জ্বলদর্চি

এমনও হয়/ মিলন পুরকাইত

এমনও হয় 

 মিলন পুরকাইত 


অপর্নার মাধ্যমিক পরীক্ষা। সেই সময় দু মাসের ব্যবধানে মা বাবা দুজনেই মারা যায় হঠাৎই। 

মা ভুগছিলো বেশ কয়েক বছর ধরে। গায়নো সমস্যা। অধিক রক্তপাতে রক্তাল্পতায় ভুগছিলো । 

রান্না করতে করতে কতবার যে মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। বাবা অফিস যাওয়ার আগে অনেকটাই করে যেতো। যাতে মেয়েকে না করতে হয়। 

অপর্না স্কুল যাবার আগে নিজে খাবার নিয়ে খেয়ে মায়েরটা টেবিলে রেখে ঝুড়ি চাপা দিয়ে যেতো। 

মায়ের ওঠানামা করাও নিষেধ। কিন্তু প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি বাবার কত আর মাইনে। আয়া রাখার সামর্থ কোথায়। তাই ওরা দুজনে সব কাজ করে ফেলতো। বেরোবার আগে বাবা ওর মাকে স্নান করতে বাথরুম নিয়ে যেতো ধরে ধরে। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতো যতক্ষণ না মায়ের হয়। 

একটা কমোড চেয়ার কিনেছে বাবা। ওরা যখন থাকতো না মা ওটাতেই সারতো। 

ঘর থেকে বেরোতে পইপই করে ওরা বারন করে যেতো। 

খুব চিন্তায় থাকতো মেয়ে বাবা দুজনেই যতক্ষণ মা একা থাকতো। 

কিন্তু সেই ভয়টাই সত্যি হোলো একদিন। 

সেদিন সকাল থেকেই মায়ের পেটখারাপ ছিল। অপর্নার পরীক্ষা চলছিল। আর বাবার অফিসে সেদিন জরুরি কাজ ছিলো। তবুও বাবা যাবেনাই বলে।  চাকরি নিয়ে টানাটানি যদি হয় সেই ভেবে মা জোর করেই বাবাকে পাঠায়। 

সেদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে এসে দেখে অপর্না বাথরুম থেকে রক্তের ধারা। 

ভয়ে হাত পা কাঁপে মেয়েটার। ওর চিৎকার শুনে পাশের বাড়ির নুপুর পিসিরা আসে। এসে দেখে মা আর নেই। 

বাবা ভেঙে পড়ে খুব। তবুও চলছিল ঠিকঠাক সব। ঠিক দু মাস পরে, অপর্না তখন বাড়িতে। সন্ধ্যা হয় হয়। বাবার অফিসের লোকেরা সবাই গাড়ি করে বাবাকে ফুল দিয়ে সাজিয়ে আনলো। 
হার্টফেল করে বাবাও ছেড়ে চলে গেলো। ওকে একা করে দিয়ে। 

কাঁদতে ভুলে গেছিলো সেদিন ওইটুকু মেয়েটা। 

অফিসের সকলে ওর বাবার পাওনা যেটুকু টাকা ছিলো সব ওকে পেতে খুব সাহায্য করে। 

ভাগ্যক্রমে বাড়িটা  পৈত্রিক ।তাই বাঁচোয়া। 

পাশাপাশি তিনটে ঘর ছিল। 

পাশের বাড়ির নুপুর পিসি, বাবলুকাকুরা  বললো
নিজের জন্য একটা ঘর রেখে বাকী দুটো ভাড়া দিতে। 

তাহলে রাতবিরেতে একা থাকতেও হবে না আবার পয়সাও আসবে। অপর্না উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়। টুকটাক টিউশন করে। ওর পড়াশোনা খাওয়া চলে যায়। 

নতুন যে ভাড়াটেরা এলো তাদের সাথে দিব্যি ভাব হয়ে গেছে ওর সাথে। মিনু কাকীমা, হরিকাকু
আর ওদের মেয়ে মিষ্টি। 

মিষ্টিকে ও নিজের বোনের মতো ভালোবাসে। 

"আমাদের সাথেই খেয়ে নাওনা। আমাদের তিনজনের রান্না থেকেই হয়ে যাবে তোমার। ভারী তো খাও ভাত। ও তোমাকে আর একার জন্য রান্না করতে হবেনা। কাকীমাও তো মা নাকী।" 
"মিনুকাকীমা অনেকবার বলেছে। 

অপর্না একটু চালে ডালে ফুটিয়েই নেয়। মায়ের অসুস্থতার জন্য কিছু কাজ তো জানতোই। বাবা রান্না করতে না দিলেও ও পারে কাজ চালাতে। 

"তুই তো আমার বড় মেয়ে রে। জানিস, আমার বড়টা বেঁচে থাকলে ঠিক তোর বয়সী হোতো।" 

একদিন মা বাবার ফটোর সামনে অপর্না কাঁদছিলো। সেই সময় কোনোও কারনে মিনুকাকীমা এসেছিল ওর ঘরে। 

তারপর ওর কোন কথা শোনেনি ওরা। ঠিক, মাছের অথবা মাংসের বাটি খাবার সময় পাতের ধারে রাখতো মিনুকাকীমা। 

" দিদি দিদি, একবার এসো না আমাদের ঘরে। মায়ের খুব পেটে ব্যাথা করছে" 

সবে মাত্র স্কুল থেকে ফিরে এসে হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসতে যাচ্ছে মিষ্টি এলো হাঁপাতে হাঁপাতে । 

এই সময় বাবলুকাকু থাকেনা। অফিস থেকে ফিরতে সন্ধ্যা। 

এক দৌড়ে আসে মিষ্টির সাথে। ব্যাথাতে নীল হয়ে গেছে মিনুকাকীমার মুখটা। 

ফর্সা মুখটা কালীবর্ন যেন। তাড়াতাড়ি গাড়ি ডেকে কাছাকাছি নার্সিংহোমে নিয়ে যায় অপর্না। মিষ্টিকে নুপুর পিসির বাড়িতে রেখে আসে। সারা রাস্তা ব্যাথাতে ছটফট করে মিনুকাকীমা। 

ফোন করতে বাবলুকাকু এসে যায় নার্সিংহোমে। 

ডাক্তার বলে এক্ষুনি অপারেশন করতে হবে। ইউটেরাসের টিউমার থেকেই সমস্যা। অনেকদিনের সমস্যা ছিল। অপর্না জানতোই না। খুব চাপা  মিনুকাকীমা। বাবলুকাকুও জানতো না এতোটা সিরিয়াস। 

ডাক্তার বলে ব্লাড লাগবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। 

তখন কোথায় পাবে আর কেই বা ব্যবস্থা করবে। 
অপর্না ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে জানে মিনুকাকীমার ব্লাড গ্রুপের সাথে ওর মিল। 

এক মূহুর্ত চিন্তা না করে ওই ব্লাড দেয়। 

মা হারা মেয়েটা মিনুকাকীমার মধ্যে নিজের মা কে পেয়েছে যেন। 

বাবলুকাকু অপর্নার মাথায় হাত রাখে। বাবার ছোঁয়া পায় যেন। 

মিনুর প্রাণ সংশয় কাটে। বাড়িতে ফেরার পর অপর্না নিজের স্কুল আর মিনু কাকীমার সংসার দুইই সামলায় । 

কিছুতেই ওরা তারপর অপর্নাকে আলাদা থাকতে দেয় না। 

মাঝে কেটে গেছে কুড়িটা বছর। 

আজ সবাই এক জায়গায় হযেছে। মিনু কাকীমার বাড়িতে । দূর্গাপূজার অষ্টমীর দিনটাতে ওরা একসাথে হবেই। 

অপর্নার একটা ছেলে। অর্ক। ওর বরের নাম সৌরভ। খুবই ভালো ছেলে। বাবলুকাকুর অফিসে ওর কাকা চাকরি করতো। সেখান থেকেই সমন্ধ। 

বাবা মায়ের মতোই বিয়ে দিয়েছে ওরা। মিষ্টি তো অপর্নার বিয়ের পরদিন  শশুর বাড়ি চলে যাবার সময় কেঁদে কেঁদে বমিই করে ফেলেছিল। 

তবে সৌরভ প্রতি রবিবার অপর্নাকে বাপের বাড়ি নিয়ে আসতো। হই হুল্লোড় খাওয়া দাওয়া মিষ্টির সাথে মজা করা সবকিছুতেই সৌরভ মন জয় করে ওদের। বাবা মায়ের অভাব কোনওদিন বুঝতে দেয় নি ওরা। 

অর্কও দাদান দিদান মাসিমনি অন্ত প্রাণ। 

মিষ্টিরও এক ছেলে। ক্লাস সিক্সে পড়ে। দুই ভাই এ
যেমন ভাব তেমনি মারামারি। এদিকে একজন মামারবাড়ি এলে আর একজনকে আসতেই হবে। কোনো কারনে যদি ওদের কারোর মা বাবার অসুবিধার জন্য আসনে না পারে চিৎকার চ্যাচামেচি জুড়ে দেবে। 

না জানলে কেউ বলতেই পারবে না অপর্নার সাথে ওদের কোনো সম্পর্কই নেই। শুধুমাত্র মনের টানে ওরা এক। 

কেবল রক্তের সম্পর্কই মানুষকে আত্মীয়তার বন্ধনে বাঁধতে পারে না। মনের টান থেকেও অনেক আত্মীয়তার সূচনা হয়। সেই আত্মীয়তা নির্ভেজাল ভালোবাসা থেকে আসে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇




Post a Comment

0 Comments