জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৪/প্রীতম সেনগুপ্ত

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত 

পর্ব ৪


১৮৮১ সালের জুন মাসে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সেবক ও ভাগ্নে শ্রীযুক্ত হৃদয় মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মন্দির-কর্তৃপক্ষের কুমারী পুজো নিয়ে মনোমালিন্য হয়। তিনি কারোর পরামর্শ ব্যতিরেকেই মথুরবাবুর নাতনির পায়ে ফুল চন্দন দিয়ে পুজো করেন। এর ফলে কন্যার অকল্যাণ হবে ভেবে মথুরবাবুর পুত্র ত্রৈলোক্যবাবু বিশেষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন এবং অত্যন্ত বিরক্ত ও রুষ্ট হয়ে হৃদয়কে মন্দিরের কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেন। সেই সময় হৃদয়ই ছিলেন ঠাকুরের সেবক। মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি না থাকায় তাঁকে এই সেবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছিল। সেবকের অভাব পূরণার্থে ত্রৈলোক্যবাবু হৃদয়কে ছাড়িয়ে দেওয়ার দিনই এক পশ্চিমদেশীয় ভৃত্য নিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু তাকে দিয়ে ঠাকুরের সেবা সম্ভব হল না। কেননা সেই সময় ঠাকুর শুধুমাত্র শুদ্ধসাত্ত্বিক ব্যক্তির স্পর্শ সহ্য করতে পারতেন, অশুদ্ধ, অসাত্ত্বিক মানুষের স্পর্শ তাঁর কাছে অসহনীয় হয়ে উঠত। এমতাবস্থায় ঠাকুরের সেবার ত্রুটি হচ্ছে দেখে ভক্তপ্রবর রামচন্দ্র দত্ত শুদ্ধসাত্ত্বিক স্বভাবের লালটুকে ঠাকুরের কাছে দেন। এর দিন দুয়েক পরে রামবাবু স্বয়ং বিষয়টি দেখভালের জন্য দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হলেন। রামবাবুকে দেখে ঠাকুর বললেন লালটুকে তাঁর কাছে রেখে দিতে। কারণ সে সেখানে থাকতে ভালোবাসে, উপরন্তু শুদ্ধসত্ত্ব স্বভাবের। কোনওরকম দ্বিধা না করে লালটুকে সেখানে রেখে দিলেন রামবাবু। এরপর থেকে ক্রমেই লালটু দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সেবক হিসেবে পরিগণিত হল। ঠাকুর ভালোবেসে কখনও তাঁকে লেটো, নেটো, লাটু ইত্যাদি নামে ডাকতেন। এসবের মধ্যে লাটু নামটিই প্রচলিত হয়ে যায়। আলোচনার পরবর্তী অংশে লাটু নামটিই ব্যবহার করব আমরা। 

       আলোচনার প্রয়োজনে সময়যানে চেপে একটু পিছন ফিরে তাকালে দেখতে পাই শ্রীরামকৃষ্ণের বাল্যকাল। তাঁর ছেলেবেলার নাম গদাধর। পাঠশালায় সামান্য লেখাপড়া শিখবার পর বাড়িতে থেকে  রঘুবীরের বিগ্রহ সেবা করতেন। পাঠশালার পাঠে তাঁর ‘শুভঙ্করী ধাঁধা’ লাগত। নিজে গান গাইতে পারতেন-- অত্যন্ত সুকন্ঠ! যাত্রা শুনে প্রায় অধিকাংশ গান গাইতে পারতেন। সদানন্দ এই বালককে কামারপুকুরে আবালবৃদ্ধবণিতা সকলেই ভালোবাসতেন। পরবর্তী সময়ে এই গদাধর যখন দক্ষিণেশ্বরে রাসমণির কালীবাড়ির পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ এবং কৃপা করেছেন দেখামাত্রই চিনে নেওয়া লাটুকে অন্তরঙ্গ পার্ষদরূপে তখন এক অদ্ভুত বিপরীত মজার চিত্র। বাল্যকালে যাঁর পাঠশালায় ‘শুভঙ্করী ধাঁধা’ লাগত, তিনি নিরক্ষর লাটুর লৌকিক বিদ্যাশিক্ষার বিষয়ে তৎপর হয়ে উঠলেন! স্বয়ং তাঁকে বর্ণপরিচয় পড়াতে শুরু করলেন। ‘ক‘ বর্ণ দেখিয়ে লাটুকে বললেন, বল ‘ক’। লাটুর জিহ্বায় অ-কার আসে না। তিনি উচ্চারণ করেন ‘কা‘। ঠাকুর যতই বলেন ‘কা’ নয় ‘ক’ লাটু ততই ‘কা’ ‘কা’ উচ্চারণ করতে থাকেন। পাশে উপস্থিত রামলাল প্রভৃতি সেবকবৃন্দকে দেখিয়ে ঠাকুর বলতে লাগলেন--“শালা ‘ক‘-কে ‘ক’ বলতে পারে না, কেবল ‘কা‘ ‘কা’ করছে। আরে! এখানেই যদি ‘কা’ বলবি, তবে ক-এ আ-কারকে কি বলবি?” লাটুর বারংবার বিফলতা দেখে ঠাকুর বললেন--“ যাঃ! আর তোর পড়ে দরকার নেই।” লৌকিক শিক্ষার পাঠ এখানেই সমাপ্ত হল। কিন্তু ব্রহ্মবিদ্যার পাঠ চলতে লাগল। ইতিমধ্যে ঠাকুরের অন্তরঙ্গ যুবক পার্ষদেরা এসে সম্মিলিত হয়েছেন। তাঁদের সকলের সঙ্গে ঠাকুরের অপার্থিব স্নেহচ্ছায়ায় অধ্যাত্মমার্গের পথে উত্তরোত্তর অগ্রসর হতে লাগলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ অন্য ভক্তদের কাছ তাঁর সাধন জীবন নিয়ে প্রশংসা করতেন। বৈরাগ্য, ধ্যানতন্ময়তা, ভাবভক্তিতে তিনি ভরপুর হয়ে থাকতেন। ঠাকুররের কথায় ‘লেটো’ এখন চড়েই আছে’-- অর্থাৎ অধ্যাত্মমার্গের উচ্চস্তরে আসীন হয়ে আছেন।

     


  বস্তুতপক্ষে লাটু মহারাজ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের এক অদ্ভুত সেবক ছিলেন। দক্ষিণেশ্বরে যখন তিনি শ্রীশ্রীঠাকুরের সেবায় রত ছিলেন, সেই সময় তাঁর সরল বালকোচিত স্বভাব ছিল। নিদ্রাভঙ্গের পরে তিনি প্রথমে শ্রীশ্রীঠাকুরের শ্রীমুখই দর্শন করতেন, আর কারোর দিকেই তাকাতেন না। ছেলেমানুষের মতো ভয় পেতেন কি জানি পাছে অন্য কাউকে দেখে ফেলেন, তাই প্রয়োজনে চোখ ঢেকে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতেন--“ কোথায় আপনি। কোথায়?” শ্রীশ্রী ঠাকুরের লীলাবসানের পর তাঁর প্রাণপ্রিয় শ্রেষ্ঠ সন্তান আচার্য স্বামী বিবেকানন্দ বরানগর মঠে গুরুভাইদের নিয়ে যথাবিধি বিরজা হোম করেন এবং সকলকে সন্ন্যাস নাম দেন। সেই সময় পিতৃশ্রাদ্ধকালে লাটু পিতৃপুরুষগণকে উপস্থিত দেখে আনন্দে বলে ওঠেন,“ আয়,আয় , বইঠ,বইঠ, পূজা লে,পিণ্ড লে।” লাটুর এই অদ্ভুত ভাব, ধ্যান-ধারণায় অদ্ভুত নিষ্ঠা, বাল্যকাল থেকেই ধর্মানুরাগ, ত্যাগ, বৈরাগ্য ও অন্যান্য অদ্ভুত আচরণে প্রীত স্বামীজী তাঁর সন্ন্যাস নাম রাখেন ‘অদ্ভুতানন্দ’, একথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য ঠাকুরের তিরোভাবের পর লাটু শ্রীশ্রীমায়ের সঙ্গে কিছুদিন বৃন্দাবন ধামে কাটান। পরে বরানগর মঠে অন্যান্য ত্যাগী সন্তানদের সঙ্গে মিলিত হন। পরিব্রজ্যার ব্যাপারে তিনি তেমন উৎসাহী ছিলেন না। এক জায়গায় পড়ে থেকে ভগবৎ চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকাটা তাঁর প্রকৃতি ছিল। বরানগর থেকে মঠ আলমবাজারে স্থানান্তরিত হলে লাটু মহারাজ অবশ্য সেখানে থাকেন নি। বেশিরভাগ সময়েই গঙ্গাতীরে পড়ে থাকতেন। দেহধারণের বিষয়ে সম্পূর্ণরূপে উদাসীন ছিলেন। তাঁর প্রতি স্বামীজীর গভীর ভালোবাসা ছিল। তিনিও স্বামীজীকে প্রাণাধিক ভালোবাসতেন। স্বামীজীর দেহত্যাগের পর অত্যন্ত শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন।

         শ্রীশ্রীমায়ের প্রতি লাটু মহারাজের ভক্তি ও নির্ভরতা ছিল অপার। শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা গ্রন্থে গ্রন্থকার স্বামী গম্ভীরানন্দ এই বিষয়ে লিখছেন--“১৯০৭ খ্রীষ্টাব্দের দুর্গা পূজার সময় শ্রীশ্রীমা জয়রামবাটী হইতে আসিয়া বলরাম মন্দিরে এক মাস ছিলেন। গাড়ী হইতে নামিয়া তিনি লাটুকে দেখিয়াই বলিলেন, বাবা লাটু কেমন আছ? লাটু অমনি উত্তর দিমি ভদ্দর ঘরের মেয়ে, সদর বাড়ীতে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ? আমাকে তো ডেকে পাঠালেই পারতে।

           “খেয়ালী সন্তানের ভব্যতা দেখিয়া মা হাসিতে হাসিতে উপরে চলিয়া গেলেন। কখন কখন অদ্ভুতানন্দ মায়ের সম্বন্ধে বেদান্ত বিচার করতেন। মা জররামবাটী ফিরিবেন। লাটু মনের বিষাদ চাপিবার জন্যই বোধহয় নিজের ঘরে দ্রুত পদচারণা করিতে  করিতে উচ্চৈঃস্বরে বেদান্ত বিচার করিতে লাগিলেন,-- সন্ন্যাসীর কে পিতা, কে মাতা? সন্ন্যাসী নির্মায়া। মাতাঠাকুরাণী নীচে নামিয়া আসিয়া উহা শুনিলেন এবং দ্বারপ্রান্তে আসিয়া বলিলেন,‘বাবা লাটু, তোমায় আমাকে মেনে কাজ নেই বাবা।’ আর যায় কোথায়? স্নেহের স্পর্শে বেদান্ত ভাসিয়া গেল-- লাটু মায়ের পদতলে লুটাইয়া কাঁদিতে লাগিলেন, মাও তখন অশ্রুসিক্তা। মায়ের চক্ষে জল দেখিয়া লাটু আবার তাঁহাকে প্রবোধ দিতে লাগিলেন। বাপের ঘরে যাচ্ছ মা, কাঁদতে কি আছে? ইহা বলিয়া স্বীয় উত্তরীয়ে মায়ের অশ্রুমোচন করিলেন। মায়ের সম্বন্ধে লাটু মহারাজ একদিন অন্তরের কথা প্রকাশ করিয়া বলিয়াছিলেন--‘মাকে মানা কি সহজ কথা রে? তিনি যে স্বয়ং লক্ষ্মী’।”

         ১৯১২ সালে লাটু মহারাজ কাশীতে চলে আসেন। পাঁচ বছর কাশীর বিভিন্ন স্থানে থাকার পর ৯৬ নং হাড়ারবাগের ভাড়া বাড়িতে উঠে যান এবং মহাসমাধি পর্যন্ত ওখানেই অবস্থান করেন। শেষ বয়সে তাঁর বহুমূত্র রোগ হয় এবং তার ফলে শরীরে কয়েকটি বিষাক্ত ক্ষত হয়। এতে ভুগেই ১৯২০ সালের ২৪ এপ্রিল তিনি দেহত্যাগ করেন। তাঁর পূতদেহ মণিকর্নিকায় জলসমাধি দেওয়া হয়। গুরুভাই স্বামী তুরীয়ানন্দজী তাঁর শেষ শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত ছিলেন। লাটু মহারাজের দেহত্যাগের পর তিনি একটি পত্রে লিখেছিলেন--“ যাহারা চরমকালে লাটু মহারাজের পরমানন্দ মূর্তি দেখিয়াছে তাহাদের সকলের মনেই এক মহা আধ্যাত্মিক সত্যের ভার দৃঢ়রূপে অঙ্কিত হইয়াছে। ধন্য গুরু মহারাজ, ধন্য তাঁহার লাটু মহারাজ।”  

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇





   

Post a Comment

0 Comments