সম্পাদকীয়,
শীতকাল এলেই যেমন বনভোজন বা পিকনিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সবাই, ঠিক তেমনই শীতকাল মানেই মেলা, প্রদর্শনী আর লোকউৎসব। বইমেলা তো হয়ই দিকে দিকে তাছাড়া নাট্যমেলা, ফুড ফেস্টভ্যাল, হস্তশিল্পমেলা, কৃষিমেলা.... হ্যাঁ, সব জায়গার মতো ফুলকুসুমপুরেও কৃষিমেলা হচ্ছে। যাবে নাকি তোমরা? তাহলে চলো রতনতনু জেঠুর কাছ থেকে জেনে নিই কিভাবে যাব সেখানে। আর ভূমিকা আন্টি বলল পাপানদের ওখানে লাট্টুর প্রদর্শনী হয়। আমি তো বাবা বাসবদত্তা আন্টির মতো সুবর্ণরেখা নদীর ধারে বেড়াতে যাবই যাব। যদি একটা স্বর্ণরেণু পেয়ে যাই। সত্যি হঠাৎ করে কেউ যদি কিছু দেয়, কি মজাই না হয়, বলো? যেমন বড়দিনে সৃজিতার মতো যদি স্যান্টা আমাকেও গিফট দেয় তাহলে আমি তো আনন্দে কি যে করব জানি না। তনুজা আন্টির নেত্য পিসির মতো শিশি বোতল ছুঁড়ে ভেঙেও দিতে পারি। না বাবা তোমরা আবার কিছু ছোঁড়াছুড়ি কোর না। তোমরা বরঞ্চ শীতে মাঠে গিয়ে খেলো। তবেই সবাই বলবে 'টাইগার' । টাইগার কোন খেলোয়ারকে বলা হতো? না জানলে জেনে নাও অর্ঘ্য আঙ্কেলের লেখা পড়ে। জানার কি আর শেষ আছে? পীযূষ আঙ্কেল প্রতিবারের মতো আমাদের বলেছেন এক বিখ্যাত মানুষের জীবনী। পড়ে নাও ও জেনে নাও। জানার এখানেই শেষ নয়। আমাদের সবচেয়ে বড়ো শিক্ষক প্রকৃতি। দেখছো সোহম দাদা কেমন সুন্দর প্রকৃতির ছবি উপহার দিয়েছে। তারসঙ্গে বড়োদিনের আগেই ছোটোবেলার ডালি ভরা ছোটোদের আঁকা উপহার দিলাম তোমাদের। খুশি তো? তাহলে লিখে জানাও কেমন লাগছে ছোটোবেলা। --- মৌসুমী ঘোষ।
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস
ফুলকুসুমপুর খুব কাছে (পর্ব ২৭)
রতনতনু ঘাটী
পরদিন সকালে বিপদভঞ্জনস্যার পড়াতে এলেন। ইচ্ছেদাদু অপেক্ষা করছিলেন স্যারের জন্যে। চায়ে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে ইজিচেয়ার থেকে উঠে দাদু বললেন, ‘বিপদভঞ্জন, এদিকে এসো তো ভাই! একটা জরুরি কথা আছে।’
‘বলো কী কথা?’ এগিয়ে এলেন স্যার, ‘কাল তোমাদের কেমন কাটল গান্ধী আশ্রমে?’
দাদু বললেন, ‘দারুণ কেটেছে। সকলকে দারুণ খাইয়েছে অনন্ত। এখন সে কথা থাক। জরুরি কথাটা বলি, আমাদের ফুলকুসুমপুরে এবার কৃষিমেলা বসছে শুনেছ তো?’
বিপদভঞ্জনস্যার বললেন, ‘হ্যাঁ, কাল পঞ্চায়েত অফিসে গিয়েছিলাম। এ খবরটা শুনে এলাম। তো কী করতে হবে বলো?’
‘আমি আমাদের হযবরল চিড়িয়াখানা নিয়ে মেলায় একটা স্টল দেব বলে ভেবেছি। উদ্দেশ্য, সাধারণ মানুষের মধ্যে পাখি আর পশুদের ভালবাসার বার্তা পৌঁছে দেওয়া। পাখি আর পশুদের বন্দি করে না রেখেও তাদের ভালবাসা যায়। তারা মানুষের সঙ্গেই থাকে। সবই তো প্রকৃতির দান!’
বিপদভঞ্জনস্যার বললেন, ‘মন্দ নয় তোমার পরিকল্পনা। বলো আমাকে কী কাজ করতে হবে?’
‘আমি তোমার কাছে সব রকমেরই সাহায্য চাই। আর তো বেশিদিন বাকি নেই মেলার। কুড়ি দিন পরে মেলা শুরু হবে। এর মধ্যে আমাদের স্টলের কথা প্রচার করতে হবে চারদিকে। দশ-বিশটা গ্রামের মানুষ যেন দল বেঁধে দেখতে আসে আমাদের স্টল, তাদের মধ্যে সেই আগ্রহ তৈরি করতে হবে। কী করে করবে, সে পরিকল্পনা তোমার।’
‘আচ্ছা, ভাবছি। এখন তো তোমার নাতি-নাতনিদের পড়াতে যাই। তারপর প্ল্যান করতে হবে।’ এ কথা বলে বিপদভঞ্জনস্যার পড়ার ঘরে চলে এলেন। ছোটরা কান খাড়া করে শুনছিল ইচ্ছেদাদুর সঙ্গে স্যারের কথা। তারাও মনে-মনে খুব উদ্দীপিত। এসে স্যার বললেন, ‘শুনেছ তো, তোমাদের বাড়ির হযবরল চিড়িয়াখানা এবার যাবে ফুলকুসুমপুর কৃষিমেলার মাঠে। তোমাদের দাদু ইচ্ছেকুমার আমাকে গ্রামে-গ্রামে সেই স্টলের খবর প্রচারের দায়িত্ব দিয়েছেন। আমরা সকলে মিলে আমাদের এই স্টল নিয়ে পোস্টার লিখব। পোস্টারের ভাষাটা আমার, হাতের লেখাটা হবে তোমাদের। মনে করো, এরকম পঞ্চাশটা পোস্টার লিখতে হবে। লেখা হয়ে গেলে তারপর আমরা যাব ফুলকুসুমপুরের চারপাশের দশখানা গ্রামে। ঘুরে-ঘুরে দশখানা গ্রামের গাছে-গাছে দড়ি দিয়ে বেঁধে দেব আমাদের পোস্টারগুলো। এক-একটা গ্রামের ভাগে পড়বে পাঁচটা করে পোস্টার। মনে রাখতে হবে, হাতে কিন্তু বেশিদিন সময় নেই।’
বুম্বা ব্যাপারটায় খুব উৎসাহ পেয়ে গেছে। সে বলল, ‘স্যার, কবে থেকে পোস্টার লেখা শুরু হবে?’
‘আমি আজ বাড়ি ফিরে গিয়ে আগে পোস্টারের লেখা নিয়ে ভাবব। তারপর লিখে ফেলব। কাল পড়াতে আসার সময় নিয়ে আসব লেখাগুলো। কাল পড়াশুনো হয়ে গেলে আমরা সকলে মিলে পোস্টার লিখব রংবেরঙের কালি দিয়ে।’
বুম্বা দু’ হাত উপরে তুলে বলল, ‘স্যার, এবার আমার জন্মদিনে যাঁরা নিমন্ত্রিত ছিলেন, বাবা সকলকে বলে দিয়েছিলেন, টি-শার্ট, ভিডিও গেম, চকোলেট বা খেলনা, এসব বার্থডে গিফট কেউ যেন না আনেন। তাই এবার জন্মদিনে আমি শুধু ছবি আঁকার খাতা, বই আর রংপেনসিলই পেয়েছি। ক’টা রংপেনসিলের বাক্স তো খোলাই হয়নি প্যাকেট থেকে। আমি কাল বইয়ের তাক থেকে রংপেনসিলগুলো নিয়ে আসব স্যার?’
স্যার বললেন, ‘তা আনবি বই কী! পোস্টার লেখার লিডার করে বিলাম তোকে। কেননা, তোর হাতের লেখা বেশ ভালো।’
তক্ষুনি শুধুকাকার পোষা খরগোশ কুমি সিঁড়ি দিয়ে পুটুর পুটুর করে উঠে এল ওদের পড়ার ঘরে। ওকে দেখতে পেয়ে স্যার নকল রাগের গলায় বললেন, ‘কুমি, এটা পড়ার ঘর। এখানে তুমি এলে কেন? টিচারের পারমিশন না নিয়ে পড়ার ঘরে আসা যায় না, তুমি জানো না? আমি যদি তোমাকে এখন একটা কঠিন অঙ্ক করতে দিই, কী করবে?’
কুমি থমকে চুপটি করে বসে পড়ল মেঝেয়। চোখ পিটপিট করে গোঁফ নেড়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। স্যার বুম্বাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘জানিস তো, খরগোশের একটা মজার খবর পড়লাম সেদিন একটা পুরনো খবরের কাগজে।’
বুম্বা জিজ্ঞেস করল, ‘কী মজার খবর স্যার? বলুন না!’
বিপদভঞ্জনস্যার চোখ থেকে চশমাটা খুলে বুম্বার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘জাপানে একটা দ্বীপ আছে, এখন তার নাম ‘খরগোশের দ্বীপ’! আগে দ্বীপটার নাম ছিল ওকুনোশিমা। একবার একটা স্কুল থেকে সেই দ্বীপে পিকনিকে গিয়েছিল ক্লাস থ্রি স্ট্যান্ডার্ডের ছেলেমেয়েরা। তাদের কারও কারও সঙ্গে ছিল পোষা খরগোশ। তারপর হল কী, হঠাৎ জোয়ারের জল এসে ছাপিয়ে দ্বীপটাকে ভাসিয়ে দিল। ছেলেমেয়েরা দৌড়ে পড়ি কি মরি করে নৌকোয় উঠে পড়ল সকলে। তারপর নৌকো যখন ভেসে চলে এসেছে মাঝনদীতে, ওদের খেয়াল হল, কয়েকটা খরগোশ ভুল করে থেকে গেছে সেই দ্বীপে।’
তিন্নি জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর কী হল স্যার?’
‘কী আবার হবে? খরগোশগুলো পড়ে রইল সেখানে। এখন সে দ্বীপে কয়েক হাজার খরগোশ বাস করছে। আর এখন দ্বীপটার নাম হয়েছে ‘খরগোশ দ্বীপ’!
বুম্বা হাততালি দিয়ে বলে উঠল, ‘বাঃ! সত্যিই খুব মজার তো!’
স্যার বললেন, ‘চলো, তাড়াতাড়ি আজকের পড়া করে নিই। আজ তো রোববার, তোমাদের স্কুল নেই। পড়া শেষ করেই আমরা আজ পোস্টারগুলো লিখতে শুরু করব, কেমন?’
সত্যি-সত্যিই পড়া শেষ হতেই স্যার বললেন, ‘চলো, এবার পোস্টার লিখব। প্রথমে অনিচ্ছে ঠাকুরমার রাধাগোবিন্দকে নিয়ে আমি লিখে এনেছি---‘টিয়াপাখি রাধাগোবিন্দ! আকাশই যার বাড়ি! সে কৃষিমেলার স্টলের চারদিকে ঘুরে-ঘুরে আপনাদের বলবে, ‘কেমন আছেন? ভাল তো!’
পোস্টারটা তিনটে রঙের কালি দিয়ে বুম্বা লিখে ফেলল তক্ষুনি। এমন সময় শুধুকাকা ঢুকে পড়লেন পোস্টার লেখার হুল্লোড়ে। টিয়াপাখির পোস্টারটা দেখে বললেন, ‘এসবই কৃষিমেলায় আমাদের স্টলের জন্যে? বাঃ! খুব সুন্দর হয়েছে! তোরা শুনিসনি তো, মিনিসোটার সেন্ট পলে একটা টিয়াপাখিদের আশ্রম রয়েছে?’
ওরা সকলে ঘাড় নেড়ে বলে উঠল, ‘না। শুনিনি তো!’ বিন্নি অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘টিয়াপাখিদের আশ্রম? কী অবাক কাণ্ড!’
