জ্বলদর্চি

Zen Z Poetry ManifestoManifesto-3/Arun Das

Zen Z Poetry ManifestoManifesto-3/Arun Das
জেন জেড কবিতার ম্যানিফেস্টো / অরুণ দাস

পর্ব-৩ (শেষাংশ)


একুশ.

প্রকৃতির সমস্ত কার্যকলাপ ও সম্পাদিত হচ্ছে প্রকৃতির গুণের প্রভাবে। উচ্চতর চেতনায় বস্তু অন্তর্নিহিত গুণ শক্তিকে অনুভব করতে পারলেও তা সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে না। কারণ এক্ষেত্রে কবি জড়বস্তু ও চেতনাকে ভিন্নভাবে দেখেন। কবি জড়বস্তুর নিজস্ব গুণকে প্রাধান্য না দিয়ে তাকে নিজস্ব ভাবনায় পরিচালিত করেন।

পরমচেতনায় চিৎশক্তি ও জড়শক্তির কোনো পার্থক্য নেই। এক্ষেত্রে কবির কাছে জড় শরীর ও চিৎশরীর উভয়ই সমান। জড় ও জীব সর্বদাই চিন্ময় এবং উভয়েই নিজস্ব গুণ-এ সম্পূর্ণ। তাই জড় ও জীবের মধ্যেকার অন্তর্নিহিত গুণ ও নিজস্বতাকে অনুভব করাই কবির কাজ। নিজস্ব সত্তাকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং অন্তর্নিহিত গুণ ও সত্তার উন্মোচনই কবির কাজ।


বাইশ.

সত্যকে দেখার, উপলব্ধি করার তিনটি ভঙ্গি বা দৃষ্টি। অধিভূত, অধিদৈবত ও অধ্যায়।

অধিভূত: সবকিছুর বাহ্যিক বা প্রাকৃতিকভাবে দেখাই অধিভূত দৃষ্টি।

অধিদৈবত: এই যে যা কিছু, সমস্তই সেই পরম পুরুষ। এইভাবে দেখা অধিদৈবত দৃষ্টি। 

অধ্যাত্ম : বাইরের যা কিছু সমস্তই স্ব-ভাবে বা আত্মাতে লীন হয়। এই দৃষ্টি অধ্যায়।

অধিভূত দৃষ্টি প্রাকৃত। প্রকৃতি থেকে নেওয়া বাহ্যিক জ্ঞানের উপর এর বিস্তার। আর অধিদৈবত ও অধ্যাত্ম দৃষ্টি অতিপ্রাকৃত। এই দুটিতে অধ্যাত্ম চেতনার দুই মেরু ধরা যায়। একটি চেনায় বিশ্বের অতীতকে আর অন্যটি অন্তরের অতলকে। 

উচ্চতর চেতনায় কবিদের দৃষ্টি অধিদৈবত অথচ সৃষ্টিশীলতায় তাঁরা আশ্রয় নেন অধিভূত দৃষ্টির। কবি তাঁর উপলব্ধিকে বাস্তবরূপ দিতে গিয়ে অসম্পূর্ণ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে নেন। ফলে জড় প্রত্যক্ষের সঙ্গে মিশে যায় তাঁর ভাবনা।

এর ফলে নিজের অজান্তে নিজের চারপাশে সীমা তৈরী করেন কবি।

বস্তু-বিশ্বের মধ্যেকার পরম অন্তর্লীন সৌন্দর্যময় পরমাত্মাকে প্রত্যক্ষ করা, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করা একমাত্র পরমচেতনায় সম্ভব। এতে বস্তু-বিশ্বের প্রকৃত স্বরূপ কবির কাছে ধরা দেয়। তাঁর সৃষ্টি হয় সার্বজনীন ও সর্বকালীন। আর এটিই যেন অধ্যাত্ম উপলব্ধির শেষ কথা।


তেইশ .

উচ্চতর চেতনার সন্ধানী কবিরা সত্যের পথে অভিযাত্রী। জড় জগতের অন্ধকারকে ভেঙে চলেছেন বুদ্ধিদীপ্ততায়। সত্যের প্রকৃতরূপ এরা প্রজ্ঞাচক্ষু দিয়ে প্রত্যক্ষ করেন। উপলব্ধির আকুতি তাঁদের যেন বাঁধনহারা করে দেয়। এখানে কবির আকুতি উপলব্ধির। পরম চেতনায় কবির আকুতি প্রকাশের। উপলব্ধির পরমন্তরের সত্য কবির হৃদয় ও মনন জুড়ে। তার সার্থক প্রকাশই যেন তাঁর মুক্তি।

 উচ্চতর চেতনায় কবির আত্মচেতনার প্রকৃত বিকাশ ঘটে। কবি জড়ত্বের বাধাকে ভেঙে বৃহৎ হতে চান। 'ব্রহ্ম' বা বৃহৎ - এর ভাবনা ধরা পড়ে কবির আকুতিতে। এই আকুতির লক্ষ্য যেন চেতনার সর্বোচ্চ স্তর পরমচেতনাকে ছোঁয়ার আকুতি। 

পরমচেতনার কবিরা বিরাজ করেন পরম জ্যোতির মধ্যে। আকাশের অন্তহীন ব্যাপ্তীর মতো বস্তু-বিশ্বের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সত্যের মধ্যে বিচরণ তাঁর কাছে পরম তৃপ্তি। এই চিন্ময় মহাবৈপুল্যে স্বচ্ছন্দ বিচরণে কোনো বাধা নেই।

তাঁর কাছে সবকিছু যেন এক বৃহৎ চেতনার অংশ। যা বাইরে অন্তরেও। আমাদের মন-হৃদয়-দৃষ্টিতে যা কিছু প্রত্যক্ষ অনুভব করি সবই চেতনার অংশমাত্র।


চব্বিশ.

সাধারণ মানুষ স্থূল ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সবকিছুকে উপভোগ করেন। জ্ঞানীরা জ্ঞানের দ্বারা বস্তু-বিশ্বের ধারণাকে ব্যাখ্যা করেন যোগীরা আত্ম উপলব্ধির দ্বারা প্রাপ্ত সূক্ষ্ম মনের দ্বারা জগৎকে উপলব্ধি করেন।

এই সব উপলব্ধির মধ্যে জগৎ-এর পৃথক পৃথক দৃষ্টিকোণে আংশিক পর্যবেক্ষণ ঘটে।

পরমচেতনায় জগতের সম্পূর্ণ পর্যবেক্ষণ সম্ভব৷ পরমচেতনার মতে জগতের জড় বা জীবের নিত্য, শাশ্বত। একই স্রষ্টার দ্বারা সৃষ্টি উপাদান মাত্র। তাদের নিজস্ব নিজস্ব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতি আছে। ফলে এক্ষেত্রে কোন বিশেষ দৃষ্টিকোণে বস্তু বা জীবকে অনুভব না করে সার্বিক বা পরম দৃষ্টিকোণের সাপেক্ষে বিচার করা হয়। ফলে বস্তু বা জীবের উপলব্ধির বৈচিত্র্যময় পথ ব্যক্তির সামনে খুলে যায়।


পঁচিশ.


পরিশেষে বলা প্রয়োজন পরমচেতনাকে উপলব্ধি করতে গেলে কয়েকটি পরমসত্যকে মেনে নেওয়া প্রয়োজন :-

 এক. প্রকৃত বিবর্তনের অর্থ বাহ্যিক উন্নতি নয়, চেতনার উন্নতি।

 দুই.  জীব উৎকৃষ্ট শক্তি। জড় নিকৃষ্ট শক্তি। কিন্তু উভয়েই নিজস্ব স্বাধীন গুণ আছে।
 
 তিন. ক্ষুদ্র বা বৃহৎ সব প্রাকৃতিক বস্তুই একই রকম মৌলিক উপাদান দিয়ে তৈরী। সংক্ষেপে বলা যায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু বা জীবের শরীরও একটি ব্রহ্মাণ্ড |

 চার. সমস্ত জড় ও জীবের গুণ ও বুদ্ধিমত্তা আপেক্ষিক।

 পাঁচ. জ্ঞান কেউ সৃষ্টি করে না। তা বাইরে থেকে অর্জন করতে হয় না। মানুষের মধ্যেই জ্ঞান সুপ্ত অবস্থায় থাকে। তাকে জাগ্রত করা, আবিষ্কার করা, ভেতর থেকে বাইরে নিয়ে আসাই আমাদের কাজ।

 ছয়. এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুকে পরম চেতনার মধ্য দিয়ে দর্শন করতে পারলে, তার প্রকৃত শক্তি ও স্বরূপ বা অন্তর্লীন বাস্তব আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে।
 
সাত. পরমচেতনা ব্যক্তির মধ্যে একটি পূর্ণতার সঞ্চার ঘটায়। যার সাহায্যে ব্যক্তি বস্তু বা জীবের মধ্যেকার শক্তি, আবেগ, অনুভূতি, ভাবনা
প্রভৃতিকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পারেন।


ছাব্বিশ .


 আট. পরমচেতনায় বস্তু বা জীবের ধারণা ও স্বরূপ স্পষ্ট। এখানে স্মৃতি, জ্ঞান বা বিস্মৃতির কোন অর্থ নেই।

 নয়. উচ্চতর চেতনায় ব্যক্তি ব্রহ্মকে উপলব্ধি করতে পারেন। পরমচেতনায় তাঁর ব্রহ্মত্ব প্রাপ্তি ঘটে। ব্রহ্মের সঙ্গে সংযোগ ঘটে। এর ফলে ব্যক্তি জড় পদার্থের অন্তর্নিহিত নিত্য, শাশ্বত, জ্ঞানময় ও আনন্দময় সত্তাকে উপলব্ধি করতে পারেন।

 দশ . পরমচেতনায় কবির উপলব্ধি ইন্দ্রিয়াতীত। তিনি পরমাত্মার নিত্য, শাশ্বত ও চিন্ময়রূপের মধ্য দিয়ে বিশ্বের প্রতিটি উপাদানের স্বরূপকে উপলব্ধি করেন। ফলে জীব ও জড়ের প্রকৃত সূক্ষ্মরূপ তার কাছে খুব সহজেই ধরা দেয়। 

পরমচেতনায় কবির ইন্দ্রিয়গুলির শক্তি সীমিত নয়। ফলে জড়ের মধ্যেকার শক্তিকে তারা খুব সহজেই যথার্থভাবে ও সচেতনভাবে ছুঁতে পারেন।

 তার কাছে জড় শক্তি ও চিৎ-শক্তি উভয়ই সমান। ফলে পরমচেতনায় কবি জড় পদার্থের অন্তর্নিহিত চেতনাকে সম্পূর্ণরূপে অনুভব করতে পারেন।

 এগারো. মাটি, জল, আগুন, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি ও অহংকার - এগুলি জগতের উপাদান। আকাশের উদ্ভব মন থেকে। মনের উদ্ভব বুদ্ধি থেকে, বুদ্ধির উদ্ভব অহংকার থেকে। আর অহংকারের উদ্ভব আত্মা থেকে। পরমচেতনার এই পরমসত্যটি আমাদের কাছে প্রকাশিত হয়। ফলে এই উপাদানগুলির স্থূলশক্তি গৌন হয়ে পড়ে, অন্তর্নীহিত শক্তির প্রকৃত স্বরূপ ব্যক্তির পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।

সাতাশ .

 বারো. আত্মজ্ঞান লাভ, আত্মউপলব্ধিই মানুষ যোগীতে পরিণত করে। কিন্তু চিন্ময় জগতে চেতনার চর্চা ও উত্তরণেই মানুষ জীবনের পরম সার্থকতা। চেতনার সর্বোচ্চ চর্চা ও আবিষ্কারই পরম চেতনা। এখানে মানুষের জীবনের পূর্ণতা, মানুষ এখানে যোগী থেকে মহাযোগী হয়ে ওঠেন।

 তেরো.  সাধারণ মানুষ জ্ঞানী বা যোগীরা মায়া ও মোহ-র দ্বারা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে আচ্ছন্ন থাকেন। তাই বস্তু ও জীবের প্রকৃত স্বরূপ এদের চোখে সম্পূর্ণভাবে ধরা পড়ে না। পরমচেতনায় ব্যক্তি মায়া ও মোহের উর্দ্ধে। তাই বস্তু ও জীবের প্রকৃত স্বরূপ এদের কাছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্য।

 চোদ্দ . বিভিন্ন বস্তুর স্বরূপের মধ্যে কোনো ভেদ নেই। এগুলি আমাদের মন-মস্তিষ্ক ও স্মৃতির মধ্যে রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আমরা বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে কেবল তার বাহ্যিক সত্তাকে অনুভব করি। বাকি সবকিছু আমাদের মন-মস্তিষ্ক ও স্মৃতির গভীরে বিদ্যমান।

 পনেরো . অনুভূতিই কোন কিছুর অস্তিত্বের প্রকৃত প্রমাণ। আমাদের প্রত্যেক অনুভূতির স্বরূপ হচ্ছে চেতনা। আর প্রতিটি অনুভূতির সূক্ষাতিসূক্ষ্ম অন্তর্নিহিত সত্যের স্বরূপই পরমচেতনা।

 ষোলো.কবিতা কবির অনুভূতি ও প্রেমের সাধনা। কবিতা জড় ও জীবের কর্মের রহস্যময়তা উন্মোচন। কবিতা হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতি (আবেগ - চেতন-উচ্চতরচেতন-অবচেতন ও অচেতন)-র মাধ্যমে পরমচেতনার অন্বেষণ।


আটাশ.

আমরা আমাদের বাইরের জগতের সত্যকে সহজেই প্রত্যক্ষ করতে পারি। তেমনি আর এক সত্য আছে। যা চরম সত্য। আমাদের জীবনের জীবন, আত্মার আত্মা, পরচেতনার সত্য। পরমাত্মার সত্য।

এই দুই সত্য বিচ্ছিন্ন নয় বরং নিবিড়ভাবে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত। আমরা সাধারণত সত্যের অনুসন্ধান বাইরের জগৎ থেকে শুরু করি। কিন্তু সত্যের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করলে, পরমচেতনার অন্তর্লীন জগতের চরম সত্যের পরমপ্রাপ্তি ঘটে।

কবি যখন অনুভব করেন, তিনি দেহের মধ্যে সীমাবদ্ধ নন, বরং জড় জাগতিক জগতের অন্য উপাদানের মতোই - তখন পরম সত্যের পথ তাঁর সামনে খুলে যায়। অর্থাৎ দেহাত্মবোধ থেকে মুক্তিই পরম সত্যের পরম প্রাপ্তির পথ। এই পরমপ্রাপ্তিই মহান সত্যের প্রাপ্তি, বিশ্বসত্তার প্রাপ্তি।

অথবা অন্যভাবে বলা যায় বিশ্বসত্তার সঙ্গে একাত্ম হওয়া। আর এটিই পরমচেতনার সত্য, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

পরমচেতনা, অনন্তচেতনা ও অনন্ত শক্তির আধার। আমাদের বাহ্যিক চেতনা, অবচেতনা, অচেতনা কিংবা উচ্চতরচেতনা তার এক একটি অংশ। এই চেতনা থেকে তৈরি হয় জড়জগৎ ও চিৎজগৎ। আমাদের চারপাশের জড় জগতে কত অদ্ভুত-বৈচিত্র্যময় বস্তু-জীবন-বিষয় আছে তা আমরা জানি। কিন্তু পরমচেতনার মধ্যেও যে সৌন্দর্যময়, মনোমুগ্ধময়, উজ্জ্বল জগৎ আছে তা সাধারণের অধরা। এই জগৎ কল্পনাতীত, অচিন্ত্য ও সুন্দরতম অনাদী, অনন্ত সৃষ্টির জগৎ। এই জগৎ সৌন্দর্যময় প্রকৃত সত্যের জগৎ। তাই এটি 'পরম'। তাই এর চেতনা পরম চেতনা।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

0 Comments