জ্বলদর্চি

খ্রিস্টোৎসব কথা /প্রসূন কাঞ্জিলাল

খ্রিস্টোৎসব কথা

প্রসূন কাঞ্জিলাল

সবলদের অত্যাচারে দুর্বলদের জীবন যখন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, যখন সাধারণ মানুষের জীবন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায় তখনই কোনো এক মহামানবের আবির্ভাব ঘটে । মানবসমাজে মুক্তির আলো দেখাতে যাঁরা আবির্ভূত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে যীশুখ্রীষ্ট অন্যতম । তিনি দিশেহারা মানুষকে সঠিক পথ দেখাতে আলোর দিশারী হয়ে জন্ম নিয়েছিলেন।

 দু-হাজার বছর আগে 25 শে ডিসেম্বরের এক শীতের রাতে মহাপ্রাণ যীশুখ্রীষ্ট জেরুজালেমের কাছে বেথলেহেমে জন্মগ্রহণ করেন । যীশুর পিতা এতই দরিদ্র ছিলেন যে সন্তানসম্ভবা মা মেরিকে নিয়ে এক আস্তাবলে আশ্রয় নিয়েছিলেন । এই আস্তাবলে যীশুর জন্ম হয় । এই রাতে এক দৈববাণী শুনে তিন প্রাজ্ঞপুরুষ একটি উজ্জ্বল তারার অনুসরণ করে এখানে যীশুকে দেখতে আসেন । তাঁদের কাছ থেকে যীশুর অলৌকিক কথাবার্তা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ।

দারিদ্রতার জন্য যীশু বিশেষ লেখাপড়ার সুযোগ পাননি। বাবার জীবিকা পশুপালন বৃত্তিই গ্রহণ করেন । কিন্তু যিনি আলোর পথের দিশারী তাঁর দ্যুতি কি নিভে থাকতে পারে ? অল্প দিনের মধ্যেই তিনি বহু মানুষের মন জয় করে নিয়েছিলেন । তাঁর সহজাত নিজ চেষ্টায় সমকালীন নানা ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ থেকে জ্ঞান আহরণ করে তিনি এক নতুন ধর্ম মতের প্রবর্তন করেন যার নাম খ্রিস্টধর্ম । তিনি সবাইকে শোনালেন যে করুণাময় ঈশ্বরই মানুষের পিতা, মানবজীবন নানা পাপের মধ্যে জড়িয়ে আছে । ঈশ্বর ক্ষমার আধার । ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখলে তিনি সবার ভালো করবেন।

 25 শে ডিসেম্বর যীশুর জন্মদিন । এদিন খ্রীস্ট ধর্মাবলম্বীরা বড়দিন হিসাবে পালন করে । শুধু ইউরোপে নয়, পৃথিবীর প্রায় বেশির ভাগ দেশে এই উৎসব পালিত হয় । এই সময় পথঘাট আলোর মালায় সাজানো হয়, রঙিন কাগজ দিয়ে ঘর সাজানো হয় । বাড়ির সামনে ক্রীসমাস ট্রি বসানো হয় । ক্রীসমাস বুড়ো অর্থাৎ স্যান্টাক্লজ, যে আনন্দের দূত গোপনে প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে এসে উপহার দিয়ে যায় । গির্জায় গির্জায় প্রার্থনা হয় । প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে আত্মীয় পরিজন আসে । চারদিক আনন্দে মুখরিত হয় ।

 যীশুর জনপ্রিয়তা যত বাড়তে লাগলো সেই সঙ্গে স্বার্থন্বেষীদের ষড়যন্ত্রও দানা বাঁধতে লাগল । যীশুর বিরুদ্ধে নানান অপপ্রচার শুরু হতে লাগল ।  রোমান শাসক ও যাজক শ্রেণির মনে সন্দেহ হয় যে যীশুই দেশের রাজা হয়ে সিংহাসনে বসবেন । যদি যীশুকে রাজা করা হয় তাহলে রাজার স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে । তাই শাসক হেরড যীশুর প্রতি অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন । শেষ পর্যন্ত জুডাস নামে যীশুর এক শিশু সামান্য অর্থের বিনিময়ে যীশুকে শত্রুদের হাতে ধরিয়ে দেয় । শুরু হয় বিচারের প্রহসন । শেষে ক্রুশবিদ্ধ করে যীশুকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

 জেরুজালেমের কালতারিতে যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হল । চরম মৃত্যু যন্ত্রণার মধ্যেও যীশু এই হত্যাকারীদের ক্ষমা করে গেলেন । তিনি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন, "হে পিতা ! এদের তুমি ক্ষমা কর।"

ক্ষণজন্মা মহামানব যীশুর জন্মের পর দু হাজারেরও বেশি বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল । এখনও পৃথিবী হাজার হাজার, কোটি কোটি মানুষের মনের মণিকোঠায় তিনি অম্লান হয়ে রয়েছেন । তাঁর প্রচারিত বাণী ও বিশ্বাসকে আশ্রয় করে বেঁচে আছে মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে । এই মহামানবের মৃত্যু নেই, তিনি অজর অমর।

এখানে একটি প্রশ্ন আসে যে যিশুর জন্ম আসলে ঠিক কবে ? সারা বিশ্বেই ২৫ ডিসেম্বর যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন পালন করা হয়ে থাকে। এই দিনটি বাঙালির কাছে বড়দিন। ২৪ ডিসেম্বর মধ্যরাতে গির্জায় গির্জায় প্রার্থনার মধ্য দিয়ে যিশুর জন্মদিন পালন করার রীতিও রয়েছে। কিন্তু যিশু কি সত্যিই ২৫ ডিসেম্বর জন্মেছিলেন?

কোনও খ্রিস্টীয় নথিতেই যিশুর জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বর বলে উল্লেখ নেই। যিশুর জন্মের সময় ধরে খ্রিস্টাব্দের হিসাব করা হলেও, খ্রিস্টাব্দের অন্তত প্রথম তিন শতক ধরে তাঁর জন্মদিন পালনের কোনও রীতিরও খোঁজ পাওয়া যায় না। এমনকি, যিশুর জন্ম প্রথম খ্রিস্টাব্দের কিছু আগেই হয়েছিল বলে মনে করা হয়।

৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট কনস্টেন্টাইনের আমলে ২৫ ডিসেম্বর দিনটিতে প্রথম যিশুর জন্মদিন পালন করা শুরু হয়। এর কিছু বছর পরে পোপ প্রথম জুলিয়াস এই দিনটিকেই সরকারিভাবে যিশুর জন্মদিন হিসেবে ঘোষণা করেন।

২৫ ডিসেম্বর দিনটিকে যিশুর জন্মদিন হিসেবে পালন শুরুর আগে ২৩ ডিসেম্বর থেকে ১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়কালটি রোমানদের মধ্যে পৌত্তলিক ধর্মের উৎসব পালনের রেওয়াজ ছিল। জনগণের প্রচলিত ধর্মীয় উৎসবকেই বেছে নিয়েছিলেন আদি খ্রিস্টানরা। জনপ্রিয়তা পেতেই তারা হয়তো পুরনো উৎসবকে বাতিল করেননি। সেটাকেই নিজের করে নেন।

পৌত্তলিকরা মূলত ছিলেন সূর্যের উপাসক। তাই ক্রান্তীয় দিবসে তারা পালন করতেন উইন্টার সলস্টিস উৎসব। যিশুকে সূর্যের সঙ্গে মেলানোর কাজ শুরু হয় তখন থেকেই। 

যিশুর পুরনো ছবিতে দেখা যায়, মাথার পেছনে সূর্য আঁকা রয়েছে। সৌরপৌত্তলিকরা ক্রমে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করেন। সেকালে রাজারাই আগে ধর্মান্তরিত হতেন। রাজার ধর্ম পরিবর্তনের ফলে প্রজারাও ধর্মান্তরিত হয়ে যেত। নিজের অজান্তে ধর্মান্তরিত হওয়া মানুষের সেন্টিমেন্টের মর্যাদা দিয়েই হয়তো কারও ধর্মবিশ্বাসে আঘাত না করে আমরা সংক্ষেপে ইতিহাসটা খতিয়ে দেখব। বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টে খ্রিস্টজন্মের নির্দিষ্ট সাল-তারিখের উল্লেখ নেই, ফলে গোড়া থেকেই এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণা ও তর্কবিতর্ক শুরু হয়। ডেল আরভিন ও স্কট সানকিস্ট তাঁদের বিশদ গবেষণার ফসল হিস্ট্রি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ক্রিশ্চিয়ান মুভমেন্ট গ্রন্থে লিখেছেন, ‘৩০০ খ্রিস্টাব্দের আগে যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন বিষয়ে খ্রিস্টানদের মধ্যে কোনও ঐকমত্য ছিল না। অনেকে বসন্তের একটি দিনকে এই উদ্দেশ্যে মানতেন, অনেকে আবার ‘অদম্য সূর্যের দিন’ ২৫ ডিসেম্বর খ্রিস্টের জন্মদিন হিসেবে পালন করতেন।

 ক্রমশ অধিকাংশ খ্রিস্টান এই তারিখটিকেই মেনে নিলেন, তার ফলে  খ্রিস্টীয় আচারে ‘সলস্টিস’ বা অয়নকাল-এর সূর্যবন্দনার সঙ্গে ‘স্যাটারনালিয়া’ নামক রোমান উৎসবের একটা মিলন ঘটল। হোমার স্মিথ তাঁর ম্যান অ্যান্ড হিজ গডস-এ লিখেছেন, ‘২৫ ডিসেম্বরের এই স্থানীয় উৎসব গ্রিক সৌর উত্‌সব ‘হেলিয়া’র সঙ্গে মিশে গেল, এই উৎসবের মধ্যে দিয়ে অ্যাটিস, ডায়োনিসাস, ওসিরিস প্রমুখ দেবতাকেও সম্মান জানাল, ‘পৃথিবীর আলো’ ও ‘পরিত্রাতা’ নামেও তাঁরা পূজিত হলেন।’ ডিসেম্বরের ২১-২২ তারিখে সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু হয়, ঠান্ডায় জমে যাওয়া ইউরোপের মানুষের কাছে বছরের কঠিনতম সময়ের অবসান ঘটে, বাকি শীতটা পার করে দেওয়া যাবে— এই স্বস্তি থেকেই শীতের উৎসব এসেছিল।

খ্রিস্টপূর্ব যুগের এই দারুণ জনপ্রিয় উৎসবের সঙ্গে দিন মিলিয়ে রোমান চার্চ ২৫ ডিসেম্বরকে খ্রিস্টের জন্মদিন হিসেবে মেনে নিলেও ৩৭৫ খ্রিস্টাব্দ অবধি পূর্ব গোলার্ধের চার্চগুলি তাতে সায় দেয়নি। কিছু পণ্ডিত দেখিয়েছেন, সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত জেরুসালেমের চার্চ এই দিনটিকে অগ্রাহ্য করেছে। আর্মেনিয়ানরা এখনও ৬ জানুয়ারি ক্রিসমাস পালন করেন। এই অনির্দিষ্টতায় খ্রিস্টের মহিমা এতটুকুও ক্ষুণ্ণ হয় না। গৌতম বুদ্ধের জন্মদিন নিয়েও নানা মত আছে। আমরা দেখতে চাইছি, একটা মহান ধর্ম কী ভাবে ঐতিহ্য থেকে বিভিন্ন উপকরণ গ্রহণ করে তাদের সংস্কার ঘটায় এবং নিজেকে সমৃদ্ধ ও সজীব করে তোলে।
                           
এই সূত্রে আরও নানা কৌতূহল ভিড় করে আসে। যেমন, ক্রিসমাস ট্রি কোথা থেকে এল? খ্রিস্টের জন্মভূমি জুডিয়া বা প্যালেস্টাইনের গরমে ওই ধরনের কনিফার জন্মানোর প্রশ্ন ছিল না। খ্রিস্টধর্ম যখন উত্তরে প্রসারিত হয়ে ইউরোপের ধর্মে পরিণত হয় তখনই পাইন গাছ থেকে ক্রিসমাস ট্রি-এর ধারণা জন্ম নিয়েছিল। ইউরোপে পুরনো মাতৃকাদেবীর মন্দিরে থাকত পাইন গাছের সারি। ইতিহাসে ক্রিসমাস ট্রি-এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় লাটভিয়ায় ১৫১০ ও জার্মানিতে ১৫৭০ সালে। কথিত আছে, জার্মান প্রোটেস্টান্ট মার্টিন লুথার ষোড়শ শতকে এটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন। ১৮৩০-এর দশকে রানি ভিক্টোরিয়ার জার্মান স্বামী অ্যালবার্ট উইন্ডসর প্যালেসে ক্রিসমাস ট্রি নিয়ে আসেন, সেই থেকে ইংল্যান্ডে তার প্রচলন হয়। অতঃপর তা ব্রিটেন থেকে তার উপনিবেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং আটলান্টিক পেরিয়ে পাড়ি দেয় আমেরিকায়, যেখানে সব কিছু নিয়েই একটু বাড়াবাড়ি করা হয়ে থাকে।

নতুন খ্রিস্টধর্মকে জনসাধারণের মধ্যে আরও জনপ্রিয় করতে খ্রিস্টপূর্ব যুগের বিবিধ উপাসনার নানা প্রতীক আর আচারও এই নতুন ধর্মে বুনে দেওয়া হল। যেমন হলি গাছের পাতার সবুজ স্তবক আর লাল চেরি ও মিসলটাও দিয়ে তৈরি ক্রিসমাসের অভিজ্ঞান। ক্রিসমাস প্রবর্তনের অনেক শতাব্দী আগে এই দিনে রোমানদের বড় উৎসব স্যাটারনালিয়া পালিত হত মহাসমারোহে। উপাসনা, খানাপিনা, নাচ-গান-নাটকে ভরপুর এই উৎসবের ধারা ক্রিসমাসের মধ্যে সঞ্চারিত হল। যে সব কোম্পানি আজ হাজার হাজার কোটি টাকার ক্রিসমাস কার্ড আর গিফট-এর ব্যবসা করে, তাদের এই পুরনো রোমান উৎসবের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত, কারণ ক্রিসমাসের সময় কার্ড আর উপহার দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর রীতি এই প্রাচীন উৎসব থেকে এসেছে। ক্রিসমাস পালনের বিভিন্ন প্রথা, যেমন ‘ইউল লগ’ পোড়ানো, মোমবাতি জ্বালানো, ক্যারল গাওয়া, এ সবই এসেছে বা নেওয়া হয়েছে পুরনো নানা রকম আচার থেকে।

বিশুদ্ধতাবাদী খ্রিস্টানরা এ-সব খ্রীস্ট-পূর্ব ও (তাঁদের মতে) ‘বিধর্মী’ রীতি ও আচারের মাধ্যমে ক্রিসমাস পালনকে অনেক সময়েই ‘অপবিত্র আড়ম্বর আর উল্লাস’ বলে নিন্দা করেন। পলিডোর ভার্জিল লিখেছেন, ‘খ্রিস্টানদের মধ্যে নাচানাচি, মুখোশ পরা, নাটক করা ও আরও নানা উচ্ছৃঙ্খল উপায়ে ক্রিসমাস পালনের রীতি এসেছে প্রাচীন রোমান উৎসবগুলি থেকেই, তাই ধার্মিক খ্রিস্টানরা যেন এগুলিকে চিরকালই ঘৃণা করেন।’ ক্লদিয়া দেলিস -এর মতে, সপ্তদশ শতকে ম্যাসাচুসেটস -এর পিউরিটানরা আচার অনুষ্ঠানের বাড়াবাড়ি দেখে ক্রিসমাস উৎসবকেই নিষিদ্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। ক্রিসমাস কেক আর পুডিং কেবল নিজেদের লোভ মেটানোর একটা উপায়— এই অভিযোগ তুলে ১৬৬৪ সালে পিউরিটানরা তা নিষিদ্ধ করে দিতে উদ্যোগী হন। সে চেষ্টা সফল হলে পাশ্চাত্যের প্রায় সব কেক ব্যবসায়ীর কারবার লাটে উঠত। কিন্তু রাজা প্রথম জর্জ ফের ক্রিসমাসে কেক আর পুডিং-এর চল ফিরিয়ে আনলেন এবং সেই সব কেক পুডিং যেন আরও মিষ্টি হয়ে উঠল, যে মিষ্টিতে লোভে পাপ।
                             
