জ্বলদর্চি

জ্বলদর্চি পঁচিশ উৎসবে সমরেশ মজুমদারের অভিভাষণ

জ্বলদর্চি পঁচিশ উৎসবে সমরেশ মজুমদারের অভিভাষণ 


আমার ইচ্ছে ছিল দাঁড়িয়ে বলার, কিন্তু ঋত্বিকরা ভয় পাচ্ছে এইভাবে আমি বেশিক্ষণ বলতে হয়তো নাও পারি।

ব্যাপারটা হল কি, ঠিক একবছর আগে আমি হসপিটালে ছিলাম, অকস্মাৎ যাকে বলে স্ট্রোক – রাত্রিবেলায় আক্রান্ত হই। জ্ঞান ফেরে তিনদিন বাদে। চিকিৎসকরা বলেন আমার ডানদিকটা অনেকদিন অবশ থাকবে। ফিজিওথেরাপী করলে ঠিক হবে। ডান হাত, ডান পা ইত্যাদি। একজন লেখকের ডান হাত ডান দিক অবশ হলে সেইদিন সেই লেখকের মৃত্যু হয়ে যায়। আমি জানি না আমার আত্মীয় পরিবার বন্ধুরা খবরটা কিভাবে নিয়েছিলেন। আমার যখন জ্ঞান ফিরল সেই রাত্রিবেলা – তিনদিনের পর রাত্রে আমার বাথরুম যাওয়ার প্রয়োজন হয়। অনেক রাত। আমি দেখলাম আমি আষ্টেপৃষ্টে নল দিয়ে আটকানো আছি। বিছানার দুপাশে ব্যারিকেড তোলা আছে যাতে না পড়ে যাই। ঘরের এক কোণে একজন মহিলা নার্স চেয়ারে বসে আধাঘুম, আধা জাগরণে রয়েছে। আমি উঠতে গেলাম তখন দেখলাম ধীরে ধীরে উঠতে পারব এবং বাম হাত দিয়ে ব্যারিকেডটা সরালাম। সেই সময় নার্সের ঘুম ভাঙে। সে চিৎকার করে ওঠে আতঙ্কে। ডাক্তাররা ছুটে আসে। আমার তখন পূর্ণ জ্ঞান। ঘুম পাড়ানির ইনজেকশান ফুঁড়ে দিয়ে যায়। আমি ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন যখন জ্ঞান ফিরল আমার ডানদিক অবশ। অবশ হয়ে যাওয়া শরীরটা পূর্ণ অবস্থায় ফিরে পেতে হলে বিশেষ করে কবজি এবং কনুইয়ের কাছটা-- চাই ফিজিওথেরাপি। 

এ তো গেল একদিক। দিন দশেকের পর যখন বাড়ি এলাম, আমি অক্ষর চিনতে পারতাম না। ঠিক একমাস পরে আমি ডাক্তারকে অনেক মিনতি করলাম আমি অক্ষর চিনতে চাই । বিশ্বাস করুন, পঞ্চাশ প্রায় ঊনপঞ্চাশ বছর লেখালেখির পর আমি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ঐ পুস্তিকাটি আবার পড়ার চেষ্টা করলাম, যেখানে অ-আ-ই ঈ লেখা আছে। অ আ-ই-ঈ থেকে অজ, আম ইত্যাদি পড়তে আমার সাতদিন লাগল। একমাস পরে যখন একটা চক দিয়ে শ্লেটে অজ, আম লিখছি শ্লেটের দাগ এদিকে হয়ে যাচ্ছে, পরেরটা ও পাশের নিচে রয়ে যাচ্ছে।

এইভাবে দুমাস যখন গেল ডিসেম্বর মাসে আনন্দবাজার থেকে চিঠি এল পুজো সংখ্যার উপন্যাস লেখার। আমি তখন হাসব না কাঁদব ভেবে পাই না। মার্চ মাস থেকে আমি উপন্যাস লেখা শুরু করলাম। আমরা জানি একটা লাইনের পরে একটা নির্দিষ্ট ব্যবধানে আর একটা লাইন লেখা হয়। আমার দুটো লাইনের মধ্যে একটাই প্রবলেম। আমি দ্বিতীয় লাইন যখন লিখছি তখন প্রথম লাইন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি না যে আমি প্রথম লাইনে কি লিখেছি। শুধু স্মৃতিনির্ভর হয়ে থেকে যাচ্ছে লাইনটা। এই করতে করতে করতে করতে উপন্যাস লেখা শেষ হল। আর যখন জানল লোকে আমি উপন্যাস লিখতে পারছি  তখন আরো অনুরোধের ভিড় এল।

 এই করতে গিয়ে সবই ঠিক ছিল, স্মৃতিটা শুধু ৯০ ভাগ লোপ পেয়েছিল। ডাক্তার বললেন যখন কারোর নাম মনে করতে পারবেন না, তখন মনে মনে এ বি সি ডি পড়ুন। ধরুন কারোর নাম বাদল, সেই এ-এর পর বি পড়বেন, তখন মূল নামটা মনে পড়বে। আমি সেই পন্থা নিয়ে আস্তে আস্তে ঐ ১০ ভাগ স্মৃতিটাকে কমিয়ে ১৫ ভাগে এনেছি। এখন লিখি।

আমি এই গল্পটা এইজন্য বললাম, গতকাল রাত্রেও ডাক্তার এবং আমার কন্যারা আলোচনা করেছেন কলকাতা থেকে প্রায় আড়াই তিন ঘণ্টা দূরে এতটা গাড়ি জার্নি করে মেদিনীপুর শহরে আসা উচিত হবে কিনা– এসে ফিরে যাওয়া উচিত হবে কিনা। কিন্তু সমস্যা – আমাকে সমস্যায় ফেলল ঋত্বিক। আজ থেকে বোধহয় বছর দশ আগে আমি ওর কাগজের সন্ধান পাই। পেয়ে আমি আপ্লুত হই। আমি কখনো কোনো লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত হইনি। বসে আছি মাঝে মাঝে কেউ কেউ জোর করে দু-একটা লিটল ম্যাগাজিনে লেখানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু কেন জানি না, লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে সেইভাবে আমার কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি। তার একটা কারণ এও হতে পারে আমি সিরিয়াস নই লেখালেখিকে নিয়ে। আমার লেখক জীবন যদি ৬৭তে শুরু হয় তবে ৭৫-৭৬ অব্দি লেখক হবার কথা ভাবিনি। তখন বছরে দুটো লেখা দেশ পত্রিকা যদি ছাপে, তবে আমার সিগারেট খরচ উঠে যেত। তখন এরকম ভাবতাম। আমার এও মনে আছে, তখন কফি হাউসে চার পাঁচজন ভদ্রলোকের সঙ্গে আরো এক বিখ্যাত সম্পাদক বসতেন তাঁর আরো বিখ্যাত পত্রিকা নিয়ে। একদিন একজন তরুণ লিটল ম্যাগ করা ছেলে তাঁকে গিয়ে বললেন, আপনার এই কাগজটাকে আপনি লিটল ম্যাগাজিন মনে করেন। উনি অবাক হয়ে বললেন, কেন ? ওটা তো লিটল ম্যাগাজিন নয়। লিটল ম্যাগাজিন হলে আপনার চেহারাটা চকচকে, সুন্দর, নাদুসনুদুস হত না। লিটল ম্যাগাজিনের সম্পর্ক আমাদের মত রোগা, না খেতে পাওয়া, প্রায় পকেটের সব পয়সা উজাড় করে কাগজ করা -আপনাকে দেখে তা মনে হয় না। বিশ্বাস করুন, জানি না কেন, কথাটা আমাকে ভীষণ স্ট্রাইক করল। সেই অর্থে লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক তৈরি হয়নি। পরবর্তীকালে আমি পেশাদারি লেখক। বাজারের কাগজের লেখক হয়ে গেলাম। কিন্তু এই কাগজ 'জ্বলদর্চি' যখন আমি দেখলাম আমি নিজেও লিখেছি অনেকবার।

