জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম--৩৫ /সন্দীপ কাঞ্জিলাল


নাস্তিকের ধর্মাধর্ম--৩৫

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ধর্মে রাষ্ট্রের ভূমিকা

দ্বিতীয়ত, আপাত ধর্মনিরপেক্ষ পাশ্চাত্য দেশগুলোতে বর্তমানে একদিকে রাষ্ট্র এক দিকে যেমন ধর্মকে ব্যবহার করে বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে প্রতিহত করবার চেষ্টা করে না, অন্য দিকে আবার প্রচলিত ধনতন্ত্র ভিত্তিক রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক কাঠামোর কোন ব্যাপক পরিবর্তনের চেষ্টাও বরদাস্ত করে না। নতুবা বর্তমান শাসক শ্রেণীর শ্রেণীস্বার্থ বিপন্ন হবে। তাই ইউরোপে অনেকগুলো রাজনৈতিক দলেরই খ্রিস্টধর্মীয় নাম আছে, যাতে করে তাদের গণতন্ত্র, এবং কারো কারো তথাকথিত সমাজতন্ত্র প্রকৃতপক্ষে খ্রিস্ট ধর্ম এবং ধনতন্ত্রের গণ্ডি না পেরোতে পারে। ধর্ম ও জাতীয়তাবাদের নামে জনসাধারণকে সরলরেখায় ঐক্যবদ্ধ করতে পারলে তবেই প্রচলিত আর্থসামাজিক কাঠামোর অসম বিন্যাস এবং সমাজের উচ্চনিচ ভেদাভেদ থেকে তাদের দৃষ্টি সরিয়ে রাখা সম্ভব হয়। এ ভাবেই পাশ্চাত্য দুনিয়ার শাসক শ্রেণী ধর্মকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক রক্ষনশীলতার হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করে তাদের শ্রেণীস্বার্থ চরিতার্থ করে থাকে। 
মূলত একই কারণে ভারতবর্ষেও সংবিধানের খোদিত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি কার্যত বৈজ্ঞানিক সমাজ ব্যবস্থা গঠনের পরিপূরক ভূমিকা পালন করে না। শাসক শ্রেণীর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সনাতন হিন্দু ধর্মে আসক্ত, এবং যাগযজ্ঞ, পূজোপার্বণ, তীর্থস্থান সহ পৌরাণিক অতিকথায় অধিষ্ঠিত হিন্দু ধর্মের ধারক ও বাহক। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, ক্যাবিনেট মন্ত্রী, লোকসভার অধ্যক্ষ এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার সহ প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই (কিছু সংখ্যক বামপন্থী ছাড়া) যত্রতত্র মন্দিরে মন্দিরে পূজা দেন, এবং ছোট-বড় অসংখ্য বাবা গুরুদের শরণাপন্ন হয়ে থাকেন। প্রশাসনের উচ্চস্তরে অধিষ্ঠিত যে হিন্দু সরকারি আমলারা জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবনের ভালো-মন্দ নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদের অধিকাংশও একই ধর্মপথের পথিক। অতএব রাষ্ট্রীয় নীতি ও প্রশাসনে হিন্দু ধর্মীয়তার প্রতিফলন অবশ্যম্ভাবী। অযোধ্যার বাবরি মসজিদ সংক্রান্ত বিতন্ডার শুরু থেকে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ধর্মাসুরদের তাণ্ডবে এই মসজিদ ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত, এমন কি পরবর্তী কালের রাষ্ট্রীয় নীতিতেও মৌলবাদীদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব পরিষ্কার। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য রাষ্ট্র নিয়ন্তারা এমন সব হিন্দু ধর্মগুরুদের দ্বারা বাবরি মসজিদ-রাম মন্দির সমস্যার সমাধান করতে চেষ্টা করছেন, যারা নিজেরাই রামের অবতারত্ব ও দেবত্বে বিশ্বাসী, এবং কট্টর হিন্দু মৌলবাদী। যে রাজনৈতিক ধান্দাবাজেরা  ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ প্রচার করে, তারাই আবার এসব মৌলবাদী ধর্মগুরুদের পায়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে। আর তাদের সাহায্যে ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয় সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে। 

তাছাড়া এদেশে সর্বধর্মের সহাবস্থানের নীতির নামে রাষ্ট্র ধর্মের প্রতি উদাসীনতা এবং বিজ্ঞানমনস্কতাকে উৎসাহিত না করে প্রত্যেক মানুষের নিজ নিজ ধর্মের প্রতি অন্ধ আনুগত্যকেই প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। এর পেছনেও শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক অভিসন্ধি বুঝতে অসুবিধা হয় না। কারণ ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষের ধর্মান্ধতা এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাব বজায় থাকলেই অসম আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামো থেকে আমজনতার দৃষ্টি সরিয়ে রাখা সম্ভব হবে, আর এভাবে অটুট থাকবে শাসক শ্রেণীর শ্রেণীস্বার্থ। প্রকৃতপক্ষে শাসক দলেরা বিরোধী দলগুলোকে বহুধা বিভক্ত রেখে নিজেদের কায়েমি স্বার্থ চরিতার্থ করবার উদ্দেশ্য অনেক সময়ই পূর্বপরিকল্পনা মাফিক মৌলবাদী রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ভাবে উৎসাহ জোগায়। এ ভাবে ধর্ম এদেশে রাষ্ট্রশক্তির একটি প্রধান হাতিয়ার রূপে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, এবং আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কাঠামোর ব্যাপক পরিবর্তনের পথে এক বিরাট প্রতিবন্ধকের ভূমিকা পালন করে। 
এ ভাবে প্রাচীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎপত্তির সময় থেকেই রাষ্ট্র শাসক শ্রেণীর স্বার্থে ধর্মকে শোষণশাসনের হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করে এসেছে। পৃথিবীতে এখনো পর্যন্ত কোন দেশেই জনসাধারণ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারেনি। সর্বত্রই জনসাধারণ বা শূদ্রশ্রেণীর নামে এক অভিজাত বা আর্য শাসক শ্রেণী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অধিকার করে রেখেছে, আর সে ক্ষমতাকে ব্যবহার করে চলেছে অসম আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোকে নিজ শ্রেণি স্বার্থে চিরায়ত করতে। আর এই উদ্দেশ্য তারা চিরকাল রাষ্ট্রশক্তির পরিপূরক হিসেবে শাস্ত্রশক্তিকে ব্যবহার করেছে। ধর্মের আফিমে শূদ্র শ্রেণীকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে আর্য শাসক শ্রেণী নিজেদের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক সামাজিক প্রভুত্ব কায়েম রেখেছে। ধর্ম না থাকলে শূদ্র শ্রেণি প্রচলিত আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানাতো। আর যেহেতু তারা সংখ্যায় অধিক, অতএব জাগ্রত শূদ্র শ্রেণীর দুর্জয় শক্তিকে শুধুমাত্র রাষ্ট্রশক্তির সাহায্যে দাবিয়ে রাখা আর্য শ্রেণীর পক্ষে সম্ভব হতো না। শূদ্রশক্তির অভ্যুত্থান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক সাম্যের সূচনা করত। আর তা হতো দেশে দেশে আর্য শাসকশ্রেণীর পক্ষে অশনি সংকেত। প্রখ্যাত মার্কিন ইতিহাসবিদ উইল ও এরিয়েল ডুরান্ট ইতিহাসে ধর্মের ভূমিকা সম্বন্ধে যথার্থই বলেছেন যে চরম দারিদ্র্য ও অসাম্যের মধ্যে ধর্মই ইতিহাসে জনগণকে চিরকাল সান্ত্বনা ও আশ্বাস জুগিয়েছে। সে আশ্বাস লুপ্ত হলে শ্রেণিসংগ্রাম ও সাম্যবাদ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়তো।

 "Destroy that hope, and class war is intensified. Heaven and utopia are buckets in a wall: when one goes down the other goes up;when religion declines, communism grows."
সুদূর ভবিষ্যতের আদর্শ মানব সমাজে বর্তমানে প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং বর্তমানে প্রচলিত ধর্মের কোন অস্তিত্ব থাকবে না। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে রাষ্ট্র ও ধর্ম উভয়ই থাকবে। অতএব সমাজবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত সে প্রশ্ন অনিবার্য ভাবেই এসে পড়ে। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে রাখা দরকার যে রাষ্ট্র কর্তৃক জবরদস্তির মাধ্যমে মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করবার চেষ্টা কোন ভাবেই সমর্থন করা যায় না। কারণ জীবনের অনিরাপত্তা বোধ, অজ্ঞানতা, এবং কাল্পনিক ইচ্ছাপূরণের তাগিদ বশত ব্যক্তিমানুষ ধর্মের প্রয়োজন অনুভব করে। শাসক শ্রেণী নিজ স্বার্থে মানুষের এই মনোজগতের প্রয়োজনকেই চিরস্থায়ী করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে। মানব সমাজের রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্যক্তিমানুষের অনিরাপত্তা বোধকে কমিয়ে আনতে না পারলে শুধু জবরদস্তির মাধ্যমে জনজীবন থেকে ধর্মকে বিলুপ্ত করা সম্ভব হবে না। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রশক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে ধর্ম বিলোপের চেষ্টা হবে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ও মানবতা বিরোধী। এ পথে জনসাধারণের ধর্মবিশ্বাস দুর্বল না হয়ে আরো শক্তিশালী হবারই সম্ভাবনা। ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই দেয়।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments