জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
সূর্যকান্ত মাহাতো
জঙ্গলমহল। যেখানে একদা শ্রীচৈতন্য পা রেখেছিলেন এবং প্রেমগানে সকলকে উন্মত্ত করেছিলেন। এই সেই জঙ্গলমহল যেখানে একদিন জৈন সন্ন্যাসীরা পা রাখতেই তাদের দিকে কুকুর লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যে লালগড় কিছুদিন আগেও খবরের কাগজের শিরোনাম হত, একদিন সেখানেই নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু গরম গরম বক্তৃতা দিয়ে গেছেন।
"অরণ্য পর্বতাবৃতং দেশং ঝারিখণ্ড খ্যাতং।
রাঢ়গঙ্গারাঢ়শ্চ অর্টবীকরাজ্যং প্রণামিতং।।
নির্বাণে পার্শ্বনাথশ্চ বর্ধমানস্ তীর্থঙ্করৌ।
বুদ্ধস্য শ্রীচৈতন্য পদরেণুভি পবিত্রম্।।"
(অরণ্য এবং পর্বতের দ্বারা আবৃত যে দেশ তাহাই ঝাড়িখণ্ড(ঝাড়খণ্ড) নামে খ্যাত। রাঢ়ভূমি, গঙ্গারাঢ় এবং অটবী রাজ্য নামেও তাহা পরিচিত ছিল। পার্শ্বনাথ এবং বর্ধমান এই দুই তীর্থঙ্কর নির্বাণের জন্য এই দেশে আসিয়াছিলেন আর মহামতী বুদ্ধ ও শ্রীচৈতন্যের পদরেণুতে এই দেশ পবিত্র।) (জঙ্গলমহল ও ঝাড়খণ্ডী লোকদর্শন/ পশুপতি প্রসাদ মাহাতো)
"ঝারিখণ্ড ঝাড়খণ্ড ঝাড়গ্রাম জঙ্গল মহল সেই আদি নিষাদজনের বাসস্থান যারা সুদূর অতীতে একদা জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীরকে কুকুর লেলিয়ে দিয়ে তাড়া করেছিল এবং পরবর্তীকালে চুয়াড় বিদ্রোহের ভিতর দিয়ে ব্রিটিশ শাসকদের, এদেশীয় মোসাহেবশ্রেণীসহ, উচ্ছেদ করতে সচেষ্ট হয়েছিল।" (পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি দ্বিতীয় খণ্ড/ বিনয় ঘোষ)
তারপর সুবর্ণরেখা কাঁসাই দামোদর দিয়ে অনেক জল বইয়ে গেছে। অনেক আগের সেই জঙ্গলমহল সময়ের কাঁধে চেপে এগোতে এগোতে এখন আর কুকুর লেলিয়ে দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। তখন এবড়ো খেবড়ো পাহাড়ী মালভুমি ভূখণ্ডে আর অরণ্যে ছিল না কোনও রাস্তাঘাট, ছিল না মানুষের উষ্ণ আপ্যায়ন করার মনোভাব। কিন্তু আজকের জঙ্গলমহল একেবারেই ভিন্ন। এখন এখানকার মানুষজন সহ পর্যটন কেন্দ্রগুলো সকলকেই দুই হাত তুলে স্বাগত জানাচ্ছে।
'জঙ্গলমহল' শব্দটা এখন মাঠে ঘাটে জলে জঙ্গলে শহরে এমনকি রাজধানীর বুকে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। শালবনী থেকে মেদিনীপুর ঢোকার পূর্বে এবং মেদিনীপুর থেকে শালবনী যাওয়ার মাঝেই পড়ে একটি ছোট্ট রেলওয়ে স্টেশন। সব ট্রেন ওখানে হয়তো দাঁড়ায় না, তবুও নির্মিত হয়েছিল। একসময়ের জঙ্গলমহলের আন্দোলনের ফল এটা। অন্যান্য স্টেশনের মতোই হলুদ রঙের নেমপ্লেটে কালো রং দিয়ে বেশ বড় বড় করে তাতে লেখা আছে "জঙ্গলমহল ভাদুতলা রেলওয়ে স্টেশন।" স্টেশনের উত্তর-পূর্ব আর পশ্চিম দিকে আছে সু বিস্তৃত বিশাল গভীর শালের জঙ্গল। যা জঙ্গলমহল নামটিকে আরো বেশি তাৎপর্যময় করে তুলেছে। স্টেশনে পা রাখলেই মনে হবে জঙ্গলমহলের প্রবেশ পথে পদার্পন করলাম। কিংবা খড়্গপুরের ব্যস্ততম স্টেশন। সর্বক্ষণ যেখানে হকারদের চিল চিৎকার। তারপরেও সবকিছুকে ছাপিয়ে ঘোষিত হচ্ছে, পরবর্তী ট্রেনের নাম - 'জঙ্গলমহল পেসেঞ্জার' দুই নম্বর প্লাটফর্মে আসছে। কিংবা মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতায় বারবার উঠে আসে, একটাই নাম বা শব্দ "জঙ্গলমহল"।
অথচ বেশ কয়েক দশক আগেও 'জঙ্গলমহল' শব্দটা শীতের ঝরা পাতায় একরকম ঢাকা হয়েই পড়েছিল। জঙ্গলমহলের এইসব মানুষদের নিয়ে কৌতুহলও তেমন একটা কারওর ছিল না। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর জেলার বাসিন্দা হিসাবেই তারা পরিচিত ছিল। নিজেদের জীবনযাত্রা শিক্ষাদীক্ষা সংস্কৃতি নিয়ে বেশ সুখীই ছিল জঙ্গলমহলের বাসিন্দারা। তৎকালীন ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট সরকারের গভীর শিকড় যখন বেশ একটু একটু করে নড়বড়ে হয়ে উঠছে। আর বর্তমান শাসক দল সবে শিকড় গজানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ঠিক এই রকম এক সন্ধিক্ষণেই অতর্কিতে জেগে উঠেছিল জঙ্গলমহল তার পুরানো দিনের মতোই। এতদিনের খোলস ছেড়ে যেন আবার বেরিয়ে এলো তার প্রাচীন রণমূর্তি। এসময়ই অর্থাৎ 2008 - 09 সালে লালগড়ে এক মহিলাকে পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে গড়ে উঠল, 'পুলিশি সন্ত্রাসবিরোধী জনসাধারণের কমিটি'। জেগে উঠল মাওবাদীরা। সত্তরের দশকের নকশাল আন্দোলনের পর আরও একবার উত্তাল হল জঙ্গলমহল। তবে এবারের পরিস্থিতি ছিল আরও অনেক বেশি ব্যাপক ও গভীর। ফলে বাঁকুড়া পুরুলিয়া মেদিনীপুরের জেলা পরিচিতিটাই একরকম উবে গেল। নতুন করে গড়ে উঠলো একটাই পরিচিতি- 'জঙ্গলমহল'। নদী যেমন সবকিছু ধ্বংস করে ভাসিয়ে নিয়ে গেলেও উর্বর পলিমাটি রেখে যায়, তেমনি এক-একটা বিপ্লব বা বিদ্রোহও নিয়ে আসে অনেক নতুন দিক। ঝাড়গ্রাম পুরুলিয়া বাঁকুড়া মেদিনীপুরের মানুষগুলো আজ সকলে জঙ্গলমহলের মানুষ হিসেবেই বেশি পরিচিতি পাচ্ছে। রেলওয়ে স্টেশন, ট্রেন, বাসের নাম রাখা হচ্ছে জঙ্গলমহল। এমনকি প্রশাসনিক কর্তাদের মুখে মুখে ঘুরছে একটাই নাম- জঙ্গলমহল। ইংরেজ আমলের পর আবার বিশ্বের কাছে পরিচিতি পাচ্ছে জঙ্গলমহল। জঙ্গলমহলের বাসিন্দাদের কাছে এটাই বা কম কিসের! এমন আন্দোলনের ফলেই তো আজ উন্নয়ন জঙ্গলমহলের দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছতে পেরেছে। অপাঙক্তেয় জঙ্গলমহল আজ কলকাতা ও পাহাড়ের সঙ্গে সমসারিতে অবস্থান করছে। মুকুটমণিপুর বেলপাহাড়ি, খাঁদারানী, লালজল, ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি প্রভৃতি পর্যটন কেন্দ্রগুলি ঘুরে এসে অনেকেই তো আজ গর্বের সঙ্গে বলেন, "দাদা জঙ্গলমহল ঘুরে এলাম।" তাদের কাছে জঙ্গলমহলের জীবনযাত্রা নিয়ে কত সব গালগল্প করেন। যদিও সেসব অনেকটাই ভ্রান্ত। যেমন অনেকেই বলেন, এখানকার কোনও কোনও মানুষ নাকি অভাবে পিঁপড়ের ডিম খেয়ে বেঁচে থাকে। কিন্তু তারা জানে না যে ওটা আর পাঁচটা খাবারের মতই একটা খাদ্যবস্তু।
'জঙ্গলমহল' শব্দটা এখন কেবল একটি জায়গা বা স্থানের নামে সীমাবদ্ধ নেই। এই নামের মাহাত্ম্য বা এই নামের আড়ালে তার যে দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস লুকিয়ে আছে সেটাই যেন বড় বেশী করে এই নামের মধ্য দিয়ে প্রতিভাত হয়। তা সে 1767 সালের সর্দারদের বিদ্রোহই হোক আর চুয়াড় বিদ্রোহ হোক, কিংবা স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনই হোক আর 2008- 09 এর মাওবাদী উত্থান। তাই বলে কি জঙ্গলমহল মানেই কেবল সংগ্রাম আর লড়াইয়ের ইতিহাস? না, তা নয়। এখানে যেমন প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ আছে তেমনি আছে এখানকার নিজস্ব সংস্কৃতি,আছে নিজস্ব জীবনযাত্রা। জঙ্গলমহলের এমন কিছু নিজস্ব সংস্কৃতি আছে যা আর অন্য কোথাও নেই। জঙ্গলমহলের আদিবাসীসহ অন্যান্য জনজাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন কিছু অভিনবত্ব সংস্কৃতি আছে বলেই আজ তা গবেষণার অন্যতম বিষয় হয়ে উঠেছে।
এ তো গেল জঙ্গলমহলের অন্তরঙ্গ বিষয়। রূপে রসে গন্ধেও বহিরঙ্গে আছে সৌন্দর্যের অপূর্ব বাহার। ঝাড়গ্রামের আকাশে বাতাসে যদি ভেসে বেড়ায় ঝুমুরের মাতাল করা সুর, তবে পুরুলিয়ার মাটি ও পিছিয়ে থাকে না। প্রবল ছৌ নৃত্যের দাপটে আর নাগাড়ার গুমগুম শব্দে সে মাটিও সর্বদাই কেঁপে কেঁপে উঠে। বাঁকুড়ার পরকূল সহ গোটা জঙ্গলমহল যেমন মকর পরবে টুসু নাচে নেচে উঠে, তেমনি সারা বছর ধরে আদিবাসী মহিলাদের সারিবদ্ধ ভাবে নাচের ছন্দে আর মাদলের তালে তালে সমানে কোমরও দোলায়।
আর জঙ্গলমহলের পরিবেশ? চোখ জুড়ানো, গা ছমছমে সবুজের পর সবুজ গভীর অরণ্য। তারই বুক চিরে বেরিয়ে গেছে সিঁথির মতো সব আঁকাবাঁকা কাঁসাই, শিলাই, সুবর্ণরেখা, দামোদর, কংসাবতীর ধারাগুলো। অরণ্যের মাঝে মাঝেই অরণ্যকে ভেদ করে মাথা তুলে আছে একটার পর একটা পাহাড়ের চূড়া। ছায়াঘেরা বন, পাহাড়, ডু্ংরি, ঝরনা তারই মাঝে জঙ্গলমহলের আদিবাসীদের পরম নিশ্চিন্তে জীবনযাপন। নেই কোনও দূষণের ক্ষত। আছে কেবল অনাবিল দূষণমুক্ত পরিবেশ। চারিদিকে কেবল শাল মহুল পলাশে মোড়া সুবিশাল অরণ্য রাশির পাহারা। আছে শালফুল, কুড়চি ফুল, ধাধকি ফুল, বেঁওরা ফুল আর মহুয়া ফুলের মাতাল করা গন্ধ। এমন অরণ্যে তাই বারবার মন ছুটে যেতে চাই। তাই তো কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় "আমি দেখি" কবিতায় বলেছেন, "আমার দরকার শুধু গাছ দেখা।/ গাছ দেখে যাওয়া/ গাছের সবুজটুকু শরীরে দরকার/ আরোগ্যের জন্য ওই সবুজের ভীষণ দরকার"/।
আছে শীতের কুয়াশা মাখা কাঁপুনি দেওয়া সকালে টাটকা খেজুর রস আর নতুন গুড়ের গন্ধ। এছাড়াও আছে কতসব রূপকথা, ধাঁধা, কহনি, প্রবাদ। আছে কত নাচ-গান আর উৎসবের পর উৎসব।
তথ্যসূত্র: ১) ঝাড়গ্রাম ইতিহাস ও সংস্কৃতি/ লেখক- মধুপ দে
২) ভারতের আদিবাসী ও দলিত সমাজ/ লেখক- পশুপতি প্রসাদ মাহাতো
৩) জঙ্গলমহল ও ঝাড়খণ্ডী লোকদর্শন/ লেখক- পশুপতি প্রসাদ মাহাতো
2 Comments
খুব ভালো হয়েছে। অনেক কিছু জানা গেল ।
ReplyDeleteজঙ্গলমহলের সংস্কৃতির অনেক কিছু তথ্য সংযুক্ত করলে আরো ভালো হয়
ReplyDelete