তারপর মেদিনীপুরের এই ছেলেটির সঙ্গে আমার যোগসূত্র তৈরি হল। আমাকে মাঝে মাঝে ও লেখা চায়। আমি কোনো দ্বিধা না করে লেখা পাঠাই। ও ভাবে যে আমি ওকে হয়তো বেশ অনুগ্রহ করলাম। কিন্তু ও জানল না, আমি লিখে নিজেকে নিজে গর্বিত করলাম যে আমি লিটল ম্যাগাজিনে লিখছি। এইভাবে বেশ কয়েকবছর ধরে ওর কাগজে আমি লিখি। আমার যে লেখাটার জন্য অন্য কাগজ অনেক টাকা দিতে রাজি আছে, সেই লেখাটা আমি বিনা পয়সায় ওর কাগজে দিয়েছি। কারণ এই ছেলেটি একটি কাগজ পঁচিশ বছর ধরে করছে তার বন্ধুদের নিয়ে এই প্রত্যন্ত মফসসল শহর থেকে। এটা আমাকে বিস্মিত করত। ভাবতাম- 'এ কী! কেন ও নিজের সংসারকে বঞ্চিত করছে। তোমার স্ত্রী পুত্রকে এভাবে অবহেলার মধ্যে ফেলে দিও না। কাগজ বন্ধ কর। কিন্তু কাগজটা হাতে পাওয়ার পর আমি সেটা বলতে পারতাম না। ও যেমন লিখত এই বিষয়ে একটা লেখা লিখুন। আমি অনায়াসে চেষ্টা করতাম সেটা আমার মত করে লিখতে।'

তাই গতরাতে যখন সবাই বলল, আমার যাওয়া উচিত কিনা, আর আমি জানলাম যে আমার প্রিয় চিত্রশিল্পী আমার সহযাত্রী হবেন। জানলাম ভাই শ্যামলকান্তি দাশও আসবে এবং আমি যাঁর গুণমুগ্ধ (বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য) তিনিও আসবেন, আমি দ্বিধা না করেই চলে এসেছি।

একটা কাগজের পঁচিশ বছর পূর্তি উৎসব। যে কাগজের ভিতরে কোনো শঠতা নেই, কোনো ধনী ব্যক্তি নেই – সে কাগজ একক উদ্যোগে অত্যন্ত রুচিশীল পরিচয় নিয়ে, আর আপনারা আছেন ওর সঙ্গে ফলে না আসতে পারলে একটা পাপ – আমি 'পাপ' শব্দটা ব্যবহার করলাম অন্য অর্থে। এই কারণে যে নিজের সঙ্গে প্রতারণা করা ঠিক হবে না। সেটা আমি করতে চাইলাম না। আর পঁচিশ বছর। ঋত্বিকের যা বয়স, ও এই কাগজের পঞ্চাশ বছর অবশ্যই পার করাবে। তবে আমি সেদিন থাকব না পৃথিবীতে, আমার যা বয়স, আমি সেদিন থাকব না। কিন্তু আমি প্রার্থনা করি সেদিন আরও সফলভাবে আজকের এই অনুষ্ঠানটা যেন হয়। নমস্কার।

(বিদ্যাসাগর মেমোরিয়াল হল, মেদিনীপুর শহর, ১৫ অক্টোবর ২০১৭)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

3 Comments

  1. লেখাটি পড়ে যারপরনাই আনন্দিত হলাম। সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার একদম সঠিক অর্থেই বলেছেন ঋত্বিক ত্রিপাঠি মহাশয়ের জ্বলদর্চিও তার অন্যতম ছানা বা তারচেয়েও বেশি কিছু। জ্বলদর্চিকে ভালো না বেসে পারা যায়না। আর তার সৃষ্টির সাথে স্রষ্টার অদম্য এক জেদ আছে। সেইজন্যই না লিটিল ম্যাগাজিনের অন্তর বাহিরের মতন অমন সুন্দর এক লেখা আর দিকনির্দেশনা পেয়েছে সবাই। আমি তো সবাইকে ঐ বইটি পড়তে বলি। সমরেশ মজুমদার কে তার অকপট লেখার জন্য জানাই শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন ।

    ReplyDelete
  2. লেখাটি পড়ে যারপরনাই আনন্দিত হলাম। সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার একদম সঠিক অর্থেই বলেছেন ঋত্বিক ত্রিপাঠি মহাশয়ের জ্বলদর্চিও তার অন্যতম ছানা বা তারচেয়েও বেশি কিছু। জ্বলদর্চিকে ভালো না বেসে পারা যায়না। আর তার সৃষ্টির সাথে স্রষ্টার অদম্য এক জেদ আছে। সেইজন্যই না লিটিল ম্যাগাজিনের অন্তর বাহিরের মতন অমন সুন্দর এক লেখা আর দিকনির্দেশনা পেয়েছে সবাই। আমি তো সবাইকে ঐ বইটি পড়তে বলি। সমরেশ মজুমদার কে তার অকপট লেখার জন্য জানাই শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন ।

    ReplyDelete
  3. অসাধারণ। জ্বলদর্চির সাথে আমার প্রেমটা আরো গভীরতর করে দিল এই অভিভাষণ।

    ReplyDelete