জ্বলদর্চি

সনাতন হিন্দুধর্মে – ওঙ্কার/প্রসূন কাঞ্জিলাল

সনাতন হিন্দুধর্মে – ওঙ্কার

প্রসূন কাঞ্জিলাল

"ধর্ম" শব্দটি সংস্কৃত 'ধৃ' ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হয়েছে, যার অর্থ 'ধারণ করা'--- একথা আমরা সবাই জানি। ধর্ম কী ধারণ করে। হিন্দুধর্ম বলেছেন: “যেনাত্মনস্তথান্যেষাং জীবনং বর্ধনাঞ্চাপি ধৃয়তে স ধর্মঃ।" অর্থাৎ যার দ্বারা নিজের এবং অপরের জীবন ও সমৃদ্ধি বিধৃত হয়, তা-ই ধর্ম। এই সূত্র ধরে সহজেই বলা যায় – ধর্ম একটি সর্ব্বজনীন ব্যাপার। এটি এমন একটি বিষয় যা সকলের কল্যাণসাধন করে।

এখন দেখা যাক, ধর্মের লক্ষণ কী। মহর্ষি মনুর মতে:- ধৃতি (ধারণ বা ধৈর্য্য), ক্ষমা, দম (দমন), অস্তেয় (অচৌর্য), শৌচ (শুচিতা), ইন্দ্রিয়নিগ্রহ, ধী (বুদ্ধি), বিদ্যা, সত্য ও অক্রৌধ --- এই দশটি হল ধর্মের সাক্ষাৎ লক্ষণ (মনু-সংহিতা, ৬/৯২)। অর্থাৎ যেকোন ব্যক্তির পক্ষে সদ্যোক্ত দশটি আচরণই ধর্মাচরণ বলে গণ্য হবে এবং এই দশটি আচরণই ধার্মিক লোকের (তিনি যেকোন ধর্ম বা ধর্মমতেই বিশ্বাসী হোন না কেন) লক্ষণ।

হিন্দুধর্মের যথার্থ নাম "সনাতন ধর্ম"। 'সনাতন' শব্দের অর্থ-যা অনাদিকাল থেকে চলে আসছে চৈতন্যের আলোয়। আমরা তাই অনুমান করতেই পারি, সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অর্থাৎ যখন থেকে মানুষ তার দ্বিপদ পশুত্বকে অতিক্রম করে চৈতনোর আলোকে নিজেকে আবিষ্কার করতে শুরু করল, তখন থেকেই যে আচরণগুলিকে মনুষ্যত্বের লক্ষণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল, সেগুলি মনু-কথিত ধর্মেরই দশটি লক্ষণ। সনাতন ধর্ম বলতে আমরা সেই ধর্মকেই বুঝব যা মনু কথিত ধর্মের দশটি লক্ষণকেই আচরণে প্রকাশ করতে বলে। এই ধর্মের মূল আশ্রয় "'বেদ'। সংস্কৃত 'বিদ্' ধাতু থেকে এর উৎপত্তি এবং 'বেদ' শব্দের অর্থ 'জ্ঞান'। বেদকে "অপৌরুষেয়"' এবং 'শ্রুতি' বলা হয়। 'অপৌরুষেয় এই জন্য যে, এই জ্ঞান কোন ব্যক্তি বা পুরুষবিশেষের বুদ্ধির ক্রিয়া দ্বারা অর্জিত এবং প্রচারিত নয়: জ্ঞাত ও অজ্ঞাত বহু ঋষির হৃদয়ের অনুভব বা উপলব্ধিরূপে সেই জ্ঞান উদ্ভাসিত ও প্রকাশিত হয়েছিল। 'শ্রুতি' এইজন্য যে, যখন লিপির আবিষ্কার হয়নি, সেইকালে উপলব্ধ জ্ঞান মুখের ভাষায় পিতা থেকে পুত্রে, গুরু থেকে শিষ্যে পরম্পরাক্রমে প্রবাহিত হতো।

আমাদের দেশে বহুরকম দার্শনিক মতবাদ আছে – অদ্বৈত, দ্বৈত, দ্বৈতাদ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত ইত্যাদি। আছে বহু সম্প্রদায় – শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব ইত্যাদি। ভারতীয়দের কাছে 'ওঙ্কার' একটি অতি প্রচলিত শব্দ। দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় দর্শন ও ধর্মবিজ্ঞানে এই শব্দটি ক্রিয়াশীল। 'উ' ধ্বনি বা অক্ষর (সংস্কৃত ভাষায় 'ওম') প্রণব, ব্রাহ্ম বা ঈশ্বরবাচক চিহ্ন। ওঁ বা ওঁ-কার (অপর বানানে ওঙ্কার) (সংস্কৃত, অ + উ + ম] বা প্রণব বা ত্র্যক্ষর হিন্দুধর্মের পবিত্রতম ও সর্বজনীন প্রতীক। এটি হিন্দু দর্শনের সর্বোচ্চ ঈশ্বর ব্রহ্মের বাচক। এই ধর্মের প্রতিটি সম্প্রদায় ও উপসম্প্রদায়ের নিকটেই এটি পবিত্র বলে গণ্য। স্বামী বিবেকানন্দের মতে, ওঁ-কার "সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক, ঈশ্বরের-ও প্রতীক।" ওঁ-কার বৌদ্ধ ও জৈনদেরও একটি পবিত্র প্রতীক। শিখ সম্প্রদায়ও এটিকে সম্মান করেন।

ওঁ (ওম)-অর্থ (অব্যয়) প্রণব, সকল মন্ত্রের আদ্যবীজ। ‘অব্যয়' মূলত বিশেষণ যার অর্থ অক্ষয়, অবিনাশী বা অপরিবর্তনীয়, কোথাও বা ব্রহ্ম। ব্যাকরণে অবায় হল সেই সমস্ত শব্দ যার কোন রূপান্তর হয় না। জেনে বা না জেনে অনেকেই এই বিশেষ অক্ষরটি উচ্চারণ করে থাকেন। ভারতীয় জনজীবনে ওঙ্কারের প্রভাব ও গুরুত্ব আমরা কমবেশি জানি।

ওঁ=অ+উ+ম= ওম, ওং বা ওঁ। মন্ত্রের এবং ব্যাক্যের আদিতে 'ওঁ' বলতে হয়। ঋষ্যাদির আদিতে বলতে হয় না। সংস্কৃতে 'মণ্ত্র' শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো--- মননাৎ ত্রায়তে ইতি মণ্ত্রঃ'। অর্থাৎ 'মন্ত্র মানে যা মনন করে মানুষ জন্ম-মৃত্যুর পরম্পরা, সংসার-সমুদ্র, মায়া বা অবিদ্যা থেকে মুক্তি পায়। প্রাচীনকালে মন্ত্র বলতে বৈদিক সুক্তকে বোঝাত। মণ্ত্র আর ব্রাহ্মণ নিয়েই সমগ্র বেদ । মন্ত্রব্রাহ্মণোর্বেদনামধেয়ম্' --- বেদ শব্দের অর্থ মণ্ত্র এবং ব্রাক্ষ্মণসমূহ। বিভিন্নরকম যজ্ঞ সম্পর্কে ঋষিদের উক্তি হলো মণ্ত্র। বেদের যে অংশে মণ্ত্রাদির ব্যাখ্যা এবং তাদের প্রয়োগের কথা বলা আছে তাকে বলে 'ব্রাহ্মণ'। সহজ কথায় মণ্ত্র হলো আধ্যাত্মিক অথবা অলৌকিক সংকেতসূত্র, যা বারংবার আবৃত্তির দ্বারা অজ্ঞানের বন্ধন, জন্ম-মৃত্যুর পরম্পরা থেকে মুক্তিলাভ করা যায়।

 মণ্ত্রের পূর্বে 'ওঁ' উচ্চারণ করলে উচ্চারণাদিগত দোষ নষ্ট হয়ে থাকে। যথা---

'যন্ন্যৃনঞ্চাতিরিক্তঞ্চ যচ্ছিদ্রং যদযজ্ঞিয়ম্।
যদমেধ্যমশুদ্ধঞ্চ যাতযামঞ্চ যদ্ভবেৎ।
তদোঙ্কারপ্রযুক্তেন সর্ব্বাঞ্চাবিকলং ভবেৎ'।।
                 ---যোগী যাজ্ঞবল্ক।


স্বরবর্ণের আদিতে 'ওম' বলাই উচিত। যথা – 'ওম আ কৃষ্ণেন রজসা, ওমিত্যেকাক্ষরং ব্রহ্ম'। 'ওমভ্যাদানে' (বৈদিক ব্যাকরণ) মন্ত্রের আদিতে ওং এর ওকার প্লুত অর্থাৎ ত্রিমাত্র করে উচ্চারণ করতে হয়। যথা – ও উ ম্। হ্রস্বম্বর উচ্চারণের সময় এক মাত্রা (হাঁটুতে ১ বার হাত বোলাতে যত সময় লাগে), দীর্ঘস্বর উচ্চারণের সময় দুই মাত্রা এবং প্লুতস্বর উচ্চারণের সময় তিন মাত্রা।

ওঁ শব্দটি সংস্কৃত 'অব' ধাতু থেকে উৎপন্ন, বা একাধারে ১৯টি ভিন্ন ভিন্ন অর্থে প্রযোজ্য। এই ব্যুৎপত্তি অনুযায়ী ওঁ-কার এমন এক শক্তি যা সর্বজ্ঞ, সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের শাসনকর্তা, অমঙ্গল থেকে রক্ষাকর্তা, ভক্তবাঞ্ছাপূর্ণকারী, অজ্ঞাননাশক ও জ্ঞানপ্রদাতা। ওঁ-কারকে ত্র্যহ্মরও বলা হয়, কারণ ওঁ তিনটি মাত্রাযুক্ত – অ-কার', 'উ-কার' ও “ম-কার'। 'অ-কার" "আপ্তি' বা 'আদিমত্ব' অর্থাৎ প্রারম্ভের প্রতীক। 'উ-কার 'উৎকর্ষ' বা 'অভেদত্ব'-এর প্রতীক। 'ম-কার' 'মিতি' বা 'অপীতি' অর্থাৎ লয়ের প্রতীক। অন্য ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এটি সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় সংঘটনকারী ঈশ্বরের প্রতীক। 'অব্' ধাতুর উত্তর মন্' প্রত্যয় যোগ করলে 'ওম্' শব্দটি পাওয়া যায়। 'অব্' ধাতু রক্ষণার্থক, ওম্ শব্দের অর্থটি তাই দাঁড়ায় 'যিনি রক্ষা করেন'। কোনও মতে অ+উ+ম=ওম্। 'অ' অর্থে ব্রহ্মা, 'উ' অর্থে বিষ্ণু এবং 'ম' অর্থে রুদ্র বা শিব। অন্য মতে– 'অ'-বিষ্ণু, 'উ’-শিব এবং 'ম'-ব্রহ্মা। আবার অ, উ, ম যথাক্রমে ত্রিবেদ ঋক্, যজুঃ ও সাম এবং পৃথিবীর তিন অবস্থা জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি। মূলতঃ 'অ'-এর অর্থ উৎপন্ন হওয়া, 'উ'এর অর্থ বিকাশ এবং 'ম'-এর অর্থ মৌন হওয়া বা ব্রক্ষ্মলীন হওয়া। ওঁ সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি এবং সমগ্র সৃষ্টির দ্যোতক।

ঋষিরা বলেছেন, ব্রহ্মের স্বরূপ হলো "সত্যং জ্ঞানম্ অনন্তম্।" (তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ২।১।৩) আর আত্মার স্বরূপ হলো "নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত।" (গীতা:শাঙ্করভাষ্য, উপক্রমণিকা)

চারটি বেদে ব্রহ্মের স্বরূপ চারভাবে সন্ধান করা হয়েছে। অণ্বেষণের এই মূল সূত্রগুলিতে 'মহাবাক্য' ধরতে হবে। যেমন---
“প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম" (ঋগ্বেদঃ ঐতরেয় উপনিষদ্, ৩।১।৩); "অহং ব্রহ্মাস্মি" (যজুর্বেদ : বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ১।৪।১০),"তত্ত্বমসি (সামবেদ: ছান্দোগ্য উপনিষদ্, ৬।৮।৭) এবং "অয়মাত্মা ব্রহ্ম" (অর্থবঃ বেদ মাণ্ডুকা উপনিষদ্ ২) এই চারটি মহাকাব্য। এই মহাকাব্য চারটির প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, জীব ও ব্রহ্মের সম্বন্দ্ধ নির্ণয়।

ব্রহ্মের স্বরূপ অন্যভাবে বলা হয় – সচ্চিদানন্দ' - সৎ, চিৎ ও আনন্দ। 'সৎ' শব্দের অর্থ- যা আছে, নিত্য, অর্থাৎ তিনকালেই আছে অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এককথায় অনাদি, অনন্ত। ব্রহ্মই একমাত্র নিত্য বস্তু। 'চিৎ' শব্দের অর্থ চৈতন্য, যা উদ্ভিদ, কীট-পতঙ্গ, ইতর প্রাণী এবং মানুষের মধ্যে প্রাণস্বরূপ প্রকাশিত। বিশ্বচরাচরের সর্বপ্রাণীতে, সর্ববস্তুতে তিনিই বিভু, চৈতন্যরূপে অনুসৃত হয়ে আছেন। 'আনন্দ’ একটি বিশিষ্ট স্পন্দন বা অনুভূতি, যা সমস্ত সৃষ্টির মূল। তিনি রসস্বরূপ, আনন্দস্বরূপ। বেদ বলছেন তিনি নিরাকার, নির্গুন এবং নিষ্ক্রিয়। শাস্ত্র বলছেন – নিষ্ক্রিয় ব্রহ্মের ইচ্ছাই প্রথম স্পন্দন। এই স্পন্দনই ওঁ-কার। জগৎগুরু শঙ্করাচার্য তাঁর 'পঞ্চীকরণ'-এ বেদান্তের আলোয় ওঙ্কারের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে 'অ'-কারের অর্থ হল জাগ্রত অবস্থা ও স্থূল শরীরে অভিমানী চৈতন্য বা বিশ্ব, 'উ'-কারের অর্থ স্বপ্নাবস্থা ও সুর শরীরে অভিমানী চৈতন্য বা তৈজস, ‘ম’-কারের অর্থ সুষুপ্তি অবস্থা ও কারণ, শরীরে অভিমানী চৈতন্য বা প্রাজ্ঞ। বেদাস্ত মতে ওঙ্কার হিরণ্যগর্ভ ঈশ্বরকেই বোঝায়।

ওঁ-কার ঈশ্বরের সকল নামের প্রতিনিধিস্বরূপ ও তাঁর শ্রেষ্ঠ নাম। বেদ, উপনিষদ, গীতা ও অন্যান্য হিন্দুশাস্ত্রে সর্বত্রই ওঁ-কারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। অথর্ববেদের গোপথব্রাহ্মণের একটি কাহিনি অনুসারে দেবরাজ ইন্দ্র ওঁ-কারের সহায়তায় দৈত্যদের পরাস্ত করেন। এই কাহিনির অন্তর্নিহিত অর্থ, ওঁ-কারের বারংবার উচ্চারণে মানুষ তার পাশব প্রবৃত্তি জয় করতে সমর্থ হয়। কঠোপনিষদ মতে, ওঁ-কার পরমব্রহ্ম। মুণ্ডক উপনিষদে ওঁ-কার অবলম্বনে ঈশ্বরোপাসনার কথা বলা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন, তিনি সকল অক্ষরের মধ্যে ওঁ-কার। মৃত্যুকালে ওঁ-কারের উচ্চারণে পরম সত্য লাভ হয়। পতঞ্জলির যোগসূত্র-এ ওঁ-কারকে ঈশ্বরের প্রতীক বলে বর্ণিত হয়েছে এবং বলা হয়েছে ওঁ-কারের স্মরণ ও উচ্চারণে সমাধি লাভ করা যায়।

সৃষ্টির মূলেও এই ওঁ-কার বা অনাহত নাদ। 'নাদ' কথাটির অর্থ শব্দ। বস্তুজগতে শব্দের সৃষ্টি হয় বাতাসের সঙ্গে কোন বস্তুর সংঘাতের ফলে। ওঁ-কার সেইরকম কোন শব্দ নয়। কারণ, ওঁ-কার সৃষ্টির আগে তো বায়ুর অস্তিত্বহ নেই। মূল স্পন্দন ওঁ-কারই বিকারপ্রাপ্ত হতে হতে দৃশ্যমান বিশ্ব চরাচরের সমস্ত কিছুর মূল উপাদান সূক্ষ্ম পঞ্চভূতে (ব্যোম, মরুৎ, তেজ, অপ্, ও ক্ষিতি) সূক্ষ্মরূপে পরিণত হলো। তারপর এই সূক্ষ্ম পঞ্চভূতের বিশেষ সংমিশ্রণ প্রক্রিয়া, যাকে 'পঞ্চীকরণ' বলে, তার দ্বারা স্থূল পঞ্চভুতের (আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল ও মাটি) সৃষ্টি হল। এরপর মানুষের পাঁচটি জানেন্দ্রিয়ের (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা এবং ত্বক) দ্বারা আস্বাদযোগ্য যা কিছু তার সৃষ্টি হলো। একেই আমরা 'জগৎ' বলি।

আত্মা সর্বব্যাপক সত্ত্বা যিনি জীবের মধ্যে প্রাণরূপে প্রকাশিত। মানুষের এই যে দেহ, মানুষে মানুষে দেহের এই ভেদ, বেদান্তের ভাষায় তাকে বলা হয়েছে নাম ও রূপের ভেদ। অর্থাৎ ব্রহ্ম বা আত্মার প্রকাশ লক্ষণ, ‘অস্তি-ভাতি-প্রিয়” (বাক্যসুধা, শ্লোক-২০)। 'অস্তি' অর্থে যিনি নিত্য আছেন, 'ভাতি' অর্থে যিনি স্বয়ংপ্রকাশ, যাঁর প্রকাশে এই জগৎ প্রকাশ পাচ্ছে এবং 'প্রিয়' অর্থে জগতের যা কিছু আমাদের ভাল লাগছে, যার থেকে আমরা আনন্দ পাচ্ছি তার মধ্যে ব্রহ্মের আনন্দময় সত্ত্বারই প্রকাশ ঘটছে। বেদ বলছেন "একং সৎ বিপ্রা বহুধা বদন্তি" (ঋগ্বেদ, ১/১৬৪/৪৬) - এক ব্রহ্ম বা আত্মাই কেবল আছেন, কিন্তু পন্ডিতেরা তাঁকেই বহু বলেন। এক অখণ্ড আত্মাই নাম-রূপের দ্বারা নিজেকে খণ্ডিত করেছেন - বিভাজিত হয়ে আনন্দ আস্বাদন করবেন বলে। এরই নাম লীলা। আমরা তাঁর লীলার অঙ্গ।

পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে এটা নিশ্চয়ই বোঝা গেল যে, সনাতন ধর্মের মূল কথা-জাগতে দুই নেই; এক ব্রহ্মই-জড় এবং চেতন দুই-ই হয়েছেন। তাই শাস্ত্র তাঁকে বলেছেন:"একমেবাদ্বিতীয়ম্” (ছান্দোগ্য উপনিষদ, (৬/২/১) - তিনি এক এবং দ্বিতীয়-রহিত। এর চেয়ে মহৎ ধারণা আজ পর্যন্ত মানুষের চিন্তারাজ্যে পাওয়া যায়নি। এর নাম অদ্বৈতবাদ, এই বেদান্তের সিদ্ধান্ত। শ্রীমদভগবৎগীতার অষ্টম অধ্যায়ে আছে --

"অক্ষরং ব্রহ্ম পরমং স্বভাবোহধ্যাত্মমুচ্যতে।
ভূতভাবদ্ভবকরো বিসর্গঃ কর্মসংজ্ঞিতঃ ।।
অধিভূতং ক্ষরো ভাবঃ পুরুষশ্চাধিদৈবতম্।
অধিযজ্ঞোহমেবাত্র দেহে দেহভৃতাং বর।।"

অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন- পরম অক্ষর হল 'ব্রহ্ম'। নিজ স্বরূপ অর্থাৎ জীবাত্মাকে বলা হয় 'অধ্যাত্ম' এবং ভূতগণের ভাবের উৎপত্তিকারী যে ত্যাগ তাকে বলা হয় 'কর্ম'। উৎপত্তি ও বিনাশশীল সমস্ত বস্তুই অধিভূত; হিরণ্যগর্ভ পুরুষই অধিদৈব এবং হে নরশ্রেষ্ঠ অর্জুন। এই দেহে আমিই (বাসুদেব অন্তর্যামীরূপে) অধিযজ্ঞ। 

আবার---
“ওমিত্যেকাক্ষরং ব্রহ্ম ব্যাহরন্ মামনুস্মরণ।
যঃ প্রয়াতি ত্যজন্ দেহং য যাতি পরমাং গতিম্।
অনন্যাচেতা: সততং যো মাং স্মরতি নিত্যশঃ।
তস্যাহং সুলভঃ পার্থ নিত্যযুক্তস্য যোগিনঃ।।”

অর্থাৎ, যিনি 'ওঁ' এই একাক্ষর ব্রহ্ম উচ্চারণ করতে করতে এবং তার অর্থস্বরূপ নির্গুণ ব্রহ্মরূপ আমাকে স্মরণ করতে করতে দেহত্যাগ করেন তিনি পরমগতি প্রাপ্ত হন। হে অর্জুন! যিনি অনন্য চিত্তে আমাকে নিরন্তর স্মরণ করেন, সেই নিত্য-নিরন্তর স্মরণশীল যোগীর নিকট আমি সহজলভ্য। 

আবার ----
“ওঁ তৎসদিতি নির্দেশো ব্ৰহ্মণাস্ত্রিবিধঃ স্মৃতঃ।
ব্রাহ্মণাস্তেন বেদাশ্চ যজ্ঞাশ্চ বিহিতাঃ পুরা।।
তস্মাদোমিত্যুদাহৃতা যজ্ঞদানতপঃক্রিয়াঃ।
প্রবর্তন্তে বিধানোক্তাঃ সততং ব্রহ্মবাদিনাম্।।"

ওঁ তৎ সৎ- এই তিনটি শব্দের দ্বারা সচ্চিদানন্দঘন ব্রহ্মের ত্রিবিধ নাম বলা হয়েছে। এই ত্রিবিধ নির্দেশ দ্বারা সৃষ্টির প্রারম্ভে যজ্ঞের কর্তা ব্রাহ্মণ, যজ্ঞের কারণ বেদ এবং যজ্ঞ রূপ ক্রিয়া নির্মিত হয়েছে। সেইহেতু বেদবাতিগণ শাস্ত্রবিধান অনুযায়ী যজ্ঞ-দান-তপস্যাদি কর্ম সর্বদা 'ওঁ' এই ব্রহ্মবাচক শব্দ প্রথম উচ্চারণ করে আরম্ভ করেন।
তদিত্যনভিসন্ধায় ফলং যজ্ঞতপঃক্রিয়াঃ।
দানক্রিয়াশ্চ বিবিধাঃ ক্রিয়ন্তে মোক্ষকাঙ্ক্ষিভিঃ ।।
সদ্ভাবে সাধুভাবে চ সদিত্যেতৎ প্রযুজ্যতে। 
প্রশস্তে কর্মণি তথা সচ্ছদঃ
পার্থ যুজ্যতে।।"

অর্থাৎ, 'তৎ'- এই ব্রহ্মবাচক দ্বিতীয় শব্দ উচ্চারণপূর্বক মুমুক্ষু ব্যক্তিগণ ফলাকাঙ্ক্ষা না করে নানাবিধ যজ্ঞ-তপস্যা এবং দানাদি কর্মের অনুষ্ঠান করেন। হে পার্থ। সদ্ভাব ও সাধুভাব বোঝাতে 'সৎ' এই তৃতীয় ব্রহ্মবাচক শব্দ প্রয়োগ করা হয় এবং শুভ কর্মেও 'সৎ' শব্দ ব্যবহৃত হয়। 

আবার -
“যজ্ঞে তপসি দানে চ স্থিতিঃ সদিতি চোচ্যতে।
কৰ্ম চৈব তদৰ্থীয়ং সদিত্যেবাভিধীয়তে।
অশ্রদ্ধয়া হতং দত্তং তপস্তপ্তং কৃতঞ্চ যৎ।
অসদিত্যুচ্যতে পার্থ ন চ তৎ প্ৰেত্য নো ইহ।।"
অর্থাৎ যজ্ঞ, দান ও তপস্যাতে যে-স্থিতি, তাকেও 'সৎ' বলা হয় এবং ভগবৎপ্রীতির নির্মিত যে কর্ম অনুষ্ঠিত হয়, তাকেও 'সং' নামে অভিহিত করা হয়। হে-অর্জুন! হোন, দান, তপস্যা বা অন্য কোনো শুভ কর্ম অশ্রদ্ধাপূর্বক করলে তাকে অসৎ' বলা হয়, সেইজন্য ইহলোকে বা পরলোকে কোথাও তা ফলপ্রসূ হয় না।
"ধনুগৃহীত্বৌপনিষদং মহাস্ত্রং শরং হ্যপাসানিশিতং সন্ধয়ীত,
আয়ম্য তদ্ভাবগতেন চেতসা লক্ষ্যং তদেবাক্ষরং সোম্যবৃদ্ধি।।” (মুণ্ডক উপনিষদ: ২/২/৩) 
অর্থাৎ, হে সাম্য, উপনিষদে কথিত প্রণবরূপ মহাস্ত্র ধনুতে উপাসনার দ্বারা তীক্ষ্ণীকৃত শর যোজনা করে লক্ষ্যকে বিদ্ধ কর। ভাবনার দ্বারা শুদ্ধ হয়েছে যে চিত্ত তার দ্বারা শর নিক্ষেপ করার আগে ধনুর জ্যা কে আকর্ষণ করতে হয় (আয়ম্য)। এখানে লক্ষ্য হচ্ছেন অক্ষর পুরুষ অর্থাৎ ব্রহ্ম, ধনু হচ্ছে ওঁ-কার। যদিও ভারতবর্ষীয় দর্শনে নানা মত ও পথের কথা আছে। কিন্তু ঈশ্বরবাদী কোনও মতই ওঙ্কারকে অস্বীকার করতে পারেনি। অদ্বৈতদর্শণে নির্গুণ উপাসনার কথা বলা আছে। এই উপাসনায় স্থূলকে সূক্ষ্মে, সূক্ষ্মকে কারণে এবং কারণকে চৈতন্যবিশেষে লয় করতে হয়। ওঙ্কারেরর মাধ্যমে আমরা সেই শুদ্ধতম চৈতন্যে পৌঁছাতে চাই।।

গ্রন্থঋণঃ----
১। চলন্তিকা – রাজশেখর বসু।
২। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (অক্ষরব্রহ্মযোগ)।
৩। বাঙ্গালা ভাষার অভিধান, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস সংকলিত ও সম্পাদিত, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা। 
৪। শ্রী শ্যামাচরণ কবিরত্ববিদ্যাবারিধি রচিত 'ডবদেরপদ্ধতি। (রাজেন্দ্র লাইব্রেরী)
৫। শতাব্দীজয়ন্তী নির্বাচিত সঙ্কলন, উদ্বোধন/ ১০০, (উদ্বোধন কার্যালয়, কলিকাতা)
৬। ক্রিয়াকান্ড বারিধি (১, ২, ৩) - বসুমতী সাহিত্য মন্দির।
 ৭। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, তৈত্তিরীয় উপনিষদ্, মাণ্ডুক্য উপনিষদ, কঠোপনিষদ, মুণ্ডক উপনিষদ (নির্বাচিত অংশ)
৮। পঞ্চীকরণ - শঙ্করাচার্য বিরচিত।
৯ | Hindu Symbols, Swami Harshananda, Ramkrishna Math, Bangalore 2000

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

3 Comments