জ্বলদর্চি

শ্যামলকান্তির কবিতা, কবিতায় শ্যামলকান্তি /উৎপল ঝা

শ্যামলকান্তির কবিতা, কবিতায় শ্যামলকান্তি

উৎপল ঝা

শিরোনাম এরকমই ভেবেছিলাম— কবিকে তাঁর জীবনচরিতে না পাওয়া গেলেও, তাঁর কবিতায় নিশ্চয় তিনি ধরা দেবেন। অন্তত বেশিরভাগ কবির কবিতায় তাঁর স্বপ্ন, প্রেম, বেদনা বা আশাভঙ্গের বিচ্ছুরণ ধরা পড়ে। এর বাইরে থাকেন যে সামান্য ক-জন তাঁরা নিজেদের কবিতায় এত প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকেন যে, তাঁদের রেখাচিত্র আঁকা দুষ্কর।

হ্যাঁ, শ্যামলকান্তিও তেমনি একজন কবি, যাঁকে, যাঁর আত্মবিক্ষেপ থেকে ব্যক্তি মানুষটিকে চিহ্নিত করা খুবই দুরূহ কাজ। আমরা যারা শ্যামলকান্তিকে কিছুটা ঘনিষ্ঠভাবে জানবার সুযোগ পেয়েছি তারা জানি তাঁর স্বভাবের কিছু তির্যক বৈশিষ্ট্যের কথা। বন্ধুবৎসল ও অভিমানী। আপাত মুখরতা, নিজের বিশ্বাসের কথা স্পষ্ট উচ্চারণে উচ্চকণ্ঠে বলা যাঁর স্বাভাবিকত্ব। উত্তেজনার মুহূর্তে তীর নিক্ষেপে নির্দয়, কিন্তু পরমুহূর্তে নিজেই অনুতাপবিদ্ধ। এমন সব মহৎগুণের অধিকারী শ্যামলকান্তি। বাইরে থেকে তাঁকে যতটা প্রগলভ ও বহির্মুখী মনে হয়, তাঁর কবিতা কিন্তু অন্যকথা বলে। বড়ই অন্তরমুখী, গভীর গোপন তাঁর চলা।

তাঁর কবিতার এক মুগ্ধ পাঠক আমি। শ্রেষ্ঠ কবিতার পাতা উল্টে আমি ব্যক্তি শ্যামলকান্তিকে খুঁজি কিন্তু পরিচিত মানুষটির কোনো স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠতে দেখি না কোথাও। কিন্তু তিনি তো আছেন তাঁর কবিতায়। কোথাও না কোথাও। যতই প্রচ্ছন্ন বা নেপথ্যে রাখুন নিজেকে। কেমন অসহায় লাগে। আমি তাঁর কবিতার মৃদু ইশারাগুলির মধ্যে খুঁজতে থাকি কবি শ্যামলকান্তিকে। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলির নামের মধ্যেই রয়েছে নানা ইশারা ও সংকেত যেমন কাগজকুচি, প্রেমের কবিতা, ভূতের চরণে, আমাদের কবিজন্ম, লাল রঙের স্বর্গ, ভালোবেসেছিলাম, সরল কবিতা, ছোট শহরের হাওয়া, দূর থেকে দেখি, বইখাতা, খড়ের মানুষ, বোকামেয়ের জন্য, শত্রুরা বাড়ি নেই, যায় চলে দিন, রাক্ষস, অগ্রন্থিত কবিতা। এই হল তাঁর তিন দশকের কাব্যসম্ভার। বিচিত্র ভাবনার আবহ বহন করে আনে এই নামকরণ। হয়তো বা এই নামকরণের মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে থাকে কবির কবিজন্ম—

‘আমরা নশ্বর কবি, মালাচন্দনের গন্ধে

মুহুর্মুহু ডুবে যায় আমাদের সামান্য জীবন —

(আমাদের কবিজন্ম)

