জ্বলদর্চি

Zen Z Poetry Manifesto-2/Arun Das

Zen Z Poetry Manifesto-2/Arun Das
জেন জেড কবিতার ম্যানিফেস্টো / অরুণ দাস
পর্ব-২


এগারো.

উচ্চতর চেতনায় কবি কেবল জড়-জাগতিক সত্ত্বাকে পরমচেতনা থেকে ভিন্ন ভাবলে তাঁর ভাবনায় বস্তু-বিষয়ের বহিরঙ্গ প্রকাশ ঘটবে মাত্র। তা সাধারণের চেয়ে পৃথক ভাবনা হলেও স্থূল। বস্তু-বিষয়ের চিন্ময় জগৎ বা অন্তরঙ্গ শক্তিকে তিনি ছুঁতে পারবেন না, তার ভাবনা মায়ার দ্বারা আবৃত হবে। পরমচেতনায় কবি বস্তু-বিষয়-এর এই অন্তর্নিহিত প্রকৃত জগৎ-এর বহুবর্ণময় জগতকে উপলব্ধি করতে পারবেন।


বারো.

কোনো বস্তু বা দৃশ্যের স্বরূপের মধ্যে কোনো ভেদ নেই। কিন্তু তা বিভিন্ন মানুষের দৃষ্টিতে বিভিন্নভাবে ধরা দেয়। ব্যক্তিমনের অবস্থা ও পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে একই বস্তু বা দৃশ্য একই মানুষের চোখেও বিভিন্নভাবে ধরা দেয়। 

কোনো বস্তু বা দৃশ্যকে অনুভব ব্যক্তির দৃষ্টিকোণের উপর নির্ভর করে। আর এই দৃষ্টিকোণ ব্যক্তিমনের অবস্থা বা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে।

অর্থাৎ বস্তু বা দৃশ্যের বহুরূপ আমাদের মনেরই সৃষ্টি। আমাদের অনুভূতি কোনো ইন্দ্রিয় বা কারণ সাপেক্ষ নয়। অনুভূতি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও অনন্তস্বরূপ। আর এই অনুভূতিগুলির স্বরূপ আমাদের আবেগ-চেতন অবচেতন-অচেতন ও উচ্চতর চেতন। এগুলি বিচ্ছিন্ন নয়। বরং পরস্পরের পরিপূরক ও পরস্পরের সংযোগ, বিয়োগ। প্রকৃতপক্ষে আবেগ-চেতন অবচেতন-অচেতন কিংবা উচ্চতর চেতন পরম চেতনার অংশ। কবির অনুভূতি যখন বস্তু বা দৃশ্যের প্রকৃত সত্য, প্রকৃত জ্ঞান ও অনন্তস্বরূপ অনুভব করে তখনই পরমচেতনার স্বরূপ পরিস্ফুট হয় তাঁর কবিতায়।


তেরো.

জড় জগত আধ্যাত্মিক শক্তিরই আর এক রূপ। এই আধ্যাত্মিক শক্তি সাময়িকভাবে জড় জগতের মধ্যে অবস্থান করছে। কিন্তু বাস্তবে এটি জড় শক্তির দ্বারা পরিবৃত হয়ে রয়েছে।

জড় জগতে দু'ধরনের শক্তি বিরাজ করে (এক) জড়া শক্তি (মাটি, জল, আগুন, বাতাস, আকাশ, বুদ্ধি, মন ও অহংকার)। এখানে শক্তিগুলি স্থূল থেকে ক্রমান্বয়ে সূক্ষ্ম অবস্থায় বোঝানো হয়েছে।

উপাদান যত সূক্ষ্ম হয় তার ক্ষমতা তত বেশী। উচ্চতর চেতনার অনুভবে বিশ্বাসী কবিদের কাছে এই জড়া শক্তিই কবিতার মূল উপাদান।

