ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৬৫
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস
রতনতনু ঘাটী
ফুলকুসুমপুর খুব কাছে ৩০
পরদিন সকাল হল যেন এক নতুন ভোরকে সঙ্গে নিয়ে। আজ আনন্দের স্রোতে ভাসতে-ভাসতে অনিচ্ছে ঠাকুরমা পুজোর ফুল তুলতে যেতে অনেক দেরি করে ফেললেন। গল্পকাকার পাড়ার ফুটবল মাঠে জগিংয়ে যাওয়া হল না ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল বলে। ইচ্ছেদাদুর সকালের চা খেতে কত বেলা হয়ে গেল। অনেক দিন ধরে সকালের চায়ের কাপটা মাধুরীজেম্মা দাদুর হাতে তুলে দেন। আজ দেরিতে ঘুম থেকে ওঠার অপরাধে তিনি দাদুর সামনে আসতে রাজি হলেন না। বকুনি শোনার ভয় আছে না! চা দিতে দেরি হলে অন্য দিন দাদু মহাভারতের যুদ্ধ বাধিয়ে ফেলেন বাড়িতে। আজ দাদু একটিও কথা বললেন না এই দেরি নিয়ে।
অনিচ্ছে ঠাকুরমা চায়ের কাপটা দাদুর সামনে এগিয়ে দিতে-দিতে বললেন, ‘ইস, তোমাকে আজ চা দিতে বউমাদের বড্ড দেরি হয়ে গেল!’
ইচ্ছেদাদুর মুখে সকালবেলার রঙিন রোদের মতো এক ঝলক রোদ-মাখা হাসি-খেলে গেল। হাসতে-হাসতে দাদু চায়ের কাপে প্রথম চুমুক দিয়ে মুখ তুলে বললেন, ‘দ্যাখো অনিচ্ছে, বউমাদের বলে দিও, এমন আনন্দের পর অমন একটু-আধটু দেরি কিন্তু মোটেও দোষের নয়।’
বিলম্বদাদুকে সকাল থেকে হাঁকডাক করে কোত্থাও পাওয়া যাচ্ছে না। সেই নিয়ে ইচ্ছেদাদু বিচলিত। ঠাকুরমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বিলম্ব তোমাকে কি কিছু বলে গেছে সে কোথায় যাচ্ছে? সকাল থেকে তিনি যে কোন মহাকাজে ব্যস্ত বুঝতে পারছি না। আমি তাকে কৃষিমেলার স্টলে একবার পাঠাব বলে কখন থেকে বসে আছি। আমাদের হযবরল চিড়িয়াখানার মেম্বাররা সকলে ভাল আছে কিনা দেখে আসতে বলতাম।’
ঠাকুরমা বললেন, ‘তুমি পরিপালনকাকুকে ফোন করলেই তো পার? কাল থেকে সে তো কৃষিমেলার স্টলেই আছে?’
দাদু বললেন, ‘সে কি আর করিনি ভেবেছ? কিন্তু পরিপালনের ফোন নট রিচেবল বলছে সেই কখন থেকে।’
চায়ের কাপ শেষ করে দাদু দোতলার বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। এমন সময় বিপদভঞ্জনস্যার নীচ থেকে হাঁক দিলেন, ‘কই গো ইচ্ছেকুমার! কী করছ? ঘুম ভেঙেছে তো?’
দাদু ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘এসো, এসো বিপদভঞ্জন। উপরে এসো!’
স্যারের জন্যে তখনই চা নিয়ে হাজির হলেন অনিচ্ছে ঠাকুরমা। ইচ্ছেদাদু ব্যস্ত হয়ে স্যারকে বললেন, ‘শুনেছ কি, আমাদের বিলম্ব সকাল থেকে কোথায় যে উধাও হয়ে গেছে, তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! এ এক মহা মুশকিল কাণ্ড হল!’
স্যার বললেন, ‘আমি এখনই তো পিচ রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এলাম বিলম্বকে।’
‘তুমি কি ঠিক দেখেছ বিপদভঞ্জন?’
‘হ্যাঁ, দেখেছি তো! বিলম্ব এসে ঢপাস করে আমাকে প্রণামও করল।’
দাদু বললেন, ‘দেখা যাক, কখন উনি এসে বাড়িতে ঢোকেন! সেখানে যে ওঁর কী এমন মহাকাজ, কে জানে?’
সূর্য এখন গাছপালার মাথার উপর উঠে পড়েছে। কাল সন্ধেবেলা টিভির খবরের পর ফুলকুসুমপুর গ্রামের অধিবাসীরা যারা ত্রিপাঠীবাড়িতে এসে শুভেচ্ছা জানাতে পারেনি, তাদের অনেকে আসতে শুরু করেছে। কারও হাতে ফুলের তোড়া, কারও হাতে মিষ্টির প্যাকেট। দাদু বাড়ির সমস্ত চেয়ার এনে বারান্দায় পেতে দিতে বললেন তিন্নির বাবাকে। তিনি বারান্দায় চেয়ার জড়ো করতে লাগলেন। কুয়াশামাসি বাড়িতে আসামাত্র তাকে দেখে অনিচ্ছে ঠাকুরমা অর্ডার করলেন, ‘তুমি এক্ষুনি বড় কেটলিতে করে অনেকটা চা বসাও। দেখছ না, কত লোকজন আসছে আমাদের বাড়িতে? তাদের অন্তত এক কাপ করে চা তো দিতে হবে? জয়তী, তুই কি একটা দিনও খানিক আগে-আগে আসতে পারিস না?’
কুয়াশামাসি বাড়িতে ঢোকার মুখে ঠাকুরমার অমন মুখঝামটা শুনে মুখ ভার করে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। যত লোকজন আসছে, মাধুরীজেম্মা, করবীকাকি আর বকুলকাকি মিলে পালাক্রমে চায়ের কাপ নিয়ে রান্নাঘর থেকে যাওয়া-আসা করছেন।
বড়দের এত কোলাহলে ছোটদের ঘুম ভাঙতে শুরু করল। প্রথমে বিন্নি ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসে হাতের তালুর উলটো দিক দিয়ে চোখ ঘষতে-ঘষতে ঘুম তাড়াতে লাগল। ততক্ষণে বুম্বা ঘুম থেকে উঠে বিন্নিকে জিজ্ঞেস করল, ‘বিন্নিদি, বাড়িতে অত হইহট্টগোল কেন রে? আমাদের বাড়িতে চোর-ডাকাত পড়েছে নাকি রে?’
তিন্নিও উঠে চোখ ডলতে-ডলতে বলল, ‘দুর, চোর-ডাকাত পড়বে কেন? এ হল গিয়ে গিনেস রেকর্ড বুকে আমাদের বাড়ির নাম ওঠার প্রাথমিক আনন্দের প্রকাশ!’
একে-একে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে জড়ো হল ওরা। এমন সময় বিন্নির ক্লাসের চিকলু সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে এসে হাতছানি দিয়ে ডাকল বিন্নিকে, ‘একটু আয় না এদিকে!’
বিন্নি তার কাছে এগিয়ে গেল। চিকলু নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কাল টিভিতে তোদের বাড়ির হযবরল চিড়িয়াখানার কথা খবরে দেখিয়েছে? সকালবেলা আমি ঘুম থেকে উঠতে বাবা বলল। আমি মেলা থেকে ফিরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তাই দেখতে পাইনি। একটু বল না রে, কী বলেছে?’
বিন্নি গলায় গমগমে ভাব এনে বলল, ‘সে অনেক কথা। চট করে তোকে বলে শেষ করতে পারব না। শুধু এটুকু জেনে রাখ, আমাদের বাড়ির কথা মনে হয় গিনেস বুকে উঠে যাবে।’
চিকলু অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কেন, তোদের বাড়ির কথা গিনেস বইয়ে উঠবে কেন রে?’
বিন্নি বলল, ‘সে অনেক কথা, স্কুলে গিয়ে সব বলব। শুধু জেনে রাখ, আমাদের হযবরল চিড়িয়ানার মতো পশু-পাখি আর মানুষ মিলে একসঙ্গে একটা বাড়িতে থাকার ঘটনা নকি সচরাচর দেখা যায় না। বাকিটা পরে শুনে নিস!’ বলে বিন্নি ভিড়ের মধ্যে আগে যে পজিশনে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
ততক্ষণে নৈবেদ্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হেডমিস অরুণিমা সরকার চলে এলেন শুভেচ্ছা জানাতে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে আসতে দেখে ইচ্ছেদাদু উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বললেন, ‘এসো, এসো অরুণিমা!’
অরুণিমা মিসের হাতে এক মস্ত বাহারি ফুলের তোড়া। তিনি ইচ্ছেদাদুর হাতে তুলে দিলেন শেই ফুলোর তোড়াটি। ঠিক তাঁর একটু পরেই এসে গেলেন অহেতুকপুর গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান দিবানিশি নস্কর। আর ঠিক তার পর-পরই গল্পকাকার মোবাইলে শুভেচ্ছাবার্তা চলে এল কলকাতা থেকে ‘পশুক্লেশ নিবারণী সমিতি’র সেক্রেটারি অনুপম দে’র।
তক্ষুনি বাড়িতে খবরের কাগজ-দেওয়া কাকু আজকের তিনটে খবরের কাগজ দিয়ে গেলেন। ইচ্ছেদাদু একটা খবরের কাগজ, স্যার একটা কাগজ আর গল্পকাকা একটা কাগজ হাতে নিয়ে একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘এই তো, ফার্স্ট পেজে আমাদের হযবরল চিড়িয়াখানার স্টলের ছবি বড় করে ছাপা হয়েছে। সে ছবিতে বুম্বা, বিন্নি আর তিন্নি তো আছেই। সেই সঙ্গে ইচ্ছেদাদু আর অনিচ্ছে ঠাকুরমাকেও সে ছবিতে দেখা যাচ্ছে। ছবিতে বিংগো, মিঁউ, কুমি এবং রাধাগোবিন্দও আছে।
তক্ষুনি কোত্থেকে হন্তদন্ত চেহারায় বাড়িতে এসে ঢুকল বিলম্বদাদু। এসেই দাদুর হাতের খবরের কাগজে তার নিজের ছবি ছাপা হয়েছে কিনা উঁকি দিয়ে আঁতিপাতি করে খুঁজছিল। না দেখতে পেয়ে ইচ্ছেদাদুকে জিজ্ঞেস করল, ‘বড়বাবু, খবরের কাগজে কই আমার ছবি তো ছাপেনি? এই খবরের কাগজের লোকেরা বড্ড একচোখো!’
দাদুর এতক্ষণের সব রাগ গিয়ে উপচে পড়ল বিলম্বদাদুর উপর। দাদু বললেন, ‘তুই এমন কী মহাকাজ করেছিস যে, খবরের কাগজে তোর ছবি ছাপা হবে? হনুমান কোথাকার! তার আগে বল, সকাল থেকে কোথায় ছিলি? দরকারের সময় তোকে কক্ষনো যদি পাওয়া যায়?’
বিলম্বদাদু ঘাবড়ে গিয়ে থতমত মুখে দাঁড়িয়ে থাকল। অনিচ্ছে ঠাকুরমা বললেন, ‘যাক, এত লোকের সামনে ওকে অমন করে আর বোকো না তো!’ তারপর গলার সুর নরম করে ঠাকুরমা জিজ্ঞেস করলেন, ‘বিলম্ব, তুই কোথায় গিয়েছিলি? বিপদভঞ্জনস্যার বললেন, তুই নাকি পিচ রাস্তায় গিয়েছিলি?’
বিলম্বদাদু বলল, ‘গিয়েছিলাম তো! সকাল থেকে কত-কত লোক আসছে মেলায় যাবে বলে। তারা আমাদের চিড়িয়াখানার স্টল দেখতে চায়। বাস থেকে যত লোক নামছে, তারা জনে-জনে জিজ্ঞেস করছে, ‘হ্যাঁ গো! হযবরল চিড়িয়াখানার স্টলটা কোথায় হয়েছে গো?’ আমি তাদের পথ না দেখিয়ে বাড়ি চলে আসি কেমন করে? তাদের পথ দেখিয়ে দিচ্ছিলাম, কোন দিকে গেলে মেলায় আমাদের চিড়িয়াখানার স্টল দেখতে পাবে।’
তখনও একটুও রাগ কমল না দাদুর। তিনি বললেন, ‘হতভাগা, তুই যে সকলকে মেলার দিকে পাঠিয়ে দিলি, এখন কি মেলার গেট খুলেছে নাকি?’
