জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা /পর্ব ৫/প্রীতম সেনগুপ্ত

আঁটপুরে রাধারমণ জীউর মন্দির


শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

পর্ব ৫

প্রীতম সেনগুপ্ত    

স্বামী প্রেমানন্দ

                                                                                শ্রীরামকৃষ্ণের যে পাঁচজন ঈশ্বরকোটি সন্ন্যাসী সন্তান ছিলেন তাঁদের অন্যতম হলেন স্বামী প্রেমানন্দ। হুগলি জেলার আঁটপুর গ্রামে এক নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব বংশে ১২৬৮ সালের ২৬ অগ্রহায়ণ (১৮৬১ সালের ১০ ডিসেম্বর) মঙ্গলবার রাত্রি ১১ টা ৫৫ মিনিটে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পূর্বাশ্রমের নাম বাবুরাম ঘোষ। পিতা শ্রী তারাপ্রসন্ন ঘোষ ও মাতা শ্রীমতী মাতঙ্গিনী দেবী। রত্নগর্ভা মাতঙ্গিনী দেবীর চার সন্তান ছিল। এক কন্যা কৃষ্ণভাবিনী ও তিন পুত্র-- তুলসীরাম, বাবুরাম ও শান্তিরাম। কন্যা কৃষ্ণভাবিনী অসামান্যরূপগুণশালিনী ছিলেন। আঁটপুরের পার্শ্ববর্তী তড়া গ্রামের শ্রী বলরাম বসুর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। বলরাম বসু ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক গৃহী পার্ষদ। অন্তরঙ্গ জন। রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনের ইতিহাসে তিনি চিরস্মরণীয় এক ব্যক্তিত্ব।

    একজন ঈশ্বরকোটি পুরুষ রূপে প্রেমানন্দজী তথা বাবুরাম মহারাজের পরিচয় জ্ঞাপন করা হয়েছে এইভাবে-- “শ্রীমতী রাধারাণীর অংশে বাবুরাম মহারাজের জন্ম, তিনি নিত্যসিদ্ধ ঈশ্বরকোটি-- একথা ঠাকুরের পার্ষদরা তাঁহার শ্রীমুখে শুনিয়াছেন। ‘ও রত্নপেটিকা’ এই একটিমাত্র কথার দ্বারা শ্রীবাবুরাম যে শ্রীরাধার সখীস্বরূপ ও শ্রীকৃষ্ণে মধুররতিসম্পন্ন, ইহাই প্রতীত হইতেছে। শ্রীরূপ গোস্বামি-কৃত ‘উজ্জ্বলনীলমণিঃ’ গ্রন্থের সখী-প্রকরণে বলা হইয়াছে-- প্রেমলীলাবিহারানং সম্যগ্বিস্তারিকা সখী, বিশ্রম্ভরত্নপেটী চ। অতি নিগূঢ় মাধুর্যপ্রেমের যত বিচিত্র লীলাবিলাস, যত বিচিত্র সম্ভোগ, মহাভাবে তাহা পরাকাষ্ঠা প্রাপ্ত হয়, এবং নর্মসখীরূপ বিশ্বস্ত আধারে ন্যস্ত হইয়া আস্বাদনের চরমোৎকর্ষ লাভ করে। সখ্যঃ শ্রীরাধিকায়া ব্রজকুমুদবিধোর্হ্লাদিনী-নাম-শক্তেঃ। সারাংশপ্রেমবল্ল্যঃ কিশলয়দলপুষ্পাদিতুল্যাঃ স্বতুল্যাঃ।। -- শ্রীশ্রীগোবিন্দলীলামৃত ১০/১৬। শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তির সারাংশকে প্রেম বলে। শ্রীরাধা সেই প্রেমের ঘনীভূত প্রতিমা, আর তাঁহার সখীরা সেই প্রেমেরই অংশভূতা। সখীরা যেন শ্রীরাধারূপ প্রেমলতিকার পত্রপুষ্পাদিতুল্য, সুতরাং তাহা হইতে অভিন্ন। কৃষ্ণলীলামৃতরসে সিক্ত হইয়া লতিকায় যখন উল্লাস ঘটে, পত্রপুষ্পাদিতে সেই উল্লাস স্বতই ব্যাপ্ত হইয়া পড়ে। মহাভাবে বিভাবিত শ্রীরামকৃষ্ণকে বাবুরাম ধরিয়া রহিতেন, স্পর্শের দ্বারা সেই মহাভাবের উল্লাস বাবুরামেও সঞ্চারিত হইত, এবং এইরূপে ইহার আবেগ হ্রাসপ্রাপ্ত হইয়া ঠাকুর ক্রমশঃ সহজ অবস্থায় ফিরিয়া আসিতেন। মনে হয়, এই অন্তরঙ্গতার জন্য ঠাকুর তাঁহাকে দরদী বলিতেন, ... ঠাকুরের কথার প্রতিধ্বনি করিয়া শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণীও বলিয়াছেন, ‘বাবুরাম আমার প্রাণের জিনিস ছিল।’

 শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথিতে আছে--

   সুন্দর গড়ন, হাসি সর্বদা বয়ানে। / কৃষ্ণপদে রতিমতি অতুল ভুবনে।। / স্বভাবসুলভ কিবা  আঁখি ঠেরে কথা। / পশ্চাতে সময় পাবে তাঁহার বারতা।। /... ... বাবুরাম নাম তাঁর। / কৃপায় যাঁহার হয় ভক্তির সঞ্চার।।“ (প্রেমানন্দ-প্রেমকথা, ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য)

    ঠাকুর তাঁর পরমপ্রিয় অন্তরঙ্গ বাবুরাম সম্পর্কে বলেছেন-- ‘ও নৈকষ্য কুলীন, হাড় পর্যন্ত শুদ্ধ।’ পরবর্তী সময়ে বাবুরাম মহারাজের জীবনে ঠাকুরের কথার সত্যতা উদ্ভাসিত হয়। তাঁর অপার পবিত্রতার সাক্ষ্য হিসেবে এই ঘটনাটি উল্লেখ করা প্রয়োজন। এর থেকে ধারণা পাওয়া যায় সম্যকরূপে। ঘটনাটি এইরকম-- “বেলুড় মঠে আসিয়া একদিন এক যুবক স্বামী শিবানন্দ ( মহাপুরুষ) মহারাজের কাছে নিজের অতীত জীবনের দুষ্কৃতির কথা বলিতে থাকে। দয়াপরবশ হইয়া তিনিও শুনিয়া যাইতে থাকেন। বাবুরাম মহারাজ কাছে দাঁড়াইয়া ছিলেন, খানিকটা শুনিয়াই বলিয়া উঠিলেন-- এসব কী কথা এ বলচে? এসব কী? মহাপুরুষ প্রশ্ন করিলেন, তুমি কি এর কোন কথাই বুঝতে পার নি? বাবুরাম উত্তর দিলেন, না। তাঁহার পা হইতে মাথা পর্যন্ত নিরীক্ষণ করিয়া মহাপুরুষ কহিলেন, আজ বুঝতে পারলুম ঠাকুর কেন তোমায় হাড়শুদ্ধ বলতেন!” (প্রেমানন্দ-প্রেমকথা, ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য)

   শ্রীম কথিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত অনুসরণ করে দেখা যায়-- “ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে বৈকাল বেলা নিজের ঘরে পশ্চিমের বারান্দায় কথা কহিতেছেন। সঙ্গে বাবুরাম, মাস্টার, রামদয়াল প্রভৃতি। ডিসেম্বর,১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দ। বাবুরাম, রামদয়াল ও মাস্টার আজ রাত্রে থাকিবেন। শীতের (বড়দিনের) ছুটি হইয়াছে। মাস্টার আগামীকল্যও থাকিবেন। বাবুরাম নূতন নূতন আসিতেছেন। ...সন্ধ্যার পরে ঠাকুরবাড়িতে আরতি হইতে লাগিল। ঘরে ছোট খাটটিতে বসিয়া ঠাকুর ঈশ্বরচিন্তা করিতেছেন। ক্রমে ভাবাবিষ্ট হইলেন। ভাব উপশমের পর বলিতেছেন, ‘মা ওকেও টেনে নাও। ও অত দীনভাবে থাকে। তোমার কাছে আসা যাওয়া করছে।’

      ঠাকুর বাবুরামের কথা কি বলিতেছেন? বাবুরাম, মাস্টার, রামদয়াল প্রভৃতি বসিয়া আছেন। রাত্রি ৮ টা-৯ টা হইবে। ঠাকুর সমাধিতত্ত্ব বলিতেছেন। জড়সমাধি, চেতনসমাধি, স্থিতসমাধি, উন্মনাসমাধি। সুখ-দুঃখের কথা হইতেছে। ঈশ্বর এত দুঃখ কেন করেছেন?

    ...শ্রীরামকৃষ্ণ-- ঈশ্বরের কার্য কি বুঝা যায়, তিনি কি উদ্দেশ্যে কি করেন? তিনি সৃষ্টি,পালন, সংহার সবই করছেন। তিনি কেন সংহার করছেন আমরা কি বুঝতে পারি? আমি বলি, মা, আমার বোঝবারও দরকার নাই, তোমার পাদপদ্মে ভক্তি দিও। মানুষ জীবনের উদ্দেশ্য এই ভক্তিলাভ। আর সব মা জানেন। বাগানে আম খেতে এসেছি; কত গাছ, কত ডাল, কত কোটি পাতা-- এসব বসে হিসাব করবার আমার কি দরকার! আমি আম খাই, গাছপাতার হিসাবে আমার দরকার নাই।

        ঠাকুরের ঘরের মেঝেতে আজ রাত্রে বাবুরাম, মাস্টার ও রামদয়াল শয়ন করিলেন।

       গভীর রাত্রি, ২টা- ৩টা হইবে। ঠাকুরের ঘরে আলো নিভিয়া গিয়াছে। তিনি নিজে বিছানায় বসিয়া ভক্তদের সহিত মাঝে মাঝে কথা কহিতেছেন।...

       পরদিন বাবুরাম, রামদয়াল বাড়ি ফিরিয়া গেলেন। মাস্টার সেইদিনও রাত্রি ঠাকুরের সঙ্গে অতিবাহিত করিলেন। সেদিন তিনি ঠাকুরবাড়িতেই প্রসাদ পাইলেন।” (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, শ্রীম-কথিত, উদ্বোধন কার্যালয়)

     

বাবুরাম মহারাজ

  

  শ্রীরামকৃষ্ণ সন্নিধান বাবুরামের জীবনে আরও ঘনীভূত রূপ নিল। কিন্তু কীভাবে তিনি  শ্রীমকৃষ্ণের সংস্পর্শে এলেন সেই আলোচনায় কিঞ্চিৎ মনোনিবেশ করা যেতে পারে। আঁটপুরের ঘোষ পরিবার তাঁদের কুলদেবতা লক্ষ্মীনারায়ণ জীউর সেবায় একনিষ্ঠ ছিল। এই ধর্মপরায়ণ পরিবারের পবিত্র আবহাওয়ায় বাবুরাম শৈশব ও বাল্যের কিছু সময় অতিবাহিত করে কলকাতায় চলে আসেন। উদ্দেশ্য উচ্চতর শিক্ষালাভ। কলকাতায় এসে চোরবাগানে খুল্লতাত শ্রীযুক্ত গুরুচরণ ঘোষের বাড়িতে অবস্থান করতে থাকেন। এরপর স্থানান্তরিত হয়ে কম্বুলিটোলায় বসবাস করতে শুরু করেন। তিনি প্রথমে এরিয়ান স্কুলে এবং পরে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের শ্যামপুকুর শাখায় ভর্তি হন। কথামৃতকার শ্রীম অর্থাৎ শ্রী মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত মহাশয় সেই সময়ে  ছিলেন এই মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক। যিনি মাস্টারমশাই নামে অধিক পরিচিত। শ্রীরামকৃষ্ণ চরণে জীবন সঁপেছিলেন তিনি। অনেক সময় স্কুলের ছাত্রদের কাছেও শ্রীরামকৃষ্ণের কথা বলতেন। এইসব ছাত্রদের মধ্যে ভক্তিমান যারা, তাদের অনেককে দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে উপস্থিত করতেন। বাবুরাম এইভাবেই তাঁর সঙ্গে একদিন দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম দর্শন লাভ করেন। এই প্রথম দেখার সময়কাল খুব সম্ভবত ছিল ১৮৮২ সালের শেষভাগ। প্রথম দর্শনেই বাবুরামকে দেখে ঠাকুরের চিনে নিতে বিলম্ব হল না যে মা যাঁদের ঈশ্বরকোটি বলে চিহ্নিত করেছেন ইনি তাঁদেরই একজন। এই প্রথম দেখার তিন চারদিন পরেই ঠাকুরের ভক্ত রামদয়াল চক্রবর্তীর সঙ্গে বাগবাজারে দেখা হল বাবুরামের। তিনি বাবুরামকে জানালেন, ঠাকুর তাঁকে ডেকেছেন। এই ডাক ক্রমশই পরিণত হল অলৌকিক ভালোবাসার সম্পর্কে। আচার্য স্বামী বিবেকানন্দ পরবর্তী সময়ে ঠাকুরের বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন সেই প্রেমের কথা। বলেছিলেন-- LOVE personified. আর নরেন্দ্রনাথের প্রতি ঠাকুরের অপার্থিব ভালোবাসার কিঞ্চিৎ আভাস পেয়েছিলেন বাবুরাম দক্ষিণেশ্বরে গমনান্তে।


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments