জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম --পর্ব-৩১/(ধর্মে রাষ্ট্রের ভূমিকা)/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম --পর্ব(৩১)

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ধর্মে রাষ্ট্রের ভূমিকা


প্রাচীনকালে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবার আগে মানব সমাজের সংগঠন ছিল উপজাতীয়, আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভৌগলিক অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। তখন উপজাতীয় প্রধানেরা সমাজ নিয়ন্ত্রণ করতো। ধর্ম ছিল টোটেম ও ম্যাজিক ভিত্তিক, এবং তাত্ত্বিকতা বর্জিত। তারপর ক্রমশ আর্থিক বিকাশ এবং শ্রম ও শ্রেণী বিভাজনের ফলে উপজাতীয় সমাজ ব্যবস্থায় ভাঙ্গন ধরে, আর অন্যদিকে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র এবং প্রাচীন সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব হয়। তখন বৃহত্তর ভৌগোলিক এলাকায় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে বিভক্ত বিপুল জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্য রাজা এবং শাসক শ্রেণীকে নূতন কৌশল অবলম্বন করতে হয়। সামরিক শক্তিই ছিল রাজতন্ত্রের প্রধান অবলম্বন। কিন্তু সামরিক প্রযুক্তি ছিল অনুন্নত। অতএব জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিলে শুধুমাত্র সামরিক শক্তির সাহায্যে তাদের বশে রাখা কঠিন হয়ে পড়তো।স্বৈরাচারী বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র, শাসক শ্রেণীর প্রভুত্ব ও শোষণশাসন, এবং নিজেদের সার্বিক হীনস্থান জনসাধারণ স্বেচ্ছায় মেনে নিলে তবেই তাদের দীর্ঘকাল ধরে বশে রাখা সম্ভব ছিল। এই পরিস্থিতিতেই রাষ্ট্রশক্তি ও শাসক শ্রেণীর তৎপরতায় মানুষের প্রাচীন অসংগঠিত ধর্মবিশ্বাসকে পল্লবীত, সংগঠিত এবং তাত্ত্বিক আবরণে আবৃত করে বড় বড় ধর্মগুলোর সৃষ্টি হয়, মূলত ধর্মশাস্ত্রের মাধ্যমে অসম আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোকে জনসাধারণের কাছে গ্রহণীয় করে তোলবার উদ্দেশ্যে। তখন থেকেই শাসক শ্রেণীর স্বার্থের পরিপূরক ধর্মগুলোকে রাষ্ট্র রক্ষা করে এসেছে, এবং জনসাধারণকে শোষণশাসনের হাতিয়ার হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করেছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে প্রধানত রাষ্ট্রশক্তির  পৃষ্ঠবলেই বড় বড় ধর্মগুলোর শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে, আর যখনই তারা সে পৃষ্ঠবল হারিয়েছে, তখনই তাদের পতন হয়েছে। অনেক সময় রাষ্ট্র শাসক শ্রেণীর স্বার্থের পরিপন্থী সব ধর্মমতকে রাষ্ট্রশক্তি প্রয়োগ করে ধ্বংস করেছে। 

  বহিরাগত আর্যেরা প্রথমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এই তিন বর্ণ নিয়ে এদেশে এসেছিল। তারপর তাদের সঙ্গে ভূমিপুত্র অনার্য এবং পরবর্তীকালে বহিরাগত 'ম্লেচ্ছ'  অনার্যদের সংঘাতের মধ্য দিয়ে শূদ্র শ্রেণীর সৃষ্টি হয়। বৈদিক যুগেই এদেশে রাজতন্ত্রেরও সূত্রপাত হয়। ঋকবেদে এ দশ রাজার যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে জয়ের মাধ্যমে রাজা সুদাসের বড় রাজ্য স্থাপনের কাহিনী এই সাক্ষ্যই দেয়। আর ঋকবেদের পুরুষসূক্তে চাতুর্বর্ণ্য রূপ আদিম শ্রেণীভেদের ঐশ্বরয়া উৎপত্তি সম্বন্ধে ধর্মতত্ত্বের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। উত্তরবৈদিক যুগের ধর্মসূত্রগুলোর মধ্যে এই চাতুর্বর্ণ্য ভিত্তিক আর্থসামাজিক কাঠামোর জোরালো সমর্থন আছে। তারপর কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এবং মনুস্মৃতি তে এই অসম আর্থসামাজিক কাঠামোকে রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের উপর অর্পণ করা হয়। বেদে নির্দিষ্ট চার বর্ণের কর্ম বিভাজনের উল্লেখ করে কৌটিল্য বলেছেন: "যারা স্বধর্ম অনুযায়ী নিজ নিজ কর্ম করে তারা স্বর্গ এবং অমরত্ব লাভ করে। আর এই নিয়ম অমান্য করলে বর্ণসঙ্করের ফলে পৃথিবী ধ্বংস হবে। অতএব স্বধর্ম এবং স্বকর্ম থেকে কোন মানুষকে কখনো সরে আসতে না দেওয়া রাজার অবশ্য কর্তব্য।" কৌটিল্য আরও বলেছেন যে রাজদণ্ডের সাহায্যে চাতুর্বর্ণ্য প্রথা বলবৎ রাখলে তবেই লোকেরা নিজ নিজ বৃত্তিতে নিযুক্ত থাকবে। মনু বলেছেন যে ঈশ্বর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে রক্ষা করবার উদ্দেশ্যেই নিজেই চার বর্ণ সৃষ্টি করে প্রত্যেক বর্ণকে নিজ নিজ বৃত্তি নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।

   প্রকৃতপক্ষে প্রায় সমগ্র মনুস্মৃতিই চাতুর্বর্ণ্য ভিত্তিক আর্থসামাজিক কাঠামোর গুরুতর অসাম্য, অত্যাচার ও শোষণের সমর্থনে রচিত। এরই মধ্যে মনু ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের নিয়ে গঠিত তৎকালীন শাসক শ্রেণীর কমন শ্রেণীস্বার্থ, এবং সে শ্রেণীস্বার্থ রক্ষায় রাষ্ট্রশক্তির সাহায্যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক শ্রমিক শ্রেণীকে দাবিয়ে রাখার গুরুত্ব বিশেষ ভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। একদিকে তিনি বলেছেন: "ব্রাহ্মণদের সাহায্য ছাড়া ক্ষত্রিয়রা উন্নতি করতে পারে না, আবার ব্রাহ্মণেরাও ক্ষত্রিয়দের সাহায্য ছাড়া উন্নতি  করতে পারে না। পরস্পর নিবিড় ঐক্যে আবদ্ধ হলে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়েরা ইহলোকে এবং পরলোকে উন্নতি করতে পারে। আবার অন্যদিকে বলেছেন: "রাজার কর্তব্য বৈশ্য এবং শূদ্রদের তাদের জন্য নির্দিষ্ট কর্মে নিযুক্ত থাকতে বাধ্য করা। কারণ এই দুই বর্ণ নিজেদের নির্দিষ্ট কর্ম ত্যাগ করলে জগৎ ছারখার হয়ে যাবে। এখানে উল্লেখ্য যে অর্থশাস্ত্র ও মনুস্মৃতির যুগে বৈশ্যদের কৃষিকর্মের অনুমতি ছিল। কিন্তু পরে একমাত্র বিত্তবান বৃহৎ ভূস্বামীদের ছাড়া আর সব কৃষককেই শূদ্র হিসেবে গণ্য করা হতো। 

  যে বৌদ্ধ ধর্ম ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বৈদিক যাগ-যজ্ঞ, পূজোপার্বণ এবং চাতুর্বর্ণ্য ভিত্তিক আর্থসামাজিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল, তারাও এদেশে সামরিক শ্রীবৃদ্ধি সম্ভব হয়েছিল সম্রাট অশোকের আমলে রাষ্ট্রশক্তির পৃষ্ঠবলে। অশোক তার বিশাল সাম্রাজ্যে প্রত্যন্ত সীমা পর্যন্ত সমস্ত রাজকর্মচারীদের আদেশ দিয়েছিলেন যে তারা যেন সর্বত্র বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেন। এবং এমন কি তিনি ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা, পশ্চিম ও মধ্য এশিয়া এবং শ্রীলঙ্কাতে বহুসংখ্যক ধর্মপ্রচারক পাঠিয়েছিলেন। প্রাচীন কালে প্রজারা সাধারণত রাজার ধর্ম গ্রহণ করত। তাই অশোকের এই রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টার ফলে প্রাচীন ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। তাছাড়া বৌদ্ধ ধর্মের অভ্যুত্থানের পেছনে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় শ্রেণীর সামগ্রিক পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলেও বৈশ্য বা বণিক শ্রেণীর পূর্ণ এবং সক্রিয় সমর্থন ছিল। প্রকৃতপক্ষে শ্রেষ্ঠী বা বিত্তবান ব্যবসায়ী শ্রেণীর অনেকেই ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ের আধিপত্য থেকে মুক্তি লাভের আশায় বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিল। আর প্রধানত তাদের অর্থ সাহায্যেই বৌদ্ধ বিহারগুলো বেঁচে থাকতো। একথাও মনে রাখতে হবে যে বৌদ্ধ ধর্মের চাতুর্বর্ণ্য বিরোধিতা কোন গণআন্দোলনের রূপ নেয়নি। ধর্মতত্ত্ব এবং বৌদ্ধ বিহারগুলোর অভ্যন্তরীণ আচারেই তা মূলত সীমাবদ্ধ ছিল। অতএব বৌদ্ধ ধর্ম ভারতে বিস্তার লাভ করলেও তার ফলে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় শ্রেণীর কোন গুরুতর শক্তিক্ষয় হয়নি।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

0 Comments