জ্বলদর্চি

আফগানিস্থানের লোকগল্প /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—আফগানিস্থান

চিন্ময় দাশ

দুই পড়শীর সীমানা ভাগ

 
নামে পাখি হলেও, ঠিকঠাক বলতে গেলে, তিতির কিন্তু ভূচর প্রাণী। তেমন ওড়াউড়ি করে না। চেহারায় ছোট, তাই পা দুটো আরও ছোট। তাতেই লাফিয়ে লাফিয়ে খাবার খুঁজে বেড়ায়।
খাবার বলতে বুনো ঘাসের বীজ, গম বা অন্য যেকোন শস্যদানা, ছোটখাটো ফল, কুচোকাচা পোকামাকড়—এইসব। উঁচু ঘাসের ছাউনি, পুকুর-ডোবা বা কোন জলা জায়গার ধারে ছোট ঝোপ, খেতখামারের আলের আড়াল ইত্যাদিতে ঘুরে বেড়ায়। খুঁটে খুঁটে খাবার খায়।   
যেমন শান্ত, তেমনি ভীতু। সামান্য একটু সাড়াশব্দ পেলে, বিপদ আঁচ করে লুকিয়ে পড়ে। কারও সাতে-পাঁচে থাকা তিতিরের স্বভাব নয়। 
এরকম একজনের সাথে বিবাদ শুরু করেছে কাঠবেড়ালি। তিতিরকে চোখে পড়লেই, অমনি লেজটি নাচিয়ে, দৌড়ে সামনে এসে হাজির হয়ে যাবে—আরে, তুমি এখানে কেন? কতবার না বলেছি, এটা আমার এলাকা। খবরদার ঢুকবে না আমার এলাকায়। কথা মনে থাকে না বুঝি? 
নিত্যদিন একই ব্যাপার। যেখানেই খাবার খুঁজতে যায়, খুঁজে খুঁজে সেখানেই হাজির হয়ে যায় কাঠবেড়ালি। দিনের পর দিন এই বিবাদ নিয়ে নাজেহাল অবস্থা তিতিরের।

তিতির বলল-- কাল গমখেতের আলে ছিলাম। তুমি গিয়ে বললে, এটা আমার এলাকা। পরশু ডোবার ধারে পৌঁছে বলেছিলে, এটা আমার এলাকা। 
--বলে ছিলামই তো।
তিতির বলল—আজ তাই এই ফাঁকা মাঠে চলে এসেছি। আবার তুমি এসে হাজির হয়েছ। 
কাঠবেড়ালি হেসে বলল—শুধু এসেছি নয়। আজও বলছি—এটা আমার এলাকা। কথা বাড়িও না। চুপচাপ কেটে পড়ো এখান থেকে। আমি কথা পাল্টাই না। বিবাদও চাই না। 
লম্বা একটা লেজ আছে কাঠবেড়ালির। তারই এক ঝাপ্টা লাগিয়ে দিল পাখিটাকে। 
কী আর করে? মাঠ ছেড়ে, একটা গাছের তলায় উঠে গেল তিতির। বসে বসে কাঁদতে লাগল।
একটা চিতল হরিণ যাচ্ছিল মাঠের দিকে। তিতিরকে কাঁদতে দেখে, দাঁড়িয়ে পড়ল—হোলটা কী? কাঁদছ কেন? 
সব কথা খুলে বলল তিতির। শেষে বলল—আজ আবার যাবার সময় লেজের বাড়িও মেরে গেল আমাকে। 
হরিণ বলল—ঠিক আছে বাছা, কেঁদো না। আমি কথা বলছি কাঠবেড়ালির সাথে। 
ঘাসের মাঠে না গিয়ে, কাঠবেড়ালির বাড়ি গিয়ে হাজির হোল হরিণ। কাজটা যে ঠিক করছে না সে, এটা বলতেই, কাঠবেড়ালি বলে বসল—বিবাদটা আমাদের। তুমি নাক গলাতে এসছ কেন, বাপু? 
হরিণ অবাক হয়ে বলল—য়্যাঁ! কী বললে? 
--য়্যাঁ নয়, হ্যাঁ। পায়ে জোর আছে তোমার, তার দোড়েই বেঁচে আছো। যেদিন পিছন থেকে দেব সেই পায়ে এক কামড়, বুঝবে সেদিন। ভালো চাও, তো মানে মানে কেটে পড়ো। নিজের কাজে যাও।
হরিণ সেই যে কেটে পড়ল, আর তিতিরের মুখোমুখি হয়নি।

হরিণ নিশ্চয় একটা কিছু ব্যবস্থা করবে—এই আশা নিয়ে বসে আছে তিতির। তখন একটা ঘাসফড়িং যাচ্ছিল মাঠের দিকে। সে দেখে বলল—কীগো, মন খারাপ কেন? কী হয়েছে? 
ফড়িংকেও সব কথা খুলে বলল তিতির।  ফড়িং হেসে বলল--  হরিণ? দুনিয়ার ভুলো জীব। দ্যাখো গিয়ে, ঘাসের মাঠ দেখে, সব দায়িত্ব উড়ে গেছে তার মাথা থেকে।
--কী আর করব ভাই। সব আমার কপাল। তিতিরকে থামিয়ে, ফড়িং বলল—কপালকে দোষ দেওয়াটা কোনও কাজের কথা হোল? কিছু ঘটলে, তার সমাধান করতে হয়।  বেশ গম্ভীর হয়ে, ফড়িং বলল—ঠিক আছো। ওর চালবাজি বের করে দিয়ে আসছি আমি। তুমি আর একটুখানি বোস এখানে। চলে যেও না কোথাও যেন। আমি যাবো আর আসবো। লম্বা লম্বা পায়ে লাফিয়ে চলে গেল ঘাসফড়িং।
--এটা তোমার কেমন ব্যবহার? লোককে খাবার খুঁটে খেতে দিচ্ছ না। কারণটা কী, শুনি তো। আয়েস করে বসেছিল কাঠবেড়ালি। পৌঁছেই চোটপাট শুরু করে দিয়েছে ফড়িং। শুনে যাচ্ছে, কিন্তু মুখে রা কাড়ছে না কাঠবেড়ালি। 

ফড়িং বলল—আমার মুখে তাকিয়ে দেখছোটা কী? জবাবটা দাও।
কোন হেলদোল নাই কাঠবেড়ালির। শান্ত গলায় বলল—শুধু দেখছি না রে, খুঁজছি। 
--কী খুঁজছো। জবাব?
--জবাব নয়। তোর নাক খুঁজছি।
ফড়িংয়েরমাথায় কিছু ঢুকল না কথাটার। বলল—আমার নাক খুঁজছো? মানে কী একথার?
--মানে হোল, এই তো সিঙ্গিপানা চেহারা। ল্যাকপেকে সরু কতকগুলো ঠ্যাং। লাফাতে পারিস ভালোই।এদিকে আবার ডানাও আছে।
-- তাতে হোলটা কী? তোমারইবা কী তাতে?
কাঠবেড়ালির গলা তখনও শান্ত—না, আমি আসলে তোর নাকটা কোথায় খুঁজে পাচ্ছি না। 
এবার ফড়িংয়ের অবাক হও্যার পালা। বলল—আমার নাক দিয়ে তোমার কী হবে?
কাঠবেড়ালি বলল—আরে না, না। আমার কিছু হবে না। আসলে, বলা নাই কওয়া নাই, হঠাত এসে পরের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছিস কি না, তাই নাকটা কত বড়ো, একটু দেখার সাধ হয়েছে আমার।
কাঠবেড়ালি যে বেমালুক বিরক্ত, বুঝতে অসুবিধা হোল না। ফড়িং তোতলাতে লাগল—না, মানে…
অমনি কাঠবেড়ালির এক জোর ধমক—মানে মানে কেটে পড়, হতভাগা। ছোট, ছোটর মত থাকবি। আর যাই কর, বড়দের ব্যাপারে নাক গলাতে আসবি না। এই লেজটা দেখেছিস আমার? আলতো করে একটি ঝাপট মারব। একেবারে অক্কা পেয়ে যাবি। ভাগ এখান থেকে। 
ছ’-ছ’খানা পা ঘাসফড়িংয়ের। পেছনের তাগড়াই পা দুটোতে চাপ দিয়ে, এমন লম্বা একখানা লাফ দিল, কোথায় যে উধাও হয়ে গেল টিকিটিও দেখা গেল না আর।

কতক্ষণ বাদে একটা খরগোশ যাচ্ছে সেই পথে। সেও বেশ শান্ত-শিষ্ট জীব। আর ভয়ানক ভীতু। আর, ভীতু বলেই কারও সাতে-পাঁচে থাকে না তেমন।
কিন্তু তিতিরকে বসে বসে কাঁদতে দেখে, সে দাঁড়িয়ে পড়ে সব কথা শুনল। বলল—ঠিক আছে, আমি একবার যাই। কিছু করা যায় কি না। 
খরগোশকে পাত্তাই দিল না কাঠবেড়ালি।গম্ভীর হয়ে বলল—ভালোয় ভালোয় কেটে পড়ো এখান থেকে। নাক গলাতে এসো না। নইলে, আমাকে জানো ত? কোথায় কোন গর্তে থাকো, সব হদিশ দিয়ে দেব গাঁয়ের কুকুরদের। ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে একেবারে। 
দুরুদুরু বুকে সরে পড়ল খরগোশ। পরোপকার মাথায় উঠল। নিজের প্রাণ বাঁচাতে সরে পড়ল সেখান থেকে। 
তিতির অপেক্ষা করে করে হতাশ হয়ে পড়েছে। কেউ যে আর ফিরবে না, বেশ বুঝতে পারা গেছে। বসে থেকে কাজ নাই আর। গাছতলা ছেড়ে উঠে পড়ল তিতির। 
তখনই একটা সামনে একটা ইঁদুরের আবির্ভাব। একেবারে মাটি ফুঁড়ে উঠে এল যেন।  সত্যিই মাটি ফুঁড়ে উঠে এসেছে ইঁদুরটা। তিতির যেখানে বসেছিল, সেই গাছের তলাতেই তার বাসা। 
গর্ত থেকে বেরিয়েই তিতিরকে দখতে পেল সে। -- কীগো, এরই মধ্যে দানা খুঁটবার কাজ শেষ? গাছতলায় বসে আছো যে!
--আর বলো কেন ভাই। বড় বিপাকে পড়েছি আমি। বলে এক এক করে আবার সব কথা বলে গেল তিতির। মন দিয়ে সব শুনল ইঁদুর।

বেশ তাগড়াই চেহারা ইঁদুরটার। লম্বা লম্বা এক জোড়া গোঁফ। লেজখানাও কম লম্বা নয়। শুনছে, আর মাথা নাড়ছে বিজ্ঞের মত। 
শেষে বলল— বসে বসে চখের জল ফেললে, না খেয়ে শুকিয়েই মরতে হবে তোমাকে। চলো আমার সাথে। কত ধানে কত চাল—আজই বুঝিয়ে দেব ব্যাটাকে।   
ইঁদুরকে সাথে নিয়ে তিতিরকে আসতে দেখে, একটু ভড়কেই গেল কাঠবেড়ালি। নিজে গাছে চড়তে পারে, সেজন্য অন্য জীবদের তেমন পরোয়া করে না সে। কিন্তু ধেড়েইঁদুরকে একটু সমঝেই চলে চিরকাল। যেমন চেহারা, তেমনি ধারালো দাঁত। থাকেও ব্যাটারা দল বেঁধে। পুরো একটা বাহিনী থাকে একটা গর্তের ভিতর। গাছে চড়াতেও বেশ ওস্তাদ ওরা।
ইঁদুর সামনে এসে সরাসরি বলল—মোড়লগিরি শুরু করেছে কবে থেকে?
কাঠবেড়ালির বুঝতে অসুবিধা হোল না, সব শোনা হয়ে গেছে ইঁদুরের। কাজটা যে গা-জোয়ারি হচ্ছিল, সেটা তো অস্বীকার করা যায় না। সে তোতলাতে লাগল। 
দেখে বেশ মজা হোল ইঁদুরের। কড়া গলায় বলল—অন্যের মুখের খাবার কেড়ে খাস তুই। তোর মতো নচ্ছারের সাথে কথা বলতে ইচ্ছা নাই আমার। শোন, কার কোন এলাকা ভাগ করে দিয়ে যাচ্ছি। সেটাই মেনে চলবি আজ থেকে।  
 

গাছগাছালি বা লতাপাতা সেগুলোতেই থাকবি তুই। নীচে আসবি না। নীচের কোন খাবার তোর নয়। নীচে নামতে পারবি কেবল এ গাছ থেকে ও গাছ করবার সময়। অন্য কোন কারণে নয়। নীচে মাটিতে থাকবে তিতির। তার কোন ব্যাপারে তোকে যেন নাক গলাতে না দেখি কোন দিন।

কাঠবেড়ালির মুখে কথাটি নাই। বেমালুম চুপ করে আছে। --সীমানা ভাগ করে দিয়ে গেলাম দুজনের।  আজ এই প্রথম বললাম। আজই কিন্তু শেষ। ইঁদুর বলল—আমাকে চিনিস তো? গোটা পাড়া ডেকে নিয়ে আসব। গাছে চড়তে আমরাও ওস্তাদ, সেটাও জানিস নিশ্চয়? ঘিরে ধরব তোকে। সারাদিন লেজ নাচিয়ে তিতিরের পিছনে লাগা, জন্মের মত ঘুচিয়ে দেব। 
এই প্রথম কেউ ধমক দিচ্ছে কাঠবেড়ালিকে। বেদম ঘাবড়ে গিয়ে, একদম চুপ হয়ে আছে বেচারা। মুখে একটিও কথা নাই। ভিতরে ভিতরে দুরদুরই করছে বুকটা।

কাঠবেড়ালি যে ভয় পেয়েছে, ইঁদুরের বুঝতে বাকি নাই। সে কড়া গলায় বলল—বাহারি একখানা লেজ নিয়ে সারাদিন বড়াই করে বেড়াস তুই। এর পরে যেদিনই তিতিরের সাথে বদমায়েসি করতে যাবি, সেদিনই টুক করে কেটে নেব তোর সাধের লেজটি। তখন বুঝবি কেমন মজা হয়। লেজ তো থাকবেই না। লজ্জায় মুখও দেখাতে পারবি না কারও কাছে। কথাটা মাথায় রাখবি। 
সেদিন থেকে এলাকা নিয়ে আর কোন বিবাদ নাই দুজনের। গাছে গাছেই থাকে কাঠবেড়ালি। নীচে বড় একটা নামেই না। 
আর, তিতির? বেশ শান্তিতেই আছে নিরীহ জীবটি। দানা জুটুক না জুটুক, এখন আর কোন বিবাদ নাই তার জীবনে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

0 Comments