‘আরে শোন না! সেসব হল বনের টিয়াপাখি! তাদের মালিক কেউ নেই। খাবার ছড়িয়ে দিলে তারা উড়ে এসে খাবার খায়। তখন তাদের ছবি আঁকা শেখানো হয়। তারপর তারা উড়ে চলে যায় যেদিকে খুশি! জানিস তো বুম্বা, টিয়াপাখির আঁকা সেসব ছবি কেনারও অনেক লোকও আছে!’ বলে থামলেন শুধুকাকা।
বিপদভঞ্জনস্যার বললেন, ‘বাঃ! এটা দারুণ খবর তো!’ তারপর তিন্নি-বিন্নির দিকে তাকিয়ে স্যার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কেউ রবার্ট লুইস স্টিভেনসননের অ্যাডভেঞ্চার ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’ বইটা পড়েছ কি?’
বিন্নি বইটা প্রাইজ পেয়েছিল ক্লাসে থ্রি থেকে ফার্স্ট হয়ে ফোর-এ ওঠার সময়। ভয়ে-ভয়ে ঘাড় নেড়ে বিন্নি বলল, ‘এখনও আমার পড়া হয়নি বইটা।’
স্যার বললেন, ‘তা হলে শোনো--গল্পটার শুরু---জিম হকিন্স নামে একটা ছেলে থাকত সমুদ্র তীরের এক শহরে। তার মা সেখানে একটা সরাইখানা চালাতেন। জিম মাকে নানা কাজে সাহায্য করত। একদিন সেই সরাইখানায় এসে হাজির হল এক ঝগড়ুটে ক্যাপ্টেন। তারপর লোকটা কয়েকদিন পরে হঠাৎ মারা গেল। তার সিন্দুক ঘেঁটে পাওয়া গেল একটা মানচিত্র। সেই মানচিত্রে আঁকা রয়েছে এক রত্নদ্বীপে পৌঁছনোর সমুদ্রপথ। এর পর জিম, তার আত্মীয় ও আরও লোকজন সেই দ্বীপ খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল। তদের সে এক দুঃসাহসিক অভিযান। এই উপন্যাসে লং জন সিলভারের একটা কথা-বলা টিয়াপাখি ছিল। সে পাখিটার নাম ছিল ‘ক্যাপ্টেন ফ্লিট’।’
এতক্ষণ সকলে পোস্টার লেখা ফেলে অ্যাডভেঞ্চারের গল্প শুনছিল সকলে। বিপদভঞ্জনস্যার খুব সুন্দর করে গল্প বলতে পারেন।
শুধুকাকা বললেন, ‘টিয়াপাখির আরও কত না আজব খবর শোনা যায়। সত্যি-মিথ্যে অত জানি না।’ স্যারের দিকে তাকিয়ে শুধুকাকা বললেন, ‘আমি শুনেছি, বিদেশে নাকি ‘হেটবিক’ নামে একটা গানের ব্যান্ড আছে। তাদের মেন ভোকালিস্ট একটা টিয়াপাখি। সে টিয়াপাখির নাম ‘ওয়ালডো’।
বুম্বা জিজ্ঞেস করল, ‘ভোকালিস্ট মানে কী গো?’
সার বললেন, ‘যে প্রধান কণ্ঠ দেয় গানে। তবে টিয়াপাখি কথা বলতে পারে এ তো কতই শুনেছি। কিন্তু গান গাইতে পারে? কক্ষনো শুনিনি!’ একটু থেমে ফের বললেন স্যার, ‘শকুন্তলার গল্পে পড়েছি অবশ্য। মালিনী নদীর তীরের তপোবনে কত না টিয়াপাখির ঝাঁক উড়ে বেড়াত দল বেঁধে, গান গাইত তারা! সে কালে যদি টিয়াপাখি গান গেয়ে উড়ে বেড়াতে পারে, এ কালে টিয়াপাখিদের কেউ-কেউ গানের তালিম নিয়ে ব্যান্ডের মেন ভোকালিস্ট হবে না-ই বা কেন?’
