ঘনাদার গল্পে রসসৃষ্টি
অতনু মিত্র
শিশু-কিশোর সাহিত্যিক ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন
"প্রেমেনদা'র শিশু সাহিত্যের সবচেয়ে বড় অবদান বোধ হয় ঘনাদা'র গল্প। এই ঘনাদাকে নিয়ে তিনি অজস্র গল্প লিখেছেন। শুধু এর জন্যই তিনি শিশু সাহিত্যে অমর হয়ে থাকবেন। অথচ এই কাল্পনিক ঘনাদা চরিত্রটি বিষয় বৈচিত্র্যে, বসসৃষ্টির ব্যাপারে এবং কাল্পনিক বিজ্ঞানের দিক্ নিয়ে অসাধারণ। ৭২নং বনমালী নস্কর লেনের বাসিন্দা এই ঘনাদা বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতে ওস্তাদ। তাঁর গল্প শোনার জন্য মেসের বাসিন্দারা প্রায় পাগল-- যদিও তারা সবাই জানে এসমস্তই ঘনাদার উর্বর মস্তিষ্কের ফসল ছাড়া আর কিছুই না। এই ঘনাদা ২০০ বছরের সমস্ত ঘটনার সঙ্গেই জড়িয়ে আছেন। ভূগোলতো প্রায়ই গুলে খেয়েছেন, পৃথিবীর হেন অঞ্চল নেই যেখানে যাননি, তা-সে আফ্রিকার গভীর জঙ্গলেই হোক বা অস্ট্রেলিয়ার জনহীন মরুভূমিই হোক বা আল্লস্ এর তুষার শৃঙ্গই হোক, এমন কি দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত তাঁর অগাধ বিচরণ। ঘনাদা নিজে বিজ্ঞানী নন, কিন্তু বহু বিজ্ঞানীর সংস্পর্শে এসে তিনি নানা অঘটন ঘটিয়েছেন। এইসব বিজ্ঞানীরা যে সব আবিষ্কার করেছেন বা করবার আয়োজন করেছেন তারমধ্যে কিন্তু বিজ্ঞানের দিক থেকে কোনও অসামঞ্জস্য নেই। যেমন কোন এক জাতের মশার লালাকে রাসায়নিক উপায়ে সাপের বিষের মত মারাত্মক বিষে পরিণত করা। আফ্রিকার এক বিশেষ জাতের পঙ্গপালের চাষ করে তাদের দিয়ে সারা ইউরোপ ধ্বংস করে দেবার পরিকল্পনা যা নাকি নাৎসী নির্যাতিত এই ইহুদী বিজ্ঞানী করেছিলেন এবং তা জানতে পেরে তারই ভাই, যিনি ছদ্মবেশে নিজেকে খাঁটি জার্মান পরিচয় দিয়ে আত্মরক্ষা করতেন, তিনিই বানচাল করেছেন। আগাছার সাহায্যে সমুদ্র বিষিয়ে দেবার পরিকল্পনাও বিজ্ঞানের দিক দিয়ে ভবিষ্যতে অসম্ভব নয় বুঝে ঘনাদা'র তা ভেঙে দেওয়া, সমুদ্রের নীচে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মুখ হঠাৎ বুলে গিয়ে যে ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটতে যাচ্ছিল তার প্রতিকারের ব্যবস্থা, তাঁবুকে বেলুনে পরিবর্তিত করে উড়ে পালাবার ব্যবস্থা- এসবই ঘনাদার মগজের উদ্ভট কল্পনা হলেও এক কথায় থ্রীলিং বলতে বাধা নেই এবং বিজ্ঞানের দিক থেকেও এগুলিকে একেবারে অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। শুধু বিজ্ঞানমনস্ক গল্প হিসেবেই নয় এর ভিতরকার রস, রঙ্গব্যঙ্গও কম উপভোগ্য নয়, এ রস যাঁরা ঘনাদার গল্প পড়েননি, তাঁদের বোঝানো যাবে না। প্রধানতঃ কিশোরদের জন্য লেখা হলেও ছেলেবুড়ো সকলেই এর রস সমানে উপভোগ করতে পারেন।"
এই উক্তি থেকে এটা বোঝা যায় ঘনাদার গল্পের মধ্যে আছে থ্রীলিং (thriling) অর্থাৎ রোমাঞ্চকর উত্তেজনা সঙ্গে রঙ্গ-বাঙ্গ রসের সমাহার। ঘনাদাকে কী করে পেলাম এই সম্পর্কিত আলোচনায় প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছেন -"নিজের যা ভালো লাগে, নিজে যাতে যা আনন্দ পাই, স্বাভাবিক ভাবে পাঠকদেরও করতে চাই তার ভাগীদার। আবিষ্কার উদ্ভাবন আর সন্ধানের দুঃসাহসিক বৈচিত্র্যে আমাদের এই শতাব্দীর প্রথম থেকেই বিজ্ঞানের বহস্য রোমাঞ্চ উত্তেজনায় স্পন্দমান নিজে যা অনুভব করি বিজ্ঞানের জগতের সেই রহস্য রোমাঞ্চ বিস্ময়ের স্বাদ পাঠকদেরও কিছু দিতে পারি কিনা দেখবার জন্যেই একটু কৌতুকের সুর মিশিয়ে ঘনাদাকে আসবে নামানো"।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের এই উক্তি হতে এটা পরিষ্কার যে রহস্য রোমাঞ্চ বিস্ময়ের স্বাদের সঙ্গে কৌতুকের সুর মিশিয়ে ঘনাদার গল্প তৈরি হয়েছে। ঘনাদা'র প্রথম গল্প 'মশা' শুরু হয়েছে এই ভাবে -'গল্পটাই আগে বলব না, গল্প যাঁর মুখ থেকে শোনা, সেই ঘনশ্যাম-দার বর্ণনা দেব, বুঝে উঠতে পারছি না। গল্পটা কিন্তু ঘনশ্যাম-দা, সংক্ষেপে ঘনাদার সঙ্গে এমনভাবে জড়ানো যে, তাঁর পরিচয় না দিলে গল্পের অর্ধেক রসই যাবে শুকিয়ে। সুতরাং ঘনাদার কথা দিয়েই শুরু করা উচিত।
ঘনাদার রোগা লম্বা শুকনো হাড় বার করা এমন একরকম চেহারা, যা দেখে বয়স আন্দাজ করা একেবারে অসম্ভব। পঁয়ত্রিশ থেকে পঞ্চান্ন যে কোনও বয়সই তাঁর হতে পারে। ঘনাদাকে জিজ্ঞেস করলে অবশ্য একটু হাসেন, বলেন 'দুনিয়াময় টহলদারি করে বেড়াতে বেড়াতে বয়সের হিসেব রাখবার কি আর সময় পেয়েছি। তবে -'বলে ঘনাদা যে গল্পটা শুরু করেন, সেটা কখনও সিপাই মিউটিনির, কখনও বা রুশ জাপানের প্রথম যুদ্ধের সময়কার। সুতরাং ঘনাদার বয়স আদাজ করা আমরা ছেড়ে দিয়েছি। শুধু এইটুকু মেনে নিয়েছি যে গত দুশো বছর ধরে পৃথিবীর হেন নেই যেখানে তিনি যাননি, হেন ঘটনা ঘটেনি যার সঙ্গে তাঁর কোনও যোগ নেই।'
'মশা' গল্পের এই প্রথম অংশে ঘনাদা চরিত্রের অসাধারণত্ত্বের বিবরণ আছে। বিবরণটা হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিতে পরিবেশিত হয়েছে। এরপরের অংশে মশাকে কেন্দ্র করে রোমাঞ্চকর গল্প পরিবেশিত হয়েছে। সাখালীন দ্বীপে যখন ঘনাদা অ্যাম্বার সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত ছিলেন, সেই সময়ে ঘটে একটি রহস্যজনক ঘটনা। তানলিন নামে এক চিনা মজদুর নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তাকে খুঁজতে গিয়ে ঘনাদা জঙ্গলে ঘেরা এক পাণ্ডব বর্জিত দ্বীপে জাপানি কীটতত্ত্ববিদ মি. নিশিমারা -র গবেষাগার খুঁজে পান। সেই সঙ্গে তিনি আবিষ্কার করেন এক অতি ভয়ানক বিষয়। অর্থাৎ সেই গবেষণাগারে বসে মি.নিশিমারা এমন এক মশা তৈরি করেছে যার সামান্য কামড়ে এক অতিকায় মানুষ তাঁর যন্ত্রণায় ছটপট করতে করতে নিমেষে মারা যায়। এমন সব রোমাঞ্চকর ঘটনার মধ্য দিয়ে গল্পটি এগোতে থাকে। শেষে ঘনাদার উপস্থিত বুদ্ধি ও সাহসিকতার জন্য বিষাক্ত মশা ও তার আবিষ্কর্তা নিশিমারা দুজনের ভবলীলা সাঙ্গ হয়। ঘনাদার বীরত্বের বর্ণনা এবং অদ্ভূত রোমাঞ্চকর এক ঘটনার বর্ণনার ফলে গল্পের এই পর্বে বীর এবং অদ্ভুত রস সঞ্চার ঘটেছে। তবে সমগ্র গল্পটি একটি সরস ভঙ্গিতে পরিবেশিত হয়েছে।
ঘনাদার প্রতিটি গল্পকে আমরা দুটি পর্বে ভাগ করতে পারি। গল্পের প্রথম অংশ এবং একেবারে শেষ অংশকে নিয়ে প্রথমপর্ব। যার প্রেক্ষাপট বর্তমান কালে বর্ণিত অর্থাৎ বনমালী নস্কর লেনের মেসবাড়ির ঘটনাক্রম। গল্পের মাঝের বৃহত্তম অংশ হল দ্বিতীয় পর্ব। যার প্রেক্ষাপট অতীত কালের। ঘনাদার দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডের স্মৃতি রচনায় এই পর্বটি নির্মিত। গল্পের প্রথমপর্বে শিবু, শিশির, সুধীর, গৌর ও ঘনাদার মধ্যেকার ঘটনাক্রমই হাস্যরসের মূল উৎস, আর গল্পের দ্বিতীয় পর্বে যা রহস্য-রোমাঞ্চে ভরপুর, ঘনাদা যেখানে তার অতি আশ্চর্য কীর্তিকলাপের গল্প বলে শিবু, শিশির, গৌর সহ আমাদের সবাইকে অবাক করে দেয়, সেখানে বীররস ও অদ্ভূতরসের প্রাধান্য বেশি লক্ষ্য করা যায়। তবে সমগ্র গল্পটি রঙ্গরসাত্মক বৈঠকী মেজাজে পরিবেশিত হওয়ার কারণে সামগ্রিক ভাবে ঘনাদার গল্পগুলিতে হাস্যরসের প্রাধান্য বেশি অনুভূত হয়।
প্রেমেন্দ্র মিত্র সচেতনভাবেই কৌতুকের সুর মিশিয়ে ঘনাদার গল্পগুলি রচনা করেছেন। তার কারণ আমাদের মনে হয় ঘনাদার গল্পগুলি যেহেতু ছোটদের উদ্দেশ্যে রচিত, তাই তাদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য তিনি কৌতুকের আশ্রয় নিয়েছেন। গুরুগম্ভীর বিষয়ে তাদের মনোযোগ ধরে রাখা সহজ নয়। তাই প্রেমেন্দ্র মিত্র বিজ্ঞান, ইতিহাস ও রাষ্ট্রের গুরুগম্ভীর বিষয়কে বলার জন্য কৌতুকের আশ্রয় নিয়েছেন। প্রত্যেক কৌতুক বোধ সৃষ্টির পেছনে একটি অসঙ্গতি সর্বদা থাকে।
ঘনাদার গল্পে যে কৌতুকের সুর আছে তার পেছনেও কোন না কোন অসঙ্গতি বা নিয়মভঙ্গজনিত পীড়া অবশ্যই আছে। সেটি কোথায় ? মূল অসঙ্গতিটি লুকিয়ে আছে ঘনাদার চরিত্রের মধ্যে। গল্পের প্রথম পর্বে যে ঘনাদাকে আমরা দেখি ভীতু, অলস, ঘরকুনো তিনিই কিনা সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছেন নানান কাজে। তুড়ি মেরে কঠিন কঠিন সমস্ত সমস্যার সমাধান করেছেন। তিনি এক চড়ে বড় বড় যোদ্ধাদের কুপোকাত করেছেন। ঘনাদার চরিত্রের মধ্যে আছে এক ভীরুতা, সারল্য যা সহজেই আমাদের মনকে জয় করে নেয়। আবার তিনি যখন রাজা-উজির মারার গল্প ফাঁদেন তখন তার এই ছদ্ম আতিশয্য আমাদের মনে কৌতুকবোধ জাগায়।
ঘনাদা গল্পে বিজ্ঞানের তথ্য বা ইতিহাসের সত্যভাস অথবা উপনিবেশিক মনস্তত্ত্ব, রাষ্ট্র ও সভ্যতার আসলরূপের যতই বর্ণনা থাক এসব কিছু না বুঝলেও ঘনাদা গল্প পাঠে একটা নির্মল আনন্দ আছে। এই আনন্দটি লুকিয়ে আছে ঘনাদা গল্পে মিশ্রিত হাস্যরসের মধ্যে। ঘনাদার নিত্যনতুন অ্যাডভেঞ্চারের খবর আমাদের বেশি আনন্দ দেয়, না কি শেষ পর্যন্ত এইটে বুঝে আমরা কৌতুক অনুভব করি যে কী ডাহা-বাগাড়ম্বরে ঘনাদা থতমত খাইয়ে দিচ্ছে শিবু-শিশির-গৌরদের। 'ফুটো' গল্পে মেসের দেওয়ালে দেখা দিয়েছে ছোট একটা ফুটো। সেখান থেকে ঘনাদা চলে যান উত্তর মেরুর দিকে রাশিয়ার শেষ স্থলবিন্দু চেল্যুস্কিন অন্তরীপে। তারপর সেখানে ঘটে বিচিত্র এক ঘটনা। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতার পর মহাশূন্যে যে 'ফোর্থ ডাইমেনশন' আছে তা বেয়ে ঘনাদা নিমেষে চলে যান একেবারে মঙ্গলগ্রহে। এই অসঙ্গতিটি আমাদের মে হাস্যরসের সঞ্চার করে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানান কথার কৌতুকপূর্ণ প্রকাশের সঙ্গে রোমাঞ্চের শিহরণ এই অপূর্ব মিশেলটাই হল ঘনাদা গল্পের আসল উপাদেয় বস্তু।
0 Comments