জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৬৮


সম্পাদকীয়,
কবি মাইকেল মধুসূদন তার এক লেখায় বলেছিলেন, ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে..’। কিন্তু হিন্দু পুরাণে একটি মন্ত্র আছে...অশ্বত্থামা বলির ব্যাসঃ হনুমন্থরঃ বিভীষণঃ।কৃপা পরশুরাম চ সপ্তৈতেয় চিরঞ্জীবীনঃ।।এই মন্ত্রে এমন সাত জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যাঁরা অমর। এছাড়াও পুরাণ মতে ঋষি মার্কন্ডেয় অষ্ট চিরঞ্জীবি, অসুর সম্রাট বলীও অমরত্বের বর পান। এখন কলিকালে নাকি অনেকে বলেন নেতাজীও চিরঞ্জীবি। পীযূষ আঙ্কেল তো তেমনই বলছেন। নেতাজীর মৃত্যু কবে কখন কোথায় হতে পারে সে নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। এই অধিক আলোচিত নেতাজীর কথা মলয় জেঠুর লেখা থেকে আরো ভালভাবে জেনে নিও, আর সেই আলোচনা পড়ে খুব গুরু গম্ভীর মনে হলে এসো ইন্দিরা আন্টির লেখা পড়ে জেনে নিই তিনি কি খেতে ভালবাসতেন, আর মুক্তি আঙ্কেলের লেখা পড়ে জেনে নিই তাঁর জীবনের মজার কথা। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছো সম্প্রতি গেল নেতাজীর ১২৫ তম জন্মদিবস। তাই তিতির তার প্রজেক্টে নেতাজীকে আঁকবে। তিতির কে? সেটা জস্নতে পড়তে হবে তোমাদের বন্ধু শতভিষার গল্প। আর তারসঙ্গে ভুললে চলবে না, এবারের ২৬ শে জানুয়ারী ছিল দেশের ৭৩ তম সাধারণ তন্ত্র দিবস। সেই দিনটিকে স্মরণ করে, আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে স্মরণ করে এসো আমরা রেডিও  - র সঙ্গে ওতোপ্রত ভাবে যুক্ত দুই আন্টি, শ্যামলী আন্টির আর পায়েল আন্টির দুটি লেখা পড়ে নিই। এবারের ছোটোবেলা পড়ে আমি জানি প্রত্যেক বারের মতো প্রিয় পাঠকরা বলবেই বলবে কদম কদম বাড়ায়ে যা। এই করোনার সময় কোথায় যেতে বলছে? আরে  বাসবদত্তা আন্টির সঙ্গে কেরালা চলো। চলো আপাতত ছোটোবেলার পাতায় ঘুরে আসি আর করোনার টীকা নেওয়া হলে বাবা-মার সঙ্গে কেরালা। জয়হিন্দ।  -- মৌসুমী ঘোষ।


 

রেডিওতে বক্তৃতা দিলেন গান্ধীজি  

শ্যামলী আচার্য 


ভারতে রেডিও সম্প্রচার শুরু করেন ব্রিটিশরাই। কিন্তু তার আড়ালে কলকাতার কিছু কৃতী মানুষও ছিলেন বইকি।  
১৯৩২ সাল। তোমরা সকলে জানো, সেই সময় সারা ভারতে জোরদার হয়ে উঠছে আইন-অমান্য আন্দোলন। তখন বম্বের (অধুনা মুম্বই) ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানির স্টেশন অধিকর্তা জানান, তিন দিন ধরে প্রায় চারশো মিটার শক্তিসম্পন্ন একটি অজ্ঞাত স্টেশন থেকে ইংরেজি, মারাঠি এবং হিন্দি ভাষায় কংগ্রেসি প্রচার চালানো হচ্ছে বলে তিনি শুনেছেন। সেই প্রচারে নাকি সারাক্ষণ বিলিতি জিনিস বয়কট করতে আহ্বান জানানো হচ্ছে। আর যায় কোথায়! ব্রিটিশ সরকারের তৎপরতা তখন তুঙ্গে। সারা বিশ্বে আর্থিক সংকট চলছে। এই অজুহাতে বেতার কেন্দ্র কিন্তু বন্ধ হল না। তার কারণ একটাই। ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পেরেছিল, বেতারের মতো একটা শক্তিশালী মাধ্যমকে অত সহজে হাতছাড়া করা যাবে না। তাহলে দেশের ভিতরে এবং বাইরে বিরোধীপক্ষই সেটা ব্যবহার করার সুযোগ নেবে। 
বেতার ততদিনে সমস্ত পৃথিবীতে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রেডিও মস্কো যেমন ব্রিটিশ শাসকদের কাছে রীতিমতো মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। ইতিহাস বলছে, ব্রিটেনে আর ভারতে বেতার সম্প্রচারের শুরু হয় প্রায় একই সময়ে। কিন্তু ভারতের সামাজিক অস্থিরতা আর রাজনৈতিক বিক্ষোভের মধ্যে ১৯২৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শুধুই একটি প্রাইভেট কোম্পানি রেজিস্ট্রি হয়। এই কোম্পানিতে সরকারি আগ্রহ প্রায় ছিল না বললেই চলে। বম্বের কয়েকজন ব্যবসায়ী, তাঁদের মধ্যে মূল উদ্যোক্তা পার্সি ব্যবসায়ী এফ এম চিনয়, তাঁরা গড়ে তুলেছেন ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি। ১৯২৭ সালের ২৩ জুলাই বম্বে শহরের বেতারকেন্দ্র উদ্বোধন করতে এলেন ভাইসরয় লর্ড আরউইন।  
কলকাতা পিছিয়ে থাকেনি। কলকাতার বেতার সম্প্রচারের ইতিহাসের কথা বলতে হলে উল্লেখ করতেই হবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডঃ শিশিরকুমার মিত্রের নাম। তিনি ছিলেন পদার্থবিদ্যা, মানে ফিজিক্সের ছাত্র। তখন প্যারিসে ইউনিভার্সিটি অফ ন্যান্সির ইন্সটিটিউট অফ ফিজিক্সে প্রোফেসর গাটনের ল্যাবরেটরিতে রেডিয়ো ভ্যালু সার্কিটের কাজ চলছে পুরোদমে; এখানেই যোগ দিলেন শিশির কুমার মিত্র। ততদিনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বেতারে যোগাযোগের ক্ষেত্রে রেডিও-ভালভের সফল ব্যবহার নিয়ে একটি রিপোর্ট হাতে এসেছে তাঁর। শিশিরবাবু ভীষণ উৎসাহী হলেন। তিনি তখন চটপট চিঠি লিখলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে। উদ্দেশ্য একটাই, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার স্নাতকোত্তর পাঠক্রমে ওয়্যারলেসকে একটি নতুন বিষয় হিসেবে যোগ করা হোক। 

স্যার আশুতোষের মতো দূরদর্শী মানুষের সহায়তায় কলকাতায় ফিরে এসে ওয়্যারলেস সেকশন গড়ে তুললেন শিশিরকুমার মিত্র। ইতিমধ্যে ভারতের সমুদ্র উপকূলে পাহারা দেওয়া ব্রিটিশ নেভিগেশন কোম্পানির নৌবহরকে বেতারযন্ত্রে সুসজ্জিত করার জন্য মার্কনি কোম্পানি কলকাতার হেস্টিংস স্ট্রিটে একটি অফিস খোলে। ১৯১৮ সালে অফিসটি তার জায়গা বদলে চলে যায় কলকাতা হাইকোর্টের সামনে টেম্পল চেম্বার্সে। ততদিনে ওপরমহলে বেশ গুরুগম্ভীর আলোচনা শুরু হয়েছে। বেতার সম্প্রচারের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ব্রিটিশ সরকার কলকাতাকে বেছে নিয়েছে প্রথম শহর হিসেবে। ব্রিগস এবং স্টেপলটন সাহেবের সহায়তায় টেম্পল চেম্বার্সে তৈরি হল ‘রেডিও ক্লাব অফ বেঙ্গল’। আর এই রেডিও ক্লাবের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়েছিলেন শিশিরকুমার মিত্র। এই ‘রেডিও ক্লাব’ প্রতিদিন সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করল। 
ডঃ শিশিরকুমার মিত্র তাঁর ওয়্যারলেস ল্যাবরেটরিতে আর একটি ট্রান্সমিটার বসালেন। প্রথমদিনের উদবোধনী অনুষ্ঠানে গান করলেন হীরেন বসু। এই ট্রান্সমিটার থেকে অনুষ্ঠান শোনা যেত বেনারস, আগ্রা, এমনকি বর্মাতেও! 
গীতিকার, সুরকার, গায়ক, অভিনেতা হীরেন্দ্রনাথ বসু তাঁর আত্মজীবনী ‘জাতিস্মর’-এ উল্লেখ করেছেন সেই দিনটির কথা। 
“বসেছিলাম আচার্য পি সি রায়ের ঘরে, খাচ্ছিলাম মুড়ি নারকেল। হঠাৎ ঝড়ের মতো একদল ছেলে ঘরে ঢুকে বললে, এখানে কে কে গাইতে জানেন শিগগির আসুন, ডঃ মিত্র ডাকছেন। সবাই মিলে, এমনকি আচার্য রায় পর্যন্ত আমায় বললেন, যা যা বেতারে গান গেয়ে আয়—খুব ভালো করে গাইবি। কলকাতা সায়েন্স কলেজের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট থেকে এক সন্ধ্যায় বেতারযোগে গান আবৃত্তি প্রচারের আয়োজন ঘটালেন শিশির মিত্র মহাশয়। সারা কলকাতায় শ্রোতারা অভাবনীয় ঘটনায় অভিভূত হয়ে পড়েন। সেদিনের প্রথম আসরে গান গেয়েছিলাম, ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কী সঙ্গীত ভেসে আসে’...। মনে হয়েছিল, আজকের প্রথম আসরে এই গানখানিই একমাত্র উপযোগী গান।”... তখন বেতার-শ্রোতাদের কানে হেডফোন লাগিয়ে বেতারের বার্তা বা গান শুনতে হত, সেগুলির নাম ছিল ক্রিস্টাল সেট। 
কলকাতার পাশাপাশি ১৯২৪ সালের জুন মাসে আরও দুটি রেডিও ক্লাব শুরু হল বম্বে আর মাদ্রাজে। প্রতিদিন অনুষ্ঠানের সময়সীমা আড়াই ঘন্টা। এই ঘটনা উৎসাহিত করল ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনকে। মনে রাখতে হবে সম্প্রচারের জগতে বিবিসিকে আদর্শ মেনে নিয়েই ভারতে বেতারের সূচনা। বিবিসি-র সি সি ওয়ালিক ১৯২৬ সালে কলকাতায় এলেন। তাঁর লক্ষ্য একটাই। ভারতে বেতার সম্প্রচারের বাণিজ্যিক সাফল্য সরেজমিনে বুঝে নেওয়া। ওয়ালিক কলকাতার টেম্পল চেম্বারের একেবারে উপরের তলায় একটি ট্রান্সমিশন স্টুডিও তৈরি করলেন। বিবিসি ধীরে ধীরে ব্যবসা শুরু করল কলকাতায়। ভারপ্রাপ্ত কর্তার আসনে বসলেন স্টেপলটন। তিনি দায়িত্ব নিয়েই স্টুডিও জন্য আরও একটু ভালো জায়গার খোঁজ শুরু করলেন। খুঁজে পাওয়া গেল এক নম্বর গার্স্টিন প্লেস। ডালহৌসি স্কোয়ার ছাড়িয়ে পশ্চিমদিকে ছোট আদালতের উল্টোদিকে এক দক্ষিণমুখী রাস্তায় এই বাড়িটি। বাড়ির পিছনে চার্চের বিশাল বাগান, অতএব নির্জন এই জায়গাটি ভীষণ পছন্দ হয় স্টেপলটনের। 
১৯২৭ সালের ২৬ আগস্ট। কলকাতায় শুরু হল ভারতের ‘প্রথম নিয়মিত’ বেতারকেন্দ্র। বাংলার গভর্নর তখন স্ট্যানলি জ্যাকসন। তিনি প্রধান অতিথি; আর সঙ্গে ছিলেন ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর মিস্টার চিনয়। সেদিন সঙ্গীত পরিবেশন করেন আঙুরবালা দেবী, জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী, প্রফুল্লবালা দেবী এবং দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বক্তা ছিলেন সাহিত্যিক মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, সম্পর্কে তিনি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জামাতা। আর ছিলেন স্টেশন ডিরেক্টর মিঃ ওয়ালিক, সহকারী মিঃ চ্যাপম্যান। এইচএমভি’র রেকর্ডিং স্টুডিও তখন বেলেঘাটায়; আর রেকর্ডিং হত চিতপুর গরানহাটার মোড়ের বাড়ি ‘বিষ্ণু ভবনে’। এইচএমভি’র অধিকর্তা কুপার সাহেবের পরামর্শে ভারতীয় প্রোগ্রাম ডাইরেক্টর নিযুক্ত হলেন নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার এবং রাইচাঁদ বড়াল।   
ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং থেকে ইন্ডিয়ান স্টেট ব্রডকাস্টিং সার্ভিস এবং সম্প্রচারের সময় অল ইন্ডিয়া রেডিও বলার পথ ছিল মসৃণ। মিডিয়াম ওয়েভকে তখন বলা হত ‘লং ওয়েভ’। তার সঙ্গে শর্ট ওয়েভ যুক্ত হয় ১৯৩৩ সালে। স্টেশন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ রায়। এই সুধীন রায় কিন্তু ছিলেন শিশিরবাবুর কৃতী ছাত্র।  
বেতার মাধ্যমে সংবাদের আদান-প্রদান গত শতাব্দীতে জনসংযোগের ক্ষেত্রে একটা বড় পরিবর্তন নিয়ে এল। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টারের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল সংবাদ সরবরাহের। কারণ, শুরুতে ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানির নিজস্ব কোনও সংবাদদাতা ছিল না। সেই অর্থে কোনও সংবাদ বিভাগও ছিল না। রয়টারের সংবাদই ছিল একমাত্র সূত্র। এই সংবাদসংস্থার খবর অনুবাদ করে দিনে দুটি করে নিউজ বুলেটিন দেশীয় ভষায় প্রচার করা হত। জওহরলাল নেহরু চেয়েছিলেন হিন্দি আর উর্দুর মিশ্রণে বোম্বাই থেকে খবর প্রচারিত হোক, কলকাতা থেকে বাংলায়। পরের দিকে সব ফর্ম্যাট ধীরে ধীরে বদলে যায়। এমনকি হারিয়ে গেছে রাজেন সেনের নাম, যিনি ছিলেন বাংলার প্রথম সংবাদপাঠক। এই রাজেন সেনের আরও একটি পরিচয় ছিল। তিনি ছিলেন ১৯১১ সালের আইএফএ শীল্ড জয়ী মোহনবাগান দলের খেলোয়াড়। আর ছিলেন বিজন বোস। সংবাদকে শুধুমাত্র খবর না করে তার সঙ্গে আরও কিছু যোগ করতেন তিনি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘এই লোকটা কি সঙ্গে সঙ্গে অনুবাদ করে বলে? বড় সুন্দর বলে তো!’  
বিজন বসুর একটি অপূর্ব অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিই সকলের সঙ্গে। 
একদিন সকালে বড়োবাবু বিজন বসুকে ডেকে পাঠালেন। সেখানে ঘরে ছিলেন অন্য এক ভদ্রলোক। স্যুট পরা। সামনের টেবিলে খোলা রিভলবার। জানা গেল, তিনি চুঁচুড়ার ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি বাজখাঁই গলায় বললেন, ‘কাল খবর পড়ার সময় আপনি ‘বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাপ’ বলেননি কোন আক্কেলে? জানেন, এর জন্য আমার বাড়িতে টেঁকা দায় হয়েছে? ঠিক এই কারণে আমার পিসিমা বড়ি শুকোতে দিতে পারেননি!’ 
বোঝাই যাচ্ছে, জনমানসে রেডিও কোথায় কীভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল! একেই বলে গণমাধ্যম। 
১৯৩৯ সালে ত্রিপুরী কংগ্রেসের সময় আকাশবাণীর কন্ট্রোলার লায়োনেল ফিলডেন বেতারে গান্ধীজির কণ্ঠ প্রচারের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার অনুমতি দেয়নি। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেই কলকাতা কেন্দ্রের স্টেশন ডিরেক্টর অশোককুমার সেন উদ্যোগী হলেন। সোদপুর স্টেশনের বাঁদিকে আশ্রম প্রাঙ্গণে গান্ধীজি এসে বসেছেন প্রার্থনা সভায়। বেতারের মাইক্রোফোন তাঁর মুখের সামনে। রেকর্ডিঙের ব্যবস্থা ডিস্কে, রয়েছেন একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং সহকারী স্টেশন ডিরেক্টর। গান্ধীজির ভাষণে ছড়িয়ে পড়ল ভারতাত্মার মর্মকথা; মৈত্রী ও শান্তির বাণী।
গান্ধীজি জানতেন বেতার মাধ্যমের বিরাট শক্তি।
আমরা সকলে এখনও অনুভব করি সেই শক্তিকে।



তোমাদের প্রিয় নেতাজী কী খেতে পছন্দ করতেন? 

ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় 


আজ তোমাদের জানাবো ভারতবাসীর প্রিয় দেশনেতা, বিপ্লবী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর খাওয়াদাওয়া নিয়ে। তোমাদের বাড়িতে হয়ত একদিন ভালোমন্দ খাবারের জোগাড় নেই। বাজার হয়নি। মা বললেন আজ সব আনাজপাতি সেদ্ধ দিয়ে ফ্যানেভাতে খেয়ে নিতে। তোমরা কী এতে খুশি হও না? জেনে রেখো তোমাদের প্রিয় নেতাজীর সবচাইতে প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল এই সেদ্ধ ভাতেভাত। সেই তথ্য পেলাম কৃষ্ণা বসুর লেখায়। 
সুভাষচন্দ্র বসুর মা প্রভাবতী বসু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবীকে বলতেন, “তুমিই সুভাষের আসল মা, আমি তো কেবল ধাত্রী।” বাসন্তী দেবীকে পরম শ্রদ্ধায় ‘মা’ বলে ডাকতেন সুভাষ। 
এক রাতে চিত্তরঞ্জনের বাড়িতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এল এক দল ছাত্র। দাশ-দম্পতির নৈশাহারের সময় । ছাত্রদল ভিতরে ঢুকে পড়ল, তার মধ্যেই ছিলেন সুভাষ। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বহিষ্কৃত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও নিষিদ্ধ। অভিযোগ, তরুণ ব্রিটিশ অধ্যাপক এডওয়ার্ড এফ ওটেন, যাঁর উদ্ধত আচরণ ছাত্রদের আহত করেছিল, তাঁর উপর সংঘটিত ছাত্র-হামলার নেতা ছিলেন উনিশ বছরের সুভাষ।

মা বলে ডাকে যে সেই সুভাষের জন্য রান্না করা বাসন্তী দেবীর কাছে নতুন নয়। দেশবন্ধুর মৃত্যুর পরেও তাঁর বাড়িতে নিয়মিত যেতেন সুভাষ। সুভাষ চলে যাওয়ার আগে তাঁকে সামান্য রাতের খাবার পরিবেশন করতেন বাসন্তী দেবী। সেদ্ধ ভাত আর তরকারি মানে যাকে বলে বাঙালির পাতি ‘ভাতে ভাত’। সেটাই সুভাষের সবচেয়ে পছন্দের খাদ্য ছিল। ১৯৪১ সালের জানুয়ারিতে ৩৮/২ এলগিন রোড-এর (অধুনা নেতাজি ভবন) পারিবারিক ভবন থেকে বিদেশে পলায়নের ঠিক আগে সুভাষকে শেষ বার দেখেছিলেন বাসন্তী দেবী। অনশন করার পর দুর্বল শরীরে সদ্য জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। বাসন্তী দেবীর দিকে তৃষ্ণার্ত ভাবে চেয়ে হেসে সুভাষ বলেছিলেন , “মনে রেখো, শিগগিরই আমাকে এক দিন ভাতে ভাত খাওয়াতে হবে।” 

উত্তর কলকাতার হাতিবাগানে লক্ষ্মীনারায়ণ সাউয়ের তেলেভাজার বিখ্যাত দোকানের নাম শুনেছো তোমরা?  আজ এই দোকানটির বয়স ১০০ পেরিয়েছে অনেকদিন। সারাবছরই ভিড় সেখানে। তবে বিগত ৭৮ বছর ধরে নেতাজির জন্মদিনে সকাল থেকে সন্ধে অবধি অগণিত মানুষকে বিনা পয়সায় তেলেভাজা খাইয়ে আসছে এই দোকান। তা কি এই দোকানের মাহাত্ম্য? প্রথমতঃ সবার প্রিয় নেতাজি স্বয়ং এসে তেলেভাজা খেয়ে গিয়েছেন এই দোকান থেকে। তেমনি দাবী তাদের এ প্রজন্মেরও। দ্বিতীয়তঃ স্বদেশী আন্দোলনে বিপ্লবীদের গোপন ডেরায় তেলেভাজার জোগান দেওয়া হত এই দোকান থেকে। দোকানের প্রতিষ্ঠাতা লক্ষ্মীনারায়ণ সাউ নিজেও যুক্ত ছিলেন বিপ্লবীদের সঙ্গে।

এরূপ এক বিপ্লবী যার কটকে জন্ম, বাংলায় উচ্চশিক্ষা আর কর্মজীবন। রাজনীতির অলিগলিতে বিচরণ। সুভাষচন্দ্রের বাঙালি খাবারের প্রতি অকুণ্ঠ ভালোবাসার গল্প শোনালেন মানবেন্দ্র পাণ্ডার নাতি অরুণাংশু পাণ্ডা। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় নেতাজী ক্লাসের ফাঁকে চলে আসতেন মানবেন্দ্র পাণ্ডার হোটেলে। সেই সময় তরুণ মানবেন্দ্র কলকাতায় এসে চাকুরি না পেয়ে রান্না করার বিদ্যা কে কাজে লাগিয়ে খুলে ফেলেছিলেন হিন্দু হোটেল। সেটা কলেজ স্ট্রিটে ১৯১৫ সাল। তখন ভালো হোটেল ছিল হাতেগোনা। সেখানে ওড়িশা থেকে আসা মানব ঠাকুরের হোটেল ঘরোয়া সুস্বাদু রান্নার জন্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।  
নেতাজী সেখানে শুধু নিজে খেতে আসেননি, সঙ্গে আনতেন রাজনৈতিক গুরু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকেও। তাঁকেও  মানবঠাকুরের রান্নার স্বাদ পাওয়া তে হবে যে । কালে কালে সেদিনের হিন্দু হোটেল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পেটপুজো এবং রাজনৈতিক আলাপ আলোচনার স্থান হয়ে উঠেছিল। পরবর্তী জীবনে কর্মজীবনের ব্যস্ততার মধ্যে নিয়মিত আসা হয়ে উঠত না। সে দিনের হিন্দু হোটেল নাম বদলে হয়েছে স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল । এই নাম পরিবর্তন করেছিলেন মানবেন্দ্র পাণ্ডা । তাঁর নাতির কথায় সুভাষচন্দ্র বসু বাটা মশলার রান্না পছন্দ করতেন। নানা রকম সবজিতে তৈরী হয় পাঁচমেশালি  তরকারি, ঠিক যেমনটি পছন্দ করতেন নেতাজী।
তাহলে এবার থেকে তোমরা মায়ের হাতের পাঁচমেশালি চচ্চড়ি দেখে নাক সিঁটকবে না তো? 

একবার প্রেসিডেন্সি কলেজের দাপুটে, মেধাবী ছাত্র সুভাষচন্দ্র বসুর কানে খবর পৌঁছতেই ওড়িয়া ঠাকুরের হাতের রান্নার স্বাদ পেতে সুভাষ চললেন মানব পাণ্ডার হোটেলে কলাপাতায় ভুরিভোজের স্বাদ নিতে। সেখানকার পুঁইশাক চচ্চড়ি, মৌরলা মাছ, বেগুন পোড়া, মাছের কাঁটা দিয়ে ডাল ছিল সুভাষচন্দ্র বসুর প্রিয় পদ। 
কলেজ স্ট্রিটের কাছেই ৮/২ ভবানী দত্ত লেনের এই স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেলে নিজের হাতে শতরঞ্চি পেতে বন্ধুদের নিয়ে এক আনায় বহু বছর ধরে দু'বেলা ভরপেট মাছ ভাত খাওয়ার খবর পেলাম আনন্দবাজার পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে। 
ই-টিভি ভারতের একটি তথ্যে পেলাম আরো অনেক কথা।  
নেতাজি সোনা মুগডালের অসম্ভব ভক্ত ছিলেন। বিবেকানন্দের মন্ত্রশিষ্য এমন হবে সেটাই স্বাভাবিক। গুরুর মতো তিনিও দেশের বাইরে যাবার সময় ভাজা মুগডাল সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন হয়ত। কেননা তিনি যখন জাপানের ইম্পিরিয়াল হোটেলে ছিলেন তখন তাঁর দুই সহকর্মী হাসান ও হাবিব তাঁদের বাড়ি থেকে তাঁদের মাকে দিয়ে মুগডাল রান্না করিয়ে সুভাষের জন্যে নিয়ে যেতেন। আর সুভাষ দেশবিদেশ যেখানেই ঘুরুন না কেন সর্বত্রই তাঁর পছন্দের মেনু ছিল ডাল, ভাত, পুরি, দই আর কলা। সেইসঙ্গে গুরু স্বামীজির মতোই ডালের খিচুড়ির প্রতি খুব আসক্তি ছিল আর পাঁচজন বাঙালির মতোই। 

সকাল থেকে সন্ধে অবধি সুপারি চিবোনোর অভ্যেস ছিল তাঁর। মধ্যাহ্নভোজের পর মুখশুদ্ধি হিসেবে হরিতকী গ্রহণ শুরু হয়েছিল বেশী বয়সে।সারাদিনের মধ্যে বেশ কয়েক কাপ চা কিম্বা কফি পান ছিল নেশার মত। তারপর সুপারি-এলাচ-লবঙ্গ মুখে নেওয়ার তুমুল নেশা ছিল। বেশী বয়সে মাছ ছাড়া অন্য আমিষ গ্রহণে আপত্তি ছিল। বেশীরভাগ নিরামিষ খাদ্যেই সন্তুষ্ট ছিলেন। 
তাহলে এসব শোনার পরে আর তোমরা নিশ্চয়ই এক আধদিন নিরামিষ খেতে আপত্তি করবে না? 
জানো তোমরা? ঈষদুষ্ণ জলে লেবুর রস আর বীট নুন দিয়ে নিয়মিত পানের অভ্যেস ছিল তাঁর। নেতাজির সঙ্গ পেয়েছেন এমন বহু মানুষ দেখেছেন সারাদিনে তাঁর ২০ থেকে ৩০ কাপ চা খাওয়ার কথা।
bengalcuisine.in ওয়েবসাইটের একটি তথ্যে পেলাম নেতাজীর ঘরে বানানো মিষ্টান্ন প্রীতির কথা।  
বাড়িতে বানানো মিষ্টির প্রতি একটু বেশীই দুর্বলতা ছিল তাঁর জীবনের শেষদিন অবধি। রসগোল্লা, পিঠেপুলি, সন্দেশ, চমচম এসব বাঙালি মিষ্টি থেকে কখনও সরিয়ে নিতে পারেন নি নিজেকে। এছাড়াও প্রিয় ছিল চিনির পুলি, মনোহরা, নারকেল নাড়ু, রসকরা, ছাতুর বরফি, মুড়ির নাড়ু, খইচুর, তিলের নাড়ু, তিলের তক্তি। 

তোমরা নিশ্চয়ই অনেকে কলেজস্ট্রীটের কফিহাউসের নাম শুনেছো? রাজনৈতিক জীবনের প্রথমদিকে নিয়মিত যাতায়াত ছিল নেতাজীর সেখানে। আর কফিহাউসের ৪ নম্বর টেবিল ও সেইসঙ্গে আমাদের মতই নেতাজীরও  সেখানকার প্রিয় ডিশ ছিল চিকেন কাটলেট। 
আমাদের মতোই কলেজস্ট্রিটের প্যারামাউন্টের ডাব শরবত ছিল তাঁর খুব প্রিয় পানীয়।



নেতাজীর কথা

মলয় সরকার


"নেতাজী " এই শব্দটা শুনলেই তোমাদের চোখে যে ছবিটা ভেসে উঠবে, তার সঙ্গে তোমরা জ্ঞান হয়ে অবধি পরিচিত। সেই টুপি পরা মিলিটারী পোষাকে সজ্জিত, দৃপ্ত ভঙ্গীর মানুষটি, হয় কলকাতার শ্যামবাজারের মোড়ে ঘোড়ায় চড়া অবস্থায়, নয় বইয়ের পাতায় বা বিভিন্ন জায়গায় দেখা, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু।
 

কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল এটাই, দেশে তো কত নেতা এসেছেন, চলেও গেছেন কিন্তু "নেতাজী" বলতেই এই একটি মানুষকেই সারা দেশের মানুষ বোঝে কেন? না, তিনি তাদের সত্যিকারের স্বপ্নের মানুষ, স্বপ্নের রাজপুত্র, মনের মত নেতা।আজ বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হত ১২৫ বছর, (জন্ম- ২৩শে জানুয়ারী ১৮৯৭) হয়ত আজ আর বাস্তবে তাঁর বেঁচে থাকা সম্ভব নয়, তবু, আজও অনেক মানুষ বিশ্বাস করেন, তিনি নিশ্চয়ই কোন দিন আসবেন, তাঁর স্বপ্নের রাজত্বের দায়িত্ব হাতে নিতে।কেন এমন ধারণা? না, তাঁর মৃত্যুর খবরটা বড় ঝাপসা। আজ পর্যন্ত কেউ সঠিক প্রমাণ দাখিল করতে পারেন নি, তিনি কবে কিভাবে মারা গিয়েছিলেন। ( যদিও সরকারী ভাবে প্রচার করা হয়, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ১৮ই আগস্ট ১৯৪৫) আর তাই অনেকেই বিশ্বাস করেন, তিনি আজও জীবিত, হয়ত তিনি ফিরে আসবেন স্বমহিমায়। মানুষ তাদের স্বপ্নের নেতাকে কত ভালবাসলে, কত নিজের বলে ভাবলে, তবেই এমন করে ভাবা যায়, ভাবতে পার। 

আর তা হবেই বা না কেন, সারা জীবন যিনি নিজের কথা না ভেবে,শুধুমাত্র দেশমায়ের শিকল ছিঁড়ে ফেলার জন্য, কত দুঃসাহসিক কাজ করে,একেবারে 'সুপারম্যানে' র মত, কত গোয়েন্দার চোখকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছেন ব্রিটিশের হাতের নাগাল থেকে অনেক দূরে ব্রিটিশের শত্রুদের দেশ জার্মানী। এর মাঝে পেরোতে হয়েছে আফগানিস্তান, রাশিয়ার মত ছোট বড় অনেক দেশ।কেউ যাতে ধরতে না পারে তার জন্য কত নিঁখুত ছদ্মবেশ নিয়েছেন, কত ভাষা যে শিখেছেন, ভাবলেই আশ্চর্য লাগে।( প্রায় তের - চৌদ্দটি ভাষা জানতেন)।জার্মানী থেকে গেছেন জাপান। যাতে কোথাও না যেতে পারেন, তাই ব্রিটিশ শাসকেরা, তাঁকে নিজের ঘরে বন্দী করে, চারিদিকে বসিয়েছিল কড়া পাহারা।সেখান থেকে সকলের চোখে ধূলো দিয়ে কি করে যে পালিয়েছিলেন তাদের হাতের ধরা ছোঁয়ার বাইরে, একেবারে পি সি সরকারের যাদুর মত, সেটাই ঠিকমত কেউ বুঝতে পারে নি। যদি কেউ তোমরা কখনও কলকাতার এলগিন রোডে তাঁর বাড়িতে যাও, দেখবে সেই গাড়িটি রাখা আছে, যাতে চেপে তিনি বাড়ি ছেড়েছিলেন।


যে কংগ্রেস দলের সঙ্গে তাঁর মতের অমিল হয়ে, তিনি দল ছেড়েছিলেন, তার সভাপতিও তিনি হয়েছিলেন। কতই বা বয়স তখন, মাত্র ৪১ বছর।

তাঁর এই "নেতাজী" শিরোপাটি পেলেন কোথায়? কারা তাঁকে প্রথম "নেতাজী" বলে ডাকলেন? না, ভারতের মাটিতে কেউ দেয় নি।এটি তিনি পেয়েছিলেন সুদূর বার্লিনে।সেখানকার ভারতীয়রাই তাঁকে সত্যিকারের নেতা হিসাবে চিনতে পেরেছিল।তখনকার যাঁরা আমাদের দেশের নেতা ছিলেন, তাঁদের নীতি তাঁর পছন্দ হয় নি।তাই তিনি এক নতুন পদ্ধতি নিয়েছিলেন।তিনি জানতেন, 'আমার শত্রুর যে শত্রু সে আমার বন্ধু'। রাজনীতিতে এটি এক মূল্যবান নীতি।কাজেই তিনি ব্রিটিশের যারা শত্রু, সেই হিটলারের দেশ জার্মানী,  তোজোর দেশ জাপানের সাথে হাত মিলিয়ে,  সেখানে তাদের হাতে যে বন্দী ভারতীয় সৈন্য ছিল, তাদের নিজের দখলে এনে বাইরে থেকে ব্রিটিশ সরকারকে আঘাত হানতে চেষ্টা করেছিলেন।


তাঁর এই চেষ্টা খুব ছোট দু একটা জায়গায় সফলতা লাভও করেছিল। ১৯৪৭ এর ১৫ ই আগষ্টের ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার আগেই, ভারতের মধ্যে তিনিই প্রথম আন্দামান নিকোবর ও মণিপুরে স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। এ বড় কম কথা নয়, যদিও সে কথা আজকের ভারতবাসী খুব বড় করে মনে রাখে নি।ভারতের তখনকার নেতারা তাঁকে ভিতর থেকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেন নি।বরং তাঁর বিরোধিতা করেছিলেন। সাহায্য করলে হয়ত ভারতের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত।


চিরতরুণ এই মানুষটি তারুণ্যের তেজে ছুটে বেরিয়েছেন পৃথিবীর এ মাথা থেকে ও মাথা। আই সি এস পরীক্ষা দিয়ে বড় সরকারী চাকরীর মোহ ত্যাগ করে তিনি ঝাঁপ দিয়েছিলেন দেশের কাজে।কত বড় স্বার্থত্যাগ! তাঁর যে স্বপ্ন ছিল, তিনি ভারতের প্রতিটি তরুণকে নিয়ে, প্রতিটি ভারতবাসীকে নিয়ে, তা তিনি বিভিন্ন জায়গায় লিখে রেখে গেছেন। জাতপাত, ধর্মের বাধানিষেধের বাইরে এসে এক সাম্যবাদী ভারত তাঁর স্বপ্ন ছিল।এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের ভাব শিষ্য। তাঁর বিভিন্ন লেখা, বক্তৃতা, দেশবাসীর জন্য আহ্বান ইত্যাদিতে ছড়িয়ে আছে তাঁর স্বপ্ন।তোমাদের মত ছোটদের জন্য তাঁর লেখা 'তরুণের স্বপ্ন' বইটি তোমাদের প্রত্যেকের পড়া উচিত। সেখানে তোমরা দেখতে  পাবে, কেমন ভারতবর্ষের ছবি তাঁর চোখে আঁকা ছিল।তা মোটেই এখনকার মত সমস্যাজর্জরিত, ধর্ম নিয়ে মারামারি করা, ধনী গরীবের এত বৈষম্যে ভরা ভারতের ছবি নয়।পরে বড় হয়ে তোমরা তাঁর অন্যান্য লেখা পড়ে নিও।দেখতে পাবে, বুঝতে পারবে কেন তিনিই একমাত্র " নেতাজী "। দেশের অন্যান্য নেতাদের সাথে তাঁর কত তফাত।

তাঁর কয়েকটি স্লোগান তো যুগান্তকারী। জান কি, "জয় হিন্দ," "চলো দিল্লী," "তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব", এই সমস্ত স্লোগান তখন তাঁর অনুরাগী সৈনিকদের মাতিয়ে তুলেছিল। এমন কি তাঁর সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য কত মেয়েরা যে এগিয়ে এসেছিলেন,তার অন্ত নেই। তার ফলেই তৈরী হয়েছিল, ঝাঁসী রাণী বাহিনী।

আজ আমরা তাঁর, জন্মদিন পালন করি, বড় মূর্তি বানাই,মূর্তিতে মালা দিই, কিন্তু ভুলে যাই তাঁর স্বপ্ন, তিনি কি চেয়েছিলেন।তিনি যে আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, ' বঙ্গজননী আবার একদল তরুণ সন্ন্যাসী চান। ভাই সকল, কে তোমরা আত্মবলির জন্য প্রস্তুত আছ এস',
সে সমস্ত কথা আমরা ভুলেই গিয়েছি।

বড় এক রাজনৈতিক আবর্তে তাঁর বাণী, তাঁর স্বপ্ন, তাঁর চিন্তা সব প্রায় বিলুপ্ত। আজ শুধু বড় বড় ছবি আর মূর্তিই সার হয়েছে।তবে নতুন দিনের তরুণ শক্তি নিশ্চয়ই তাঁর স্বপ্ন কোনদিন সার্থক করবে এই আশা তিনি করতেন। তাই বলেছিলেন, " মাথার উপরে যদি ভগবান থাকেন, পৃথিবীতে যদি সত্যের প্রতিষ্ঠা হয়,তবে আমার হৃদয়ের কথা দেশবাসী একদিন না একদিন বুঝিবেই বুঝিবে"।

তোমাদের মত, নতুন যুগের যারা নতুন শিশু, তরুণ তাদের উচিত নেতাজীর চিন্তা, স্বপ্নকে সার্থক করার কাজে এগিয়ে এসে দেশকে এক নতুন স্বপ্নের দেশে নিয়ে যাওয়ার।সেটিই ছিল তাঁর আশা।আর যেদিন তা হবে,সেদিনই হবে তাঁর প্রতি প্রকৃত সম্মান জানানো।


রসিক সুভাষচন্দ্র

মুক্তি দাশ
 
স্বাধীনতা সংগ্রামের বীরযোদ্ধা নেতাজি সুভাষচন্দ্রের বহু ছবির মধ্যে তাঁর দৃঢ়প্রত্যয়ে ভরা সৈনিকবেশী ছবিটির সংগেই আমরা সমধিক পরিচিত। এই ছবি দেখে বোঝার উপায় নেই যে, দেশের এতবড় মহান গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্রতী হয়ে বিশাল দায়িত্ব মাথায় নিয়ে সুভাষচন্দ্র কখনো রঙ্গরসিকতা করার সামান্যতম সুযোগ বা অবসর পেয়েছেন।

সুভাষচন্দ্রের লেখা বেশ কয়েকটি পারিবারিক চিঠিপত্রে নানা গুরুভার বিষয়বস্তুর ফাঁকফোকরে দমকা বাতাসের মতন হালকা মেজাজে লেখা কিছু টাটকা রসিকতা থেকে তাঁর সূক্ষ্ম পরিহাসপ্রিয় রসিক মনের পরিচয় পাওয়া যায়।
 
তাঁর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মেজদা শরৎচন্দ্র বসুর পত্নী বিভাবতী বসুই তাঁর দমবন্ধ করা লড়াকু জীবনের একমাত্র জানালা। যাঁর সাথে দু’দন্ড কথা বলেও শান্তি। যাঁর কাছে তিনি স্বচ্ছন্দ, সাবলীল এবং নির্ভার।

বর্মার মান্দালয় জেল থেকে ‘মেজবৌদি’ অর্থাৎ শরৎচন্দ্র বসুর সহধর্মিনী বিভাবতী বসুকে ১৯২৫ সালের ৭ই আগস্ট তারিখে লেখা একটি চিঠিতে নানান দরকারি কথার মধ্যে সুভাষ একজায়গায় লিখেছেন –

“…আমাদের শাস্ত্রে একটা কথা আছে – মধ্বাভাবে গুড়ং দদ্যাৎ। অর্থাৎ যেখানে মধু-র অভাব, সেখানে গুড় দিয়ে মধু-র কাজ সারা উচিৎ। তাই ছোট ছেলেপুলের অভাব এখানে বেড়ালছানা দিয়ে মেটান হয়।…এখানে বেড়াল সবচেয়ে ভালবাসে যে লোকটি মেথরের কাজ করে – তাকে সবাই ‘ময়লা-লু’ বলে, তার আসল নাম ‘লবানা’। আর ময়লা সাফ করে বলে তার নাম সবাই রেখেছে ‘ময়লালু’। বর্মা ভাষায় ‘লু’ মানে লোক বা মানুষ। সে ময়লা সাফ করে, অতএব তার নাম ‘ময়লা লু’। ‘ময়লা লু’ কথাটা ভাল লাগে না বলে ‘ময়লালু’ – তার থেকে ভাল নাম দাঁড়িয়ে গেছে ‘মলয়’। আমাদের ‘মলয়’ যখন শোয় – তখন তার মাথার কাছে বেড়াল, বুকের উপর বেড়াল, পায়ের কাছে বেড়াল। চতুর্দিকে বেড়ালের পরিবারের দ্বারা পরিবৃত হয়ে সে ঘুমোয়।”

এ তো গেল ‘বেড়াল কাহিনী’। মুরগিরাও বাদ যায়নি কিন্তু। যেমন –

“…ম্যানেজারবাবুর কৃপায় এখানে আমাদের উঠানের এককোনে মুরগিশালা খোলা হয়েছে। সেই ঘরের মধ্যে কতগুলি মোরগ ও মুরগি স্থান পেয়েছে। সকাল সন্ধ্যা এইসব পক্ষবিশিষ্ট জীবের ‘কক্কর কোঁ’ শব্দে আমি অস্থির হয়ে উঠি – কিন্তু এই মধুর রব না শুনলে ম্যানেজারবাবুর নাকি ঘুম হয়না।”

এইসব মুরগি দেখাশোনার ভার দেওয়া হয়েছিল ‘ইয়াঙ্কা’ নামে মান্দ্রাজ অঞ্চলের অধিবাসী এক নিম্নশ্রেণীর কয়েদিকে। কিন্তু –

“গোড়া থেকেই ইয়াঙ্কা প্রভু ডিম সরাতে আরম্ভ করলেন। যেখানে ডিম হয় ৫/৬টা সেখানে ঘরে উঠে মাত্র ২/৩টা। বাকি কয়টা তাঁর কৃপায় অদৃশ্য হয়। যেদিন ধরা পড়লেন, সেদিন একেবারে নেকা। তাঁর বয়স মাত্র ৭১ বৎসর কিন্তু পেটটা অতিশয় বড়। অনেকে বলেন যে, তিনি ভোলানাথের অবতার। কারণ পেটটি একেবারে মহাদেবের মত। ইয়াঙ্কার কৃপায় প্রত্যহ মুরগির ছানা মরতে আরম্ভ করল। ১০/১২ থেকে দাঁড়াল তিনটা। সেগুলি এখনও পর্যন্ত জীবিত আছে, বোধহয় মরবার আর আপাতত আশা নাই। একদিন তার অযত্নের দরুণ চিল এসে ছোঁ মেরে একটি মুরগিছানা নিয়ে গেল। সকালবেলা যখন ধরা পড়ল তখন ইয়াঙ্কা সাধু সেজে বললেন, ‘মুসীতু’। অর্থাৎ ছিল না। অনেক ধমকা-ধমকির পর সত্য কথা স্বীকার করলেন।”

জেলখানার অভিজ্ঞতা সুভাষচন্দ্রের অপরিসীম। জীবনের বহু মূল্যবান সময় তাঁকে লৌহকপাটের অন্তরালে অতিবাহিত করতে হয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সংস্পর্শে পুষ্ট হয়েছে তাঁর অভিজ্ঞতার ভান্ডার। সেইসব অভিজ্ঞতার ছিটেফোঁটা লঘুরসে চুবিয়ে বেশ রসালো করে পরিবেশন করেছেন তাঁর অতিপ্রিয় মেজবৌদির কাছে লিখিত চিঠিপত্রে – তারই কিছু বিক্ষিপ্ত অংশ এখানে উদ্ধৃত করলাম।




তিতিরের প্রজেক্ট
শতভিষা মিশ্র
নবম শ্রেণী, জ্ঞানদীপ বিদ্যাপীঠ, পশ্চিম মেদিনীপুর

সকাল থেকেই একই জিনিস পড়ে যাচ্ছে তিতির কিন্তু কিছুতেই মুখস্থ হয় না তার।এবছর মহামারীর কারনে নেতাজি জন্মজয়ন্তী অনলাইনে অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে তিতিরকে কিছু একটা করতে হবে। সে ভেবেছে বক্তৃতা দেবে। সেইমত একটা বক্তব্যও বানিয়েছে সে। কিন্তু কিছুতেই মুখস্থ হচ্ছে না। সকাল থেকেই খাওয়াদাওয়া ভুলে মুখস্থ করে যাচ্ছে। পরশু অনুষ্ঠান। হঠাৎ কি মনে হল সে ঠিক করল নেতাজির ছবি আঁকবে। বেগুনি ভেলভেটে মোড়া খাতাটা বন্ধ করে সে আঁকার খাতা আনতে গেল। তাক থেকে খাতা নামাতে গিয়ে অনেকগুলো বই ফেলে দিল। তিতিরের  কান্ড দেখে মা  একেবারে রেগেমেগে একাকার। বললেন ,"সেই সকাল থেকে বক্তব্য মুখস্ত করতে বসলি। আবার এখন আঁকা। কিছুই করতে পারবিনা সেদিন। এখন আবার আমারই কাজ বাড়ালি। পারিনা বাবা তোকে নিয়ে।" তিতির মুখ বেজার করে পাশের ঘরে আঁকার খাতা নিয়ে চলে এলো। আঁকতেও বসল। কিছুটা আকার পর তার যেন মনে হল ছবিটা ঠিক নেতাজির মত হচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করল তবু হলো না। মুছে মুছে রবারটা শেষ করে ফেলল অর্ধেক। আর খাতার কাগজ? তাকে বোধহয় জীর্ণ পাতা বললেও কম হবে। শেষে বিরক্ত হয়ে তিতির খাতাটাই ছুঁড়ে ফেলে দিল। তোমরা হয়তো ভাবছো গান করতে পারে। কিন্তু তা হবার জো নেই। আসলে তিতির গান শেখে না। এবার তো মহা মুশকিলে পড়ল তিতির।বক্তব্য হবে না ,ছবিও হবে না, গানও হবে না। তাহলে  কি করবে সে। শেষে মায়ের কথাই সত্যি হবে নাকি। সারাদিন ভাবতে ভাবতেই কেটে গেল। পরের দিনও কিছুই করে উঠতে পারলোনা তিতির।
          ২৩ শে জানুয়ারি। নেতাজির জন্ম জয়ন্তী। ডাইনিং টেবিলে চেয়ারে বসে মুখ বেজার করে পা দোলাচ্ছে তিতির। আর মাত্র দু'ঘণ্টা পর অনুষ্ঠান। কিন্তু সে এখনো ঠিক করতে পারেনি সে কি করবে। দরজায় বেল বাজল। দরজা খুলতেই দেখা গেল পেপার ওয়ালা কাগজ দিতে এসেছে। বাবা কাগজটা নিয়ে পড়তে বসতেই তিতির দেখতে পেল কাগজের প্রথম পাতাতে নেতাজির মস্ত একটা ছবি। বিদ্যুতের ঝলক খেলে গেল ওর মাথায়। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে সে ছুটে চলে গেল ওর বাবার কাজের ঘরে। ও জানে ওর বাবা পেপার কাটিং সংগ্রহ করেন। সে তার বাবার ফাইলটা খুলে আগের বছরের নেতাজি জন্মজয়ন্তী খুঁজতে লাগলো। পেয়েও গেল। অনেকগুলো পত্রিকায় প্রকাশিত নেতাজির কাজের সময় এর ছবি, তাঁর পরিবারের সাথে ছবি , আজাদ হিন্দ বাহিনীর সাথে ছবি সবই সেই ফাইল ছিল। ছবিগুলো নিয়ে সে তার ঘরে এলো। প্রথমে একটা কার্ডবোর্ড জোগাড় করে সাদা ভেলভেট জড়িয়ে তার উপর ছবিগুলো আঠা দিয়ে চেটাতে লাগলো। এবং ছবিগুলো নিচে ছোট ছোট করে তাঁর সম্পর্কে লিখল। এক ঘণ্টার মধ্যেই তার প্রজেক্টটা শেষ করে ফেলল তিতির। প্রজেক্টটা দেখানোর জন্য সে খুবই অধৈর্য হয়ে পড়েছিল। ঠিক সাড়ে দশটায় শুরু হলো অনলাইন অনুষ্ঠান। সবার প্রথমে স্কুল থেকে আমন্ত্রিত একটি প্রখ্যাত পত্রিকার সম্পাদক রমেশবাবু বক্তব্য রাখলেন। তারপর কেউ গান করল, কেউ বক্তব্য দিল, কেউ ছবি দেখালো। অবশেষে এল তিতিরের পালা। সে তার প্রজেক্টটা দেখাতেই সবাই অবাক। কেউ এসব ভাবতেই পারেনি। প্রিন্সিপাল ম্যাম তো খুব খুশি।রমেশ বাবু বললেন তিতিরের প্রোজেক্টের ছবি তিনি তাঁর পত্রিকায় ছাপাবেন। তিতির খুব খুশি হলো। বাবা মাও খুব খুশি। তিতির বুঝতে পারল বিভিন্ন বিষয়ের ওপর পেপার কাটিংগুলি কতটা প্রয়োজনীয়।সে ঠিক করল সেও তার বাবার মতো পেপার কাটিং সংগ্রহ করবে।   
       তারপরের দিন  তিতিরকে একটা বাক্স দিলেন একজন আঙ্কেল। বাক্সটা খুলে তিতির দেখে একটা পত্রিকা। দু-এক পাতা উল্টাতেই দেখে তার প্রজেক্টটার ছবি আর তার নিচে লেখা তিতির বোস, চতুর্থ শ্রেনী ,সোনারপুর আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।


স্মৃতিকথা:-''দেশের জন্মদিন''

পায়েল চট্টোপাধ্যায়

-"ওখানে যাবি?"
-''কোথায়?"
-''ওই যে দেখ, ওই বড় দরজার ওপারে, ওখানে।''
-''ভেতরে ঢুকতে দেবে নাকি।''
-''কেন? দেবে না কেন?''
-''ওটা তো আমাদের জায়গা নয়।''
-''কে বলেছে?''
-''ওখানে তো সব অন্য লোকজন। আমাদের চেনা কেউ নেই তো।''
-''তাতে কি! ওরা সবাই আমাদের বন্ধু।''
-''ধুর! তাই আবার হয় নাকি।''
-''ওই যে দ্যাখ, ওপরে আমাদের দেশের পতাকা উড়ছে, কমলা, সাদা, সবুজ তেরঙা পতাকার নীচে দাঁড়ালে আমরা আর কেউ আলাদা থাকি না, সকলেই সমান, বুঝলি?''

অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিলাম দুই ক্ষুদের। শেষ কথাটা শুনে এবার পেছন দিকে তাকালাম। যে বলছে তার গায়ে পাঁশুটে হলুদ রঙের শার্ট। আর যাকে বলছে তার লম্বা বিনুনি দেখে মন ভাল হয়। কালো গ্রিল-দরজা দিয়ে ঘেরা অংশটার বাইরে চলছিল কথোপকথন। দিনটা ছিল আমাদের স্বাধীনতা দিবস। ওদের স্পষ্ট কথা, দ্বিধার লেশমাত্র নেই। তবুও ভেতরে ঢুকতে পারছে না। নির্দিষ্ট সময়ে পতাকা উত্তোলন শেষ হলে অফিসের সামনের ওই অংশটাতে গেলাম। এবার তো তোমাদের আলাপ করাতেই হবে ওই দুই বন্ধুর সঙ্গে। কে বন্ধু? ওই যে যারা আমার অফিসের বাইরে ওপরের কথাগুলো বলছিল। তোমরা জানো সেদিন ওদের কথা শুনে আমি ভেতরে নিয়ে এসেছিলাম ওদের। হলুদ জামা, কালো প্যান্ট সমেত এক বন্ধু এবং লাল ফ্রক আর বিনুনী সমেত এক বন্ধু। ওদের কথা শুনে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এলাম। ওহো! তোমাদের তো বলাই হয়নি আমার অফিস কোথায়! সেই যে তেপান্তরের মাঠের পাশে উলুম-ঝুলুম করা একটা গাছ, তার পাশে মুখ ব্যাজার করে থাকা সোজা বড় রাস্তা দিয়ে গেলেই আমার অফিস। অফিস শুনেই মুখ কোঁচকাচ্ছো! তা‌ অফিস গেলে কাজ করতে হয়, তবে আনন্দ হয়! ঠিক তোমাদের স্কুলের মত, পড়াশোনা করতে হয়, কিন্তু তাতে আনন্দ আছে। তাই না? আমাদের অফিসে একটু অন্যরকম। গান শোনায়, গল্প শোনায়। তোমাদের জন্য অনেক গল্প শোনায় আমাদের অফিস। তোমরা নিশ্চয়ই রেডিও শুনতে ভালোবাসো! আমাদের অফিসে সারাক্ষণ রেডিও চলে। তাই তার নাম রেডিও-অফিস।

যাক যেটা বলছিলাম, তোমাদের দুই বন্ধুর কথা। হলুদ শার্ট আর লাল ফ্রক। ওদের নিয়ে এলাম আমাদের অফিসের পতাকা উত্তোলনের পরে। কি খুশি ওরা! দু জোড়া চোখে টলটলে আনন্দ। পতাকার নীচে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ একমনে প্রার্থনা করল দুজনে। কৌতূহল সামলাতে না পেরে আমি জিজ্ঞেস করে বসলাম
-''কি এত প্রার্থনা করছিস দুজনে?''
-''প্রার্থনা করলে সেগুলো বলতে আছে নাকি? তুমি যে জিজ্ঞেস করলে দুম করে!'' লাল ফ্রকের উত্তর। আচ্ছা ছোটরা বকলে বড়রাও তো ভয় পায় বল! আমি আর কোন প্রশ্ন করিনি তাই। কিন্তু হলুদ শার্ট বোধহয় আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছিল, বলে উঠলো
-''আজ তো আমাদের দেশের জন্মদিন, তাই প্রার্থনা করছিলাম।''
কি সুন্দর বলল ওরা। 'দেশের জন্মদিন'। সত্যি তো! দু'শ বছর আমাদের দেশ বন্দী থেকেছে। ইংরেজরা শাসন করেছে আমাদের। আমরা কেমন করে থাকবো তার নিয়ম তৈরি করেছে অন্য দেশের মানুষ। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট অবশেষে স্বাধীনতা পেয়েছে দেশ‌। সে তো এক জন্মদিনই বটে। আমার ভাবনার মাঝে হঠাৎ করে আমার জামায় টান পড়ল।

-''ভেতরে নিয়ে যাবে না আমাদের?''

সেই হলুদ শার্ট প্রশ্ন করছে। হঠাৎ মনে পড়ল একটা কথা, তাই প্রশ্ন করলাম-

-''সে তো যাবো, কিন্তু তোদের মা বকবে না তো?''

উত্তর এলো চটপট।

-''মা তো সেই সকালে বেরিয়েছে, বাবাকে বলে এসেছি, এখন নিয়ে চলো তো ভেতরে।''

হলুদ শার্টের হাত ধরে ভেতরে ঢুকতে যাবো, হঠাৎ দেখি সেই লাল ফ্রক উধাও। 
-''কিরে, তোর বোন কোথায় গেল?"
হলুদ শার্টের চোখ ছল ছলে। 
-''চল ভেতরে দেখি।'' আমি বলেই হলুদ শার্টকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। আমাদের অফিসে ঢুকতে গেলে বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হয় জানো। তড়িঘড়ি কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ভেতরে গিয়ে দেখি সেই লাল ফ্রক তখন দিব্যি আমাদের অফিসের এক নিরাপত্তারক্ষীকাকুর সঙ্গে ভাব জমিয়েছে। তবে ভেতরে ঢুকতে পারেনি। আমায় দেখেই বললো
-''তোমরা বাইরে এতক্ষণ কথা বলছিলে , আমি একা একাই চলে এলাম।''

রেডিওর কোথা থেকে গান বাজে, কেমন করে গান বাজে, কেমন করে গল্প শোনানো হয় সব সেদিন ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলাম তোমাদের সেই দুই বন্ধুকে। ওদের নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে কখন যে দুপুর হয়ে গেছে মনেই নেই। একজোড়া সরল আনন্দময় চোখ দেখে কি আনন্দ হয়েছিল সেদিন আমারও। 
-''তোরা যে এমন ঘুরছিস তোদের মা জানতে পারলে বকবে না?'' ঘড়ির কাঁটার দিকে দেখে প্রশ্নটা করে ফেললাম। হঠাৎ দেখি ছল ছল করে উঠেছে দুই খুদের চোখ।

-''মা তো রোজ সকালে কাজে বেরিয়ে যায়, মা জানেই না আমরা এখানে এসেছি।" উত্তর দিলো সেই লাল ফ্রক।

-"আর বাবা?" আমি জিজ্ঞেস করলাম।

-''বাবা তো বিছানা থেকে বেশি উঠতে পারে না, বাবাকে বলেই বেরিয়েছি আমরা, অন্য দিন তো স্কুলেই যাই আজ দেশের জন্মদিনে তোমাদের এখানে এলাম।'' এবার উত্তর দিলো হলুদ শার্ট।

জানো, হঠাৎ করে সারাদিনের আনন্দের শেষে কেমন যেন মন খারাপ করছিল। একটা বাক্সে খাবার গুছিয়ে এগিয়ে দিলাম ওদের খানিকটা রাস্তা। বললাম ''বাড়ি চলে যাস, বাবা চিন্তা করবে না হলে।'' ওদের এগিয়ে দিয়ে যখন আমার অফিসের লম্বা দরজা পার করে ফিরে আসছি হঠাৎ করে মনে পড়ল, যাহ! এই দুই বন্ধুর নাম জানা হলো না তো! ভাবলাম ডাকি আরেকবার। হঠাৎ চোখ পড়ল আমাদের দেশের পতাকায়, হাওয়ায় উড়ছে। মুক্ত, স্বাধীন, আলোর মত। ওদের দুজনের কথাই মনে পড়ল আবার। ওরা তো আমার দেশের অংশ। আমারই মত। আমাদের মত। তোমাদের সকলের মত। নাম না...ই বা জানা হলো। এই পতাকার তলায় দাঁড়ালে আমরা তো আর কেউ আলাদা নই, সবাই এক। তাই ওদের পরিচিতি টুকুই সব, তাই না! আজও যতবার স্বাধীনতা দিবস আসে, তোমাদের সেই দুই বন্ধুর সরল চোখ আর ওদের এই কথা মনে পড়ে বারবার।



ধারাবাহিক ভ্রমণ
চলো যাই (কেরালা)

