জ্বলদর্চি

শ্যামল কান্তি /বুদ্ধদেব গুহ

শ্যামল কান্তি
 
বুদ্ধদেব গুহ

শ্যামলের সঙ্গে আমার পরিচয় প্রায় চল্লিশ বছর আগের। আনন্দবাজারের রবিবাসরীয় বিভাগের সম্পাদক রমাপদ চৌধুরীর ঘরে লেখা নিয়ে ও প্রায়ই আসত। তখন আমি সেখানে উপস্থিত থাকলে তার সঙ্গে দেখা হতো।

ছিপছিপে কালো সেই তরুণ সদালাপী কবিটির সঙ্গে তখন থেকেই সম্ভাব ছিল আমার। পরে ও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সম্পাদিত আনন্দমেলাতে যোগ দেয়।

শ্যামলের কবিতা ও ছড়ার আমি খুবই ভক্ত ছিলাম। মনে পড়ে না ওর একটিও কবিতা এবং ছড়া আমার খারাপ লেগেছিল বলে। ছড়া তো ও অনেক নামী কবির চেয়েও অনেক ভাল লিখত এবং আজও লেখে। আমি বলব যে ওর যোগ্যতা অনুযায়ী ওর যশস্থান দুর্বল বলেই যে নামযশের অধিকারী ওর হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। এটা দুর্ভাগ্যের। সাহিত্য পুরস্কারও ওর পাওয়া উচিত ছিল। তবে আমরা সকলেই জানি যে সাহিত্য পুরস্কার বঙ্গভূমে গুণবিচার করে কোনোদিনও দেওয়া হয়নি। কোনো কোনো বিবেকহীন প্রভূত ক্ষমতাসম্পন্ন কবি সাহিত্যিকই এ সব পুরস্কারের ধারক ও বাহক। তাদের ছত্রছায়াতে না থাকলে এই সব পুরস্কার জোটে না। শ্যামল একজন অত্যন্ত ক্ষমতাবান কবির অত্যন্ত কাজের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কেন যে নানা পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হয়ে রইল তা আমার কাছে এক রহস্য।

শ্যামলকে পূর্ব মেদিনীপুরের অন্যতম প্রধান কবি বললেও অত্যুক্তি হয় না। আজকাল কবির সংখ্যা অগুনতি অথচ তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই কবি নন। কবিতা লিখলে, কবিতার বই ছাপা হলেই কেউ সে কারণেই কবি হয়ে যান না। অথচ আজকাল সেইরকম কবিদের সংখ্যাই বেশি। জীবনানন্দ এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায় দুজনেই বলেছিলেন সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি। শক্তি একবার দেশ পত্রিকাতে একটি প্রবন্ধে ‘এত কবি কেন?' শীর্ষক একটি লেখা লিখে শক্ত ভিত গড়ে নেওয়া কিছু কবির কাছে সমালোচিত হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে অনেকে সরাসরি তাঁদের মত প্রকাশ করেছিলেন। যাঁরা কাব্য সাহিত্য জগতের পুরোভাগে আছেন অথচ প্রকৃত কবি নন, তাঁরা আড়াল থেকে শক্তিকে অপদস্থ করেছিলেন। অথচ শক্তি থেকে গেছেন এবং থেকে যাবেন তাঁদের যাবতীয় উষ্মা সত্ত্বেও। প্রকৃত কবিরা থেকে যাওয়ার জন্যেই আসেন – কিছুকাল সাহিত্য জগতে জল ঘোলা করে নানা পুরস্কার ‘বাগিয়ে' নেওয়া সত্ত্বেও তাঁরা কালের অমোঘ নিয়মে স্বাভাবিক ভাবেই হারিয়ে যান। তাই শ্যামল কবি হিসেবে থেকে যাবেন। মুছে যাবার জন্যে তিনি সাহিত্য জগতে আসেননি।

শ্যামলের কবিতার দু' একটি ছোটখাটো উদাহরণ দিতে পারি। যেমন— 'বাবা' শীর্ষক একটি কবিতা।

"বোন তোর ক্ষীরে ক্ষারে আছে
মাকে তোর কাগাবগা খায়
মিছিলের আগে আগে বাবা
স্বপ্নের পতাকা ওড়ায়।"

অথবা :

যাচ্ছি বনে ভাদর মাসে বাঘ কুড়োতে
আমরা ক'জন স্বভাবকালো গাঁয়ের ছেলে
এঁড়িগোপাল গেঁড়িগোপাল

আমরা ক'জন পেছনপাকা দেখতে পাচ্ছি নয়ন মুদে ফাঁকফোকরে থোম্বা মেরে আছেন তিনি ---
গুচ্ছ গুচ্ছ বাদল ঝরে উচ্ছেপাতায় 
মনের আগুন ছড়িয়ে পড়ে বনের কোলে
খুঁজতে খুঁজতে বাঘের সোনা রাত হয়ে যায়.....

খুঁজতে খুঁজতে এঁড়িগোপাল গেঁড়িগোপাল
দিগনগরে আমরা ক'জন চাঁদ হয়ে যাই 
চাঁদের সঙ্গে ভাদর মাসে ফিরছি বাড়ি ----
মেঘ জমেছে গাঁয়ের নীচে পায়ের নীচে 
উলটে যাচ্ছে কালাশশীর রসের হাঁড়ি 
তারপরে আর?

গাঁইতি শাবল উঠছে নামছে
আর কিছু নাই আর কিছু নাই আর কিছু নাই!”

শ্যামলের আরও একটি কবিতা বলি

"জনমানবশূন্য ঘরে
ছড়িয়ে আছে পাকুড়পাতা
কোথায় তোমার হারমোনিয়ম
কোথায় তোমার গানের খাতা ?

উচ্ছেগাছে কাঁপছে ফিঙে
ধানের মাঠে বৃষ্টি পড়ে,
ভূতের মতো চাঁদ উঠেছে
জনমানবশূন্য ঘরে।

আমরা শ্যামলের যোগ্য স্বীকৃতি পাওয়ার অপেক্ষাতে দিন গুনব আর প্রার্থনা করব শ্যামল যেন হতোদ্যম না হয়ে পড়ে, যেন তার কবিতা লেখা বন্ধ না করে। বন্ধ করলে তা আমাদের পরম পরিতাপের কারণ হবে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

0 Comments