শুধুকাকা বললেন, ‘আজকাল মিউজিক ট্রেনিংওলা টিয়াপাখিও কিনতে পাওয়া যায় কলকাতার গালিফ স্ট্রিটের পাখিবাজারে রোববারের সকালবেলা। এমনকী, আমার নিজের চোখে দেখা নয় যদিও, তবে শুনেছি, সার্কাসে বাঘ, সিংহ, হাতি, ঘোড়া নিয়ে খেলা দেখানো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সার্কাসে টিয়াপাখির খেলা দেখতে দর্শকদের আগ্রহ বেড়েছে। তাই গালিফস্ট্রিটে সার্কাসে খেলা দেখানোর মতো ট্রেন্ড টিয়াপাখিও নাকি এখন চড়া দামে কিনতে পাওয়া যায়।’
বিপদভঞ্জনস্যার হাসতে-হাসতে বললেন, ‘এখন আমরা কৃষিমেলার স্টল নিয়ে ব্যস্ত। পোস্টার লেখার কাজ চলছে। গল্প শুনতে-শুনতে তিন্নি একটা পোস্টার লিখে ফেলেছে: আমাদের হযবরল চিড়িয়াখানার বিড়াল মিঁউ,/ আপনাদের দেখলে বলবে---কিঁউ! কিঁউ! /ওকে খেতে কিছু দেবেন না তো! /আদর দেবে, ছোটরা যদি বাঁ হাত পাতো!’
শুধুকাকা সব দেখেটেখে বললেন, ‘স্যার, দারুণ জমবে আমাদের স্টলটা, বলুন?’
স্যার বললেন, ‘দর্শকরা আমাদের স্টলের সামনে ভিড় করে এগিয়ে আসবে, এ আমি হলফ করে বলে দিতে পারি!’
ইচ্ছেদাদু পায়ে-পায়ে দেখতে এলেন পোস্টারগুলো। এখন সবে সাতটা পোস্টার লেখা হয়েছে। স্যার বললেন, ‘ইচ্ছেকুমার, আমরা কিন্তু তোমার স্টলটা যাতে দারুণ জমে ওঠে, তার কোনও চেষ্টাই বাকি রাখছি না!’
এমন সময় ঘর ঝাঁট দিতে এসেছিল কুয়াশামাসি। এসব পোস্টার দেখে ছুটতে-ছুটতে গিয়ে তক্ষুনি গোটা ত্রিপাঠীবাড়িতে কথাটা রাষ্ট্র করে দিল। সেই শুনে বিলম্বদাদু ছুটে এল। অনিচ্ছে ঠাকুরমা পুজোর ঘর থেকে দৌড়ে চলে এলেন। রান্নাঘর থেকে হলুদ মাখা হাতে এসে হাজির হলেন মাধুরীজেম্মা। আনাজকাটা ফেলে এলেন করবীকাকি। বকুলকাকি কী কাজে যেন ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর ছুটে আসতে কিঞ্চিৎ দেরি হল। গোটা বাড়ি জুড়ে শুরু হয়ে গেল সে এক মস্ত হইচই কাণ্ড!
বিলম্বদাদু কয়েকটা মাত্র পোস্টার দেখে অবাক হয়ে ছুটল পাড়ায় খবর দিতে---‘আমাদের বাড়িতে কেমন সব রংওলা পোস্টার আঁকা হচ্ছে, তোমরা দেখবে তো এক্ষুনি ছুট্টে চলে এসো!’
যারা মেলায় স্টল দেওয়ার কথা এর আগে শোনেনি, তারা মুখ তুলে জানতে চাইল, ‘বিলম্ব, তোমাদের বাড়ইতে কী হয়েছে গো? কীসের পোস্টার? সে দিয়ে কী হবে?’
সকলকে বিলম্বদাদু একই উত্তর দিতে-দিতে চরকির মতো ঘুরতে লাগল পাড়ায় রাস্তায়-রাস্তায়, ‘ওকথা মুখে বুঝিয়ে বলতে পারব না গো! আমার কি আর অত লেখাপড়া জানা আছে নাকি? তোমরা দেখতে চাইলে নিজে থেকে দেখবে তো এক্ষুনি ত্রিপাঠীবাড়িতে চলে এসো!’
ইচ্ছেদাদু চেয়ার পেতে বারান্দায় আয়েস করে বসেছিলেন। অমন সময় নীচে একতলায় পাড়ার দু’-একজন করে লোক জড়ো হতে দেখে বুঝতে পারলেন, এ নিশ্চয়ই বিলম্বের বিভ্রাট! তক্ষুনি পোস্টার আঁকা থামিয়ে দিতে বললেন স্যারকে। সকলকে বেরিয়ে আসতে বললেন। পড়ার ঘরের দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিতে বললেন অনিচ্ছে ঠাকুরমাকে।
মাথামুন্ডু কিচ্ছু বুঝতে না পেরে ঠাকুরমা দাদুর কাছে জানতে চাইলেন, ‘কী হয়েছে আগে বলবে তো? আমি তো ঠাকুরঘরে ছিলাম! কিছুই জানতে পারিনি?’
‘তুমি দয়া করে পড়ার ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ফের তোমার ঠাকুরঘরে ফিরে যাও! এদিকে মহা প্রলয় ঘটে গেলেও তুমি কিচ্ছু জানতেই পারো না। বারান্দা দিয়ে নীচে তাকিয়ে দ্যাখো, পাড়ার কত লোক জমায়েত হয়েছে!’
‘কেন, বিলম্ব কিছু ঘাট-কাজ করে ফেলেছে নাকি?’ ঠাকুরমার গলায় বিস্ময় ঝরে পড়ল।
‘হ্যাঁ, যা ঘটিয়েছে, সে বিলম্বই ঘটিয়েছে। আমাদের কৃষিমেলার স্টলের খবর পাড়ায় ফাঁস করে দিয়ে সকলকে ডেকেছে, কী হচ্ছে দেখে যাওয়ার জন্যে।’
‘তাতে দোষটা কী করেছে বিলম্ব শুনি? তুমি সবতাতেই বিলম্বের দোষ না দেখে থাকতে পার না, তোমার ওই এক দোষ!’
‘আরে বাবা!। মেলায় হযবরল চিড়িয়াখানার মেম্বারদের নিয়ে গিয়ে স্টল দেওয়া হবে। তখন তা দেখতে আট-দশখানা গ্রামের লোক ভিড় করবে। সেই ভিড়ের কথা টিভিওলাদের কানে পৌঁছলে, তারা ও. বি. ভ্যান নিয়ে দৌড়ে আসবে সে খবর কভার করতে। এমন ঘটনা ভূ-ভারতে দুটো ঘটে কিনা সন্দেহ! কিন্তু এখনই পাড়ার লোক দেখতে এলে পরে মেলায় স্টল দেখার তত ক্রেজ থাকবে না। এই সহজ কথাটা তোমার বিলম্ব বুঝতে পারছে না। তুমি বুঝতে পারছ তো?’
ঠাকুরমা আদ্ধেক বুঝলেন। বাকিটা বুঝতে পারলেন না। মাধুরীজেম্মা ঠাকুরমার হাত ধরে পাশের ঘরে নিয়ে যেতে-যেতে বললেন, ‘চলুন মা, আমি আপনাকে সব বুঝিয়ে বলছি!’
বড়বাবু জগিং থেকে ফিরে বাড়ির নীচে এত হট্টগোল দেখে থমকে গেলেন। নিমেষে সব বুঝতে পেরে দোতলার দরজায় সামনে দাঁড়িয়ে দু’ হাত দিয়ে দরজাটা ঘিরে ধরে বললেন, ‘সকলে এখন বাড়ি ফিরে যান। আমাদের বাড়ি থেকে হযবরল চিড়িয়াখানার পশু-পাখিদের নিয়ে গিয়ে কৃষি মেলায় একটা স্টল দেব। এরা যে আমাদের বাড়িতে কীরকম মিলমিশ করে থাকে, মানুষকে এত ভালবাসছে শিখেছে, সেসব আপনারা নিজের চোখে সেদিন দেখতে পাবেন। সেদিন আপনাদের ভিড় দেখে টিভির লোকও ক্যামেরা নিয়ে কলকাতা থেকে ছুটে আসবেন। এ খবর সন্ধেবেলা টিভিতে দেখাবে! খবরের কাগজের রিপোর্টার এসে খবর লিখে নিয়ে যাবেন। পরদিন খবরের কাগজে ছাপা হবে। এসবে আমাদের ফুলকুসুমপুর গ্রামের কত সুনাম হবে, আপনারাই বলুন?’
সকলে বুঝল কথাটা। ধীরে-ধীরে চলে যেতে লাগল যে-যার বাড়ির দিকে। এমন সময় বিলম্বদাদু ঘেমেনেয়ে হাজির হল। ভেবেছিল তার কাজের জন্যে সে খুব প্রশংসা পাবে ইচ্ছেদাদুর কাছ থেকে। উলটে দাদু তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বিলম্ব, তুমি কৃষিমেলা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত বাড়ির বাইরে যাওয়ার জন্যে এক পা-ও বাড়াবে না। মেলা শুরুর দিন তুমি আমার আর অনিচ্ছের সঙ্গে মেলায় যাবে! কেমন? মনে থাকবে তো?’
ইচ্ছেদাদুর কাছ থেকে বকুনি খেয়ে বিলম্বদাদুর এখন ভিরমি খাওয়ার জোগাড়!
বাইশ গজের এক-চক্ষু বাঘ
অর্ঘ্য দে
ইংল্যান্ডের উইনচেস্টার কলেজের হয়ে নবাবি ভঙ্গিতে খেলছে বছর ষোলোর এক কিশোর। শুধু কী খেলছে!ভেঙে দিচ্ছে বিগত সব ব্যাটিং রেকর্ড। তার ব্যাটিং স্টাইল, ক্যারিশমা তৎকালীন ব্রিটিশ কাগজের রীতিমতো চর্চার বিষয়। সেখানকার কাগজ কিশোরটিকে বলছে 'বিস্ময় বালক'। তার অজেয় ব্যাটিংয়ে ভেঙে গেছে উইনচেস্টারের আরেক কৃতি ডগলাস জার্ডিনের সব রেকর্ড।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই কিশোরের বাবা ইফতিকর আলি খান পাতৌদি দেখে যেতে পারেননি ছেলের এমন চোখ ধাঁধানো সাফল্য। তিনিও ছিলেন প্রতিবান ক্রিকেটার। জীবিতকালে ছেলের কোচ হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন আরেক প্রবাদপ্রতিম ফ্র্যাঙ্ক উইলিকে।
কে সেই 'বিস্ময় বালক' ? যাকে নিয়ে এত আলোচনা? তার নাম মনসুর আলি খান পাতৌদি। বিশ্ব ক্রিকেটে তাকে চিনত 'টাইগার' নামেও। ওনার সতীর্থ ক্রিকেটাররাও ওনাকে এই নামে ডাকতেই বেশি পছন্দ করতেন। 'টাইগার' নামের কারণ ওনার ক্ষিপ্র ফিল্ডিং। তিনি ছিলেন সে যুগের বিশ্ব ক্রিকেটের সেরা ফিল্ডার।
১৯৫৭ সালে সুযোগ পেলেন সাসেক্স ক্লাবের হয়ে কাউন্টি খেলার। তখন তার বয়স মাত্র ষোলো। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হল ক্রিকেটের নবাবের। ১৯৫৯ সালে স্কুল ক্যাপ্টেন হিসেবে খেলে এক মরশুমে ১,০৬৮ রান করেন। রেকর্ড রানের নিরিখে পিছনে ফেলে দিলেন ডগলাস জার্ডিনকে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৩১০টি ম্যাচে ওনার মোট রান ১৫,৪২৫
গড় ৩৩.৬৭ যার মধ্যে আছে ৩৩টি সেঞ্চুরি এবং ৭৫টি হাফ সেঞ্চুরি। সর্বোচ্চ রান ২০৩
এহেন পরাক্ৰমী নবাবের জীবনে ঘটর গেল এক ভয়াবহ পথ দুর্ঘটনা। ১৯৬১ সালের ১লা জুলাই, হোভ শহরের রাস্তায় এক মোটর দুর্ঘটনায় হারালেন ডান চোখ। তবু খেলা ছাড়লেন না। ক্রিকেট যার রক্তে সে কী এত সহজে হার মানে! সেই বছরই ডিসেম্বরে দিল্লিতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে নবাবের টেস্ট অভিষেক ঘটল। দান চোখ খোয়া যাবার পর প্রথম দিকে ডাবল ভিসনের সমস্যায় ভুগতেন। নেটে এক চোখে খেলার কৌশল রপ্ত করলেন। অভিষেক টেস্টে ব্যর্থ হলেও সেই সিরিজে কলকাতার। চতুর্থ টেস্টের প্রথম ইনিংসে করেন ৬৪ রান। এবং চেন্নাইতে পঞ্চম টেস্টের প্রথম ইনিংসে করেন ১০৩ রান।
সেই সময়ে ক্রিকেটে বোলারদের দাপট ছিল সাংঘাতিক। ফাস্ট বোলিংয়ের ক্ষিপ্র গতি আর বিষাক্ত বাউন্সার থেকে মাথা গা বাঁচাবার জন্য না ছিল হেলমেট , না ছিল চেস্ট গার্ড, এলবো বা থাই গার্ড। সে যুগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওয়েস হল, গ্রিফিথ, লেস্টার কিংয়ের মতো খুনে বোলারদের হেলায় সামলেছেন টাইগার। ক্রিকেট হল আই রিফ্লেক্সের খেলা। সেই খেলায় এক চোখে গলি ক্রিকেটেও ভালো করে খেলা যায় না। সেখানে এক চোখে ফাস্ট বোলারদের শাসন করে গেছেন ম্যাচের পর ম্যাচ। সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে। ব্যাকরণগত এবং কৌশলগতভাবে কতটা নিখুঁত ও ত্রুটিমুক্ত হলে এমনটা সম্ভব! নবাব-গিন্নী অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর বলেছিলেন যে, একটা চোখ হারানোর পরেও যে ভাবে টাইগার ক্রিকেটে ফিরেছিল,
তা প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর মনের জোর ছাড়া কখনই সম্ভব হতো না।
১৯৬২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে ট্যুর ম্যাচে চার্লি গ্রিফিথের প্রাণঘাতী বলে মারাত্মক চোট পেলেন ভারত অধিনায়ক নরি কন্ট্রাক্টর। তিনি বাকি টেস্ট ম্যাচে খেলতে পারেননি । সেই সফরে সহ-অধিনায়ক টাইগার অধিনায়কের দায়িত্ব নিলেন। তখন পাতৌদির মাত্র ২১বছর। সর্ব কনিষ্ঠ টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করলেন। এরপর নিজে ১৯৭০ সাল অব্দি অধিনাকের দায়িত্ব সামলেছেন। অধিনায়ক হিসেবে রেকর্ড মোটেই ভালো নয়। জীবনের ৪৬ টি টেস্টে ৪০ টেস্টে অধিনায়ক হিসেবে খেলেছেন। তাতে জয় মাত্র ৯টি, হার ১৯টি এবং ড্র ১২টি। টাইগারের বিস্ময়কর, অদ্ভুত কিছু হটকারী সিদ্ধান্ত অবশ্য হারের জন্য দায়ী।
টাইগার আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে, ওনার টিমে না ছিল গাভাস্কারের মতো ওপেনার না ছিল কপিল দেবের মতো বোলার। এনাদের মতো ক্রিকেটার ওনার দলে থাকলে পরিসংখ্যানটা হয়তো অন্যরকম হতো। অধিনায়ক হিসেবে তেমন সফল হতে না পারলেও ব্যাট হাতে কিন্তু উনি সফল। ৪৬টি আন্তর্জাতিক টেস্টে ওনার মোট রান ২,৭৯৩ এবং ৬ টি সেঞ্চুরি, ১৬টি হাফ সেঞ্চুরি। গড় ৩৪.৯১ এবং সর্বোচ্চ রান ২০৩
সবচেয়ে নজর করার মতো বিষয় হল দেশের থেকে বিদেশের মাটিতে সাফল্য এবং গড় বেশি। সেঞ্চুরির সংখ্যাও বেশি। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ওনার গড় ৫৬.৫ যা সর্বাধিক। ১৯৬৮ সালে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে কিউইদের হারিয়ে ভারত প্রথম বিদেশে টেস্ট জেতে টাইগারের নেতৃত্বে।
বিশ্ব ক্রিকেটে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৬২ সালে পেয়েছেন 'ক্রিকেটার অফ দ্য ইয়ার', ১৯৬৪ সালে 'অর্জুন' পুরস্কার, ১৯৬৪ সালে 'উইসডেন ক্রিকেটার অফ দ্য ইয়ার' পুরস্কার। ১৯৬৭ সালে 'পদ্মশ্রী' পুরস্কারে ভূষিত হন।
২০১১ সালে ২২ সেপ্টেম্বর, ৭০ বছর বয়সে নবাব পাতৌদি জীবনকে বিদায় জানান। বাইশ গজের ইতিহাসে আজও রয়ে গেছে এক-চক্ষু বাঘের গর্জন।
1 Comments
চমৎকার শীতের উপহার পেলাম, আমরা ছোটো বড় সবাই।
ReplyDelete