(দুই) এছাড়া আর এক ধরনের উৎকৃষ্ট শক্তি আছে। এটি পরাশক্তি। আমরা এই জড়া শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। উচ্চতর চেতনার কবি এই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে তার অন্তর্নিহিত সত্ত্বাকে কবিতায় তুলে ধরেন।

আর পরমচেতনার কবি ছুঁতে চান এর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সত্বাকে। আবেগ চেতন-অবচেতন ও অচেতনের পরম নিয়ন্তা, সর্বময় পরমাত্মাকে তাঁরা ছুঁতে পারেন। ফলে কোনো কিছুর বর্জন নয়, বরং সুষ্টু সংমিশ্রণেই পারমার্থিক জগতের উপলব্ধিকে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রয়োগ ঘটান তাঁদের কবিতায়।


চোদ্দ.

আমাদের অতীত জীবনের সমস্ত চিন্তা ও অভিজ্ঞতাগুলি বীজাকারে অবচেতন মনের মধ্যে থাকে। মনে রাখা উচিত অতীতের লক্ষ লক্ষ সজ্ঞান ক্রিয়াগুলির নিষ্ক্রয় রূপে থাকে অবচেতনায়। অবচেতনার কাজ চেতনার নিম্নস্তরে হয় এবং চেতনার উর্ধ্বে থাকে অতিচেতন। অচেতনায় পৌঁছালে মানুষ মুক্ত হয়, আত্মজ্ঞান লাভ করে। এই আত্মজ্ঞান অর্থে কল্পনা, আবেগ অবচেতনকে অস্বীকার করা নয় কিংবা পূর্বলব্ধ জ্ঞানকে ছোট করা নয়, বরং তাকে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে স্বীকার করলেই পরচেতনার অবর্ণনীয় সুন্দরতম জগতের অভিভূতকে ছুঁতে পারে।

বিবেকানন্দের কথায় -- “ঠিক ভাবে নিয়োজিত হলে কল্পনা আমাদের পরম বন্ধুর কাজ করে। কল্পনা যুক্তির রাজ্য ছাড়িয়ে যায় এবং একমাত্র কল্পনার আলোই আমাদের সর্বত্র নিয়ে যেতে পারে।'

তার কথাই 'আমাদের অবচেতন স্তরে যে সব অসংখ্য চিন্তা ডুবিয়া রহিয়াছে, আমাদের জ্ঞান-নিরপেক্ষ হইয়াই যেগুলি নিজে নিজে কাজ করিয়া চলে, সেগুলিকে স্ববশে আনিতে চাওয়াই হইল আমাদের সর্বপ্রথম কাজ।'

সুতরাং আবেগ-অবচেতনার অস্বীকার নয় বরং তাদের সুনিয়ন্ত্রিত সচেতন সংযম প্রয়োগের দ্বারাই পরমচেতনার পরম শক্তির জাগরণ সম্ভব। যা কবির সামনে খুলে দেবে এক অতিসুন্দরতম জগতের দরজা। বস্তু বিষয়ের মধ্যে নিহীত সুন্দর বর্ণময় জগতকে কবি অতি সহজে আঁকতে পারবেন তাঁর কবিতায়।


পনেরো.

উচ্চতর চেতনার অভ্যাস কবির সামনে বস্তু-বিষয়ের সূক্ষ্মতম অনুভবের পথ খুলে দেয়। আর পরমচেতনায় কবি বস্তু-বিষয়ের সূক্ষ্মতম ধ্বনিকে বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণে উপলব্ধি করতে পারেন।

বাস্তব জগতের যাবতীয় জ্ঞান আমরা ব্রহ্মের মধ্য আহরণ করি। অতএব আত্মা অজ্ঞাত নয়। কিন্তু আমাদের জড়জাগিতিক অজ্ঞানতার জন্য এই সত্য আমাদের অধরা থেকে যায়। উচ্চতর চেতনায় কবি এই আত্মার স্বরূপকে উপলব্ধি করতে পারেন। জড় জাগিতিক জগতের বহু অজানা রহস্য, তিনি সহজে বুঝতে পারেন। কিন্তু এই আত্মজ্ঞান অধিকাংশ ক্ষেত্রে অহংবোধের জন্ম দেয়। সীমিত ইন্দ্রিয় ও অহং তাঁকে সীমাবদ্ধ করে। অজ্ঞানতা বশে তিনি অধিষ্টানের জ্ঞান হারান। তাই ভাসমান চঞ্চল, অস্থায়ী, অসম্পূর্ণ আভাসকে সত্য বলে মনে করেন। পরমচেতনায় কবি অহংবোধের সম্পূর্ণ বিসর্জন দেন। ইন্দ্রিয় স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়। অধিষ্ঠানের জ্ঞান তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে বস্তু-জগতের সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম সত্যের রহস্য তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।


ষোলো.

উচ্চতর চেতনায় কবির আত্মজ্ঞান ও আত্মউপলব্ধি ঘটে। কিন্তু কবি ইন্দ্রিয়ের মধ্যে সীমায়িত হয়ে পড়লে কোনো বিষয়ে তাঁর অনুসন্ধান, কৌতূহল ও অসম্পূর্ণ হয়। তিনি লক্ষ্যভ্রষ্ট হন। তাঁর চিত্ত বিক্ষিপ্ত হয়, ভাবনায় শূণ্যতার সৃষ্টি হয়। ফলে তার মগ্ন আনন্দময় সৃষ্টিও যেন অসম্পূর্ণ অগোছালো মনে হয়।।

পরমচেতনায় কবির আত্ম উপলব্ধির মধ্যে পরিপূর্ণ জ্ঞান আছে, অহংবোধ নেই। তা সম্পূর্ণ ইন্দ্রিয়ের সুনিয়ন্ত্রিত অনুসন্ধানে। ফলে একইভাবে জগৎ বিদ্যমান থাকলেও তাঁর জ্ঞানদৃষ্টিতে তা অন্যরূপে প্রতিভাত হয়। ফলে বিভিন্ন প্রাণী ও বস্তুসমূহের বহিঃস্বরূপ না দেখে সহজেই তাদের অদৃশ্য সত্ত্বা দর্শন করতে পারেন।

কিন্তু বস্তু - বিশ্বের সূক্ষ্ম পরম সত্যের প্রকৃত স্বরূপের সন্ধান দিতে পারে পরমচেতনার সার্থক উপলব্ধি।


সতেরো.

উচ্চতর চেতনায় কবি উপলব্ধি করেন চেতনা আসছে জড় পদার্থ থেকে। তাই তারা জড় পদার্থের মধ্য দিয়ে চেতনার অন্বেষণ করেন। প্রকৃতপক্ষে জড়ের উদ্ভবও চেতনা থেকে। চেতনার অস্তিত্ব সবসময়ই আছে। তা অজ্ঞানের দ্বারা আচ্ছাদিত হলে আমাদের কাছে অচেতন মনে হয়।

পরমচেতনায় কবি অনুভব করেন চিৎ-শক্তি জড় ও চেতন সবকিছুর উৎস। চিৎ-শক্তি ছাড়া জড়শক্তি অস্তিত্বহীন। জড় জগৎ ক্ষনস্থায়ী, কিন্তু চিন্ময় জগৎ নিত্য। সুতরাং পরমচেতনার মধ্য দিয়ে জড় বস্তু ও জীবনকে উপলব্ধি করলে তার যথার্থ রূপকে ছোঁয়া যায়। পরমচেতনায় ব্যক্তি-বস্তু, সব কিছুই নিত্য, শ্বাশ্বত ও চিন্ময়।


আঠারো.

বাস্তবিক অভিজ্ঞতায় আমরা দেখি আমাদের চারপাশের শিক্ষিত অশিক্ষিত, সাধারণ-অসাধারণ মানুষজন কোন এক মুহুর্তের এমন কিছু বলেন যা একটি বড় দার্শনিক সত্য। অর্থাৎ প্রতিটি মানুষই দার্শনিক।

এই ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি ছোট-বড়ো বস্তু ও জীবের অবস্থা বা পরিপেক্ষিত থেকে এমন কিছু জ্ঞান লাভ করি যা বাস্তব জীবনে এক অমোঘ সত্য। 

এই জগত মায়া ও জ্ঞানের সমন্বয়ে সৃষ্টি। মায়া প্রকৃতির নির্মাণ করে এবং জ্ঞান তাকে সমৃদ্ধ করে। 

অতিচেতনায় আত্মজ্ঞান লাভ হয়। কিন্তু আত্মজ্ঞানের প্রকৃত পরিপাক না হলে পরমচেতনার উপলব্ধি সম্ভব নয়। আত্ম উপলব্ধিতে আত্মজ্ঞান প্রাপ্ত হয়। কিন্তু কেবল আত্মায় আত্মার যথার্থ উপলব্ধির দ্বারা পরমচেতনার পরমাত্মময় পথের আবিষ্কার ও পরমপ্রাপ্তি সম্ভব।


উনিশ.

সমস্ত জীবজন্তদের মধ্যে একমাত্র মানুষেরই স্বাধীন মন আছে। এই স্বাধীন মনকে নিজের ইচ্ছানুযায়ী বিভিন্ন দিকে বিস্তৃত করতে পারি আমরা। একই দৃশ্যকে বিভিন্ন রূপে কল্পনা করতে পারি।

 এই মনকে কিভাবে কতটা বিস্তৃত করবো তা নির্ভর করে আমাদের ইচ্ছাশক্তি ও মন-মস্তিষ্কের অন্তর্নিহিত শক্তির উপর।

এই ইচ্ছাশক্তি ও অন্তর্নিহিত শক্তির ক্ষমতা ক্ষুদ্র হলে ভাবনা ও অনুভব ক্ষুদ্র পরিসর বদ্ধ হয়ে পড়ে। আর এই ক্ষমতা অনন্ত হলে একই দৃশ্য বা বিষয়কে অনুভব করার অন্তহীন পথের খোঁজ পাওয়া যায়।

এক শ্রেণীর কবি সীমার মধ্যে সীমিত ভাবনার পরিমণ্ডলে সৃষ্টিতে বাঁধতে চান। অন্য এক শ্রেণী চান অনন্ত, অসীমতার আনন্দকে উপলব্ধি করতে। তাই তারা সীমার মধ্যেও অসীমকে ছুঁতে পারেন। আবার অসীমতার মধ্যেও বিভিন্ন ভাবনা, দৃশ্য, বিষয়কে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে সীমায়িত করতে পারেন। অসীমতার মধ্যে খুঁজে নেন সার্থক সৃষ্টির পথ।


কুড়ি.

এই ব্রহ্মাণ্ডে সবকিছুই আপেক্ষিক। আমাদের বুদ্ধিমত্তাও আপেক্ষিক। আমরা সবকিছুকে নিজেদের অবস্থার পরিপেক্ষিতে বা দৃষ্টিকোণে বিচার করতে চেষ্টা করি। এটা আসলে নিজের সীমাবদ্ধতাকে অস্বীকার করে অসীমকে সীমায়িত করার চেষ্টা।

পরমচেতনা কবির ব্যক্তিগত অবস্থার পরিপেক্ষিতে ও দৃষ্টিকোণের বাইরে, সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক অবস্থানকে নির্দেশ করে। যা নিরপেক্ষ, যা জড় ও জীবের অন্তর্নিহিত গুণের যথার্থ অন্বেষণের বাইরে এক সার্বিক অবস্থান।

এই অবস্থান দেশ-কাল-পাত্র অনুসারে জ্ঞান বিবেচনা করতে শেখায়। এখানে দেশ অর্থে পারিপার্শ্বিক অবস্থা, কাল অর্থে সময় এবং পাত্র হল বিষয়। পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সময় ও বিষয়ের বৈচিত্র্যকে সঠিকভাবে অনুভব করাই পরমচেতনার পরম পথ।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

0 Comments