সান্তা ক্লস কবে এলেন? কে-ই বা তিনি? উপকথায় বলে, তিনি নাকি চতুর্থ শতকের এক অত্যন্ত দয়াবান বিশপ। তাঁর আদি নিবাস তুরস্ক, নাম ছিল নিকোলাস। তিনি দীন-দরিদ্রদের সাহায্য করতেন, বিশেষত যাঁরা মুখ ফুটে সাহায্য চাইতে পারতেন না তাঁদের। তাঁর সম্পর্কে একটি দারুণ লোককথা প্রচলিত। এক বার এক খুব গরিব মানুষের বাড়িতে তিনি চিমনি বেয়ে উঠে তার ভিতর দিয়ে কয়েকটি স্বর্ণমুদ্রা ফেলে এসেছিলেন। চিমনির পাশে একপাটি মোজা শুকোনোর জন্য রাখা ছিল, মুদ্রাগুলি তার মধ্যে গিয়ে পড়ে। দরিদ্র মানুষটি স্বর্ণমুদ্রাগুলি বিক্রি করে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছিলেন। 

আর সেই থেকে সান্তার জন্য বাচ্চারা মোজা ঝুলিয়ে রেখে দেয়, তাকে উদ্দেশ করে অপূর্ব সব চিঠি লেখে আর অপেক্ষা করে, কখন সান্তা এসে দারুণ সব উপহার দিয়ে যাবে। কবিতায় গানে গল্পে আমরা জেনেছি, কেমন করে সেই সন্ত উত্তর মেরু থেকে বড় বড় শিংওয়ালা হরিণে টানা স্লেজে চেপে বরফের মধ্যে দিয়ে এসে সারা পৃথিবীর অগণিত বাচ্চাকে উপহার দিয়ে যান। ক্রিসমাসের আগের রাত্রে শিশুরা ঘুমিয়ে পড়লে মা-বাবা মোজার ভেতর নানান খেলনা, উপহার রেখে সেই মোজা তাদের মাথার কাছে রেখে দেন। পরের দিন সকালে শিশু ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে গিয়ে সেই মোজা খুলে দেখতে যায় সান্তা তার জন্য কী উপহার রেখে গেছে— তৈরি হয় এই উৎসবের শ্রেষ্ঠ দৃশ্য।

ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে যখন নৌবাণিজ্যের প্রসার হল, তখন নাবিকরা এই সন্তের গল্প বয়ে নিয়ে গেলেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, অচিরেই তাঁর নাম হল ‘ফাদার ক্রিসমাস।’ পরে ওলন্দাজ অভিবাসীরা এই লোককথাকে আমেরিকায় নিয়ে গেলেন, তাঁদের ‘সিন্টার-ক্লাস’ হয়ে গেলেন সান্তা ক্লস। বিশাল খেলনা-শিল্প রঙবেরঙের বিজ্ঞাপন করে উৎসবের মহিমা বাড়িয়ে তুলল। অনেক দিন অবধি আমেরিকানরা সান্তাক্লস কে তাঁদের পতাকার (স্টার্স অ্যান্ড স্ট্রাইপস) নকশা দিয়ে সাজাতেন। তার পর ১৮৮১ সালে হার্পার্স উইকলি-তে ছাপা হল সান্তার নতুন ছবি: লম্বা সাদা দাড়ি, লাল জোব্বা, নাদুসনুদুস মানুষটির হাত ভরতি খেলনা। দুনিয়া জুড়ে বাণিজ্য এবং ধর্ম অনেক সময়েই হাতে হাত মিলিয়েছে। ১৯৩১ সালে কোকা কোলা নিয়ে এল টকটকে লাল, বিশাল ‘কোক সান্তা’ বিজ্ঞাপন, আজও ক্রিসমাসের সময় যা অতিপরিচিত। এ ভাবেই গোটা পৃথিবীতে জনপ্রিয় হয়েছে ‘জিঙ্গল বেলস’।

এই ভাবেই বেথলেহেম থেকে রোম হয়ে দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ক্রিসমাস, আর সান্তা ক্লস তুরস্ক থেকে উত্তরমেরু পাড়ি দিয়েছেন, এবং এখন তিনি অবাধে বিশ্বের সর্বত্র ঘুরে বেড়ান, পাসপোর্ট ভিসার তোয়াক্কা না করে অনাবিল আনন্দ বিতরণ করেন।
                         
যিশু (জন্ম: আনুমানিক ৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ এবং মৃত্যু: আনুমানিক ৩০ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন একজন ইহুদি ধর্মপ্রচারক, যিনি খ্রিস্টধর্মের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। তাঁকে নাসরতের যিশু (Jesus of Nazareth) বা যিশু খ্রিস্ট নামেও অভিহিত করা হয়। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করেন, তিনি হলেন ঈশ্বরপুত্র এবং পুরাতন নিয়মে যে মসিহ (খ্রিস্ট, অভিষিক্ত ব্যক্তি) সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, সেই মসিহ।

ইসলাম, খ্রিস্টান ও বাহাই - এই তিনটি ধর্মে, যিশুর ঐতিহাসিক সত্যতাকে তাদের ধর্মগ্রন্থসমূহের ভিত্তিতে স্বতঃসিদ্ধভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। তথাপি, এটাও সত্য যে, যিশুর সমসাময়িককালের এমন কোনো দলিল আজও পাওয়া যায় নি, যাতে যিশুর অস্তিত্বের কোনো উল্লেখ আছে। যিশুর সবচেয়ে প্রাচীন উল্লেখ হল নতুন বাইবেল, আধুনিক ইতিহাসবিদদের মতে যার রচনাকাল যিশুর অনুমিত মৃত্যুকালের কয়েক দশক পর। ধর্ম তিনটিতে যিশুকে মসিহ মনে করা হয়, যদিও মসিহের ভূমিকা প্রসঙ্গে ধর্মসমূহের ধারণা ভিন্ন। অপরদিকে ধর্মনিরপেক্ষ ইতিহাসবিদ ও অন্যান্য ধর্মের (যেমন ইহুদি ধর্ম ) অনুসারীগণ যিশুকে একজন সাধারণ মানুষ বলে মনে করেন, এমনকি অনেকে মনে করেন যিশু বলে আসলে কেউ কখনো ছিলো না।

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন বাইবেলে যিশুর জীবনের যে বর্ণনা তা নিরপেক্ষ কোনো ঐতিহাসিক দলিল নয়, বরং নতুন বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার তাগিদে লিখিত কোনো ঐতিহাসিক ব্যাক্তিত্বের জীবনের উপর ধর্মীয় বা পৌরাণিক রচনা। সেক্ষেত্রে, কোন বর্ণনাটি ঐতিহাসিক সত্য, আর কোন বর্ণনাটি নয়, তা আলাদা করা ইতিহাসবিদদের জন্য কঠিন একটি কাজ। বর্ণনার অনেক অংশ অতিরঞ্জিত, কোনো উপকথা হতে গৃহীত বা সম্পূর্ণ বানোয়াট হতে পারে। এমনকি, ঐতিহাসিকভাবে সত্য বর্ণনাসমূহও পুনঃবর্ণনায় পরিবর্তন হয়ে থাকতে পারে বলে তারা মনে করেন।