পর্ব - ৪
কলমে - বাসবদত্তা কদম

 মাঝিদাদা কি কি বলবে জলদি বলো গো। নাহলে তোমাদের দেশের এই জলের নয়নাভিরাম রূপ দেখতে দেখতে দিন কেটে যাবে আর সকাল হলেই আমাদের হাউসবোটে ঘোরা শেষ।
আচ্ছা শোনেন তাহলে। আপনাদের খেতে কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে। কোZhiকোর বা কোচি বন্দরের কাছে আছে এক জায়গা, নাম তার বেপুর। সেই বেপুরের ছুতোর মিস্ত্রিরা যুগ যুগ ধরে এ নৌকা বানিয়ে চলেছে। কম সে কম কয়েকশো বছর ধরে ওখানকার জঙ্গলের নীলাম্বু কাঠ দিয়ে এই নৌকা বানায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সেই কবে থেকে কেরালার ব্যবসায়ীরা এই নৌকায় চড়ে যেতেন। এক একটা নৌকা ক-ত ওজন নিতে পারে আপনারা ভাবতেও পারবেন না।
সত্যি কথা তো, আগে তো সব ব্যবসাই হতো নদীপথে, সড়কপথ তো ব্যবসার উপযোগী হয়েছে এই সেদিন। তাই তো সব প্রাচীন সভ্যতাই গড়ে উঠেছে নদীর ধারে। কিন্তু মাঝিদাদা নীলাম্বু কাঠ কি? 
-ঐ আপনাদের টিক। 
-আচ্ছা বুঝলাম। সেগুন কাঠ।
-এই সব নৌকায় ব্যবসা যখন কমে আসলো, তখন এই সমস্ত নৌকাকে পরিবর্তন করে ধীরে ধীরে ট্যুরিস্টদের বেড়াবার কাজে ব্যবহার শুরু হল। তবে এখানকার ধনীদের কিন্তু নিজেদের এরকম প্রমোদতরী থাকে। বছরে এক দুবার তারা বেড়াতে যান। আর ছোট ছোট নৌকা তৈরী হয় অনেক। মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্তরা কেনেন। এখানে তো রাস্তা মানেই জল।
-তা ঠিক আলাপুZhআতে অজস্র খাল আর এর ধারে ধারেই গড়ে উঠেছে সব গ্রাম আর পাড়া। এই খালগুলোই রাস্তা। এমনকি সেই নিচু নিচু ক্ষেতগুলোর পাশ দিয়েও বয়ে চলেছে জল। তবে সব জায়গায় দেখলাম পাড় বাঁধানো। নীচে ক্ষেত, ওপরে জল।   
-আরে মাঝিদাদা ঐ দুই বুড়ো দেখি মাছ ধরছেন।
-হ্যাঁ ধরবেই তো। এভাবে অনেকেই নৌকা নিয়ে বেড়িয়ে মাছ ধরে। কেউ কেউ পাড়ে বসেও ধরে।


-বাহ বেশ মজা তো। গালে হাত দিয়ে গল্প শুনছি আমি আর দেখি কি জানো! গল্পের গন্ধে গন্ধে, আমার পাশে এসে বসে পরেছে মা, বাবা, তোমাদের আঙ্কেল। গল্প শুনতে কে না ভালবাসে বলো! 
হঠাৎ একখানা জোরে ধাক্কা লাগলো। এত জোরে ধাক্কা! ওরে বাবা, তিমি মাছ নাকি। কে জানে তারাও কি বেড়াতে আসে কেরালার খালে আর দিল কি আমাদের নৌকোখানাকে ধাক্কা মেরে ভেঙে! সিনেমায় দেখেছি, অমনি হয়। গেছি গো বাঁচাও বলে চেঁচিয়ে উঠতে যাব, রান্নাঘরের দুই ছোটভাই দেখি হাতে বিশাল ট্রেতে করে অনেক কিছু এনে খাবার টেবিলে নামাচ্ছে। 
-নেন খেয়ে নেন বেলা হয়ে গেছে যে। যা! তিমিমাছ রান্না খাবারে বদলে গেলো! 
পেট তখন বলছে অতি জবরদস্ত খিদে পেয়েছে। আর টেবিলে কি যে অসাধারণ সে সব রান্না বলব কি!  
টেবিল তো প্লেট দিয়ে ভর্তি।কত খাবার! আর যা খিদে পেয়েছে আমাদের!
ওরাই বলে দিল, আভেইল কারি(কেরালার এক বিশেষ পদ্ধতিতে রান্না সব সবজি মিশিয়ে) কেরালা স্টাইলে পমফ্রেট ভাজা, শুখা চিকেন কারি আর চিংড়ির মালাবার কারি। কি জিভে জল এসে গেল তো? তাহলে ভাবো দেখি আমাদের অবস্থা! সামনে অতসব। 
আর সামনে তাকিয়ে দেখি কি আমাদের নৌকোখানা এসে দাঁড়িয়েছে এক নারকেল দ্বীপে। ছোট, বড় কত যে সারি সারি নারকেল গাছ সেখানে। খেয়ে দেয়ে সেই দ্বীপে নামলাম আমরা। (ক্রমশঃ)


স্মরণীয়
(নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু)

কলমে - পীযূষ প্রতিহার

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, চিরস্মরণীয় কিংবদন্তি নেতা বললে যার কথা মনে পড়ে তিনি হলেন এক এবং অদ্বিতীয় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি ১৮৯৭ সালের ২৩ শে জানুয়ারি ওড়িশা রাজ্যের কটক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন জানকীনাথ বসু এবং মাতা ছিলেন প্রভাবতী দেবী। বাবা জানকীনাথের আদি বাসস্থান ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার কোদালিয়া গ্রামে। মাতা প্রভাবতী দেবী ছিলেন উত্তর কলকাতার হাটখোলার প্রভাবশালী দত্ত পরিবারের কন্যা। জানকীনাথ কটকে গিয়ে আইন ব্যবসা করে প্রভাব প্রতিপত্তি অর্জন করেছিলেন। সুভাষচন্দ্রকে তিনি কটকের প্রোটেস্ট্যান্ট ইউরোপীয় স্কুলে ভর্তি করে দেন। বারো বছর বয়সে ভর্তি হন রাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে। এখানেই বাংলা ভাষা শেখেন তিনি। এই স্কুলে পড়ার সময় তিনি প্রধান শিক্ষক বেনীমাধব দাসের আদর্শ, নিষ্ঠা, নিয়মানুবর্তিতা ও নৈতিকতায় আকৃষ্ট হন। এই সময়েই তিনি স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত হন এবং উপলব্ধি করেন যে নিজের মুক্তির জন্য নয় বরং দেশের মানুষের মুক্তির জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। ষোল বছর বয়সেই রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ যুবগোষ্ঠী সংগঠিত করে গ্রামীণ পুনর্গঠনের জন্য উদ্যোগ নেন। ১৯১৩ খ্রীষ্টাব্দে তিনি রাভেনশ কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশ নিয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। এইসময় সুভাষচন্দ্র শ্রী অরবিন্দ ঘোষের চিন্তাধারার আকৃষ্ট হন ও দেশপ্রেমের আগুন জাগ্রত হয়। ১৯১৬ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজের অধ্যাপক ই এফ ওটেন ভারতবর্ষ ও ভারতীয়দের সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করলে সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে ছাত্র ধর্মঘট হয়। তিনি সতর্কিত হন। এর কিছুদিন পরেই ওটেন সাহেব একজন ছাত্রকে শারীরিক হেনস্থা করলে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয় এবং কমিটির বিচারে সুভাষচন্দ্র বসু কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। তিনি কটকে ফিরে যান। অবশেষে একবছর বাদে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের চেষ্টায় স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন বিভাগে ভর্তি হন। এই সময়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতরক্ষা বাহিনীর একটি শাখায় যোগ দিয়ে চারমাস সামরিক শিক্ষা গ্রহন করেন। ১৯১৯ সালে দর্শনশাস্ত্রে অনার্স নিয়ে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। 
      বাবার ইচ্ছায় আই সি এস পরীক্ষার জন্য লন্ডনে যান ১৯১৯ সালে। ১৯২০র আই সি এস পরীক্ষায় তিনি চতুর্থ স্থান অধিকার করেছিলেন। ১৯২১ সালে ভারতে ফিরে এসে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি তাঁকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের কাছে পাঠান এবং বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হন। এই সময় তিনি 'স্বরাজ' নামে একটি সংবাদপত্রও শুরু করেন। ১৯২৩ সালে তিনি সর্বভারতীয় যুব কংগ্রেসের সভাপতি ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৩০ সালে কলকাতা শহরের মেয়র নির্বাচিত হন। তিনের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি ইয়োরোপের নানা দেশে যান ও কমিউনিজম এবং ফ্যাসিজম প্রত্যক্ষ করেন। ১৯৩৫ সালে লন্ডনে তাঁর লেখা 'দ্যা ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল' নামে একটি বই প্রকাশিত হয়, ভারতে ব্রিটিশ সরকার বইটি ব্যান করেছিল গন আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে এই শঙ্কায়। সুভাষ চন্দ্র ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন পরপর দুবার ১৯৩৮ এবং ১৯৩৯ সালে।  তিনি মনে করতেন গান্ধীজির অহিংসা ও সত্যাগ্রহ নীতি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যথেষ্ট নয়। তিনি জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে মতাদর্শগত সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন এবং সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৩৯ সালের ২২জুন কংগ্রেসের মধ্যে থেকেই 'ফরওয়ার্ড ব্লক' দল গঠন করলে তিনি কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হন। ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করে তিনি সত্বর ও পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানাতে থাকেন। ১৯৩৯ সালেই তিনি কলকাতায় একটি প্রেক্ষাগৃহ নির্মানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে কলকাতা পৌরসভার থেকে একটি জমি লিজ নেন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অনুরোধ করেন ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের। রবীন্দ্রনাথ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে এসে পেক্ষাগৃহটির নামকরণ করেন 'মহাজাতি সদন' এবং সুভাষচন্দ্রকে ভূষিত করেন 'দেশগৌরব' উপাধিতে। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে এগারোবার কারারুদ্ধ করেও দমাতে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ১৯৪১ এর ১৬ জানুয়ারী ছদ্মবেশে লুকিয়ে ভারত ত্যাগ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মানি ও জাপান পৌঁছন। ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে সিঙ্গাপুরে একটি সভায় রাসবিহারী বসু আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্ব তুলে দিলে তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এই বাহিনীতে ঝাঁসি রানী রেজিমেন্ট নামে ক্যাপ্টেন লক্ষী সহগলের নেতৃত্বে একটি পৃথক নারী বাহিনী ছিল। আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্ব দিয়ে ইম্ফল ও ব্রহ্মদেশে(বর্তমান মায়ানমার) ব্রিটিশ মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কিছু ভূখণ্ড দখল করেন। ১৯৪৪ এর ৪ জুলাই বর্মায় আজাদ হিন্দ ফৌজের জন্য দেওয়া ভাষণে 'তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব' কথাটি উচ্চারণ করেন। এছাড়াও 'দিল্লী চলো' এবং 'জয় হিন্দ' স্লোগান তিনিই তুলেছিলেন। আজাদ হিন্দ সরকারের নিজস্ব মুদ্রা, ডাকটিকিট ও আদালত ছিল। অক্ষশক্তির নয়টি রাষ্ট্র এই সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। জাপান সরকার আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অধিকার আজাদ হিন্দ সরকারের হাতে অর্পণ করলে সুভাষ চন্দ্র এই দ্বীপ দুটির নাম দিয়েছিলেন 'শহীদ' ও 'স্বরাজ' দ্বীপ। ১৯৪৪এ সিঙ্গাপুর থেকে প্রচারিত একটি রেডিও বার্তায় সুভাষচন্দ্র গান্ধীজিকে 'জাতির পিতা' বলে সম্বোধন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে যখন জাপান পিছু হটতে থাকে তখন আজাদ হিন্দ ফৌজও পিছু হটতে বাধ্য হয়। অবশেষে রেঙুনের পতন এবং সর্বাধিনায়কের মৃত্যু সংবাদে (১৯৪৫ এর ১৮ ই আগস্ট) আজাদ হিন্দ বাহিনী ভেঙে পড়ে ও সস সরকারের পতন ঘটে। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ সরকার ও আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তি সংগ্রাম ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে যে স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিল তার ফলস্বরূপ নানা ছোট ছোট বিদ্রোহের ( ১৯৪৬ এর নৌবিদ্রোহ অন্যতম) স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতজুড়ে। এককথায় আজাদ হিন্দ ফৌজ ব্রিটিশ সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল।
       তাঁর লেখালেখি যা 'দি এসেনশিয়াল রাইটিংস অব সুভাষচন্দ্র বোস' নামে প্রকাশিত হয়েছে যদিও বাঙালিদের কাছে তাঁর 'তরুণের স্বপ্ন' বইটিই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। বিশিষ্ট ভারততত্ত্ববিদ রোম্যাঁ রঁল্যা সুভাষচন্দ্রের লেখা 'দি ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল' পড়ে তাঁকে লিখেছিলেন "একজন যথার্থ ইতিহাসবিদের সমস্ত গুনাবলীই এই বইতে প্রকাশিত। ...সক্রিয় রাজনীতিতে থেকেও নিজেকে দলমতের উর্ধ্বে রেখে নিজেকে বিচার করতে পারার দুর্লভ ক্ষমতা আপনার রয়েছে।" তিনি যে চিন্তায় এবং ভাবনায় যুগনায়ক ছিলেন সে প্রমাণ তিনি তাঁর কাজের মধ্যে রেখে গেছেন। কলকাতার মেয়র থাকাকালীন ও আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক থাকাকালীন তিনি সর্ব ধর্ম সমন্বয় ও তাদের সমান অংশীদারিত্ব বহাল করেছিলেন। তিনি তাঁর ফৌজে যে নারী বাহিনী রেখেছিলেন সে প্রচেষ্টা দক্ষিণ এশিয়ায় তার আগে দেখা যায়নি। 
    এই অগ্নিপুরুষ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। আজও রহস্যময় তাঁর শেষ অধ্যায়। বিভিন্ন সুচতুর পরিকল্পনা করে তাঁর শেষ অধ্যায় বারে বারে আমাদের সম্মুখে উপস্থিত করা হলেও তাকে অভ্রান্ত প্রমাণ করা যায়নি। তাই দেশবাসী আজও মনে করেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু অমর।


জ্বলদর্চি ছোটোবেলা ৬৭ /নারায়ণ দেবনাথ স্মরণে বিশেষ সংখ্যা

পাঠ প্রতিক্রিয়া 

বন্দনা সেনগুপ্ত 

ছোট্ট বন্ধুরা কেমন আছো? আমাদের সাথে সাথে তোমাদের অনেকেরও মন খারাপ নিশ্চয়। নারায়ণ বাবু আর নেই, ভাবতেই কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। উনি আমাদের ছোটবেলার অনেকটা জুড়ে ছিলেন। শুধু তাই নয়, বন্ধুরা, আমি এই কিছুদিন আগে পর্যন্তও ওঁর হাঁদা ভোঁদা, বাঁটুল দি গ্রেট ইত্যাদির অ্যানিমেশন দেখেছি। মনেই হতো না যে বড় হয়ে গেছি। ওঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলি আমাদের একজন ছিল। যে দুষ্টুমি আমরা করতে পারছি না, যে বোকামিগুলি আসলে আমাদের খুব স্বাভাবিক ও ঠিক মনে হয়, সেগুলি সব উঠে আসতো ওঁর লেখায়, আঁকায়। তাই জন্যেই তো রাজীব আঙ্কেল অনেক দুষ্টুমি মাফ করে দেন। আর, বাঁটুল  ... সে তো জাস্ট দি গ্রেট! বাঙালি সুপারম্যান। যেমন খেতে পারে, তেমনি কোনও কাজই ওর জন্য অসম্ভব নয়। হ্যাঁ, আমিও জানি যে বাঁটুল অ্যাসিড অ্যাটাক প্রতিহত করতে পারে, ঠিক যেমনটি রাজীব বাবু বলেছেন।

রাজীব বাবুর প্রবন্ধটি অত্যন্ত তথ্যসমৃদ্ধ এবং সুলিখিত। উনি নারায়ণ বাবুর আঁকা ও বিশেষ করে লেখার খুব সুন্দর আলোচনা করেছেন। খুব ছোটদের হয়তো একটু 'বোরিং' লাগতে পারে কিন্তু অন্যদের জন্য উনি যেন সময়ের একটি চলচিত্র তৈরী করেছেন। সময় এগিয়ে চলেছে, পরিবর্তন হচ্ছে সারা দুনিয়ায়। ডিজিটাল দুনিয়া খাতা, কলম, রং পেন্সিল, ইত্যাদির জগৎ থেকে আলাদা। সুবিধা অসুবিধা দুইয়েরই আছে। আর এখন করোনা কালের জন্য মোবাইল, আই প্যাড, ল্যাপটপ ইত্যাদি অবশ্য প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। বাংলা পড়ার লোকও ক্রমশঃ কমছে। প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে গল্পের বইয়ের জন্য বাচ্চাদের সময়ও কমে আসছে। 

আবেশ বাবুর সঙ্গে আমি একমত, ছোটোবেলাটাই আমাদের গুপ্তধন। কত কিছু যে সেই স্মৃতির ভাণ্ডারে লুকিয়ে আছে তা কে জানে! সেদিন আমাকে একজন শুকতারার একটা সংখ্যা ফরওয়ার্ড করেছিল। সেটা পড়তে পড়তে ছোটবেলায় ফিরে গেলাম। কত গল্প হাঁদা ভোঁদার বা বাঁটুল দাদার। বাচ্চু বিচ্ছুকেও কি বাদ দেওয়া যায়? অথবা, অন্য চরিত্রদের? আসলে ঐ যে বললাম, যা করতে চাই কিন্তু পারি না ... তারই গল্প বার বার উঠে আসে ওঁর ছবিতে ও কাহিনীতে। তাই ওঁর আবেদন চিরন্তন। ( আবেশ বাবু চুপি চুপি বলি, আর কিছু বছর বাদে কিন্তু ওই পয়সাগুলি সত্যি সত্যি গুপ্তধন হয়ে যাবে)।

বিশ্বদীপ বাবু, খুব ভালো লাগলো আপনার চিঠি। আমারও খুব ভালো লাগে গল্পের বই পড়তে, এখনও। এখন তো কত সুবিধে, কত ওয়েবসাইট। ফ্রীতেই যত ইচ্ছা বই পড়। কিন্তু আমাদের ছোটবেলায় সে সুবিধা ছিল না। সব সংখ্যা কেনার মতো পয়সাও থাকত না। তাই বন্ধুদের থেকে বা লাইব্রেরি থেকে নিয়েও অনেক বই পড়া হতো। সবাই যেখানে ভাবছেন নারায়ণ বাবু নেই, কাজেই তাঁর সৃষ্ট চরিত্ররাও এবার হারিয়ে যাবে। তা কিন্তু হবেনা। বিশ্বদীপ বাবু বলছেন তারা সবাই আমাদের সঙ্গেই থাকবে। 

আমি বলছি শুধু থাকবে না, বহাল তবিয়তে থাকবে। আরো অনেক নতুন কাহিনীর মধ্য দিয়ে থাকবে।  

তা কি করে হবে? জানতে হলে পড়ে নাও শ্রীপর্ণার লেখা “সূর্যাস্তের সত্যি রঙ”। হুঁ হুঁ ! আমি কিচ্ছুটি বলব না। মন দিয়ে পড়ে ফেল দিকি নতুন কাহিনী।

রুম্পা দেবী খুব সহজ সরলভাবে সুন্দর স্মৃতিচারণ করেছেন। তাঁর লেখায় নিপাট ভদ্রলোক নারায়ণ দেবনাথের পরিচয় পাচ্ছি। তাছাড়া প্রচ্ছদের ছবিটিও তাঁর দেওয়া। একটানে এঁকে দেওয়া কি সুন্দর এক স্কেচ।

সন্দীপন রায়ের নারায়ণী শৈশব একদম আমার মনের কথা ... ওদের সঙ্গে যে চিরকালের দোস্তি। 

পীযুষ প্রতিহার বাবুর প্রতি সংখ্যার "স্মরণীয়" সব সময়েই স্মরণ করার মতো লেখা। এই সংখ্যাও ব্যতিক্রম নয়। নারায়ণ দেব নাথবাবুর জীবনকথা খুব সুন্দর ভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে। অনেক অজানা তথ্যই জানতে পারলাম ওঁর লেখা পড়ে।

স্নেহা, ভাই তোমার লেখা পাঠ প্রতিক্রিয়া আমাকে অবাক করেছে। খুব মন দিয়ে পড়েছো। আর তার পর কি সুন্দর গুছিয়ে গুছিয়ে লিখেছ। ভবিষ্যতে তোমার কাছ থেকে আরো অনেক লেখা আশা করবো।

এবারে আসি আঁকার কথায়। সমারোহ, রায়ান, তুলি, প্রমিত, প্রবাহ নীল, শানভি  ... কাকে রেখে কার কথা বলি। সবাই খুব সুন্দর এঁকেছ। তবুও এরই মধ্যে ছোট্ট রায়ান ও প্রবাহ নীল বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। তবে, অন্যরা যে কম, তা নয় কিন্তু। আর তোমরা বলে দিচ্ছ যে নারায়ণ বাবুর সৃষ্টি আমাদের সঙ্গে ছিল, আছে ও থাকবে।

আজ আসি। আশা করি শিগগিরই স্কুল খুলবে আর তোমরা এই ঘর বন্দী জীবন থেকে মুক্তি পাবে। ভালো থেকো সবাই। 

আরও পড়ুন 
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


     

Post a Comment

0 Comments