তুর্কী নাচন
পর্ব -১
মলয় সরকার
চলেছে ছোট্ট লাক্সারী মিনি বাস, একটু বড় প্রাইভেট গাড়ী আর কি। গাড়ীতে বসে আছেন নানা দেশের মানুষ, বেশির ভাগই একটু বয়স্ক, তার মধ্যে আমরা কর্তা গিন্নীও আছি। মাঝে উড়ে বেড়াচ্ছে একটি ঝকঝকে প্রজাপতি। অল্পবয়সী, চঞ্চলা, প্রগলভা নয় অথচ সুন্দর চটপটে কথা বলা, সুন্দরী স্মিতাননা মেয়েটিকে প্রজাপতি ছাড়া আর কি-ই বা বলা যায়। গাড়ীর ভিতর প্যাসেজ দিয়ে এ মাথা থেকে ও মাথা প্রত্যেক যাত্রীর পাশে গিয়ে একেবারে অন্তরঙ্গের মত বা নিজের লোকের মত কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। সবাই বুঁদ হয়ে আছে ওর কথা বলার ঢং এ। একসঙ্গে ইতিহাস ভূগোল সাহিত্য সংস্কৃতি সব একেবারে গুলে খাইয়ে দিতে দিতে চলেছে। ফলে যাত্রার কোন ক্লান্তিই কারোকে স্পর্শ করছে না।বরং সবাই বেশ মজা করে শুনছে।
মেয়েটির নাম বলেছে রুইয়া। এর অর্থ নাকি গোলাপ। হ্যাঁ, সেই কামাল আতাতুর্কের তুর্কীস্থানের প্রস্ফূটিত গোলাপ।আর আমরা চলেছি রুক্ষ পাহাড় আর ধূ ধূ মরুভূমির মত পাথুরে রাস্তা দিয়ে তুরস্ককে চিনতে চিনতে।
উদ্যোগ পর্ব
মানুষ বোধ হয় জন্ম যাযাবর। মন একটু ফাঁকা হলেই আর একটু সুযোগ সুবিধা হলেই ” – উড়ে চলে দিক দিগন্তের পানে নিঃসীম শূন্যে–”।তাকে ঘর বাঁধতে হয় পাখীর মতই নিতান্ত প্রয়োজনের তাগিদেই। নাহলে সে বোধ হয় আজও ঘুরেই বেড়াত। তার মধ্যেই কিছু মানুষ কিছুতেই বাঁধা পড়তে চান না। আমরা সেই বাঁধা আর মুক্ত দু দলের মাঝামাঝি হয়ে আছি। ঘরেই থাকি, তবে সুযোগ খুঁজি সেই বাঁধন ছেঁড়ার। সেই তাগিদেই বেরিয়ে পড়ি বাইরে। খুঁজে দেখতে চাই বহুত্বের মাঝে সেই ‘পরম এক ‘কে, সেই পরম কেন্দ্রে পৌঁছাতে চায় মন। যে খোঁজার আগ্রহে বৈজ্ঞানিক ছুটে চলেছেন সৃষ্টির আদির সন্ধানে, ঋষি খুঁজেছেন সেই সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মকে , সাধারণ মানুষের ‘আমি’ও খুঁজে চলেছে তার ভিতরের ‘আমি’কে। এ জানার বোধ হয় শেষ নেই। তাই ‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না’। তবু এ খোঁজারও শেষ নেই। তাই আমাকে কেউ জিজ্ঞাসা করলেও হয়ত’ বলতে পারব না, কি দেখতে, কেন ঘুরে বেড়াই।মন টানে তাই যাই, আর মানুষ খুঁজে বেড়াই হয়ত। মানুষের নানা রূপ, প্রকৃতি, ধরণ সব কিছুর ভিতরের সত্যিকারের মানুষকেই হয়ত খুঁজি। এ খোঁজার শেষ নেই—
সালটা ২০১৩। হঠাৎই পরিকল্পনা হল ঘুরে আসি তুরস্ক, আর সঙ্গে জর্ডনটাও , অতিরিক্ত ফাঊ হিসাবে। সুযোগ যখন এসেই গেল, নেচে উঠেছিল মনটা। কতদিন কত রঙ্গীন স্বপ্ন দেখেছি, বসফরাসের ঘন নীল জলে সাঁতার কাটছি নীলাভ এক সন্ধ্যায়, কিংবা ঘুরে বেড়াচ্ছি সেই সব অতীত রোমান সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক ধ্বংসস্তূপের মাঝে হয়তো কোনো রোমান সুন্দরীর হাত ধরে, হাতড়ে বেড়াচ্ছি ইতিহাস।তার সঙ্গে একটা কথা ছেলেবেলায় খুব শুনেছি মা মাসির মুখে, ‘তুর্কী নাচন’। কথাটার উৎপত্তি আর আক্ষরিক অর্থ কি, সেটা জানারও ইচ্ছা।
আসলে বিদেশে বেড়াতে যাওয়ার জন্য আর্থিক ব্যাপার ছাড়াও বেশ কিছু অসুবিধা আছে, সেই জন্যই ইচ্ছা হলেই যে সব সময় সব দেশে যাওয়া যাবে তার কোন মানে নেই।বিশেষ করে সেই দেশের সঙ্গে নিজের দেশের বৈদেশিক সম্পর্ক কেমন বা গন্তব্য দেশের রাজনৈতিক, প্রাকৃতিক ইত্যাদি নানা পরিস্থিতি কেমন বা তা সেই সময় ভ্রমণের অনুকূল কি না এসমস্ত নানা ব্যাপার থাকে। সব ঠিক হলে তবে নিজের যাওয়ার অন্যান্য ব্যবস্থা করা।একটু বয়স হলে যাওয়ার আগে ডাক্তার দেখিয়ে নেওয়া দরকার যে সে দেশে যাওয়ার ধকল শরীর নেবে কি না।এই সব নানা ব্যাপার--
কোথাও গেলেই, সেই দেশের সম্বন্ধে কিছু পড়াশোনা করে নেওয়া আমার চিরকালের অভ্যাস। তাও আবার এত বিচিত্র এক ইতিহাস, প্রকৃতি সব কিছুর খনি যে দেশ সেই দেশ সম্বন্ধে কিছু তো জেনে নিতেই হয়। তবে এবারে সেই সুযোগটা হয়েছে কম, তাই তেমন করে পড়া হয় নি।আসলে, ছেলের কাছে গিয়েছিলাম আমেরিকায়। সেখানে সে-ই হঠাৎ করে প্রস্তাবটা দিল, যাও ঘুরে এস। সব সময় সময় হয় না। এখন ওখানে পরিস্থিতি ভাল। এর আগে একবার ইজিপ্ট আর একবার মেক্সিকো যাওয়ার সব ব্যবস্থা করেও নানা কারণে হয়ে ওঠে নি। তাই এ সুযোগ আর নষ্ট করতে চাইলাম না।যদিও তার আগে কিছুদিন পক্স হয়ে আমার স্ত্রী বুলবুল, বেশ দুর্বল ছিল। কিন্তু ও -ও তো একই পথের পথিক। নেচে উঠল। বলল, ঠিক পারব।আশা এবং সাহস পেলাম, যদিও ভয় ছিল যে, এই দুর্বল শরীর নিয়ে বিদেশ বিভুঁই গিয়ে কোন অসুবিধায় পড়ব না তো।
তাই কম পড়া হলেও স্বচক্ষে দেখেই জ্ঞান আহরণ করব, এই আনন্দেই মেতে উঠলাম।তবে এই ফাঁকে ওরহান পামুকের লেখা ‘ইস্তানবুল’ বইটা পড়ে নিয়েছিলাম। সেই দেশকে নিজের মত করে খুঁজে বের করার ইচ্ছাও ছিল।ইচ্ছা ছিল, তাঁর দেখার সঙ্গে নিজের দেখা মিলিয়ে নেওয়ার।
কাপাদোসিয়া পর্ব-১
আমরা সেদিন আমেরিকার ওয়াশিংটন ডি সি তে গিয়েছিলাম ঘুরতে।সেখানের ঘোরা শেষ করে ওখান থেকেই সোজা প্লেন ধরলাম তুরস্কের উদ্দেশ্যে।
আমরা দুজনে গিয়ে নামলাম কায়াসেরি এরকিলেট এয়ারপোর্টে। এটা সামরিক ও অসামরিক উভয়ের জন্যই ব্যবহার হয়।আমাদের, আসামের জোরহাট এয়ারপোর্টের মত আর কি! ছোট এয়ারপোর্ট। বাইরে বেরিয়ে দেখি, কাউকে দেখতে পাই না। একটু হতাশ হলাম। চিন্তা করছি, কি করব, এমন সময় দুজন বেশ ষণ্ডা মতন লোক এগিয়ে এল, হাতে একটা বোর্ড নিয়ে।ভয়ই পেয়েছিলাম ওদের দেখে। কি জানি, চেনা জানা নেই, অচেনা দুজন লোক এগিয়ে আসাতে ভয় পাওয়ার কথা বৈকি। খেয়াল করে দেখি ,ওদের হাতে বোর্ডে ইংরাজী অক্ষর ‘এম’ দিয়ে কিছু একটা লেখা আছে।তার অর্থ বুঝছি না।
লোকগুলো এগিয়ে এসে, যে টুর কোম্পানীর মাধ্যমে গেছি, তাদের নাম করল। ওদের উচ্চারণ তো, প্রথমে বুঝতেই পারি নি।শেষে কষ্ট করে বুঝলাম যখন, ধড়ে একটু প্রাণ এল।এরা বোধ হয় আমাকেই খুঁজছে। তখন ওরা বোর্ডএর লেখাটার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে যে উচ্চারণ করল, সেটা, সঠিক না হলেও, শুনে বোঝা গেল, আমার নামের কাছাকাছি কিছু। তুর্কীদের হাতে ইংরাজী লেখায় আর বলায়, আমার পিতৃদত্ত নামের যে এই দুর্দশা হয়েছে, সেটা আমি কি করে বুঝব।
সমস্ত মেসেজ পাঠানো হয়েছে, সেটা দেখে নামটা কপি করতেই যিনি এই দুর্দশা করেছেন, সেই পণ্ডিত প্রবরকে (?) মনে মনে উল্টোদিকে প্রণাম জানালাম। যাক, বুঝলাম, এরা আমাকে নিতে এসেছে।আমার নিয়ম হচ্ছে, যে কোন নতুন দেশে গেলে, এয়ারপোর্টেই, এটিএম থেকে সেই দেশের টাকা কিছু তুলে নিই, আপাতঃ হাত খরচের জন্য।এখানেও রাস্তার উল্টোদিকের এটিএম থেকে কিছু লিরা তুলে নিলাম।
গাড়ী খুব ভাল কিছু নয়।ছুটে চলেছে প্রায় জনশূন্য ফাঁকা রুক্ষ মাঠের মধ্যে দিয়ে।
আমরা যাব গোরেম বা কাপাদোসিয়া, যেটা এখান থেকে প্রায় ৭০ কিমি দূর। যেতে প্রায় একঘণ্টা মত লাগল। ততক্ষণে ড্রাইভার আর তার সাথীর ব্যাপারে জড়তা একটু কেটে এসেছে। মাঝে মাঝে ইংরাজীতে কথা বলার চেষ্টা করছি।ওরা ( আমার কথা বুঝতে পারলে) ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরাজীতে উত্তর দিচ্ছে। তবে ওরাও তো পণ্ডিত(?)। অর্ধেক কথা বোঝে না। ভয় হচ্ছে, কি জানি রে বাবা, কতদূর যাচ্ছে, ঠিক যাচ্ছে তো? ‘তুর্কী নাচন’ নাচাচ্ছে না তো?
যাই হোক প্রায় ঘণ্টা খানেক চলার পর একটা প্রায় কুঁড়ে ঘরের দরজায় এনে দাঁড় করাল। বলল, নামুন, এটাই আপনাদের হোটেল। চমকে উঠলাম- এতকাল যত জায়গায় গেছি, ভাল হোটেলে উঠেছি, দুই- তিন- চার বা পাঁচতারা। সেগুলোর ঢং ই আলাদা। এরকম কুঁড়ে ঘরে তো থাকিনি। লোকটি ঘরের দিকে বাসিন্দাদের উদ্দেশ্য করে একটা হাঁক ছাড়ল। সেই শুনে হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে এল একটি ছেলে, তারও না আছে তেমন বেশবাস, না কেতাদূরস্ত আদব কায়দা। ঠিক আমাদের গ্রামের বাড়ীতে কেউ গেলে যেমন বাড়ীর চাকরটা এসে খাতির করে ভেতরে নিয়ে যায়, তেমনই আর কি! এ কি রে বাবা! ঢোকার দরজাটা আমাদের গ্রামের বাড়ীর মতই শিকল দিয়ে আটকানোর ব্যবস্থা, অপটু মিস্ত্রী দিয়ে তৈরী মোটা মোটা কাঠের, ঢোকার মুখে ক্যাঁচকোঁচ করে দরজা যেন আড়মোড়া দিয়ে ঘুম ভাঙ্গার প্রতিবাদ করল। ঢুকে দেখি সামনের দেওয়ালের পাশে একটা পুরানো গরুর গাড়ীর চাকা দাঁড় করানো আর দেওয়ালে ঝুলছে একটা ভাঙ্গা হ্যারিকেন, কিছু লাঠি আর একটা পুরানো দিনের চরকা জাতীয় কিছু। দেখে বুঝলাম, এই কুঁড়েতেই রাত্রিবাসের বন্দোবস্ত। নিজের মনকেই বোঝালাম, নিজের দেশে গ্রামের বাড়ীতে থাকার অভ্যাস আছে৷ তুর্কীদের কুঁড়েতেই না হয় থেকে দেখি, নতুন অভিজ্ঞতা হবে এই আর কি।অভিজ্ঞতার ঝুলির বেড়াল বেরোবে পরের পর্বে–
0 Comments