জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম--- পর্ব-৩৪ /সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম

পর্ব-৩৪

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ধর্মে রাষ্ট্রের ভূমিকা

এই পটভূমিতে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রোটেস্ট্যান্ট দেশে ক্যাথলিকদের উপর এবং ক্যাথলিক দেশে প্রোটেস্ট্যান্ট দের উপর নৃশংস অত্যাচার চলতে থাকে। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর জ্ঞানবাদী আন্দোলন, ফরাসি বিপ্লব, এবং আমেরিকার সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্র কর্তৃক বিভিন্ন ধর্মের প্রতি সহনশীলতার তত্ত্ব ও নীতি ক্রমশ স্বীকৃতি লাভ করে। আর তার পর থেকে রাষ্ট্রের নেতৃত্বে অরাষ্ট্রীয় ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণুতার নীতি পাশ্চাত্য  দেশগুলোতে ক্রমশ কমে আসে। প্রোটেস্ট্যান্ট দেশগুলোতে তো বটেই, তথাকথিত প্রতিসংস্কার (Counter-Reformation) আন্দোলনের মাধ্যমে ক্যাথলিক দেশগুলোতেও ধর্মের রাজ্যকে জাগতিক রাষ্ট্র থেকে ক্রমশ আলাদা করে ফেলা হয়। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর এই প্রবাহের ফলে বিংশ শতাব্দীতে ধর্ম কার্যত রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, এবং অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের যন্ত্রে পরিণত হয়। উদাহরণ স্বরূপ, ফ্যাসিস্ট জার্মানি ও ইতালিতে যথাক্রমে প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ ও রোমের পোপ ফ্যাসিবাদকে পূর্ণ সমর্থন জানায়, এবং হিটলার ও মুসোলিনী সামরিক অস্ত্রশস্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় অস্ত্রেরও পূর্ণ ব্যবহার করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও "হোয়াইট অ্যাংলো-স্যাক্সন প্রোটেস্টান্ট" (WASP) বাহিনী রক্ষণশীল অভ্যন্তরীণ নীতি এবং নয়া সাম্রাজ্যবাদী বিদেশ নীতির পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে এসেছে। আমেরিকার রাজনীতিতে ধর্মীয়তা অবশ্য পালনীয় এবং ধর্মহীনদের কার্যত স্থান নেই। বর্তমানে আবার মৌলবাদী প্রোটেস্টান্টরা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, এবং ধর্মভিত্তিক শিক্ষানীতি সহ দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রীয় নীতির দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। 

বর্তমান পৃথিবীতে রাষ্ট্র কর্তৃক ধর্মাস্ত্র ব্যবহারের সবচেয়ে জ্বলন্ত উদাহরণ ইসলামপ্রধান দেশগুলো। মধ্যযুগে প্রায় কোনো দেশেই ধর্ম থেকে রাষ্ট্র বিচ্ছিন্ন ছিল না। ইসলামও ব্যতিক্রমী ছিল না। বাগদাদের খলিফারা হজরত মহম্মদের উত্তরসূরী রূপেই গন্য হতেন, এবং তারা একাধারে সার্বভৌম জাগতিক প্রশাসক এবং ধর্মীয় সর্বাধিনায়ক ছিলেন। কোরআনের বিধান অনুযায়ী ধর্ম ব্যক্তিজীবনের সব ক্ষেত্রকেই নিয়ন্ত্রণ করতো, আর খলিফাদের নেতৃত্বে রাষ্ট্রযন্ত্র এসব বিধানকে জনসমাজে বলবৎ করতো। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এসেও একমাত্র ইসলামপ্রধান দেশগুলোতেই ধর্ম ও রাষ্ট্রের সরাসরি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বজায় আছে। কামাল পাশার তুর্কিতে অল্প কালের জন্য ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে আধুনিকতার বীজ বপন করা হয়েছিলো। কিন্তু সে পরিবর্তনশীল ছিল ক্ষণস্থায়ী। তথাপি কামাল পাশার ঐতিহাসিক ভূমিকা তথা ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রভাবে বর্তমান তুরস্কের রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মের প্রভাব খুব প্রবল নয়। কিন্তু সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আমিরশাহী, আফগানিস্থান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ সহ অধিকাংশ ইসলামপ্রধান রাষ্ট্রে ইসলাম শুধু যে রাষ্ট্রীয় ধর্ম তাই নয়, রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ সমর্থন এ মুসলিম মৌলবাদী আন্দোলন ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে। ফলস্বরুপ এসব দেশে শুধু যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপরে নির্যাতন চলছে তাই নয়, কোন কোন দেশে মৌলবাদ বিরোধী মুসলিম বুদ্ধিজীবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের রাষ্ট্র কর্তৃক হত্যা ও নির্যাতন নিত্যকার ঘটনা দাঁড়িয়েছে। যেসব দেশে রাষ্ট্র ইসলামীয় মৌলবাদকে সরাসরি প্রশ্রয় দিচ্ছে না, সেখানেও রাষ্ট্র কর্তৃক ধর্মীয় মৌলবাদের সক্রিয় প্রতিরোধের দৃষ্টান্ত বিরল। 

ইসলামপ্রধান দেশগুলোর এই সাধারণ পরিস্থিতির মূল কারণ এই যে এসব দেশে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং রাজনৈতিক আর্থসামাজিক কাঠামো মধ্যযুগের পরে আর বেশি দুর অগ্রসর হয়নি। রাজতন্ত্র অথবা অন্য ধরনের কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতি এসব দেশকে মধ্যযুগীয় অন্ধকারে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। রাজন্য শ্রেণি, বুর্জোয়া শ্রেণি এবং মোল্লা শ্রেণি নিজেদের শ্রেণিস্বার্থে বর্তমান রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কাঠামোকে চিরায়ত করবার উদ্দেশ্যে জনসাধারণকে ধর্মের আফিমে ঘুম পাড়িয়ে নিজেদের বশে রাখবার সুপরিকল্পীত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে শাসক শ্রেণীর উল্লিখিত চার অংশ পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। মধ্যযুগের ইউরোপের মতো রাজতন্ত্র এবং সামন্ত শ্রেণি ধর্মপতি শ্রেণীর সমর্থনের উপর নির্ভরশীল। ধর্মপতিরা তাদের সম্পত্তি এবং প্রভুত্ব রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল। রাষ্ট্র, ধর্ম ও ধর্মীয় মৌলবাদকে সমর্থন করে আমজনতাকে বশে রাখতে সচেষ্ট। আর মোল্লা শ্রেণি রাজতন্ত্র বা সামন্ততন্ত্রকে অপরিবর্তনশীল রাখতে রাষ্ট্রকে সাহায্য করে। 
আধুনিক পাশ্চাত্য জগতে গণতন্ত্রের আঙ্গিক হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সাধারণ রাষ্ট্রীয় নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু এই রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতা, এমন কি ধর্মের প্রতি উদাসীনতা দ্বারা চিহ্নিত নয়। এই রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতার নীতীতে প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে মানুষের ধর্মীয়তাকে উৎসাহিত করা হয়। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মের সহাবস্থানকে রাষ্ট্র নীতিগত ভাবে সুরক্ষা প্রদান করে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে রাষ্ট্র একটি নৈর্ব্যক্তিক সত্তা নয়। কিছু মানুষের দ্বারা গঠিত শাসক শ্রেণী রাষ্ট্রকে এবং রাষ্ট্রের  নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ কঠিন সত্যকে ঢাকবার উদ্দেশ্যে পাশ্চাত্য দুনিয়ার অনেক বুদ্ধিজীবী রাষ্ট্রের নানা রকম অধিবিদ্যা সংজ্ঞা দিয়েছেন, এবং শাসকশ্রেণীর পরিবর্তে এলিট বা অভিজাত শ্রেণীর উল্লেখ করেছেন। কিন্তু গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর সময় (৪২৭-৩৭৪ খ্রিঃপূঃ) থেকেই এ সমাজবৈজ্ঞানিক সত্য স্পষ্ট হয়ে গেছে যে রাষ্ট্রযন্ত্র প্রকৃতপক্ষে একটি শাসক শ্রেণী দ্বারাই পরিচালিত হয়ে থাকে। এখন এই শাসক শ্রেণীর অধিকাংশ সদস্য, দেশত বিশেষত ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা যদি ধর্মপ্রাণ হয়, এবং কোন বিশেষ ধর্মে আসক্ত থাকে, তবে বাস্তব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পক্ষে সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ থাকা সম্ভব নয়। যেহেতু পাশ্চাত্য দেশগুলোতে শাসক শ্রেণী মূলত খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী, অতএব বাস্তব ক্ষেত্রে তাদের দ্বারা রচিত অভ্যন্তরীণ ও বিদেশ নীতিতে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ভাবে খ্রিষ্ট ধর্মের প্রতিফলন থাকা অবশ্যম্ভাবী। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনীতিকদের, বিশেষত পরিচালকদের, ধর্মীয় কার্যত বাধ্যতামূলক। ঈশ্বরভক্তির বাহ্য প্রকাশ তাদের রাজনৈতিক আচরণবিধির অপরিহার্য আঙ্গিক। একই কারণে সেখানে শ্বেতচর্ম ইংগ-স্যাকসন প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম রাষ্ট্রের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক হাতিয়ার রূপে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ প্রায় সমস্ত পাশ্চাত্য দুনিয়ার রাজনীতিতে ধর্মহীন কিংবা নাস্তিক মানুষদের স্থান পাওয়া দুঃসাধ্য।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

2 Comments