কার্যত প্রাচীন ইতিহাসবিদ সকল গবেষকই এই ব্যাপারে একমত যে যিশু একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁরা মনে করেন, পর্যবেক্ষণমূলক সুসমাচারগুলি (ম্যাথিউ, মার্ক ও লুক) হল যিশুর ঐতিহাসিক সত্যতা অনুসন্ধানের শ্রেষ্ঠ সূত্র। যিশুকে প্রায়শই "রাব্বি" সম্বোধন করা হয়েছে। তিনি মুখে মুখে তাঁর বাণী প্রচার করতেন। দীক্ষাদাতা যোহন তাঁকে দীক্ষা (ব্যাপ্টিজম) দিয়েছিলেন এবং রোমান প্রিফেক্ট পন্টিয়াস পাইলেটের আদেশে তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল। আধুনিক যুগে সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, যিশু ছিলেন একজন রহস্য উন্মোচনকরি ধর্মপ্রচারক এবং তিনি ইহুদি ধর্মের মধ্যেই একটি সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন। যদিও কয়েকজন বিশিষ্ট গবেষক মনে করেন যে, যিশু আদৌ রহস্য উন্মোচনকরি ছিলেন না। ঈশ্বরের ইচ্ছা পালনের শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি কী, তা নিয়ে যিশু ইহুদি ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিতর্কে অংশ নিতেন, রোগীদের রোগমুক্ত করতেন, নীতিগর্ভ কাহিনির মাধ্যমে শিক্ষা দিতেন এবং শিষ্য সংগ্রহ করতেন।

 যিশুর অনুগামীরা বিশ্বাস করতেন যে, তিনি মৃত্যুর পর পুনর্জীবন লাভ করেছিলেন এবং তাঁরা যে সমাজ গঠন করেছিলেন তা-ই পরবর্তীকালে খ্রিস্টীয় চার্চে পরিণত হয়। ২৫ ডিসেম্বর তারিখে (বা কয়েকটি ইস্টার্ন চার্চের মতানুসারে জানুয়ারির বিভিন্ন তারিখে) যিশুর জন্মদিন পালিত হয়। এটি একটি ছুটির দিন এবং এটি বড়দিন বা ক্রিসমাস নামে পরিচিত। যিশুর ক্রুশারোহণের তারিখটি গুড ফ্রাইডে এবং পুনর্জীবন লাভের তারিখটি ইস্টার নামে পরিচিত। বহুল ব্যবহৃত পঞ্জিকা যুগ "খ্রিস্টাব্দ" (লাতিন "Anno Domini" বা "আমাদের প্রভুর বছরে" থেকে) যিশুর জন্মতারিখের ভিত্তিতে প্রচলিত।
                            
খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করেন যে, বিশ্বে যিশুর একটি “স্বতন্ত্র গুরুত্ব” রয়েছে। খ্রিস্টীয় মতবাদের অন্তর্ভুক্ত বিশ্বাসগুলির মধ্যে রয়েছে পবিত্র আত্মার প্রভাবে যিশুর গর্ভে প্রবেশ এবং মেরি নাম্নী এক কুমারীর গর্ভে জন্ম, যিশুর বিভিন্ন অলৌকিক কার্য সম্পাদন, চার্চ প্রতিষ্ঠা, প্রতিকার বিধানার্থে আত্মত্যাগ স্বরূপ ক্রুশারোহণে মৃত্যু, মৃত অবস্থা থেকে পুনর্জীবন লাভ, সশরীরে স্বর্গে আরোহণ, এবং ভবিষ্যতে তাঁর পুনরাগমনে বিশ্বাস।

 অধিকাংশ খ্রিস্টানই বিশ্বাস করেন, যে যিশু ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের পুনর্মিলন ঘটানোর শক্তি রাখেন। নাইসিন ধর্মমত অনুসারে, যিশু মৃতদের বিচার করবেন। এই বিচারকার্য সম্পাদিত হবে হয় তাদের শারীরিক পুনর্জীবন লাভের আগে অথবা পরে। এই ঘটনাটি খ্রিস্টীয় শেষবিচারবাদে যিশুর দ্বিতীয় আগমনের সঙ্গে যুক্ত। যদিও কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে, ত্রাণকর্তা রূপে যিশুর ভূমিকা মৃত্যুপরবর্তী জীবনের তুলনায় অনেকাংশেই জীবনবাদমূলক বা সমাজমূলক। অল্প কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ধর্মতত্ত্ববিদ বলেছেন যে, যিশু একটি বিশ্বজনীন পুনর্মিলন ঘটাবেন। খ্রিস্টানদের অধিকাংশই যিশুকে ত্রয়ীর তিন জন ব্যক্তির দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব ঈশ্বরপুত্রের অবতার রূপে পূজা করেন। খ্রিস্টানদের একটি সংখ্যালঘু অংশ সম্পূর্ণত বা অংশত ত্রয়ীবাদকে অশাস্ত্রীয় বলে প্রত্যাখ্যান করে।

ইসলাম ধর্মে যিশুকে (ইসলামে তিনি ঈসা নামে পরিচিত) ঈশ্বরের তথা আল্লাহর গুরুত্বপূর্ণ একজন নবী ও মসিহ বলে মনে করা হয়। মুসলমানেরা বিশ্বাস করেন যে, যিশু ছিলেন শাস্ত্র আনয়নকারী নবী তথা রাসূল। তিনি কুমারীগর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তবে তাঁরা যিশুকে ঈশ্বরপুত্র মনে করেন না। কোরান অনুসারে, যিশু নিজে কোনওদিন নিজের ঈশ্বরত্ব দাবি করেননি। অধিকাংশ মুসলমানের মতে, যিশু ক্রুশবিদ্ধ হননি। ঈশ্বর তাঁকে সশরীরে স্বর্গে তুলে নিয়েছিলেন। ইহুদি ধর্ম বিশ্বাস করে না যে, যিশুই সেই মসিহ যাঁর সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। ইহুদিদের মতে, ক্রুশে যিশুর মৃত্যুই প্রমাণ করে যে ঈশ্বর তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তাঁরা যিশুর পুনর্জীবন লাভের ঘটনাটিকে একটি খ্রিস্টীয় কিংবদন্তি মনে করেন।

বড়দিন বা Christmas বা Christmas Day আদতে একটি বাৎসরিক খ্রিস্টীয় উৎসব। ২৫ ডিসেম্বর তারিখে যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন উপলক্ষে এই উৎসব পালিত হয়। এই দিনটিই যিশুর প্রকৃত জন্মদিন কিনা তা জানা যায় না। আদিযুগীয় খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অনুসারে, এই তারিখের ঠিক নয় মাস পূর্বে মেরির গর্ভে প্রবেশ করেন যিশু। সম্ভবত, এই হিসাব অনুসারেই ২৫ ডিসেম্বর তারিখটিকে যিশুর জন্মতারিখ ধরা হয়। অন্যমতে একটি ঐতিহাসিক রোমান উৎসব অথবা উত্তর গোলার্ধের দক্ষিণ অয়নান্ত দিবসের অনুষঙ্গেই ২৫ ডিসেম্বর তারিখে যিশুর জন্মজয়ন্তী পালনের প্রথাটির সূত্রপাত হয়। বড়দিন বড়দিনের ছুটির কেন্দ্রীয় দিন এবং খ্রিষ্টধর্মে বারো দিনব্যাপী খ্রিষ্টমাসটাইড অনুষ্ঠানের সূচনাদিবস।
                      
প্রকৃতিগতভাবে একটি খ্রিষ্টীয় ধর্মানুষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও, একাধিক অ-খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ও মহাসমারোহে বড়দিন উৎসব পালন করে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে উৎসবের আয়োজনে প্রাক-খ্রিষ্টীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়ভাবনার সমাবেশও দেখা যায়। উপহার প্রদান, সংগীত, খ্রিষ্টমাস কার্ড বিনিময়, গির্জায় ধর্মোপাসনা, ভোজ, এবং খ্রিষ্টমাস বৃক্ষ, আলোকসজ্জা, মালা, মিসলটো, যিশুর জন্মদৃশ্য, এবং হলি সমন্বিত এক বিশেষ ধরনের সাজসজ্জার প্রদর্শনী আধুনিককালে বড়দিন উৎসব উদযাপনের অঙ্গ। কোনো কোনো দেশে ফাদার খ্রিষ্টমাস (উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আয়ারল্যান্ডে সান্টাক্লজ) কর্তৃক ছোটোদের জন্য বড়দিনে উপহার আনার উপকথাটি বেশ জনপ্রিয়।
উপহার প্রদানের রীতিটি সহ বড়দিন উৎসবের নানা অনুষঙ্গ খ্রিষ্টান ও অ-খ্রিষ্টানদের অর্থনীতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই উৎসব উপলক্ষে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয়ের একটি বিশেষ মরসুম চলে। বিগত কয়েকটি শতাব্দীতে বিশ্বে বিভিন্ন অঞ্চলে বড়দিনের অর্থনৈতিক প্রভাবটি ধীরে ধীরে প্রসারিত হতে দেখে গেছে। ভারত ও বাংলাদেশে বড়দিন একটি রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়।

ইংরেজি খ্রিস্টমাস (Christmas) শব্দটি "খ্রিস্টের মাস (উৎসব)" শব্দবন্ধটির যুগ্ম অর্থ থেকে উৎসারিত। শব্দটির বুৎপত্তি ঘটে মধ্য ইংরেজি Christemasse ও আদি ইংরেজি Cristes mæsse শব্দ থেকে। শেষোক্ত শব্দটির প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় ১০৩৮ সালের একটি রচনায়। "Cristes" শব্দটি আবার গ্রিক Christos এবং "mæsse" শব্দটি লাতিন missa (পবিত্র উৎসব) শব্দ থেকে উদগত। প্রাচীন গ্রিক ভাষায় Χ (চি) হল Christ বা খ্রিষ্ট শব্দের প্রথম অক্ষর। এই অক্ষরটি লাতিন অক্ষর X-এর সমরূপ। ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে তাই এই অক্ষরটি খ্রিষ্ট শব্দের নামসংক্ষেপ হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু হয়। এই কারণে খ্রিষ্টমাসের নামসংক্ষেপ হিসেবে এক্সমাস কথাটি চালু হয়।

আকাদেমি বিদ্যার্থী বাংলা অভিধানে যিশু খ্রিষ্টের জন্মোৎসব খ্রিষ্টমাস উৎসবটিকে বাংলায় বড়দিন আখ্যা দেওয়ার কারণটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে: "২৩ ডিসেম্বর থেকে দিন ক্রমশ বড়ো এবং রাত ছোটো হতে আরম্ভ করে"।
                           
বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রেই বড়দিন একটি প্রধান উৎসব তথা সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। এমনকি অ-খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ কয়েকটি দেশেও মহাসমারোহে বড়দিন উদযাপিত হতে দেখা যায়। কয়েকটি অ-খ্রিষ্টান দেশে পূর্বতন ঔপনিবেশিক শাসনকালে বড়দিন উদযাপনের সূত্রপাত ঘটেছিল। অন্যান্য দেশগুলিতে সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান জনসাধারণ অথবা বৈদেশিক সংস্কৃতির প্রভাবে বড়দিন উদযাপন শুরু হয়। তবে চীন (হংকং ও ম্যাকাও বাদে), জাপান, সৌদি আরব, আলজেরিয়া, থাইল্যান্ড, নেপাল, ইরান, তুরস্ক ও উত্তর কোরিয়ার মতো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দেশে বড়দিন সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয় না। অধিকাংশ দেশে প্রতি বছর বড়দিন পালিত হয় ২৫ ডিসেম্বর তারিখে। তবে রাশিয়া, জর্জিয়া, মিশর, আর্মেনিয়া, ইউক্রেন ও সার্বিয়ার মতো কয়েকটি ইস্টার্ন ন্যাশানাল চার্চ ৭ জানুয়ারি তারিখে বড়দিন পালন করে থাকে। কারণ এই সকল চার্চ ঐতিহ্যশালী জুলিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে থাকে; জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ২৫ ডিসেম্বর প্রামাণ্য জর্জিয়ান ক্যালেন্ডারের ৭ই জানুয়ারি তারিখে পড়ে।

সারা বিশ্বে, সাংস্কৃতিক ও জাতীয় ঐতিহ্যগত পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে বড়দিন উৎসব উদযাপনের রূপটিও ভিন্ন হয়ে থাকে। জাপান ও কোরিয়ার মতো দেশে খ্রিষ্টানদের সংখ্যা আনুপাতিকভাবে কম হলেও বড়দিন একটি জনপ্রিয় উৎসব। এই সব দেশে উপহার প্রদান, সাজসজ্জা, ও খ্রিষ্টমাস বৃক্ষের মতো বড়দিনের ধর্মনিরপেক্ষ দিকগুলি গৃহীত হয়েছে।

খ্রিষ্টধর্মে খ্রিষ্টমাস বা বড়দিন হল যিশুর জন্মোৎসব। খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, আদি বাইবেলর ত্রাণকর্তা-সংক্রান্ত একাধিক ভবিষ্যদবাণীতে বলা হয়েছে যে কুমারী মেরির গর্ভে তাঁদের মসিহা বা ত্রাণকর্তার জন্ম হবে। নূতন নিয়ম বা নূতন বাইবেলের মথিলিখিত সুসমাচার (মথি ১: ১৮ – ২: ১২) এবং লূকলিখিত সুসমাচার (লূক ১: ২৬ – ২: ৪০)-এ বর্ণিত যিশুর জন্মকাহিনী খ্রিষ্টমাস উৎসবের মূলভিত্তি। এই উপাখ্যান অনুসারে, স্বামী জোসেফের সাহচর্যে বেথলেহেম শহরে উপস্থিত হয়ে মেরি যিশুর জন্ম দেন। জনপ্রিয় ধারণা অনুযায়ী, একটি আস্তাবলে গবাদি পশু পরিবৃত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন যিশু। যদিও বাইবেলের উপাখ্যানে আস্তাবল বা গবাদি পশুর কোনো উল্লেখই নেই। যদিও লূকলিখিত সুসমাচারে (লূক ২: ৭) একটি যাবপাত্রের উল্লেখ আছে: "আর তিনি আপনার প্রথমজাত পুত্র প্রসব করিলেন, এবং তাঁহাকে কাপড়ে জড়াইয়া যাবপাত্রে শোয়াইয়া রাখিলেন, কারণ পান্থশালায় তাঁহাদের জন্য স্থান ছিল না।" 

যিশুর জন্ম-সংক্রান্ত প্রথম দিকের চিত্রগুলিতে গবাদি পশু ও যাবপাত্র পরিবৃত একটি গুহায় যিশুর জন্মদৃশ্য দর্শানো হয়েছে। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, এটি বেথলেহেমের চার্চ অফ দ্য নেটিভিটির অভ্যন্তরে। এক স্বর্গদূত বেথলেহেমের চারিপার্শ্বস্থ মাঠের মেষপালকদের যিশুর জন্ম সম্বন্ধে অবহিত করেন। এই কারণে তাঁরাই সেই দিব্য শিশুকে প্রথম দর্শন করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। অনেক খ্রিষ্টানই মনে করেন, যিশুর জন্ম আদি বাইবেলের ত্রাণকর্তা-সংক্রান্ত ভবিষ্যদবাণীগুলিকে পূর্ণতা দেয়। মথিলিখিত সুসমাচার অনুসারে, কয়েকজন ম্যাজাই (জ্যোতিষী) স্বর্ণ, গন্ধতৈল ও ধূপ নিয়ে শিশুটিকে দর্শন করতে যান। কথিত আছে, একটি রহস্যময় তারা তাঁদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। সাধারণভাবে বেথলেহেমের তারা নামে পরিচিত এই তারাটি ছিল প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে ইহুদিদের রাজার জন্মবার্তার ঘোষক। ম্যাজাইদের আগমনের স্মরণে পালিত হয় ৬ই জানুয়ারির এপিফেনি উৎসব। কোনো কোনো চার্চে এই ৬ই জানুয়ারিতেই আনুষ্ঠানিকভাবে বড়দিন উৎসব সমাপ্ত হয়।
                           
খ্রিষ্টানরা নানাভাবে বড়দিন উদযাপন করে থাকে। এগুলির মধ্যে বর্তমানে গির্জার উপাসনায় যোগ দেওয়া সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যতম জনপ্রিয় প্রথা বলে বিবেচিত হয়। এছাড়াও রয়েছে অন্যান্য বিভিন্ন উপাসনা পদ্ধতি ও জনপ্রিয় রীতিনীতি। বড়দিনের পূর্বে যিশুর জন্মোৎসব উপলক্ষে ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ নেটিভিটি উপবাস পালন করে থাকে; অন্যদিকে পাশ্চাত্য খ্রিষ্টধর্মে অধিকাংশ চার্চে অ্যাডভেন্ট পালন করা হয়। বড়দিনের সর্বশেষ প্রস্তুতিটি নেওয়া হয় খ্রিষ্টমাস পূর্বসন্ধ্যায়।
বড়দিন উৎসব পর্বের অন্যতম অঙ্গ হল গৃহসজ্জা ও উপহার আদানপ্রদান। কোনো কোনো খ্রিষ্টীয় শাখাসম্প্রদায়ে ছোটো ছেলেমেয়েদের দ্বারা খ্রিষ্টের জন্মসংক্রান্ত নাটক অভিনয় এবং ক্যারোল গাওয়ার প্রথা বিদ্যমান। 

আবার খ্রিষ্টানদের কেউ কেউ তাঁদের গৃহে পুতুল সাজিয়ে খ্রিষ্টের জন্মদৃশ্যের ছোটো প্রদর্শনী করে থাকেন। এই দৃশ্যকে নেটিভিটি দৃশ্য বা ক্রিব বলে। এই ধরনের প্রদর্শনী উৎসবের মুখ্য আকর্ষণ হয়ে ওঠে। কোথাও কোথাও লাইভ নেটিভিটি দৃশ্য ও ট্যাবলো ভাইভ্যান্টও অনুষ্ঠিত হয়; এই জাতীয় অনুষ্ঠানে অভিনেতা ও জন্তুজানোয়ারের সাহায্যে যিশুর জন্মদৃশ্যের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়।
চিত্রশিল্পে যিশুর জন্মদৃশ্য ফুটিয়ে তোলার ঐতিহ্যটি সুদীর্ঘ। এই সকল দৃশ্যে মেরি, জোসেফ, শিশু যিশু, স্বর্গদূত, মেষপালক এবং যিশুর জন্মের পর বেথলেহেমের তারার সাহায্যে পথ চিনে তাঁকে দর্শন করতে আসা বালথাজার, মেলকোয়ার ও ক্যাসপার নামক তিন জ্ঞানী ব্যক্তির চিত্র অঙ্কন করা হয়।

যে সকল দেশে খ্রিষ্টান সংস্কার প্রবল, সেখানে দেশজ আঞ্চলিক ও লোকসংস্কৃতির সঙ্গে মিলনের ফলে বড়দিন উদযাপনে নানা বৈচিত্র্য চোখে পড়ে। অনেক খ্রিষ্টানের কাছে ধর্মীয় উপাসনায় অংশ নেওয়া এই উৎসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। উল্লেখ্য, বড়দিন ও ইস্টারের মরসুমেই গির্জায় জনসমাগম হয় সর্বাধিক।

অনেক ক্যাথলিক দেশে খ্রিষ্টমাসের পূর্বদিন ধর্মীয় শোভাযাত্রা বা কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়। অন্যান্য দেশে সান্টাক্লজ ও অন্যান্য মরসুমি চরিত্রদের নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। এই মরসুমের অন্যতম বহুলপ্রচলিত বৈশিষ্ট্য হল পারিবারিক সম্মেলন ও উপহার আদানপ্রদান। অধিকাংশ দেশেই বড়দিন উপলক্ষে উপহার আদানপ্রদান হয়; আবার কোনো কোনো দেশে এই প্রথাটির জন্য বেছে নেওয়া হয় ৬ই ডিসেম্বরের সেন্ট নিকোলাস ডে বা ৬ই জানুয়ারির এপিফেনির দিনগুলি।

অনেক পরিবারেই বড়দিন উপলক্ষে বিশেষ পারিবারিক ভোজসভা আয়োজিত হয়। ভোজসভার খাদ্যতালিকা অবশ্য এক এক দেশে এক এক রকমের হয়। সিসিলি প্রভৃতি কয়েকটি অঞ্চলে খ্রিষ্টমাসের পূর্বসন্ধ্যায় যে ভোজসভা আয়োজিত হয় তাতে পরিবেশিত হয় বারো রকমের মাছ। ইংল্যান্ড ও ইংরেজি সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবান্বিত দেশগুলিতে সাধারণ বড়দিন ভোজসভার পদে দেখা যায় টার্কি (উত্তর আমেরিকা থেকে আনীত), আলু, শাকসবজি, সসেজ ও গ্রেভি; এছাড়াও থাকে খ্রিষ্টমাস পুডিং, মিন্স পাই ও ফ্রুট কেক। পোল্যান্ড, পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশ ও স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলের ভোজে মাছের উপস্থিতি লক্ষ্যনীয়; তবে এই সব অঞ্চলে ভেড়ার মাংসের মতো অত্যধিক-চর্বিওয়ালা মাংসের ব্যবহারও বাড়ছে। জার্মানি, ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ায় হাঁস ও শূকরের মাংস বেশ জনপ্রিয়। এছাড়া প্রায় সারা বিশ্বেই গোমাংস, হ্যাম ও মুরগির যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। ফিলিপিনসের ভোজসভার প্রধান খাদ্য হল হ্যাম।

বিশেষ ধরনের টার্ট ও কেকের সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ ডেসার্টও তৈরি হয় খ্রিষ্টমাস উপলক্ষে: ফ্রান্সে bûche de Noël বা ইতালিতে panettone। মিষ্টি আর চকোলেট সারা বিশ্বেই জনপ্রিয়। খ্রিষ্টমাসের বিশেষ মিষ্টিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য জার্মান স্টোলেন, মারজিপান কেক বা ক্যান্ডি এবং জামাইকান রাম ফ্রুট কেক। উত্তর দেশগুলিতে শীতকালে যে অল্প কয়েকটি ফল পাওয়া যায় তার মধ্যে কমলালেবু খ্রিষ্টমাসের বিশেষ খাদ্য হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে পরিচিত।
                      
বড়দিন উপলক্ষে বিশেষ ধরনের সাজসজ্জার ইতিহাসটি অতি প্রাচীন। প্রাক-খ্রিষ্টীয় যুগে, রোমান সাম্রাজ্যের অধিবাসী শীতকালে চিরহরিৎ বৃক্ষের শাখাপ্রশাখা বাড়ির ভিতরে এনে সাজাত। খ্রিষ্টানরা এই জাতীয় প্রথাগুলিকে তাদের সৃজ্যমান রীতিনীতির মধ্যে স্থান দেয়। পঞ্চদশ শতাব্দীর লন্ডনের একটি লিখিত বর্ণনা থেকে জানা যায়, এই সময়কার প্রথানুসারে খ্রিষ্টমাস উপলক্ষে প্রতিটি বাড়ি ও সকল গ্রামীণ গির্জা "হোম, আইভি ও বে এবং বছরের সেই মরসুমের যা কিছু সবুজ, তাই দিয়েই সুসজ্জিত করে তোলা হত।" প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, হৃদয়াকার আইভিলতার পাতা মর্ত্যে যিশুর আগমনের প্রতীক; হলি প্যাগান (অখ্রিষ্টান পৌত্তলিক) ও ডাইনিদের হাত থেকে রক্ষা করে; এর কাঁটার ক্রুশবিদ্ধকরণের সময় পরিহিত যিশুর কণ্টকমুকুট এবং লাল বেরিগুলি ক্রুশে যিশুর রক্তপাতের প্রতীক।

খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দীতে রোমে নেটিভিটি দৃশ্য প্রচলিত ছিল। ১২২৩ সালে সেন্ট ফ্রান্সিস অফ আসিসি এগুলিকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এরপর শীঘ্রই তা সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। সমগ্র খ্রিষ্টান বিশ্বে স্থানীয় প্রথা ও প্রাপ্ত দ্রব্যাদির অনুষঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সাজসজ্জার প্রথা চালু রয়েছে। ১৮৬০-এর দশকে শিশুদের হাতে নির্মিত কাগজের শিকলের অনুপ্রেরণায় প্রথম বাণিজ্যিক খ্রিষ্টমাস সজ্জা প্রদর্শিত হয়।

খ্রিষ্টমাস বৃক্ষ ও চিরহরিৎ শাখাপ্রশাখার ব্যবহার দক্ষিণ অয়নান্তকে ঘিরে প্যাগান প্রথা ও অনুষ্ঠানগুলির খ্রিষ্টীয়করণের ফলস্রুতি; এক ধরনের প্যাগান বৃক্ষপূজা অনুষ্ঠান থেকে এই প্রথাটি গৃহীত হয়েছিল। ইংরেজি ভাষায় "Christmas tree" শব্দটির প্রথম লিখিত উল্লেখ পাওয়া যায় ১৮৩৫ সালে। শব্দটি গৃহীত হয়েছিল জার্মান ভাষা থেকে। মনে করা হয়, আধুনিক খ্রিষ্টমাস বৃক্ষের প্রথাটির সূচনা ঘটেছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর জার্মানিতে। যদিও অনেকের মতে, এই প্রথাটি ষোড়শ শতাব্দীতে মার্টিন লুথার চালু করেছিলেন। প্রথমে তৃতীয় জর্জের স্ত্রী রানি শার্লোট এবং পরে রানি ভিক্টোরিয়ার রাজত্বকালে আরও সফলভাবে প্রিন্স অ্যালবার্ট জার্মানি থেকে ব্রিটেনে এই প্রথাটির আমদানি করেন। ১৮৪১ সাল নাগাদ খ্রিষ্টমাস বৃক্ষের প্রথাটি সমগ্র ব্রিটেনে যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছিল। ১৮৭০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণও খ্রিষ্টমাস বৃক্ষের প্রথাটি গ্রহণ করে। খ্রিষ্টমাস বৃক্ষ আলোকসজ্জা ও গহনার দ্বারা সুসজ্জিত করা হয়।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে পোইনসেটিয়া নামে মেক্সিকোর একটি দেশজ বৃক্ষ খ্রিষ্টমাস প্রথার সঙ্গে যুক্ত হয়। অন্যান্য জনপ্রিয় হলিডে গাছ হল হলি, মিসলটো, লাল অ্যামারিলিস, ও খ্রিষ্টমাস ক্যাকটাস। খ্রিষ্টমাস বৃক্ষের সঙ্গে মালা ও চিরসবুজ পত্রসজ্জায় সজ্জিত এই সব গাছ দিয়েও বাড়ির অভ্যন্তর সাজানো হয়ে থাকে।

অস্ট্রেলিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং ইউরোপে বাড়ির বাইরে আলোকসজ্জা, এবং কখনও কখনও আলোকিত স্লেজ, স্নোম্যান, ও অন্যান্য খ্রিষ্টমাস চরিত্রের পুতুল সাজানোর প্রথা রয়েছে। পুরসভাগুলিও এই সাজসজ্জার পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। রাস্তার বাতিস্তম্ভে খ্রিষ্টমাস ব্যানার লাগানো হয় এবং টাউন স্কোয়ারে স্থাপন করা হয় খ্রিষ্টমাস বৃক্ষ।

পাশ্চাত্য বিশ্বে ধর্মনিরপেক্ষ বা ধর্মীয় খ্রিষ্টমাস মোটিফ সহ উজ্জ্বল-রঙা রোলকরা কাগজ উৎপাদিত হয় উপহারের মোড়ক হিসেবে ব্যবহারের জন্য। এই মরসুমে অনেক গৃহে খ্রিষ্টমাস গ্রামের দৃশ্যরচনার প্রথাও লক্ষিত হয়। অন্যান্য প্রথাগত সাজসজ্জার অঙ্গ হল ঘণ্টা, মোমবাতি, ক্যান্ডি ক্যান, মোজা, রিদ ও স্বর্গদূতগণ।
অনেক দেশে নেটিভিটি দৃশ্যের উপস্থাপনা বেশ জনপ্রিয়। এই সব দেশে জনসাধারণকে সম্পূর্ণ এবং বাস্তবসম্মত নেটিভিটি দৃশ্য সৃজনে উৎসাহিত করা হয়। কোনো কোনো পরিবারে যেসকল দ্রব্য বা পুতুল দিয়ে এই দৃশ্য রচিত হয়, সেগুলিকে উত্তরাধিকার সূত্রে মূল্যবান পারিবারিক সম্পত্তি মনে করা হয়। ৫ জানুয়ারির পূর্বসন্ধ্যায় দ্বাদশ রজনীতে খ্রিষ্টমাস সাজসজ্জা খুলে নেওয়া হয়। খ্রিষ্টমাসের প্রথাগত রংগুলি হল পাইন সবুজ (চিরহরিৎ), তুষার ধবল ও হৃদয় রক্তবর্ণ।
                           
অনেক দেশেই বড়দিন বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে উপহার আদানপ্রদানের মরসুম। বড়দিন ও উপহার আদানপ্রদানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত একাধিক খ্রিষ্টীয় ও পৌরাণিক চরিত্রের উদ্ভবের সঙ্গেও বড়দিন উৎসব অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। এঁরা হলেন ফাদার খ্রিষ্টমাস বা সান্টাক্লজ, পেরে নোয়েল, ও ওয়েনাকসম্যান; সেন্ট নিকোলাস বা সিন্টারক্লাস; ক্রাইস্টকাইন্ড; ক্রিস ক্রিঙ্গল; জৌলুপুক্কি; বাব্বো নাতালে; সেন্ট বাসিল; এবং ফাদার ফরেস্ট।

আধুনিককালে এই চরিত্রগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় হল লাল পোশাক পরিহিত পৌরাণিক উপহার প্রদানকারী সান্টাক্লজ। সান্টাক্লজের উৎস একাধিক। সান্টাক্লজ নামটি ডাচ সিন্টারক্লাস নামের অপভ্রংশ; যার সাধারণ অর্থ সেন্ট নিকোলাস। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর নিকোলাস ছিলেন অধুনা তুরস্কের মিরার বিশপ। অন্যান্য সন্তসুলভ অবদানগুলির পাশাপাশি শিশুদের পরিচর্যা, দয়া ও উপহার প্রদানের জন্য তিনি খ্যাতনামা ছিলেন। অনেক দেশে তাঁর সম্মানে ৬ ডিসেম্বর উপহার আদানপ্রদানের মাধ্যমে উৎসব পালিত হয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, বিশপের পোশাক পরিহিত নিকোলাস তাঁর সহকারীদের সহায়তায় বিগত এক বছরে শিশুদের আচরণের খোঁজখবর নিতেন; তারপর স্থির করতেন সেই শিশু উপহার পাওয়ার যোগ্য কিনা। 

খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সেন্ট নিকোলাসের নাম নেদারল্যান্ডে পরিচিতি লাভ করে এবং মধ্য ও দক্ষিণ ইউরোপে তাঁর নামে উপহার আদানপ্রদানের ঐতিহ্য চালু হয়ে যায়। সংস্কার আন্দোলনের সময় অনেক প্রোটেস্টান্ট উপহার প্রদানকারীর চিরাচরিত চরিত্রটি বর্জন করে শিশু খ্রিষ্ট (Christ Child) বা Christkindl (ইংরেজি অপভ্রংশে ক্রিস ক্রিঙ্গল) চরিত্রটির আমদানি করেন এবং উপহার প্রদানের তারিখটি ৬ই ডিসেম্বর থেকে বদলে হয় খ্রিষ্টমাস পূর্বসন্ধ্যা।

যদিও সান্টাক্লজের আধুনিক রূপকল্পটির সৃষ্টি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে। এই রূপান্তরের পশ্চাতে ছয়জন মুখ্য অবদানকারী ছিলেন। এঁদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ওয়াশিংটন আরভিং এবং জার্মান-আমেরিকান কার্টুনিস্ট টমাস ন্যাস্ট (১৮৪০–১৯০২)। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের পর নিউ ইয়র্কের অধিবাসীরা শহরের অ-ইংরেজ অতীতের কিছু প্রতীক ফিরিয়ে আনার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। প্রকৃতপক্ষে নিউ ইয়র্ক শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ডাচ ঔপনিবেশিক শহর নিউ আমস্টারডাম নামে এবং ডাচ সিন্টারক্লাস ঐতিহ্যটি সেন্ট নিকোলাস নামে সেখানে পুনরাবিষ্কৃত হয়েছিল। 

১৮০৯ সালে নিউ ইয়র্ক হিস্টোরিকাল সোসাইটি আনুষ্ঠানিকভাবে ইতিহাস স্মরণ করে Sancte Claus-কে নিউ ইয়র্ক শহরের ডাচ নাম নিউ আমস্টারডামের পৃষ্ঠপোষক সন্ত বা প্যাট্রন সেন্ট ঘোষণা করেন। ১৮১০ সালের প্রথম আমেরিকান উপস্থিতিতে সান্টাক্লজকে বিশপের আলখাল্লায় অঙ্কন করা হয়েছিল। যদিও নতুন শিল্পীরা তাঁর চিত্রাঙ্কনের ভার নিলে, সান্টাক্লজের পোষাকেও ধর্মনিরপেক্ষতার স্পর্শ লাগে। ১৮৬৩ সাল থেকে ন্যাস্ট প্রতি বছর সান্টাক্লজের ছবি আঁকতেন। ১৮৮০-এর দশকে ন্যাস্টের সান্টা তার আধুনিক রূপটি পরিগ্রহ করে। এই রূপটি সম্ভবত ইংরেজ ফাদার খ্রিষ্টমাসের আদলে আঁকা হয়েছিল। ১৯২০-এর দশকে বিজ্ঞাপন নির্মাতাদের সৌজন্যে এই রূপটিই স্থায়িত্ব লাভ করে।

সান্টাক্লজ চরিত্রটির পূর্বসূরি ফাদার খ্রিষ্টমাস হাস্যরসিক, নাদুসনুদুস ও দাড়িওয়ালা ব্যক্তি। তিনি বড়দিনের শুভ চেতনার প্রতীক। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমভাগের ইংল্যান্ডে ফাদার খ্রিষ্টমাসে লিখিত উল্লেখ পাওয়া যায়। অবশ্য সে সময় ছেলেমেয়েদের উপহার প্রদানের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক ছিল না। তিনি সংযুক্ত ছিলেন বড়দিনের আমোদপ্রমোদ ও মাতলামির সঙ্গে। ভিক্টোরিয়ান ব্রিটেনে সান্টার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে তাঁর চরিত্রটি পুনঃসৃজিত হয়। এই পথে ফ্রান্সে গড়ে ওঠে পেরে নোয়েল চরিত্রটিও। ইতালিতে সান্টাক্লজের ভূমিকাটি পালন করে বাব্বো নাতালে; এদেশে উপহার প্রদানকারী চরিত্রটি হলেন লে বাফানা। তিনি এপিফেনির পূর্বসন্ধ্যায় উপহার নিয়ে আসেন। কথিত আছে, লা বেফানা শিশু যিশুর জন্য উপহার আনতে বেরিয়েছিলেন; কিন্তু তিনি পথ হারিয়ে ফেলেন। এখন তিনি সব শিশুর জন্যই উপহার নিয়ে আসেন। কোনো কোনো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুসারে সান্টাক্লজের সঙ্গী হলেন নেচ রুপরেক বা কালো পিটার। অন্যান্য গল্প অনুসারে, এলফেরা উপহার প্রস্তুত করে। সান্টাক্লজের স্ত্রীর নাম দেওয়া হয়েছে মিসেস ক্লজ।
                         
সেন্ট নিকোলাসের সান্টায় রূপান্তরিত হওয়ার আমেরিকান কাহিনিটির কিছু বিরোধিতাও ধ্বনিত হতে শোনা যায়। দাবি করা হয় সেন্ট নিকোলাস সোসাইটি ১৮৩৫ সালের পূর্বে স্থাপিত হয়নি; যা আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্তত পঞ্চাশ বছর পরের ঘটনা। সর্বোপরি, চার্লস জোনস কৃত নিউ আমস্টারডামের "শিশুসাহিত্য পুস্তক, সাময়িকপত্র ও পত্রিকা"র গবেষণায় সেন্ট নিকোলাস বা সিন্টারক্লাসের কোনো উল্লেখ নেই। যদিও ১৯৭৮ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত জোনসের গবেষণার প্রতি সকল বিশেষজ্ঞ আস্থা রাখেন না। নিউ ব্রানসউইক থিওলজিক্যাল সেমিনারির হাওয়ার্ড জি. হেজম্যান হাডসন ভ্যালির আদি বসতির সিন্টারক্লাস সংস্কৃতির আদলে নিউ ইয়র্কের সিন্টারক্লাস সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যটিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।

ভেনেজুয়েলা ও কলম্বিয়ার মতো কিছু লাতিন আমেরিকান দেশের সাম্প্রতিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুসারে, সান্টা খেলনা প্রস্তুত করে যিশুকে তা দেন; যিশুই বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছেলেমেয়েদের সেই খেলনা উপহার দিয়ে যান। এই বিশ্বাস ঐতিহ্যগত ধর্মীয় বিশ্বাস ও আমেরিকা থেকে আমদানিকৃত সান্টা সংস্কৃতির এক মেলবন্ধনের প্রয়াস।

অল্টো আদিগে/সাদতিরোল (ইতালি), অস্ট্রিয়া, চেক রিপাবলিক, দক্ষিণ জার্মানি, হাঙ্গেরি, লেচেনস্টেইন, স্লোভাকিয়া ও সুইজারল্যান্ডে ক্রাইস্টকাইন্ড (চেক ভাষায় Ježíšek, হাঙ্গেরিয়ান ভাষায় Jézuska, স্লোভাক ভাষায় Ježiško) উপহার প্রদান করেন। জার্মান সেন্ট নিকোলাউস ও ওয়েনাকসম্যান চরিত্রদুটি এক নয়। ওয়েনাকসম্যান আধুনিক সান্টার জার্মান সংস্করণ। সেন্ট নিকোলাউস নেচ রুপরেকের সহযোগিতায় ৬ ডিসেম্বর ক্যান্ডি, নাটবাদাম ও ফলের মতো ছোটো ছোটো উপহার নিয়ে আসেন। সারা বিশ্বেই পিতামাতারা তাদের সন্তানদের সান্টাক্লজ ও অন্যান্য উপহার প্রদানকারীদের সম্পর্কে শিক্ষা দিলেও, কেউ কেউ এগুলি কুসংস্কার বলে প্রত্যাখ্যানও করেন ।।
                        
তথ্যসূত্র :----

১- The historical figure of Jesus, E. P. Sanders, Penguin Books (১৯৯৬)।

২- The Historical Jesus: A Guide for the Perplexed, Helen Bond, T&T Clark (২০১২)।

৩- Christmas: A Candid History, Bruce Forbes, University of California Press (২০০৭)।

৪- The Origins of Christmas, Joseph F. Kelly, Liturgical Press (২০০৩)।

৫- উইকিপিডিয়া।

৬- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪শে ডিসেম্বর ২০১৫ সাল।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

1 Comments