বিলম্বদাদু নিজের হাত দিয়ে কপাল চাপড়ে বলল, ‘আমার কপাল! সে খবরও শোনেননি বড়বাবু? সকাল থেকে এত-এত লোক আসছে দেখে মেলার গেট কখড় থেকে খুলে দেওয়া হয়েছে ডি এম সাহেবের অর্ডারে।’
‘ও, তাই নাকি? পরিপালন তো ওখানে আছে। এ খবর ও তো কই আমাদের একবারও দিল না?’
তড়িঘড়ি হঠাৎ ত্রিপাঠীবাড়ির সব ভিড় যেন ফাঁকা হয়ে গেল। সকলে ছুটলেন গ্রামীণ কৃষিমেলার দিকে। ইচ্ছেদাদুর সব রাগ ততক্ষণে গলে জল হয়ে গেল। শুধুকাকা, গল্পকাকা আর তিন্নির বাবাকে বললেন, তোরা সকলে এক্ষুনি মেলায় যা তো! আমিও বিপদভঞ্জনকে নিয়ে মেলার মাঠে যাচ্ছি।’
তারপর বিলম্বদাদুর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় ইচ্ছেদাদু বললেন, ‘বিলম্ব, তুই বাবা বড়মার কাছ থেকে আমাদের সকলের জন্যে ব্রেকফাস্ট নিয়ে চলে আয় মেলার মাঠে। দেখিস, কোত্থাও দেরি করিস না যেন! তোর যা ভুলো মন! সকাল থেকে আমাদের কারও তো ব্রেকফাস্টই হয়নি। অযথা পথে বিলম্ব করিস না যেন!’ তারপর বুম্বা, বিন্নি আর তিন্নিকে বললেন, ‘তোরাও আমার সঙ্গে চল! গিয়ে দেখি মেলার মাঠে কী কাণ্ড হচ্ছে।’
সকলে মেলার মাঠে গিয়ে দেখলেন, লোকে থইথই করছে মেলাপ্রাঙ্গণ। সমস্ত ভিড় উপচে পড়ছে হযবরল চিড়িয়াখানার স্টলের সামনেই। সে খবর ফের পৌঁছে গেল কেমন করে টিভির অফিসে আর খবরের কাগজের অফিসে। একটু পরেই টিভির ওবি ভ্যান ছুটে এল। সেদিন সন্ধেবেলা আবারও ফলাও করে টিভিতে দেখানো হল ফুলকুসুমপুর গ্রামীণ কৃষিমেলার খবর। হযবরল চিড়িয়াখানার ছবিও অনেকক্ষণ ধরে দেখাল।
এভাবে আরও একটা দিন হয়ে হইহই করে কৃষিমেলা শেষ হয়ে গেল। আশপাশের কত গ্রামে যে ছড়িয়ে পড়ল হযবরল চিড়িয়াখানার খবর। সব স্টল ভেঙে গুটিয়ে নেওয়া হল। হযবরল চিড়িয়াখানার সব মেম্বারকেও নিয়ে আসা হল ত্রিপাঠী বাড়িতে। পরিপালনকাকু রাধাগোবিন্দ, বিংগো, মিঁউ আর কুমিকে স্নান করিয়ে ভাল করে খাইয়ে তারপর বাড়ি গেলেন।
ইচ্ছেদাদু পরিপালনকাকুকে বললেন, ‘তুমি বাবা কালকের দিনটা ছুটি নাও। তোমার অনেক ধকল গেল স্টল দেখতে।’
এ কথা শুনে গল্পকাকা আর শুধুকাকা বললেন, ‘বাবা, তুমি ঠিকই বলেছ। পরিপালন তিনদিন ধরে খুব খেটেছে। ওর বিশ্রাম দরকার।’
তিন্নির বাবা বললেন, ‘একটা দিন আমরা বিংগো-মিঁউ-কুমিদের সঙ্গে ভালভাবে কাটাই।’
অনিচ্ছে ঠাকুরমা বললেন, ‘আমার রাধাগোবিন্দকে তোদের দেখতে হবে না। আমি একাই দেখতে পারব। আর আমার সঙ্গে শুধু একা বুম্বা থাকলেই হবে।’
তারপর বুম্বার দিকে ফিরে ঠাকুরমা বললেন, ‘তুই আমার রাধাগোবিন্দকে আরও ছোট-ছোট দু’-একটা কথা বলা শিখিয়ে দিবি তো!’
বুম্বা জিজ্ঞেস করল, ‘কী কী কথা ঠাকুরমা?’
‘এই যেমন ধর, ‘আপনি ভাল আছেন তো?’---‘আবার আসবেন’—এরকম। কেউ মাস্ক না পরে এলে রাধাগোবিন্দ যেন বলতে পারে—‘ মাস্ক পরেননি কেন?’---এই কথাটাও শিখিয়ে দিস।’
ঘাড় নাড়ল বুম্বা। বলল, ‘তুমি কিচ্ছু ভেবো না ঠাকুরমা! আমি রাধাগোবিন্দকে ঠিক ও কথাগুলো শিখিয়ে দিতে পারব। ও আমার কথা খুব শোনে আর চটপট মনেও রাখতে পারে।’ বলে চলে গেল রাধাগোবিন্দর কাছে। সেই কবে থেকে রাধাগোবিন্দ ঘরের ভিতর খোলাই থাকে। এখন ঠাকুরমার টিয়াপাখিটা চুপচাপ বসে আছে বারান্দা রেলিঙে। ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখছিল। বুম্বা বলল, ‘কাল সকাল থেকে আমার কাছে তোর কথা শেখার ক্লাস হবে! পরিপালনকাকার আসার আগেই ঠাকুরমা খেতে তোকে সকালে খেতে দেবে। ততক্ষণে আমারও ব্রেকফাস্ট হয়ে যাবে। তারপর শুরু হবে তোর-আমার কথা বলার ক্লাস?’
রাধাগোবিন্দ কী বুঝল কে জানে। বলল, ‘ট্যাঁ-টাও, ট্যাঁ-টাও!’
ওর কথা শুনে ঠাকুরমা হেসে-হেসে বললেন, ‘দেখলি তো? তোর কথা শুনে আমার রাধাওবিন্দ বলল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে!’
বুম্বা কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। অবাক হয়ে ঠাকুরমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বড়রা ঠাকুরমার মুখে রাধাগোবিন্দর প্রশংসা শুনে হেসে চলে গেলেন।
তখনও ঠাকুরমার মুখের হাসিটা পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি। বুম্বা বারান্দা থেকে বাইরে ছাতিমগাছের দিকে তাকাল। দেখল পাতার ফাঁক দিয়ে পিটপিট করে রাধাগোবিন্দর দিকে তাকিয়ে আছে রুপোর থালার মতো গোল চাঁদটা!
(আগামী সংখ্যায় শেষ)
ধারাবাহিক ভ্রমণ (কেরালা)
কলমে - বাসবদত্তা কদম
পর্ব ২
আলেপ্পি বা আলাপুZhআর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে অনেক ছোট ছোট খাল আর এই খালগুলোর মাঝে মাঝে টুকরো টুকরো জমি। নারকেল গাছের তো কথাই নেই। যেখানে সেখানে নারকেল বন। খালগুলোর দুপাড়ে নারকেল গাছের সারি। আর সেসব গাছে ঝুলে আছে প্রচুর নারকেল। আমাদের দেশের নারকেলের ফলনের একটা বেশ বড় অংশ কিন্তু আসে কেরালা থেকে। ধর তুমি যাবে তোমার মাসি বা পিসির বাড়ি, মায়ের রান্না তরকারি পৌঁছাতে। দুটো রাস্তা পরেই সেই বাড়ি। তুমি আমি হলে সাইকেলটা বার করবো আর কেরিয়ারে বেঁধে চলে যাব। তরকারিটা পৌঁছে দিয়ে চলে আসব। ওরা কি করে বলত? বাড়ির সামনে বাঁধা নৌকোটা খুলে বৈঠা হাতে বসে পড়বে আর ও বাড়ির ঘাটে গিয়ে টুকুস করে তরকারির বাটিটা পৌঁছে দেবে। খালের আশে পাশে মাঝখানের ঐ চৌখুপী জমিগুলোতে ধান হয় প্রচুর। সবুজ থেকে সোনা রঙে মাঠগুলো বদলে যাচ্ছে দেখা যায় নৌকায় যেতে যেত্র। কেরালায় অবশ্য রবার এবং মশলাও হয় প্রচুর। চা কফি দুটোই হয় কেরালার পাহাড়ি অঞ্চলে। সেসব তো আমরা কেরালা ঘুরতে ঘুরতেই দেখতে পাব তাই না! তবে একটা খুব জরুরী এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে রাখো, আলাপুZhআ শুধু নয় পুরো কেরালায় শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা অথবা অনুপাত দুটোই পুরো ভারতবর্ষের শীর্ষে। আলাপুZhআ আবার কেরালা রাজ্যেও শিক্ষায় বেশ ওপরের দিকে নিজেকে ধরে রেখেছে। কেরালায় গড়ে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা একশো জনের মধ্যে ৯৬.২। আমাদেরই দেশের একটা রাজ্যে এত এত শিক্ষিত মানুষ! কি ভালো একটা তথ্য তাই না! আমার শুনেই মন ভালো হয়ে গেছিল।
আলাপুZhআ স্টেশনে যখন আমরা নামলাম, তখন সকাল সাতটা। এই স্টেশন থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে আমরা রওনা হলাম হাউসবোটেদের স্টপেজের উদ্দেশ্যে। একটা ছোট্ট ব্রিজ পেরিয়ে সে ট্যাক্সি চলেছে অনেকটা একটা পোকার মত গুটিগুটি। সামনে এলো একটা ব্রিজ, বেশ পাতলা পলকা চেহারা। ট্যাক্সির জানলা দিয়ে নীচে তাকিয়ে দেখি অনেকগুলো ছইঢাকা ময়ূরপঙ্খি নৌকা। ঠিক যেন ঠাকুরমার ঝুলি থেকে উঠে এসে ব্রিজের নীচে দাঁড়িয়েছে একটু নিঃশ্বাস নেবে বলে। আমি তো গলা খুলে চিৎকার করে উঠেছি, -ওই দেখ, কতগুলো ময়ূরপঙ্খি নাও। আমাদের ট্যাক্সিওয়ালা দাদা দেখি ধমকে উঠল -Those are houseboats madam.
যাব্বাবা বাংলাও জানে নাকি! কেরালার মানুষজন শিক্ষিত, এই মন ভালো করা খবর জেনেই এসেছি; কিন্তু তাবলে সে বাংলাও জানবে! সংশয়ও সেই কাটালে, শুনলাম বাঙালি ট্যুরিস্টের সংখ্যা এত প্রচুর, দু চারটে শব্দ শিখে গেছে সেও। তার মানে আমার মত ময়ূরপঙ্খি ভ্রম… আরো অনেকেরই হয়!
ব্রিজটা পেরিয়ে ট্যাক্সি নামল একখানা ঢালু পথে। ট্যাক্সি সে পথে গড়গড়িয়ে নামছে। সামনে আর বাঁদিকে জল, ডানদিকে কত ক—ত যে হাউসবোট। একতলা, দোতলা, আড়াইতলা; আর কি যে তাদের বাহার। ট্যুরিস্টরা তাতে উঠবে কি ফটো তুলেই কুল পাচ্ছে না। ট্যাক্সি থামতেই আমি ট্যুরিস্টেরও একই অবস্থা।
তা-র-প-র তো আমাদের জন্য বরাদ্দ হাউসবোটখানায় চড়লাম।
আমাদের চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেছে নৌকায় প্রবেশ করে তখন (ক্রমশঃ) এটা একটা নৌকো! কি নেই এর মধ্যে সেটাই গবেষনার বিষয় হয়ে উঠল আমাদের কাছে। যেখান দিয়ে উঠলাম সেটা এ বোটের ডাইনিং স্পেস আবার বসার জায়গাও বটে। খাবার টেবিল, ছখানা চেয়ার, তিনখানা বেতের সোফা, টেবিল। আর খাবার টেবিলের উপর অপূর্ব সুন্দর ভাবে সাজিয়ে রাখা ফল। ঢুকতেই অভ্যর্থনা মিলল ডাবের জল দিয়ে (ক্রমশঃ)
Comments
Post a Comment