জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা- ৩/প্রীতম সেনগুপ্ত


শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

পর্ব -৩

প্রীতম সেনগুপ্ত


ঠাকুরের কথা শুনে মনের ভিতর তোলপাড় শুরু হল লালটুর। কে এই মহামানব? যাঁর কথায় এত জাদু, এত টান! লালটু ভেসে গেল। এই সময়ই শুরু হয়ে গেল তাঁর গোপন সাধক জীবন। তখন প্রায়ই দেখা যেত সে দুপুরবেলায় একখানা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে, মাঝে মাঝে চোখ দুটো জলে ভিজে যেত। তখন বাঁ হাতে তা মুছে ফেলত। কার জন্য বা কীজন্য ছিল তাঁর এই অশ্রুবর্ষণ! সুস্পষ্ট কোনও সিদ্ধান্তে আসা যায় না। পিতৃব্যের জন্য মন খারাপ হয়েছে এই অনুমানে দত্ত-গৃহিনী তাঁকে নানা সান্ত্বনা প্রদান করতেন। লালটু কিছু বলত না, নীরব থাকত। যে মানস সাধনা লালটু শুরু করেছিল তার থেকে অনিবার্যভাবে জন্ম নিল ব্যাকুলতা। মানসিকভাবে চঞ্চল হয়ে পড়ল।

   শ্রীরামকৃষ্ণদেবের বলা নানা গল্প, ভাবব্যঞ্জক কথা শুনে তাঁকে দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জন্ম নিল। একদিন সাহসে ভর করে মনিব রামচন্দ্রকে মরিয়া হয়ে বলেই ফেলল , “আপুনি আজ উখানকে যাবেন; হামায় লিয়ে চলুন। হামি আপুনাদের পরমহংসকে দেখবে। তাঁকে দেখাবেন?” মনিব রামচন্দ্রের কাছে লালটুর এই আবদার অন্যায় মনে হয়নি, সেই রবিবারই তিনি লালটুকে সঙ্গে নিয়ে দক্ষিণেশ্বরে গেলেন। আর তার পরের পর্বে লালটুকে নিয়ে যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণের অবিশ্বাস্য, অলৌকিক ঈশ্বরীয় লীলার সাক্ষী থাকল এই কলকাতা শহর। লালটু (পরবর্তী সময়ে যিনি লাটু মহারাজ, স্বামী অদ্ভুতানন্দ, শ্রীরামকৃষ্ণ পার্ষদ, অন্তরঙ্গ, শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক) তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে এসে পৌঁছলো। শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর এই প্রথম সাক্ষাতের যে বর্ণনা আমরা পাই তা ভারী সুন্দর। তার আগে একটা কথা উল্লেখ করি, ঠিক কত সালে লালটু শ্রীরামকৃষ্ণের সন্নিধানে উপস্থিত হয় তা নিয়ে নানা মত রয়েছে। ১৮৭৯, ১৮৮০ নাকি ১৮৮১! কিন্তু এই বিতর্ক নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আমরা চলে আসি সেই দিনটির কথায়। যে দিনটির বিষয়ে চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায় লিখছেন-- “...ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র রামলাল চট্টোপাধ্যায়ের নিকট হইতে যাহা শুনিয়াছি, প্রথমে তাহাই আপনাদের নিকট পরিবেশন করিতেছিঃ ‘একদিন দেখি রামবাবু সঙ্গে করে এক ছোঁড়া-চাকর এনেছেন। ছোঁড়াটা দেখতে বেঁটেখেটে জোয়ান বলেই মনে হোল। তখন আমি তাঁর নাম জানতেম না। এই যে পশ্চিমের বারাণ্ডা দেখছো, এইখানে ছোঁড়া-চাকরটা দাঁড়িয়েছিলো, তখন ঘরের ভিতর রামবাবু ঠাকুরের অনুসন্ধানে গিয়েছিলেন। ঠাকুর তখন বাহিরে ছিলেন। রাধিকার কীর্তন গাহিতে গাহিতে উপস্থিত হইলেন-- ‘তখন আমি দুয়ারে দাঁড়ায়ে’ , তাহাতে আখর দিতেছিলেন, ‘কথা কইতে পেলুম না’, ‘আমার বধূর সনে কথা হোলো না’, ‘দাদা বলাই ছিল সাথে, তাই কথা হোল না' ইত্যাদি। বারাণ্ডায় ঠাকুরের সঙ্গে লাটুর দেখা হয়, সেই সময় রামবাবুও ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। ঠাকুর রাম বাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন--‘এ ছেলেটাকে বুঝি তুমি সঙ্গে করে নিয়ে এনেছো? রাম! একে কোথা পেলে? এর যে সাধুর লক্ষণ দেখছি।’ এই কথা বলিতে বলিতে রাম বাবু ও পরমহংসদেব ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেন। লাটু তখনো সেখানে দাঁড়িয়ে রইল; আমি বললুম-- যাও না ভেতরে। আমার কথা শুনে বালক ঘরের মধ্যে যাবে কি-না ভাবতে লাগলো। ঠাকুর তাকে ঘরের মধ্যে ডেকে নিলেন। আমি আর ঘরের মধ্যে যাই নি।’

      ঘরের মধ্যে কি কথা হইয়াছিল তাহা জানিবার সৌভাগ্য ঘটিয়াছিল স্বয়ং রামবাবুর নিকট হইতে। ঠাকুরের অলৌকিক শক্তির সম্বন্দ্ধে বলিতে বলিতে তিনি লালটুর প্রসঙ্গ তুলিয়া যাহা বলিয়াছিলেন, এক্ষণে তাহাই আপনাদের জানাইতেছিঃ

    ‘আমাকে এক বেশভূষাহীন সাধুর পায়ে প্রণাম করতে দেখে লেটোটা কি ভাবলে জানি না। আমার পরই দেখি সে ঠাকুরের পায়ে ধরে প্রণাম করতে আরম্ভ করে দিয়েছে। ঠাকুর আমার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা আরম্ভ করে দিলেন, ততক্ষণে দেখি লেটোটা চুপ কোরে হাতজোড় কোরে ওনার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের কথাগুলো শুনছে। আর ঠাকুর মাঝে মাঝে তার দিকে চেয়ে হাসছেন আর বলছেন--‘বোসনারে বোস্’। এমন সময় আমাদের কথার মধ্যে এসে গেলো--সিদ্ধ ও নিত্যসিদ্ধের কথা। ঠাকুর বললেন--‘যারা নিত্যসিদ্ধ তাদের জন্মে জন্মে জ্ঞানচৈতন্য হোয়েই রয়েছে। তারা যেন পাথরচাপা ফোঁয়ারা। মিস্ত্রী এখান-সেখান ওস্কাতে ওস্কাতে যেই এক জায়গায় চাপটা সরিয়ে দেয়, অমনি ফোঁয়ারার মুখ থেকে ফর্ ফর্ করে জল বেরুতে থাকে।‘ এই কথা কয়টি বলিয়া ঠাকুর সহসা লালটুকে ছুঁয়ে দিলেন। ঠাকুরের স্পর্শে লেটোর ভাব যেন উথলে উঠলো। তার হুঁশটুশ সব চলে গেল-- মনে হোলো সে কোন অজ্ঞাত রাজ্যে বাস করছে। সহসা তার লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠলো, কন্ঠস্বর গদগদ হোয়ে পড়লো, দরদরধারে অশ্রু পড়তে লাগলো! ঠাকুরের স্পর্শে লেটোর এমন ভাববিহ্বল অবস্থা দেখে আমার ভারী আশ্চর্য ঠেকলো। লেটোকে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদতে দেখলাম। এক ঘন্টার বেশী হোয়ে গেলো, তবু কান্না থামল না। শেষে বাধ্য হোয়ে ঠাকুরকে অনুরোধ কোরে বসলুম--‘ তাতো বুঝলুম। এখন এই ছেলেটা কি সারাক্ষণ কাঁদতে থাকবে?’ আমার কথায় ঠাকুর পুনরায় লালটুকে ছুঁয়ে দিলেন। দেখতে দেখতে লালটুর ফোঁপানি কমে গেল। তবু তোমরা ঠাকুরের অলৌকিকত্বে বিশ্বাস করবে না! ঠাকুর যে অবতার একথা তবু মানতে চাইবে না!” (শ্রীশ্রী লাটু মহারাজের স্মৃতিকথা, শ্রী চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায়)

      

 শ্রীরামকৃষ্ণ প্রথম দর্শনেই বুঝে নিয়েছিলেন লালটুর পবিত্র আধার সাধুর প্রকট লক্ষণযুক্ত। তার চেয়েও বড় কথা যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ চিনে নিয়েছিলেন তাঁর অন্তরঙ্গকে, লীলাসঙ্গীকে। স্পর্শমাত্রেই আধ্যাত্মিকতা সঞ্চার করতেন। লালটুর ক্ষেত্রেও কালবিলম্ব না করে তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত করেন বিপুল আধ্যাত্মিক শক্তি, যা অলৌকিক এক ঘটনা ঘটালো সময়ের সঙ্গে। রামচন্দ্র দত্তের গৃহভৃত্য থেকে ক্রমে রূপান্তরিত হলেন রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক স্বামী অদ্ভুতানন্দে। যথার্থভাবেই miracle। এমন অত্যদ্ভুত ঘটনার কথা মাথায় রেখেই স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর সন্ন্যাস নাম রাখেন স্বামী অদ্ভুতানন্দ। “চিরদিনই লাটুর অদ্ভুত চরিত্র,অদ্ভুত ভাব, ধ্যানধারণায় অদ্ভুত অনুরাগ ও আন্যান্য অদ্ভুত আচরণ স্মরণ করিয়া স্বামীজী তাহাকে অদ্ভুতানন্দ নামে অভিহিত করেন।” (স্বামী সারদানন্দ লিখিত। ‘সৎকথা’র ভূমিকা থেকে উদ্ধৃত)

          শ্রীরামকৃষ্ণ সাক্ষাতের প্রথম দিনেই লালটুর মনিব ভক্ত রামচন্দ্রকে বলে দিলেন, “ওরে!  ইখানে ওকে মাঝে মাঝে পাঠাবি।” আর লালটুকে বলেছিলেন--“ ওরে! আসিস্, এখানে মাঝে মাঝে আসবি। জানিস।” লালটু এসেছিল, চিরকালের জন্যই। কেননা শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর জীবনের ধ্রুবতারা হয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণময় ছিল তাঁর জীবন। নাহলে ইতিহাসের পাতায় স্বামী অদ্ভুতানন্দ নামে এক পরম ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষকে আমরা পেতাম না। সাধুসন্তের দেশ এই ভারতবর্ষে তিনি যথার্থই ছিলেন এক ভারতের সাধক। তাঁর মহিমময় জীবন কীর্তনে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের ষষ্ঠ সঙ্ঘাধ্যক্ষ স্বামী বিরজানন্দ লিখেছেন--“স্বামীজী-প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামকৃষ্ণ-সঙ্ঘকে তিনি প্রাণের সহিত ভালোবাসিলেও এবং তাঁহার জ্ঞান-বৈরাগ্য-প্রেমদীপ্ত দিব্যচরিত্র এই সঙ্ঘের সাধু ও ভক্তগণের আধ্যাত্মিক জীবন পরিপুষ্ট করিতে বহুভাবে সহায়তা করিলেও সাক্ষাৎভাবে তিনি বিবেকানন্দ-প্রবর্তিত সেবাব্রতে কখনও যোগদান করেন নাই। রজস্তমোবিরহিত শুদ্ধ ভগবদভজন লইয়া আপনভাবে সমগ্র জীবন কাটাইয়া গেলেন। বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠিত হইবার পর গুরুভ্রাতৃগণের বহু পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও তথায় রাত্রিবাস করিতে তিনি কখনও স্বীকৃত হইতেন না। বলিতেন--‘হামরা সাধু, হামাদের আবার জমি, বাড়ী, বাগান, ঐশ্বর্য এসব কি? বাবা! এসব বৈভবের ভিতর হামি থাকবে না।‘ ইহাই তাঁহার নিজস্ব স্বতন্ত্র ভাব ছিল-- যেমন অপরাপর শ্রীরামকৃষ্ণ-শিষ্যগণেরও প্রত্যেকের মধ্যে অন্যান্য এক একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষিত হয় সেইরূপ। এক একজন পার্ষদকে অবলম্বন করিয়া অনন্তভাবময় শ্রীশ্রীঠাকুরের এক একটি ভাব বিশেষভাবে স্ফুরিত হইয়াছে, কিন্তু তবুও সব ভাবগুলির ভিতর একটা নিবিড় সামঞ্জস্য ও একতানতা আছে।” (শ্রীশ্রী লাটু মহারাজের স্মৃতিকথা, শ্রী চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায়)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments