জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম --৩৭ /সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -- পর্ব--(৩৭)

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ভারতবর্ষ ও ধর্ম



মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অবস্থান এবং ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার দিক দিয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অবস্থান নিরূপণ করতে হলে প্রাচ্যের অন্যতম উপমহাদেশ ভারতবর্ষকে নানা দিক দিয়ে খুঁজতে হবে। সারা পৃথিবীতে ধর্মের মানুষ ও মানুষের ধর্ম কিভাবে মানবজাতিকে যুগে যুগে সভ্যতা ও সংস্কৃতির অগ্রগমনের ইতিহাসের দিকে এগিয়ে বা পিছিয়ে দিয়েছে তার খবরও পাওয়া দরকার।

 ভারতবর্ষ প্রাচ্যের একমাত্র দেশ, যেখানে সব ধর্মের মিলন ঘটেছে, সব ধর্মের মানুষের সহাবস্থান সম্ভব হয়েছে এবং প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই এই ভূমিখন্ডে মানুষ তার আত্মার আনন্দ লাভের জন্য ব্যাকুল থেকেছে। এখানেও বিনা বিচারে মানুষের ধর্মীয় দর্শনগুলিকে কখনও গ্রহণ করা হয়নি এবং কোন ধর্মই এখানে সুপ্রতিষ্ঠিত একমাত্র ধর্ম বলে স্বীকৃতি লাভ করেনি। ধর্ম কেন ভারতীয়দের জীবনে মূল প্রেরণাশক্তি; কেন আবহমানকাল ধরে নানা উত্থান পতনের মধ্যেই ধর্মীয় বিশ্বাসগুলি থেকে মানুষকে এক চুলও নড়ানো যায়নি- এসব প্রশ্নের উত্তরও খোঁজার প্রয়োজন রয়েছে। অপরদিকে এই বিশ্বাস ভারতবাসীকে কতটা এগিয়ে বা পিছিয়ে দিয়েছে, কেন ভারতবর্ষের মানুষ অক্লান্তভাবে ধর্মকেই এত গুরুত্ব দিয়েছে ও দৈনন্দিন জীবন চর্চার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নিজেদের নুতন করে পরিমার্জিত ও পরিশীলিত করতে এখনও গড়িমসি করছে; বিজ্ঞানকেই বা তারা কি চোখে দেখছে, বিশেষত ধর্ম ও আধ্যাত্বিকতার আলোকে, তার বিশ্লেষণেরও প্রয়োজন রয়েছে। 

কেন ভারতবর্ষের যুগন্ধর মহামানবগণ ধর্ম ও আধ্যাত্মিক জীবনের পরম্পরাকে আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে নিরীক্ষণ করে এখনও নির্দ্বিধ প্রত্যয় নিয়ে 'ধর্মই জীবন' এই সত্য পালনে বদ্ধপরিকর, তাও জানা দরকার। নানা কুসংস্কারের জর্জরিত এই ভারতভূখণ্ডের মানুষ দারিদ্র্য অশিক্ষা অপুষ্টিতে নিত্য দীর্ণ এবং জীবনযাপনের প্রতিপদে ধর্মের মানুষের এত বাড়বাড়ন্ত এবং মানুষের ধর্মপালনে এখনও অনুদার; তার পিছনে আর কি কি কারণ এখনো বর্তমান তাও জানা দরকার।

 অপ্রতিহত গতি মহাকালের কোলে মানব সভ্যতাকে বিচার করতে গিয়ে সারা পৃথিবীতে মানুষের অবস্থান কোন দিকে দিয়ে শ্রেষ্ঠ, অপর দিকে কোন কোন ক্ষেত্রে মানুষ এখনো জীবস্রেষ্ঠ হতে চাইছে না বা পারছে না এবং কি কি কারণে তা সম্ভবপর হচ্ছে না তারও বিচার বিশ্লেষণ নতুন করে করা দরকার। 

আপামর ভারতবাসীর প্রাণবহ্নিতে কি সেই দাহিকাশক্তি যা তাকে নিত্য দহনের মধ্যে রেখেও অনিঃশেষ ভস্মীভূত করতে পারে না বরং দীপ্যমান রাখে; সাকার উপাসনার মধ্য দিয়ে তার ধর্মজীবনকে নিরবচ্ছিন্ন আনন্দধারায় স্মাত রাখে- সে বিষয়ে জানতে হলে তার আধ্যাত্বিক অস্তিত্ব ও অবস্থানকেও বিচার করতে হবে। কবি, দার্শনিক মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে প্রত্যয়ী হয়ে কেন তিনি ভারতবর্ষকে ভালোবাসেন, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন- "I love India, not because I cultivate the idolatory of geography,not because I have had the chance to be born in her soil;but because she has saved through tumultuous ages the living words that have issued from illumined consciousness of her great sons- saytam Jnanam Anantam Brahma: Brahma is Truth,Brahma is wisdom,Brahma is infinite;santam sivam Advaitam: Peace is in Brahma,goodness is in Brahma and the unity of all beings."

গৃহী ভারতবাসীর সমগ্র জীবন এই ব্রহ্মের উপর প্রতিষ্ঠিত, সে তার অভিজ্ঞতার মধ্যে সবকিছুকেই ব্রহ্মের আলোকে দর্শন করে এবং তার সমস্ত জাগতিক পারমার্থিক কাজকর্ম ব্রহ্মের চরণেই নিবেদন করে। তার প্রার্থনার দেবতাকে সে সাকার করে নিজের করে গড়ে তোলে। তার চোখে তাই এই বিশ্বজগত পরমেরই প্রকাশ। মেরি সে বিশ্বাস করে- তার শুভকাজ তাকে শুদ্ধ জীবনের অধিকারী করে এবং খারাপ কাজ তাকে নরকে পতিত করে। মন্দ থেকে ভালোর দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই সে পাবে মুক্তি। পরমের চরণেই তার শেষ আশ্রয়। 

এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পরমের লীলাক্ষেত্র, যেখানে মানুষই একমাত্র জীব, যে তার এই লীলা বুঝতে ও অনুভব করতে পারে। কেমন করে ভারতবাসী যুগ যুগ ধরে বিবিধের মাঝে মিলনক্ষেত্রটিকে রচনা করতে পেরেছে, কেমন করে বহু ব্যবধান ও বৈচিত্রের মধ্যে বহু জাতি ধর্মের মানুষের আবাসভূমি এই ভারতবর্ষ সকলকে আপন করে বুকে তুলে নিয়ে স্বধর্ম পালনের ক্ষেত্রে তাদের আশ্রয় দান করেছে এবং নিজের স্বধর্মে নিজেকে স্থিত রাখতে পেরেছে; বহু আক্রমণের শিকার হয়েও ভারতবর্ষ নিপীড়ন লাঞ্ছনা-বঞ্চনা ও ধ্বংসের মধ্যে থেকেও প্রত্যাঘাতকে প্রবলভাবে আত্মসংযমের খাঁড়া প্রশমিত রাখতে পেরেছে, তার ইতিহাস খুঁজতে হবে। ভারতবর্ষের ভৌগোলিক বৈচিত্র্যও তার সামগ্রিক জীবন ও জীবনযাত্রার বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলির পরিবেশনে তাকে নানাভাবে প্রাণিত করেছে। নৃতত্ত্বের দিক দিয়ে বিচার করলে তার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে প্রতিদিনের জীবনচর্চার ভিতর দিয়ে; খাওয়া পরা বসবাস সামাজিক কাজকর্ম নৈতিক ও ধর্মীয় আচরণও সেই অর্থে বিপুলভাবে বৈচিত্রময়। নানা জাতি নানা ভাষা নানা পরিধান/ বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান- এক কথায় ভারত জীবনের দর্শন প্রতিফলিত। 

পারমার্থিক, অর্থনৈতিক সামাজিক ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের ভৌগোলিক অবস্থানের ভূমিকাও অনবদ্য। আর্যজাতির ভারত অভিযানের যুগ থেকে (খ্রিঃ পূঃ ২০০০-১৫০০) বর্তমান কাল পর্যন্ত যে ভারতীয় জীবন গড়ে উঠেছে, ভারতের ভৌগোলিক অবস্থানের অবদান ও প্রভাব তার জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পিছনে রয়েছে তার দর্শন, ধর্মজীবন এবং এই দর্শন ও ধর্মজীবনের উৎস রয়েছে বেদাশ্রিত জীবনাচরণ ও ঔপনিবেশিক ধর্মের প্রতিপালন। 

যুগে যুগে ধর্মগুরুগণ তাকে সব সময়ে স্মরণ করিয়েছেন, তার উপাস্য শ্রেয় কি? কি পেলে এই নশ্বর জীবনের সব পাওয়া যায়? ভারতবর্ষের মহামানবগণ কেউ-ই শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ছিলেন না; অমিতবিক্রমী যোদ্ধা ছিলেন না বা কুশলী বণিক ছিলেন না। তারা ছিলেন আধ্যাত্মিক জীবনের শ্রেষ্ঠ বার্তাবহ- অন্ধকার থেকে আলোয়, অসৎ থেকে সৎ- এ এবং মৃত্যু থেকে অমৃত জীবনের দিকে অসাধারণ পরিচালিকা শক্তির ধারক ও বাহক। তারা কখনও বিশেষ জাতি-গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন না; তারা সর্বযুগের সর্বকালের সমগ্র মানবজাতিকে দেশকালপাত্র ভেদে ডাক দিয়েছিলেন। ( ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

0 Comments