জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম পর্ব--৩২/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম
 পর্ব-৩২

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ধর্মে রাষ্ট্রের ভূমিকা

এই ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে কোণঠাসা ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় শ্রেণি যৌথভাবে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিরোধে সচেষ্ট হয়েছিল। মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পরে এই ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় শ্রেণীর নেতৃত্বেই সুংগযুগ থেকে গুপ্তযুগ পর্যন্ত রাষ্ট্রশক্তির ব্যাপক প্রয়োগে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়, এবং এই দুই শ্রেণী আবার যুগ্ম ভাবে শাসক শ্রেণীতে পরিণত হয়। রাষ্ট্রশক্তির প্রতিকূলতায় এ সময়ে বৌদ্ধ ধর্ম বিপর্যস্ত হয়, এবং চাতুর্বর্ণ্য ভিত্তিক আর্থসামাজিক কাঠামো আবার শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পরবর্তী কালে সম্রাট হর্ষবর্ধনের সহায়তায়, এবং তারপর উত্তর-পূর্ব ভারতে পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধ ধর্ম এদেশে আরো কিছুকাল বেঁচে ছিল। কিন্তু তারপর এক দিকে সেন রাজারা হিন্দু ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে, আর অন্যদিকে রাষ্ট্রশক্তি ক্রমশ বহিরাগত ইসলাম ধর্মাবলম্বী তুর্কি আফগানদের হাতে চলে যায়। এভাবে রাষ্ট্রশক্তির পৃষ্ঠবল হারিয়ে এদেশে বৌদ্ধ ধর্ম কার্যত বিলুপ্ত হয়ে যায়। চীন ও জাপানে রাষ্ট্রশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় এবং তাও ধর্ম ও কনফুসিয় ধর্ম (চীনে) এবং সিন্টো ধর্মের (জাপানে) সঙ্গে সংমিশ্রণের মাধ্যমে বৌদ্ধ ধর্ম তার পরেও বেঁচে থেকেছে। ব্রহ্মদেশ, থাইল্যান্ড, ইন্দোচীন, শ্রীলংকা প্রভৃতি দেশেও রাষ্ট্রশক্তির পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমেই বৌদ্ধ ধর্ম স্থায়িত্ব লাভ করেছে। 

  ইহুদি ধর্ম অতি প্রাচীন কালে রাজা ডেভিড ও সলোমনের রাজত্বকালে রাজধর্ম হিসেবে পশ্চিম এশিয়ার প্রাচীন ক্যানান অঞ্চলে গড়ে উঠেছিলো। কিন্তু তার পর থেকেই এই অঞ্চলটি পর্যায়ক্রমে মিশর, ব্যাবিলনিয়া, অ্যাসিরিয়া, ইরান, গ্রিস, রোম ও তুরস্ক দ্বারা অধিকৃত হয়। আর সে সময় থেকেই আরম্ভ হয় ইহুদিদের দাসত্ব এবং নির্যাতন। বাইবেল এর "ওল্ড টেস্টামেন্ট" এ মিশরে ও ব্যাবিলনিয়ায় ইহুদিদের দাসত্বের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। কয়েকশো বছরের এই ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের মধ্যে রাষ্ট্রশক্তির সমর্থন হারিয়ে ইহুদিরা ক্যানন ক্যানান অঞ্চল ছেড়ে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়, এবং প্রায় সর্বত্রই, বিশেষত ইউরোপে, নির্যাতিত জীবন যাপন করতে থাকে। উনিশ শতকের শেষে ইউরোপ ও আমেরিকায় ব্যাঙ্কিং ও অন্যান্য ব্যবসায়ে ইহুদিরা বিশেষ শক্তিশালী হয়ে ওঠে, এবং সেই শক্তিবলে আন্তর্জাতিক ইহুদি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (Zionist Movement) গড়ে ওঠে। কিন্তু কোন শক্তিশালী রাষ্ট্রজোটের সক্রিয় সমর্থনর অভাবে এই আন্দোলন তখন কোন রাজনৈতিক পরিণতি লাভ করতে পারেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ধনী ইহুদি ব্যবসায়ীরা ইউরোপ ও আমেরিকাকে, বিশেষত ব্রিটিশ সরকারকে, উল্লেখযোগ্য আর্থিক সাহায্য করে।

  কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ব্রিটিশ সরকার প্যালেস্টাইন অঞ্চলে (যা তখন তাদের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল) ভবিষ্যতে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। তার পর থেকেই ব্রিটিশ সরকার এবং ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর সক্রিয় সহায়তায় ইউরোপীয় ইহুদিরা বহু সংখ্যায় প্যালেস্টাইনে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলার দ্বারা কয়েক লক্ষ ইহুদি নিধনের ফলে বিশেষত ইউরোপ-আমেরিকায় আন্তর্জাতিক ইহুদি আন্দোলনের প্রতি রাষ্ট্রীয় সমর্থন জোরদার হয়ে ওঠে। তারপর আন্তর্জাতিক রাজনীতির ঘটনা পরম্পরায় এবং পাশ্চাত্য বৃহৎ শক্তিগুলোর তৎপরতায় ১৯৪৮ সালে প্যালেস্টাইন ভূখণ্ডকে দুভাগ করে ইসরায়েল রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়, এবং সে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ধর্ম রূপে ইহুদি ধর্মের কিছুটা শ্রীবৃদ্ধি হয়। 

  রোমক সাম্রাজ্যে খ্রিস্ট ধর্ম প্রবর্তিত হবার আগে রোমক আইনে সম্রাটকে দেবতা রূপে পূজা করা বাধ্যতামূলক ছিল। তাই খ্রিস্ট পরবর্তী প্রথম তিনশো বছর খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা ছিল সংখ্যাল্প ও নির্যাতিত। ৩১২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট কনস্টানটাইন খ্রিস্ট ধর্মকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দান করেন। তারপর ৩৮১ খ্রিস্টাব্দে এই ধর্মকে রোমক সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ধর্ম রূপে জনসাধারণের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সৈন্যবাহিনী, সরকারি চাকুরি, যাজকত্ব, এবং আইনের সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হয়। আর খ্রিস্ট ধর্মীয় পুরোহিত শ্রেণীকে দেওয়া হয় সৈন্যবাহিনীর সুরক্ষা, বিপুল আর্থিক অনুদান, এবং অন্যান্য অনেক সুযোগ সুবিধা। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এবং খরচে প্রতিষ্ঠিত হয় অসংখ্য গির্জা।
 
  এভাবেই রাষ্ট্রশক্তির প্রয়োগে খ্রিস্ট ধর্ম রোমক সাম্রাজ্যের পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তার লাভ করে, আর এই সংগঠিত ধর্ম সম্পূর্ণ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে পোপ গেলাসিয়াস  মনুর মত এই তত্ত্ব প্রচার করেন যে পৃথিবী প্রধানত দুটি শক্তি দ্বারা শাসিত হয়- পবিত্র পুরোহিত শ্রেণি এবং রাজন্য শ্রেণী। যীশু যেমন সিজারের রাজ্য এবং ঈশ্বরের রাজ্যকে আলাদা করতে বলেছিলেন, সে ভাবেই গেলাসিয়াস রাজন্য শ্রেণীকে ইহলৌকিক বিষয়ের অধিকারী শাসক এবং পুরোহিত শ্রেণীকে পারোলৌকিক বিষয়ের অধিকারী শাসক বলে ঘোষণা করেন। এভাবে পশ্চিম রোমক সাম্রাজ্যে পোপ ও ধর্মগুরুরা রাজন্য শ্রেণীর একাধিপত্যের উপর কিছুটা অঙ্কুশ লাগাবার চেষ্টা করলেও পূর্ব রোমক সাম্রাজ্যে ধর্ম ও গির্জার উপরে রাষ্ট্রীয় অধিকার সম্পূর্ণ নিরঙ্কুশই থেকে গিয়েছিলো। 

  এভাবেই একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত খ্রিস্ট ধর্ম এবং গির্জার ব্যাপক রাজন্য শ্রেণি ও পুরোহিত শ্রেণীর পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে কার্যত রাষ্ট্রশক্তির নিয়ন্ত্রণেই থেকে গিয়েছিলো। এতে উভয় শ্রেণীরই যথেষ্ট সুবিধা হয়েছিলো। রাজন্য শ্রেণী সাম্রাজ্য বিস্তার করতে এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে খ্রিস্ট ধর্ম এবং গির্জার শক্তিশালী সংগঠনকে কাজে লাগাতো। আবার বিধর্মীদের নির্মূল করতে, সাম্রাজ্যের ভিতরে ও বাইরে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে, সামরিক সুরক্ষা পেতে এবং বিশেষ করে বিপুল ভূসম্পত্তি ও বিত্তের মালিক হতে পুরোহিত শ্রেণি রাষ্ট্রশক্তির উপর নির্ভর করতো। আর পোপ এবং পুরোহিত শ্রেণী রাজন্য শ্রেণীর রাজনৈতিক আর্থিক আধিপত্য, স্বৈরাচার এবং শোষণশাসনকে চ্যালেঞ্জ করতো না বলে এই শ্রেণী সমঝোতায় কোন ফাটল ধরেনি।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇




Post a Comment

0 Comments