জ্বলদর্চি

হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার পুতুল ও তার দর্শন কথা /প্রসূন কাঞ্জিলাল

হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার পুতুল ও তার দর্শন কথা


 প্রসূন কাঞ্জিলাল


মাটির পুতুল, মোমের পুতুল কিংবা কাঠের পুতুল কিছু অবশিষ্ট থাকলেও সেগুলো থাকে আজকাল বাড়ির কোনে ধুলো ময়লার আস্তরনে। আজকের ব্যাটারি চালিত, দূর নিয়ন্ত্রিত আধুনিক খেলনার সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে তারা মিউজিয়ামেই জায়গা করে নিয়েছে।

পুতুল যে শুধু খেলার সামগ্রী তা নয় বরং পুতুল একটি বিশেষ অঞ্চলের সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং সমাজ ভাবনার চিহ্ন বহন করে। বিভিন্ন ধর্মের সঙ্গেও পুতুল অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। হিন্দু ধর্মের ঝুলন উৎসব কিংবা খ্রিস্ট ধর্মের মা মেরি এবং যীশুকে নিয়ে সাজানোর প্রথায় সরাসরিভাবে পুতুল যুক্ত করা হয়। এমনকি সান্তাক্লজের যে চেনা চেহারা আমাদের মনে আঁকা সেটির উৎস আসলে সান্তাক্লজের পুতুল থেকেই।

ছোটবেলা থেকেই গ্রাম খুব ভালোবাসি,আর ইচ্ছে হলেও ঘোরার সুযোগ খুব কমই থাকে। অনেক দিন পরে মনে হল এবারে গ্রাম ঘুরবো, আর এরকমই একটা গ্রামের খোঁজ মিলল যার নাম 'নতুনগ্রাম'। তাই দেরি না করে বেরিয়ে পড়লাম গ্রাম ঘুরে দেখার উদ্দেশ্যে, আর পৌঁছে গেলাম 'নতুন গ্রামে '। এই গ্রামের আসল পরিচিতি হল কাঠের পুতুল। গ্রাম টা খুব বড় না, খুব বেশি হলে ৪০-৫০ টা পরিবার এখানে বসবাস করে, এদের জীবিকা ই হল কাঠের পুতুল বানানো। গ্রামে এসে শুনলাম ৮ থেকে ৮০ সবাই এই কাজ ই করে থাকে। পুরুষ রা কাঠ খোদাই করে মূর্তি বা পুতুলের ছাঁচ তৈরী করে, আর সেই ছাঁচ শুকনো হবার পরে তাতে বাড়ির ছোট মেয়ে বা মহিলারাই তাতে রঙ করেন। পুতুল বলতে বেশির ভাগটাই প্যাঁচা। ছোট বড় সব রকমের প্যাঁচা যেটা প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই দেখা যাচ্ছিল।

তবে এর সাথে সাথে নিতাই গৌরাঙ্গ,  কৃষ্ণ, রাজা - রাণী, ছোট খাট, মোড়া, টেবিল ল্যাম্প, সেন্টার টেবিল, ছোট টি ট্রে, এছাড়াও বাড়ির নানান আসবাবপত্র, মেয়েদের কানের দুল, গলার হারের লকেট সবই পাওয়া যাচ্ছিল। প্রায় সব বাড়ির উঠনেই দেখা যাচ্ছিল লম্বা কাঠের খোদাই করা দুর্গা। পুতুল দেখতে দেখতে ঢুকে পড়লাম অজয় ভাস্করের বাড়ির উঠোনে। ঢোকার পরে দেখলাম বাড়ির সকলে ই প্রায় সেই কাজে নিযুক্ত। দেখলাম ছোট্ট বোন লাবনী কত সুন্দর ভাবে তার নিজের হাতে শ্রীকৃষ্ণ কে তার তুলির টানে সাজিয়ে তুলছে। বাড়ির কর্তা অজয় বাবু আমাদের সুন্দর ভাবে সব টা দেখালেন ও বললেন কত বছর ধরে ওনারা বংশ পরম্পরায় একই কাজ করে চলেছেন। আর রুজি রোজগার বলতে এই পুতুল বানানোই।

 ওনাদের মুখে শুনলাম দীর্ঘ প্রায় এক বছর লক ডাউন হওয়ার কারনে কোনো হস্তশিল্প, বইমেলা হয়নি, বা কোনো পর্যটক আসেনি। সেইজন্যে অনেক ক্ষতি হয় ওনাদের। 

কথা বলতে বলতে শুনলাম প্রতিবছর এই সময় গ্রামে মেলা হয়, যেটা আগামী সপ্তাহে শুরু হবে, মেলা  চলবে তিন দিন ধরে। অনেক খুশি হয়ে ওনারা বললেন, বাবু তোমরা এসে দেখে যেও আমাদের মেলা কেমন হয়। এমনি গ্রাম ঘুরে দেখতে দেখতে কখন যে ৩ ঘণ্টা সময় কাটিয়ে ফেললাম বুঝে উঠতে পারিনি। গিয়েছিলাম খালি হাতে কিন্তু ফেরার সময় খালি হাতে ফেরার উপায় ছিল না, কারন  সব টা দেখে কিছু না নিয়ে আপনি খালি হাতে আসতে পারবেন না, মনে হবে এটাও নিয়ে নি। গ্রাম বাংলার এই শিল্পকলা গুলো বেঁচে থাকুক এইভাবেই। তুলে ধরুক এইভাবেই ওনারা নিত্য দিন নতুন ভাবে।

সবটা শোনার পরে মনে হচ্ছে কিভাবে যাবেন? হাওড়া থেকে কাটোয়া যাওয়ার ট্রেনে উঠে অগ্রদীপ স্টেশন নামতে হবে। নেমেই অটো তে (১০টাকা) 'নতুন গ্রাম '।ছুটির দিনে একবেলার জন্যে ঘুরে আসতে পারেন। কথা দিতে পারি আমার মত সবার ই ভালো লাগবে। থাকতে চাইলে থাকার সুব্যবস্থা ও ওখানে পাবেন।

আধুনিক প্রজন্মের শিশুদের হাতে পুতুলের বদলে অন্য খেলা উঠলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পুতুলকে কেন্দ্র করে উৎসব পালন করা হয়ে থাকে।  ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যাবে সভ্যতার ঊষা লগ্ন থেকেই পুতুল তৈরি করত মানুষ। তবে সেটি খেলা বা বাড়িঘর সাজানোর থেকে দেবতা এবং অশুভ শক্তির প্রতীক হিসেবেই বেশি।
 
মনে করা যেতেই পারে আদিম মানুষের আঁকা গুহা চিত্র পুতুল তৈরির প্রথম ধাপ। সেক্ষেত্রে আলতামিরার গুহাচিত্রকে পুতুলের উত্তর পুরুষ বলা জেতেই পারে। পুতুল কখনও মানুষের চেহারার কাছাকাছি আবার কখন কোনো পশুর চেহারার অনুকরণে হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে বৃহত্তর দৃষ্টিতে মাটি, কাঠ, মোম, প্লাস্টিকের বানানো পশুপাখি থেকে ফল, গাছ সব কিছুকেই পুতুলের শ্রেণিভুক্ত করা যায়।

অর্থাৎ যে বস্তুগুলিকে "শো পিস" বলে থাকি সেগুলি আসলে এক একটি পুতুল। মিশরের মমির ভিতরেও অনেক ক্ষেত্রে পুতুল পাওয়া গেছে। অন্যদিকে, মিসরের মমির ধারণার সঙ্গে পুতুলের ধারণার অনেক মিল পাওয়া যায়।

উপকরণের ওপর ভিত্তি করে পুতুলকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।

মাটির পুতুল
কাপড়ের পুতুল
কাঠের পুতুল
পাটের পুতুল
তালপাতার পুতুল
গালার পুতুল
ধাতব পুতুল
কাগজের পুতুল
শোলার পুতুল  .....   ইত্যাদি

পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগর ( ঘূর্ণী) মাটির পুতুলের জন্য বিখ্যাত। বলা হয়, কৃষ্ণনগরের মাটির ফল সবজির সঙ্গে একটি আসল ফল সবজি রাখলে পার্থক্য বোঝা যায় না। শিল্পীদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে বাড়ি সাজাতে কিছু মাটির পুতুল বিক্রি হয়। এছাড়া পূজা পার্বণেও কিছু পুতুল বিক্রি হয়। আগে পুতুল নাচ, হরবোলার জন্য কিছু পুতুল বিক্রি হতো। বর্তমানে সেগুলি অনেক কমে গেছে। তবে শুধু মাটির পুতুল নয় পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, সোনামুখি অঞ্চলের শোলার পুতুলও তার নিখুঁত নির্মাণ শৈলীর জন্য জনপ্রিয়। পশ্চিমবঙ্গের ছুতোর মিস্ত্রিদের বানানো ‘মমি পুতুল’, লাট্টু আজও অনেক বাড়িতে হয়তো রয়েওছে।  


গ্রাম বাংলা জুড়ে তৈরি হয় মাটির পুতুল। লৌকিক প্রথার সাথে নানা ভাবে জড়িয়ে রইল পুতুলগুলো। থানে মানত করার হিসেবের সাথেও সম্পর্ক রইল পুতুলের। মানতের পথ ধরে ভক্তদের দৌলতে কুম্ভকারের পুতুল স্থান করে নিলো গ্রাম সুবাদে বটতলায় কিংবা আলের পাশের থানে। কুম্ভকারেরা মানতের বাহন হিসেবে বানান হাতি আর ঘোড়া। পল্লী গ্রামের মানুষের মনে বিশ্বাস এ সব হাতি আর ঘোড়া দিতে হয় বসন্ত রায়ের জন্যে। লোকো কথা চালু আছে ----

‘ সাজিল বসন্ত রায় তুরকি ঘোড়ায়/ 
কলেরব সভা পা এ লোচন জুরায়/ 
হাতে শক্তি শরাসন তূন পূর্ণ বান/ 
চান্দ করে ঝকমক পিঠে ঢাল খান/ 
জব্রবান আদি বলে পাত্র পঞ্চানন/ 
মুরতিমান ব্যাধি চলে না যায় গণন/ 
মন্দ আগন ব্যাধি একে একে চাপে/ 
রুষিলে বসন্ত রায় রাখে কার বাপে/' 

...সেদিন বসন্ত রায় হয়ে গিয়েছিলেন ব্যাধি নিরাময়ের দেবতা। তিনি যখন গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের রোগ নিরাময় করবেন তখন তো তাঁর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হাতি ঘোড়া লাগবে। হাজার হোক সে হল গিয়ে রাজা। তাই গ্রামের মানুষের কথা হল - ‘তোমার জন্যে ঘোড়া রাখলুম রায় রায়ান, তুমি গ্রাম দাপিয়ে বেড়াও। আর রোগ তাড়াও। আর তাই তৈরি হয় কোলে পোঁ কাঁখে পোঁ মা পুতুল। কোথাও তাঁর নাম জো-পুতুল আবার কোথাও বা ষষ্ঠী পুতুল। এমন পুতুলও থানে পড়ে গৃহস্থের খোকা হোক মানত করে। আর মা মনসার চালি তো আছেই। 

বাংলার এই সব মাটির পুতুল বানানোর মহল্লায় নির্মাণগত অনেক শব্দ চালু আছে। তেমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হল ‘পুতুল বানাতে বসে আমাদের পাঁচ ভুতের কারবার করতে হয়, আমাদের পুতুল খেলা ওই পাঁচ ভুতের সাথেই’। এমন গ্রামবাংলার শিল্পীর কথনে লুকিয়ে আছে এক চমৎকার অর্থ---

 পাঁচ ভুত বলে বোঝায় পঞ্চভূতের পাঁচ কাহন। শাস্ত্র মতের পঞ্চভুত হল ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। আর ক্ষিতি মানে হল- পৃথিবী, অপ কথার মানে হল- জল। ঠিক সেরকমই তেজ কথার অর্থ হল- আগুন, আর মরুৎ মানে হল- বাতাস। এবং ব্যোম বলতে বোঝায় শূন্যতা অর্থাৎ আকাশকে। এবার দেখা যাক পুতুল কারিগর এসব দিয়ে কি করে?

পুতুল কারিগর "ক্ষিতি মানে পৃথিবী" থেকেই মাটি নিয়ে আসে। তার পর "অপ অর্থাৎ জল" দিয়ে শিল্পী সেই মাটিকেই মাখে। সেই নরম মাটিকে সে পরিণত করে মনের মতন আঁকারে। এর পর শিল্পী ভাবেন কাঁচা মাটিকে পুড়িয়ে শক্ত করার কথা। আর তখনই তাঁর দরকার হয় "আগুনের, অর্থাৎ তাঁর লাগে তেজ"। এবার তো পুতুলকে ঠাণ্ডা করতে হবে। তাই সেই পোড়া উত্তপ্ত পুতুল সে দেয় বাতাসের কাছে। সুতরাং তাঁর লাগলো " হাওয়া বা মরুৎ" কে। এবার ব্যোম কে কাজে লাগাতে হবে শিল্পীর। কিন্তু শূন্যতাকে কি ভাবে পুতুলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে? এর উত্তর লোকো শিল্পী বের করে নেয় অবলীলায়। সে সমস্ত পুতুলগুলি বানাতে থাকে ফাঁপা করে। আর "ফাঁপা মানেই হল শূন্যতা" অথবা অসংখ্য ছিদ্র করা হয় পুতুলের গায়ে। আর সেই শূন্যতাই তখন আকাশ হয়ে নেমে আসে পুতুলের গায়ে। তৈরি হয় মাটির পুতুল। বসন্ত রায়, মা মনসা, হাতি, ঘোড়া সবাই তখন পঞ্চভূতের প্রতিনিধি হয়ে হাজির হয় আমাদের সামনে। 

পশ্চিমবঙ্গে আশির দশক পর্যন্ত মাটি, কাঠ এবং মোমের পুতুলের চাহিদা ছিল। নব্বইয়ের দশক থেকে বদলে যেতে থাকে চিত্রটা। পুতুলের জায়গা দখল করে নেয় স্প্রিং দেওয়া গাড়ি, নকল বন্দুক আর চাবি ঘোরানো কলের পুতুল। তারপরে ভারতের বাজার ছেয়ে যায় চীন থেকে আসা বিভিন্ন প্লাস্টিকের পুতুলে। বিদেশি পুতুলের হাত ধরে আসে টেডি থেকে শুরু করে ‘বার্বি ডল’। স্মৃতির অতলে চলে যায় পশ্চিমবঙ্গের মাটির পুতুল।

এছাড়া আছে গালা দিয়ে তৈরি পুতুল, পোড়া মাটির পুতুল, বাঁকুড়ার বিখ্যাত পোড়া মাটির ঘোড়া, ডোকরা প্রভৃতি। বর্তমানে মাটি, কাঠ, মোম বা সোলার পুতুল নির্মাতারা অনেকেই অন্য পেশায় চলে গেছেন।
 
দুর্গা পূজার সময় মণ্ডপ সজ্জার কাজে তাদের ডাক পড়ে। তবুও তারা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে নিয়মিত পুতুল বানান। তাদের আশা আবার হয়তো ভবিষ্যতে কোনদিন বাবা মায়েরা সন্তানদের হাতে তুলে দেবেন মাটির কিংবা কাঠের পুতুল। সেই হাতেই বেঁচে থাকবে শিল্প বেঁচে থাকবে ঐতিহ্য এবং ইতিহাস।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

8 Comments

  1. ভীষণ ভালো লাগলো। বাংলার কৃষ্টি সংস্কৃতিতে বাংলার মাটির পুতুল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। বিষ্ণুপুরের পোড়ামাটির ঘোড়া থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মাটির পুতুল ছাড়া গ্রাম বাংলার মেলা ভাবা যায়! খুব সুন্দর লাগলো লেখাটি। শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন রইলো লেখক- কে। ( গৌতম বাড়ই )

    ReplyDelete