জ্বলদর্চি

শ্যামলকান্তি দাশের কবিতা ও কবিতার মনোজগতে /গৌতম হাজরা

শ্যামলকান্তি দাশের কবিতা ও কবিতার মনোজগতে

গৌতম হাজরা

সত্তর দশকে যে ক'জন কবি তাদের নিজস্ব কাব্য প্রতিভায় ভাস্বর হয়েছেন, তাদের মধ্যে শ্যামলকান্তি দাশ অন্যতম। এ যাবৎকাল তার যত কবিতা পড়েছি তাতে আমি শুধু মুগ্ধ হয়েছি তা নয়, বরং বলা চলে আমি তার গুণমুগ্ধ হয়ে উঠেছি। আজ পর্যন্ত তার কোনো কবিতাতেই জটিলতা খুঁজে পাইনি, অথচ সহজ সরল শব্দে তিনি যে জগৎ সৃষ্টি করেছেন, তা মনের মাঝে অদ্ভুত এক অণুরণন সৃষ্টি করেছে। তাই বলা যেতেই পারে তার কবিতার মেজাজ একেবারেই আলাদা। তার কবিতার ঝুলি থেকে বেরিয়ে আসে হ্যামলিনের বাঁশি, আর সেই বাঁশির সুরে পিলপিল করে বেরিয়ে আসে অজস্র শব্দ।

এড়িগোপাল, গেঁড়িগোপাল' কবিতাটি 'দেশ' পত্রিকায় বেরিয়েছিল। কবিতাটি পড়ে বুঝেছিলাম কীভাবে তিনি শব্দকে অনায়াসে করায়ত্ত করতে পারেন। কীভাবে উলটে দেন 'কালাশশীর রসের হাঁড়ি।'

'খুঁজতে খুঁজতে এড়িগোপাল গেঁড়িগোপাল
দিগনগরে আমরা ক'জন  চাঁদ হয়ে যাই 
চাঁদের সঙ্গে ভাদর মাসে ফিরছি বাড়ি—
মেঘ জমেছে গায়ের নীচে পায়ের নীচে
উলটে যাচ্ছে কালাশশীর রসের হাঁড়ি....
তারপরে আর ?
গাঁইতি শাবল উঠছে নামছে
আর কিছু নাই আর কিছু নাই আর কিছু নাই।'

 শ্যামলকান্তির কবিতায় 'বাঘ'কে যদি চিনতে হয় তাহলে অবশ্যই পড়তে হবে 'রসুই ঘরের বাঘ'। কবিতার শেষ পংক্তিতে আছে 'অভিভূত রসুই ঘরের বাঘ, চিরনূতনের ফাঁসে জড়াল তোমাকে।' যদি ক্রিয়াপদের কৌশল জানতে হয় তাহলে পড়তে হবে তার 'বাঘ ভালুক' কবিতাটি। 'ছবির কত রঙ' রঙে বাঘভালুক ফোটে।' 'বাঘের খোঁজে' কবিতায় ছেলেকে ঠাকুরমার ঝুলি থেকে শোনান বাঘের গল্প। যেখানে খড়ের বাঘ, কাগজের বাঘ, ন্যাকড়ার বাঘের সঙ্গে কবি স্বয়ং 'বাঘ' হয়ে শোনেন বউমার আবদার। 'রূপ আর রূপকের রহস্য ভেদ করেন ছেলে আর বউয়ের জন্য একই কবিতায়। শ্যামলকান্তির কবিতায় দেখা যায় 'বাঘ' শব্দের অর্থময়তা কীভাবে কবিতালোকের নিজস্ব সত্তায় উঠে আসে। কত সহজে তিনি নির্ধারণ করেন কীভাবে কবিতার মধ্যে থেকেও বাঘের খুব কাছে যাওয়া যায়।

শ্যামলকান্তির কবিতাগুলি সহজ হলেও তার গভীরতা কিন্তু বহুদূর বিস্তৃত। অনুভূতি দেশের গভীরে তার বার্তা পৌঁছে যায় অতি সহজে। তার 'রাক্ষস' সিরিজের কবিতায় উঠে আসে তেমনিই অনুভূতি। কে কাকে সৃষ্টি করেছে তার কোনো ঠিক নেই। সৃষ্টির আহ্লাদে মেতে ওঠা এই এক ও অনেকের জগৎ আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে :
'আমি আয়নার সামনে দাঁড়াই। হাত জোড় করি। 
মাথা ঠেকাই আয়নার পায়ে।

আমার কবিতার মতোই সত্য আর পরিপূর্ণ এই আয়না।
 আয়নার মতোই বিকশিত আর সত্য এই আমার শরীর। 
শরীর থেকে টেনে হিচড়ে বের করে আনি কথা। 
অন্ধকার ঘরে হাজার হাজার কথা ছড়িয়ে আছে।
 পিঁপড়ের মতো। মাকড়শার মতো। চিনির মতো। 
অশ্রুর মতো। বেদনার মতো।'

(কথা সাজিয়ে নিচ্ছে আমাকে)

শ্যামলকান্তির বেশিরভাগ কবিতাতেই ছুঁয়ে আছে প্রান্তিক সংবাদ, গ্রাম জীবনের হাওয়া। তার ভাষায় উঠে আসে অভিজ্ঞানের জ্যোৎস্না। শ্যামলকান্তির 'লাল রঙের স্বর্গ' কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। কাব্যগ্রন্থটির এক কপি আমাকে উনি দিয়েছিলেন অনেক ভালোবাসায়। এই কাব্যগ্রন্থে তাঁর 'টুকটুকি ও শব্দজব্দ' কবিতায় যে চমৎকার একটা খেলা আছে তা বলাই বাহুল্য।

‘রাত ফুটুস হয়ে আসছে, এদিকে আমরা কী দেখছি ? দেখছি যে শব্দের
জট খুলতে খুলতে ন্যাতা মেরে গেছেন বভ্রূবাহন
আলস্যে ঘন ঘন মাজায় হিল্লোল তুলছে টুকটুকি
শব্দে শব্দে এখনও জব্দ হয়ে আছে ঘর
 এখানে 'তটিনীতটের কুমির', ওখানে 'লোক শিল্পের দাঁড়াশ_'
এখানে 'বাঘবন্দি মৃণাল', ওখানে 'হৃদয়হরণ সর্বস্ব'
 কে কাকে নেবে, কে কাকে তুলে ধরবে, আমরা ঘরকুনো রাঢ় বঙ্গের পাঠকরা
কিছুই বুঝতে পারছি না
শুধু দেখতে পাচ্ছি লেপকাঁথার জলজঙ্গল থেকে
ধীরে ধীরে হাওয়ায় বিন্দু হয়ে যাচ্ছে শীতঘুম!'

 শ্যামলকান্তির এমন অজস্র কবিতা আছে যেখানে সাপ, ব্যাঙ, পিঁপড়ে, তিমিরা যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে টাকা পয়সাও, এসেছে ভূত, যক্ষ, রাক্ষস আরও কত কী! কী নেই তার কবিতায়। তাই যখন তার কবিতায় মনোনিবেশ করি দেখতে পাই চাঁদের টুকরোগুলো জড়ো হয়ে শেষে চাঁদের বই হয়ে গেছে। 'চাঁদের আলোয় একদিন জন্ম হয়েছিল আমাদের /আজ এতদিন পরে অক্ষরের আলোয়/আমরা একটা চরিতার্থ চাঁদের বই হয়ে গেলাম।'

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments