ গ্রহণ করতে দেয় না। সবারই কোথাও না কোথাও অপূর্ণতা থেকেই যায়। আমার তো তাই মনে হয়।

--কাব্যি নামোটেই। তুমিই তো ধরিয়ে দিলে। শিমুল আবার বাইরের দিকে চোখ ফেরাল। পৃথিবীর অস্তিত্বের কাছে আমরা অত্যন্ত ক্ষুদ্র। কত বয়স হল বলো তো পৃ্থিবীর.৫৪ কোটি বছর। যোগ আর বিয়োগ করে দেখলে ৫০ মিলিয়ন। সেদিন গুগল সার্চ করতে করতে পেয়ে গেলাম। কোটি কোটি বছর ধরে কত পাখ পাখালি থেকে গেছে এই পৃথিবীতে। আমার খুব ভাল লাগে এইসব অজানা তথ্য জানতে পেরে।

--বাহশিমুল বাহআমি জানলাম পৃথিবীর বয়স এখন।


()স্রোতে ভাসা

অনেকখানি খোলামেলা যায়গা নিয়ে শিমুলদের বাড়িটা। মোট চোদ্দটা ঘর। একতলায় ছয়টা আর দোতলায় আটখানা ঘর। বাঁ পাশের নিজেদের আরও একটা জমিতে আবার একটা বাড়ী তুলে ঝামেলা বাড়ায় নি ওরা। দুজনেই খুব শান্তপ্রিয় তাই আর অহেতুক ঝামেলার মধ্যে যেতে চায় নি। কাজেই সেখানে একটা ব্যাডমিন্টন কোর্ট করে রেখেছে। বাইরের দিকের বেড়ার সাথে সাথে তিনদিকে রেড টিপ ফোটিনিয়া গাছ। নিজেরাই একটা একটা করে তিনদিকে ঘন করে এই গাছ লাগিয়েছে। 'চিরসবুজ গাছ' যাকে বলে। ওরা নিজেরাও যে 'চিরসবুজই' থাকতে চায়। কোর্টের ডানদিকে নানা রঙের ডোয়ার্ফ গোলাপ ফুলের সারি। ড্রাইভওয়ে দিয়ে কোর্টে যেতে চলাচলের সুবিধার জন্য কংক্রিট দিয়ে রাস্তা মতন করা হয়েছে। তার দু-পাশে সবুজ লন। নিচের তলার ঘর থেকে বেরুলেই সিমেন্টের প্যাটিও ইটের গাঁথুনি দিয়ে তিন ফুটের মত দেওয়াল করে নিয়েছে যাতে বাইরের জমা জল ভেতরে না আসে। সেখানে একটা দোলনা আর সব সারি সারি জুঁইটগরকাপিশসপ্তমুখী জবাডালিয়াসূর্যমুখী ফুলের টব। দোতলার ব্যালকনি পুরোটাই শ্যাওলা হীন কালো সুচারু রেলিং তাতে কবিতা রঙের কাগজ-বলেই মুখ টিপে হেসে উঠল শিমুল।



--ফুল আর পাখিই তো সারা দিনের আগমন বার্তা জানায়। এই ফুল আর পাখি হল সবার মনের রসদ। আগে বেলা গড়ালে আসত পাখির দলনিয়ম করে। তাদের খাবার দিতে ভুলেও যাই আজকাল। তাই তারাও আর আসে না সময়মত। এখানে মেনি বেড়ালরাও দুপুরে পাড়া বেড়াতে আসে না। কেউ আসে নাজীবনটা এখন একটা 'ম্যাগ্নোলিয়া লাইফ'...বলেই একটু শ্বাস নিল শিমুল। বেশ বললাম তো। ম্যাগ্নোলিয়া লাইফইয়েসমাই লাইফ ইজ এ ম্যাগ্নোলিয়া লাইফ। একটু ভালো করে আমার সব কথা শুনলে ঠিক বুঝতে পারবে।

স্বামীজী বলতেন"রেডি টু অ্যাটাচ এন্ড রেডি টু ডিটাচ এনি মিনিট (কোন বিষয়ে লাগতেও যেমনছাড়তেও তেমন--প্রতি মুহূর্তে প্রস্তুত থাকা চাই)।” আমরা কাজ করতে গিয়ে তাতে জড়িয়ে যাইআর সেটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারি না। সেটা কিন্তু ঠিক নয়।

--এটা কি ঠিক বললেশিমুল। কেউ আসে না। আতা গাছে তোতার বাসা/শিমুল পাশে পলাশ আসা/তাই তো থাকি ভারি খাসা। আমি তো আসি... আমার কাছে এই ম্যাগ্নোলিয়া ফুল গাছটা একটা অদ্ভুত সাইকোলজির কাজ করেকেন জানি না। এই ম্যাগ্নোলিয়া গাছের বিশেষত্ব জানোখুব ইন্টেরেস্টিং।

--আমি হাসলাম। এসব কথার তো আর কোনও উত্তর হয় না পলাশ। এর জন্য একটা স্পেশাল বোকা বোকা হাসি সব মেয়েদেরই তৈরী থাকেআমিই বা তার থেকে বাদ যাব কেন?

ধ্যাৎ! আবার সাইকোলজি কিসেরপ্লাটো-এর কথায় বলি তাহলে, “হোয়েন দ্য মাইন্ড ইজ থিঙ্কিংইট ইজ টকিং টু ইটসেলফ।” আমি ফস করে বলে ফেললাম।

জানিমানে আমার ভালো লাগে বলে এই গাছটার সম্বন্ধে পড়েছিলাম একটা বইতে। প্রাচীন চিনে প্রবাদে জেনেছিলাম, “মেয়েদের সৌন্দর্য এবং নমনীয়তার মূর্ত প্রতীক হল এই ম্যাগ্নোলিয়া ফুল। আমেরিকার দক্ষিণপ্রান্তে নববিবাহিতা বধূর হাতে সেইজন্য এই সাদা ফুলের তোড়া দেখা যায়। নিমন্ত্রিত অতিথিদের কাছে এই ফুলগুলো নববধূর পবিত্রতা এবং শ্রেষ্ঠত্ব-কে প্রকাশ করে।” এই গাছটাকে আবার চিনেরা হো পাউ(hO pau) বলে। আমেরিকার মিসিসিপি স্টেট তো এই ফুলগাছটাকে 'ন্যাশনাল ফ্লাওয়ারআখ্যা দিয়েছে। এই ফুলের একটা খুব স্নিগ্ধ গন্ধ আছে। আমাদের অফিসের চারিদিকে এই ফুলের গাছে ভরা ছিল। আমি তুলে এনে আমার টেবিলে রাখতাম। সাদা ফুল কিন্তু পরের দিন হালকা হলুদ অথবা তামাটে রঙ্গের হয়ে যেত। পাপড়িগুলো একটু মোটা হয়।

--এক্সেলেন্ট শিমুল তুমি তো দেখছি গ্লোবাল রিডার। চোখ বড় বড় করে পলাশ বলে ফেলল।

--গ্লোবালাইজেশনের যুগে কেন মিসিসিপির চারিদিকে এত ম্যাগ্নোলিয়া ফুলজানব না বুঝিলুইজিয়ানার মিসিসিপি নদীর আশে পাশেই তো থাকতাম আমরা। যখন বেড়াতে যেতাম তখন দেখতাম হাঁ করে। ঐ দেখোকোথা থেকে আবার মেঘ ভেসে এল যেএই তো বেশ ফরসা ফরসা দিন হচ্ছিল। সত্যি কি যে হয় মাঝে মাঝে আজকাল। আমার তো কেমন সব অদ্ভুত লাগে।

আকাশের দিকে তাকিয়ে শিমুল আবার বলে উঠলসেরেছে! বেশ ম্যারিনেট করেই মেঘ আসছে তোতা...ই একটু শিরশির করছে শরীরটা। ভেতর থেকে একটা চাদর গায়ে দেবার জন্য নিয়ে আসি চট করেকেমন। আমার তো আবার গলার ব্যথা চাগাড় দেবে। গ্ল্যান্ড ফুলে একশা ব্যাপার। গ্ল্যান্ড ফুলে ২০০৪ সালে কি কান্ড। ভাগনার বিয়েতে নিউ জার্সি গেছিলাম। প্লেন থেকে যখন নামলামতখন মাঝ রাত। যদিও বাড়ির সবাই ছিল সাথে। এপ্রিল মাস—আর হু হু করে বরফের ঠান্ডা হাওয়া। ওরা ট্যাক্সির খোঁজ করছিল বাইরে থেকে আর আমিও মাঝে মাঝে এয়ারপোর্টের দরজা খুলে বাইরে আসছিলাম। আমেরিকা বলে বেঁচে উঠলাম সেইবার। মেজর অপারেশন হয়েছিল কিন্তু অবাক হবে তিন দিন পরেই অফিস গেছিলাম। তোমাকে জানানো হয় নি সে কথা। ভয় লাগে খুব তাইযতটা পারা যায় সাবধানে থাকি। দেশেও পপ্পিদের বাড়ি থেকে তেঁতুলের আচার খেয়ে মুখ ধুয়ে তারপর জল খেয়ে বাড়িতে আসতাম। দিদি যদি বকে তাই। আর তা থেকেই গলায় গ্ল্যান্ড ফুলে অপারেশন অবধি করতে হয়েছে। তবে থেকেই আমার গলার স্বর ধরা ধরা ।

এই তো কি সুন্দর সোনালী রোদ উঠতে দেখলাম। মনে হচ্ছে হল্লা করে বৃষ্টি নামবে একটু পরেই। মনটা বিগড়ে দিল তো। বেশ খোশমেজাজে ছিলাম আজ।


()বনের পাখি

চলো ততক্ষণ একটু খেলি আজ শব্দ নিয়েমনটা ভালো হয়ে যাবে। ধরো বৃষ্টি/রোদ শব্দ দুটো শুনে যে শব্দদুটো মনে আসবে সেটা বলবে। ধ্যুস ভাবছোএ আবার কি খেলাহ্যাঁ এইটা একটা মজার খেলা। শুরু করো। দেখো কেমন ভালো লাগছে।

আমিঃ বৃষ্টি/রোদ

পলাশঃ অশ্রু/ঝিলমিল

আমিঃ নদী/ছায়া

পলাশঃ নৌকার পাল/গাছ

আমিঃ মেঘলা আকাশ/পাখির ডাক

পলাশঃ ঝড়/বড্ড চড়া

আমিঃ বৃষ্টি/রোদ

খেলা শেষ। বৃষ্টি/রোদ দিয়ে শুরু করেছিলাম বৃষ্টি/রোদ দিয়েই শেষ করলাম। মজার খেলা বলো। কোন বইতে দেখেছিলাম এরকম খেলা। বৃষ্টি পড়ছে মনে হয়। কয়েক ফোঁটা আমার গায়ে এসে পড়ল। এখানে আবার অ্যাসিড রেন হয় তো। তাই বৃষ্টির ফোঁটায় গন্ধ থাকে অ্যাসিডের।

দেখো দেখো...একটু দেখো না চারিদিক চেয়ে...কেমন মায়ায় আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধে এই প্রকৃতি। সারা শীত এই পাখিগুলো সব কিন্তু আমাদের এই এভার গ্রিন গাছে থাকে। খালি খুনসুটি করে সারাদিনবিশেষতএই সময়টায়। ঠিক তোমার আর আমার মতন। ফিক করে হেসে ফেলে শিমুল। বিছানা তুলে আবার আসছি।

শিমুল এসেই বলল, “মনে পড়েছেজব্বলপুর কলেজে পড়বার সময় মেসোমশাই (সেজবৌদির বাবাআমাকে খাঁচাশুদ্ধু টিয়াপাখি দিয়েছিলেন। তার নাম রেখেছিলাম টুসি। ওর সব কাজ নিজে করতাম কলেজ ছুটি থাকলে। বাবা আবার তাকে শিখিয়েছিলেন, “টুসি...টু.উউ..সি। খেতে দে খেতে দে এ।” কেউ বেড়াতে আসলেই তিনি শুরু করতেন, “টুসি খেতে দে... খেতে দে।” যতক্ষণ না তাদের খেতে দেওয়া হচ্ছে তার চিল চিৎকার থামার নয়। সে ঘণ্টি বাজিয়েই যেত। তার গলায় একটা ঘন্টি বেঁধে দিয়েছিলাম।

বাবা মাঝে মাঝে বলতেন “ওরে!ওকে ছেড়ে দে না...বনের পাখি বনেই তো থাকে। তাই তো ও চেঁচায় অতদেখিস নাসে খাঁচায় থাকবে কেন?” কিন্তু ওকে ছেড়ে দিলেও তো সে আবার চলে আসত। বাবাকে বলব ভেবেছিলাম, “আমি মেয়ে বলে আমিও তো খাঁচার পাখি। একদিন এই খাঁচা থেকে অন্য খাঁচায় পাঠিয়ে দেবে। বলা আর হল নামুখ দিয়ে তখন তো কথাই বেরুত না। একদিন কলেজ থেকে আসতে দেরি হয়েছিলদিদি-বৌদিরাও খেয়াল করে নি। ঠাণ্ডা লেগে মারা গেছিল আমার টুসি। খুব কেঁদেছিলাম। সবার কথামতন মাটিতে গর্ত করে তার মধ্যে ফুল দিয়ে তাকে শুইয়ে দিয়েছিলাম। তারপর আবার মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হল। সেই থেকে বড্ড খারাপ লাগে পাখি পুষতে। জানোপাখি আমার খুব প্রিয়।গলাটা যেন ধরে গেল শিমুলের।

এই মেসোমশাই খুউউব কঞ্জুষ ছিলেন। কিন্তু আমার ব্যাপারে একেবারে দরাজহস্ত। জীবনে কোনোদিন চাকরি করেননি। বাবার সম্পত্তি আর শিকার করেই কাটিয়ে দিলেন শেষ জীবন অবধি। আমার জীবনে এত ভালো মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। বাবা আর মেসোমশাই-এর মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। দুজনেই ছিলেন হরিহরাত্মা।

মেসোমশাই এর নাম ছিল প্রকাশ চন্দ্র চ্যাটার্জ্জী। তিন পুরুষ ধরে মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরে স্থায়ী বসতি। তাই বাংলাটা বেশ মজার করে বলতেন। আর বাবার সাথে লেগে যেত। আসলে বাবার ব্যাপারটাই ছিল এমনিযে একবার বাবার সংস্পর্শে এসেছেভালো না বেসে পারে নি। মেসোমশাই যখন তখন চলে আসতেন আমাদের বাড়ি শুধু বাবার জন্য। এই নিয়ে দুজনের সে কি খুনসুটি। সামনে বারান্দায় একটা চেয়ার পাতা থাকতবাবা সেখানে বসে মুখের সামনে খবরের কাগজের ফাঁক দিয়ে দেখে নিতেন যেমেসোমশাই এসেছেন। কিন্তু এমন ভাণযেন জানেন না কিছুই। মেসোমশাই গেট খুলে ঢুকে বারান্দায় বসা বাবাকে যেই বলতেন, "কেমন আছেন দাদা?”

ব্যাসবাবা ওনার দিকে তাকিয়েই, "আরে মশাই যখন তখন খালি হাতে মেয়ের বাড়ি চলে আসেন।মেসোমশাই হেসে বলতেন, "আমি তো মেয়ের বাড়ি আসি নাআসি আমার প্রাণের বড় দাদার বাড়ি।নিজের বড় দাদা থাকলেও মেসোমশাই বলতেন স্নেহটা যেন বেশি পান বাবার কাছ থেকে। বাবাকে পরে আমরা সবাই বললেবাবা বলতেন, "আমি কি সত্যি সত্যি বলি নাকিওনাকে মজা করে বলি। উনি বেশ বোঝেন সেটা। উনি না আসলে আমারও ভালো লাগে নাজানিস তোরা?” বাবা যেমন- ঠিক তেমনি মেসোমশাই ছিলেন।

আগেকার দিনের মানুষেরা ছিল নির্ভেজালনির্মৎসর।

জব্বলপুরের নেপিয়ার টাউনে তিন ছেলে আর তিন মেয়ে নিয়ে মেসোমশাই-এর সুখের সংসার। হবে না কেনবাড়ির মালিক যদি এরকম ভোলাভালা মানুষ হন। বড় মেয়ে চুনি আমার সেজবৌদি। বৌদির বাপের বাড়ি থেকে এ্যম্বুলেশন এন্ড গান ফ্যাকট্রী আমাদের কোয়ার্টারের দূরত্ব ছিল চল্লিশ মিনিট বাসে।

--বৌদি এখনও তো জব্বলপুরিয়া বাংলা বলেবলেই হেসে উঠল পলাশ আবার।

--আমি যে এত বকবক করছি-সব কথা কানে যাচ্ছে কিযদি যায় তাহলে আমার বকবক করা সফল।

--আজ্ঞে না। আমি আমার দুই কানকে সজাগ থাকতে বলেছি। আমার কথা না শুনলেই মোক্ষম কান মলা দেব সেই ভয়ে চুপচাপ সব শুনছে।

--আচ্ছা বেশতুমি পাখিদের মেটিং দেখেছোপলাশদেখো নি তোনেচারকে ভালোভাবে স্টাডি করবে। কত কী জানতে পারবে। এর জন্য কিন্তু বই পড়তে লাগে না। যেমন পুরুষ পাখি গালগলা ফুলিয়ে পেখম ছেতরেএকবার এদিক একবার ওদিক যায়। 'টিকরি টিকরিশব্দ করে গলায়। আর গায়ের রংটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। স্ত্রী পাখি তখন ঠিক বুঝতে পারে। যখন ওরা পেয়ে যায় মনের মতো সাথি তখন আনন্দে গলা ভেঙে আটরকম শব্দ বার করে। অদ্ভুত তাই নাতারপর যখন ওদের মেটিং এ বুঝতে পারে কেউ আসছে তখন ওদের আগমন সংবাদ অক্টেভে খেলে বেড়ায়। প্রকৃতির এ এক অদ্ভুত লীলা। আমি দেখেছি মার্চ-এপ্রিল এদের মেটিং এর সময়। কিছু কিছু পাখি তো জোড় বেঁধে সংসারধর্ম পালন করে না ঠিক মানুষের মতন। নির্দিষ্ট ঋতুতে যৌন মিলনে মেয়ে পাখির পেটে ডিম আসেতখন সে-ই খড়কুটো দিয়ে কোনওরকমে একটা বাসা বানায় তারপর তার ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা পালন করার সব দায়িত্বই তো পালন করে মা-পাখিটা । তখন পুরুষটার পাত্তাও পাওয়া যায় না। আমাদের ব্যালকনিতে যখন বাচ্চা হল দেখলে তো। ঝড় জল মাথায় নিয়ে বাচ্চাকে পালক দিয়ে আগলে রাখছিল মা পাখি কেমন। প্রথম প্রথম আমাদের দেখে মা পাখিটা উড়ে বাড়ির সামনের ত্রিকোন গম্বুজ-টার মাথায় বসে লক্ষ্য করছিলআমরা ক্ষতি করছি কিনা বাচ্চার। আর কখনই একটা বাচ্চার জন্ম দেয় না। দুটোর। ভারী অদ্ভুত তাই না?

বইতে তুমি পাবে না সব কিছু। শুধু পাখিরা নাজীব জন্তুরাও এইসময় মেটিং এর জন্য ছটফট করে। আমার তাই চুপচাপ দেখতে বড় ভাল লাগে। কি অদ্ভুত সব সিস্টেম এই পৃথিবীর বইতে আছে।
(চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

0 Comments