কী সেই সামান্য জীবন। সে জীবন, সেই কবিজন্ম যাকে ঢেকে রাখে ‘শালুক-পদ্মের কিছু পাতা'। শালুক-পদ্মের পাতায় ঢাকা যে জীবন তা হয়তো পূর্ণ নয়, তাই তাঁর মনে হয় 'যে জীবন পূর্ণ নয় তাকে আমি উদয়াস্ত খরচ করেছি।' অর্থাৎ কোথাও একটা অপচয় বেদনা, পূর্ণতার আকাঙ্ক্ষা লুকিয়ে রয়েছে কবিসত্তার গভীরে। 'সামান্য কথা' নামক ভূমিকায় কবির নিজের কথা এইরকম— ‘তিন দশক ধরে অবিশ্রান্ত চলছে এই কাটাকুটির খেলা। অনেক রাত্রে যখন চোখ জ্বেলে বসি এইসব বাতিল, ব্যর্থ ছেঁড়া ভাঙা অক্ষর সমষ্টি আর শব্দপুঞ্জের কাছে, অদ্ভুত এক শূন্যতায় বুক ভরে ওঠে। কিচ্ছু হয়নি। কিচ্ছু হয়নি এতদিন।... বিষাদে আর মনস্তাপে দিন যায়।' 

তাই কবি ‘অস্থির দুহাতে’ সরান ‘মাঘের কুয়াশা' এবং ‘স্তম্ভিত পাথর'। এইভাবে তাঁর অন্বেষণ জারি থাকে 'ভিতরে, বাইরে'। আর সেই অন্বেষণে ধরা পড়ে, 'নাভির ভিতর একটা অতৃপ্ত গাছ শাখা মেলছে।' সেই অতৃপ্তির ঘোর থেকে মনে হয় 'ঘুরে ঘুরে উড়ছে একটা হলুদ ডিম / ডিম না জীবনাকাঙ্ক্ষা টের পাই না ।' টের না পাওয়ার মধ্যে এই অতৃপ্তি প্রবল হয়ে ওঠে কিছুই জানা হল না 'তেমন করে কিছুই বোঝা হল না।'

এই অতৃপ্তি মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে শুরু করে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস পর্যন্ত সকল সৃষ্টিশীল লেখকের আত্মকথায় ফুটে উঠতে দেখেছি আমরা। বোধহয় এই অতৃপ্তি লেখকের বা কবির চালিকাশক্তি। যতই কেন কবি বলুন —

'দেখি, আমাদের ঠাণ্ডা, নিরুত্তেজ জীবনের উপর

অদ্ভুত অদ্ভুত সব পাতা ঝরছে ভাঙা বিষণ্ণ পাটকিলে রঙের পাতা।

(গ্রাম জীবনের হাওয়া)

কবির যে চেহারা শ্যামলকান্তির কবিতায় ঝলকে ওঠে সেখানে দেখি—

‘আর বাইরে মানুষগড়া সাঁকোর উপর দিয়ে

না-দেখা-গাঁয়ের কবিয়াল চলেছে.

পিঠে তার থালার মতো চাঁদ, তার কলঙ্কের ডালা।'

(বসন্তকুমারী) 
আবার সেই কবি কখনও বা 'স্বভাব কালো গাঁয়ের ছেলে'—এঁড়িগোপাল গেঁড়িগোপাল,তার কখনও মনে হয়—

দিগনগরে আমরা ক'জন চাঁদ হয়ে যাই। 
চাঁদের সঙ্গে ভাদর মাসে ফিরছি বাড়ি— 
মেঘ জমেছে গায়ের নীচে পায়ের নীচে

(এঁড়িগোপাল গেঁড়িগোপাল)

কবি যে মূর্তি মনে মনে গড়ে চলেন তা শুধু গড়া আর গড়ে নতুন করে ভাঙা। কবির হাতেই আছে 'তালপাকানো একটুখানি এঁটেলমাটি।' সেই এঁটেলমাটিতেই কবি গড়ে চলেছেন তাঁর অভীষ্ট নানা মৃন্ময় ও চিন্ময় মূর্তি। শুধু কি তাই 'ঘোড়া নিয়ে আমি একসময় দু-হাতে কবিতা লিখতাম' বলে কবি আরও জানান— 'জীবনমুখী এই কবিতাগুলি নিয়ে আমি একটি বই লিখেছিলাম / একবার: আমাদের ঘোড়াজন্ম।' এইভাবে কবিজন্ম ঘোড়াজন্ম একাকার হয়ে যায়। আর এই গড়া, এই লেখা ছাড়া তাঁর ‘কিছুই করার নেই, কথার কুহক ভেঙে ভেঙে' তাঁর একমাত্র সাধ 'আমি যেন একমনে বই-খাতা লিখে যেে পারি।'

হ্যাঁ, কথার কুহক ভেঙে ভেঙে তা মিশে যেতে চায় সামগ্রিক কবি জীবনের স্রোতে যেখানে কবির নিষ্ক্রমণ সেই সমূহ জীবনের দিকে—

সূর্যান্ত পেরিয়ে যাই আর কাঁসাই নদী আর নুড়িপাথর
 জল পেরিয়ে যাই আর বালি আর মাথা নিচু হয়ে আসে 
ডোমচণ্ডালের জীবন আমাদের আমরা আর শালবনি দেখতে পাই না'
(শালবনি)

এইভাবে অতর্কিতে প্রান্তিক জীবনের দিকে ঘুরে যায় তাঁর কবিতা, কখনওবা একক কবিজীবন কবিসম্মেলনের মোহনায় গিয়ে ভেড়ে—

ধানচালের মতো এইসব পুরুষ্ট গম নিয়েও
একদিন দারুণ দারুণ কবিতা লিখব আমরা— 
পড়তে পড়তে তরুণ কবিদের জীবন ধন্য হয়ে উঠবে! 
(গম)

বর্তমান আর ভবিষ্যৎ এইভাবে লীন হয়ে যায়। কবিতার সঙ্গে কবির যেন রক্ত-মাংসের নিবিড় সম্পর্ক—

'আমার কবিতার মতোই সত্য আর পরিপূর্ণ এই আয়না
 আয়নার মতোই বিকশিত আর সত্য এই আমার শরীর।

(কথা সাজিয়ে নিচ্ছে আমাকে)

কবিতা যেন কবি-অস্তিত্বের গভীরে গিয়ে মেশে। আর 'লক্ষ লক্ষ কথা' কবিকে 'নিজের মতো করে সাজিয়ে নিচ্ছে' অর্থাৎ কবি যেমন কবিতা গড়ছেন, কবিতাও কবিকে গড়ে চলেছে।

সত্তরের কবি শ্যামলকান্তির কবিতায় নাগরিক আর গ্রামজীবনের এক অদ্ভুত মিশেল ও উদ্ভাস। যা তাঁর কবিতাকে করেছে স্বতন্ত্র। 

‘ছেলেবেলা থেকে যে বর্ণকানা' সেই কবির চোখেই ধরা পড়ে পৃথিবীর অপরূপতা, অপূর্ব তার মায়া। মানুষের সঙ্গলোভী কবির মনে হয়— 'একাকী থাকাও খুব ভালো নয়' সংসারমায়া তাঁকে ঘিরে ধরে।

'একেকদিন এই ব্যর্থ অসম্পাদিত জীবনে
খুব হাহাকার বইতে থাকে
 জানলার জোড় খুলে যায়—'

(জীবনকাহিনী)

জীবনকে ভালোবেসেই ‘মরণমধু গাছের কাছে' গিয়ে দাঁড়াতে সাধ হয়— 
মনে হল, মরে যাই। মনে হল, কী হবে এখন মরে

মনে হল, অনেক সময় আছে, একটু একটু করে
প্রাণ খুলে মরা যেতে পারে।
সংসারে অপূর্ব মায়া। যাই গিয়ে হাঁটু গেড়ে রাত্রি জয় করি। 
একদিন এইসব মনে হওয়া কান্ত কোমল এই কবিকেও
ভাসিয়ে দিয়েছে।

(একদিন)

মন কেমন করা বিস্ময়ে ষাটের দরজায় দাঁড়ানো এই শ্যামল কোমল কান্ত-কবির উদ্দেশ্যে ভাসিয়ে দিই তাঁরই কবিতার চূর্ণ দুটি পঙক্তি—

'দুয়ারে ধানের ছায়া / ধানগম / উড়ে চলো ও শ্যামল / আরও আরও পঞ্চাশ বছর—'

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments