জ্বলদর্চি ছোটোবেলা ৬৭
নারায়ণ দেবনাথ স্মরণে বিশেষ সংখ্যা
সম্পাদকীয়,
যেমন কর্ম তেমন ফল, অতি লোভে তাঁতী নষ্ট, এক মাঘে শীত যায় না, কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ - এমন প্রবাদ প্রবচনগুলো পদে পদে মিলে যেত হাঁদা ভোঁদা পড়লেই। সে হাড়ে হাড়ে দুষ্ট, ভাবিয়া করিও কাজ, অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী - এইগুলো মিলে যেত নন্টে ফন্টের কেল্টুদার কান্ড কারখানা দেখলেই। আর যাকে দেখলে এখনও বিষ্ময় কাটে না সেই বাঁটুলদার ছবি দেখলে আজো মনে হয়, কি করে এত বিশাল লোকটার একটুও ভুঁড়ি নেই! এত এত বিষ্ময়, মজা, ছবি, গল্প দিয়ে তৈরি এই চরিত্রগুলো যে কি ভীষণ আমাদের ছোটোবেলাকে আকৃষ্ট করে রাখতো সে গল্প আমরা শুনবো রাজীব স্যার, বিশ্বদীপ আঙ্কেল আর আবেশ কাকুর কাছে। সন্দীপন আঙ্কেল বলবেন এদের নিয়ে ছড়া। রুম্পা কাকিমা বলবেন প্রচ্ছদের ছবিটি তিনি কিভাবে চোখের সামনে শিল্পীকে আঁকতে দেখেছেন। কে সেই শিল্পী? তিনি কমিক্স স্রষ্টা, শিশু সাহিত্যিক নারায়ণ দেবনাথ। তাঁর জীবনীটি জেনে নিও পীযূষ আঙ্কেলের লেখা পড়ে। আর তোমরাও যে তাঁর কমিক্স পড়েছো সেতো তোমরা আঁকা পাঠিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছো। আরে আছে আছে, গল্পও আছে এবারের সংখ্যায়। সেটি লিখেছে, তোমাদের বন্ধু খুদে গল্পকার শ্রীপর্ণা। শ্রীপর্ণার গল্প দিয়েই এসো আমরা অঞ্জলি দিই সদ্যপ্রয়াত শিল্পীর চরণে। 🙏 --- মৌসুমী ঘোষ।
আমি দেখলাম অ্যাসিডেও বাঁটুলের কিছু হয়নি
রাজীব কুমার ঘোষ
হ্যাঁ আমি নিজের চোখে দেখেছিলাম অ্যাসিডেও বাঁটুলের কিছু হয়নি।
কে বাঁটুল! তাহলে তোমরা বাঁটুলকে চেনো না! এখন থেকে বছর কুড়ি আগে তোমরা এই কথা বললে আমি খুব অবাক হয়ে যেতাম। অবাক হয়ে যেতাম বললে ঠিক বলা হবে না একটু ভারী ভাষায় বলতে হবে বিস্ময়বিমূঢ় এবং চিত্রার্পিত হয়ে যেতাম। সেই সময় এমন কোনো বালক-বালিকা ছিল না যারা বাংলা পড়তে জানে অথচ শিল্পী নারায়ণ দেবনাথের আঁকা বাঁটুলকে চেনে না। কথাটা তোমাদের কাছে একটু বাড়াবাড়ি বলে মনে হলেও কিছু করার নেই, কথাটা সত্যি।
তাহলে কী এমন হল এই কুড়ি বছরে যার জন্য আমার মনে হচ্ছে তোমরা বাঁটুলকে না চিনতেও পারো। তবে ওই যে তোমাদের অনেককেই এই লেখা পড়তে পড়তে অজান্তেই হাত তুলে ফেলেছ দেখতে পাচ্ছি। হাত তুলে বলছ, চিনি আমরা বাঁটুলকে চিনি।
তোমাদের অনেকে আবার লেখাটা পড়া বন্ধ করে স্ক্রল করে চলে যাবার উদ্যোগ নিচ্ছ। তোমরা এর মধ্যেই দেখতে পেয়েছ ছোটোবেলার এই সংখ্যায় নারায়ণ দেবনাথকে নিয়ে অনেক লেখা আছে। তোমরা জেনে গেছ নারায়ণ দেবনাথ সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন। এও হয়ত জেনে গেছ, বাঁটুল, নন্টে-ফন্টে, হাঁদা-ভোঁদা এবং আরো অনেক কমিক্স চরিত্রের তিনি স্রষ্টা। যারা আরেকটু বেশি জেনেছ তারা জানো যে, তিনি প্রায় পঞ্চাশ বছরের ওপর ধরে নিয়মিত বহু কমিক্স স্ট্রিপ নিয়মিত এঁকে গেছেন এমনকি গল্পও লিখেছেন অনেক। ফলে তোমরা ভাবছ এই লেখাতেও তার বিষয়ে নানা কথায় ভরা থাকবে – এবং যা বড্ড বোরিং।
‘বোরিং’ – এই শব্দটাকে আমরা বড়রা খুব ভয় পাই। আমাদের ছোটোবেলার কোনো প্রিয় বই বা চলচ্চিত্র যখন পরের প্রজন্মের ছোটোরা ‘বোরিং’ বা ‘স্লো’ বলে ঠেলে সরিয়ে রাখে তখন সেই বোরিং শব্দটা শুনতে আমরা ভয় পাই। মানুষ এক জীবনে দু’বার বাঁচে। একবার তার নিজের জীবন বাঁচে আরেকবার সে তার সন্তানের মধ্য দিয়ে বাঁচতে চায়, বিশেষত ফিরে যেতে চায় তার শৈশবে। হ্যাঁ আমরাও আমাদের শৈশবে বড়দের শৈশবের সব ভালো লাগার সঙ্গে আমাদের ভালো লাগা মেলাতে পারিনি কিন্তু তুলনা করলে দেখতে পাই সেই পরিমাণটা ছিল কম। এখন তার পরিমাণ অনেক, অনেক বেশি। ভাবতে বসলে দেখতে পাই আগে একটা যুগ ধীরে ধীরে সরে গিয়ে আরেকটা যুগকে জায়গা করে দিত ফলে নতুন যুগের ছোটোদের অসুবিধা হত না পুরোনো যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে। সবচেয়ে বড় কথা এই ধীর গতির জন্য আগের যুগের যা কিছু তার ভালোমন্দ বিচার করার এবং যা ভালো তা গ্রহণ করার জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যেত। ২০০০ সালের পর থেকে এই পরিবর্তন কল্পনার চেয়েও দ্রুত হয়ে উঠেছে। প্রতি বছর তার গতি আরো দ্রুত থেকে দ্রুত হয়ে চলেছে। এর অন্যতম কারণ টেকনোলজির বিপুল প্লাবন। তাই আজকের এই মোবাইল, ইউ-টিউব, ভার্চুয়াল গেমস, আমাজন প্রাইম, নেটফ্লিক্স, ডিজনি হটস্টার আরো কত কত অনলাইন চ্যানেলের কাছে, কম্পিউটার জগতের কাছে, কার্টুন বা অ্যানিমেশন মুভির কাছে, ইন্টারনেটের তথ্যের বণ্যার কাছে বাঁটুলরা কোথাও হেরে যাচ্ছে বলেই মনে হয়। তাই আজ যদি তোমাদের বলি নারায়ণ দেবনাথের এই চলে যাওয়া, যার সঙ্গে তার চরিত্রদেরও চলে যাওয়া আসলে আমাদের কাছে এক চরম শোক, ছোটোবেলার বন্ধুদের চির বিদায় দেওয়া তাহলে তোমরাও বোধহয় ‘বিস্ময়বিমূঢ়’ হবে।
চলো ফিরে যাই এমন একটা সময়ে যখন মোবাইল ফোন তো দূরের কথা ল্যান্ড ফোনও সবার বাড়িতে থাকত না। এমনকি বাড়িতে বাড়িতে টিভি-ও নেই। তখন ইন্টারনেট নেই, কম্পিউটার শব্দটাও অচেনা। ছোটোবেলায় সিনেমা দেখা মানে সিনেমা হলে গিয়ে দেখা কটা দেখা তা হাতের আঙুল গুনে বলে দেওয়া যায়। কার্টুন এই ব্যাপারটা জানতেই জীবনের প্রথম দশ-এগারো বছর কেটে যায়। আরো কয়েক বছর কেটে যায় কার্টুন সিনেমাও হয় তা জানতে। আরো কয়েক বছর কেটে যায় তা প্রথম দেখতে।
সেই সময়ে ছোটোদের জন্য পত্রিকা শুকতারায় মলাট ওল্টালেই দু-পাতায় বাঁটুলের কাহিনি। প্রতি সংখ্যায় আলাদা আলাদা কাহিনি। কখনও কয়েকটা সংখ্যা মিলে একটা গল্প। আর পত্রিকার ভেতরের দিকে দু’পাতায় আরেকটা কমিক্স — হাঁদা-ভোঁদা।
আমরা সুপারম্যানের কথা পরে জেনেছি, আগে আমাদের জীবনে ‘বাঁটুল দি গ্রেট’ এসেছে। যার গায়ে গুলি লাগলে ছিটকে যায়, যে এক হাতে উপড়ে ফেলতে পারে গাছ, তুলতে পারে হাতি। জলের নীচের সাবমেরিন বাঁটুল ফুঁ দিয়ে সাব-বেলুন করে ভাসিয়ে দেয় হাওয়ায়। দাঁত তুলতে রকেট উৎক্ষেপণ কেন্দ্রে গিয়ে নড়বড়ে দাঁতের সঙ্গে দড়ি বেঁধে সেই দড়ি রকেটে বেঁধে রাখে। আমাদের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই বাঁটুলের কাছে সুপারম্যান তুচ্ছ। অ্যাভেঞ্জাররা বাঁটুলকে দলে নিল না তাই। নিলে বাঁটুল দু’মিনিটে থ্যানোসকে থানকুনি বানিয়ে দিত অবশ্যই। দু’রং-এর সেইসব কমিকস পরে খন্ডে খন্ডে বেরোয়। তোমরা আজ একেবারে রঙিন যে বাঁটুল কমিকস দেখতে পাও সেই রং অনেক পরে কম্পিউটারে করা।
শুকতারার প্রচ্ছদেই থাকত নারায়ণ দেবনাথ সৃষ্ট আরেকটি চরিত্র কৌশিক, ভারতের এক কল্পিত গুপ্তচরের ধারাবাহিক কমিক্স। ব্যাপারটা অভিনব ছিল, এর আগে কোনো পত্রিকার প্রচ্ছদে ধারাবাহিক কমিক্স দেখি নি। দিনের পর দিন দেখতে দেখতে ওটাই আমাদের কাছে সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে গেছিল। একই সময়ে কিশোর ভারতী পত্রিকায় নন্টে-ফন্টের কমিক্স। বলে রাখা ভালো পরে ‘বাহাদুর বেড়াল’, ‘ডানপিটে খাঁদু এবং তার কেমিক্যাল দাদু’ এই দু’টি কমিকস সিরিজ শুরু হলেও বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা বা নন্টে-ফন্টের মতো এরা অতটা কাছের হয়ে ওঠেনি। হয়ত তখন একটু বড় হয়ে গেছিলাম।
কেন এই কমিক্সগুলো আমাদের শৈশবকে ঘিরে ছিল? আজ এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখতে পাই একটা নয় অনেক কারণ ছিল এর পেছনে।
১. কমিক্স এখনকার মতো অত সহজলভ্য ছিল না তখন। বিশেষত মফস্সল বা গ্রামের দিকে। সাধারণ মানুষকে তখন টাকা-পয়সার ব্যাপারটা খুব হিসেব করে চলতে হত। প্রয়োজন আর অপ্রয়োজনের মাপকাঠিটা ছিল খুব কড়া। সেখানে শুকতারা আর কিশোর ভারতী এই দু’টি ছোটোদের পত্রিকা কেউ না কেউ নিত, স্কুলে কেউ আনলে হাত ফেরতা হয়ে অনেক হাতেই ঘুরত। অনেক লাইব্রেরিতেও রাখা হত। দামেও মোটামুটি সহজলভ্য ছিল। সেই সময় কোথাও কার্টুন বা কমিক্স দেখলেই আমরা হামলে পড়তাম।
২. এই কমিক্সগুলো ছিল খাঁটি বাঙালি কমিক্স, চরিত্ররা বাঙালি, বাঙালি সমাজ। শুধু মূল চরিত্ররা নয় অন্যান্য চরিত্ররাও আমাদের মুগ্ধ করে রাখত বিশেষত নন্টে-ফন্টে গল্পের আরেক প্রধান চরিত্র কেল্টুদা আর ছেলেদের হোস্টেলের সুপারিনটেন্ডেট সেই হাতিরাম পাতি। এই দ্যাখো এই শোকের মধ্যেও মুখে আমার হাসি ফুটে উঠছে। হাসি ফুটে উঠছে হাঁদা-ভোঁদার পিসেমশাইয়ের কথা মনে পড়তেই। একইভাবে বাঁটুলের পিসিমাকেও মনে পড়ছে বিশেষত ইয়া বড় গামলা ভর্তি বিরিয়ানি ট্রলি চাপিয়ে রুগ্ন পিসির নিয়ে যাবার দৃশ্যটি। মনে পড়ছে বাঁটুলকে জ্বালানো বাচ্চু-বিচ্ছুকে আর বাঁটুলকে সাহায্য করা সামান্য শব্দও শুনতে পাওয়া ছেলেটি লম্বকর্ণকে, বাঁটুলের কুকুর ভেদোকে। শুধু চরিত্র কেন কত সব ঘটনাও বোনা হত গল্পে। ধারাবাহিকভাবে এগুলো পড়লে দেখা যাবে সেই সময়কার অনেক কিছুই কমিক্সগুলোতে উঠে এসেছে। ফলে কমিক্সগুলোর পরিবেশ ছিল আমাদের চেনা। তোমাদের চুপি চুপি বলে রাখি পরে যখন আমিও হোস্টেলের এক প্রকার সুপারিনটেন্ডেট হয়েছিলাম এই নন্টে-ফন্টের গল্পগুলোর জন্যই খুব একটা কড়া শাস্তি কখনো দিতে পারিনি। কড়া হবার ভান করতাম বটে কিন্তু ছেলেদের দুষ্টুমিগুলো দেখে নন্টে-ফন্টে-কেল্টুরামের কথা মনে পড়ে যেত আর আয়নায় নিজেকে প্রায়ই পাতিরাম হাতি দেখে ফিক্ফিক্ করে হাসতাম। আমার হোস্টেলের সেই সব শাস্তি মকুব ছাত্ররা জানতেও পারত না যে কমিক্স-এর কিছু চরিত্র তাদের কীভাবে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
৩. ছবিগুলো ছিল মনকাড়া। ধারাবাহিকভাবে দেখলে দেখা যাবে প্রতিটি চরিত্রের চেহারায় একটু এদিক-ওদিক বদল এসেছে সময়ের সঙ্গে। এই ছবিগুলো দেখতে দেখতেই কিন্তু আমার ক্যামেরার ফ্রেমের জ্ঞান হয়েছে অজান্তেই। অজান্তেই আরেকটা জিনিসের ধারণা ঢুকে গেছে অবচেতনে, গল্প কীভাবে বলতে হয়। ঘটনা কীভাবে একের পর এক সাজাতে হয়। গল্পে ক্লাইম্যাক্স কখন আনতে হয়। আর ক্লাইম্যাক্সের ছবি অন্য ছবি থেকে কীভাবে আলাদা হয়ে যায়। তাছাড়া দৈনন্দিন জীবনের নানা টুকরো-টাকরা জিনিস এইসব কমিক্সে দেখে আমরা খুব আনন্দ পেতাম। কার্টুন আঁকার প্রথম পাঠ, সেও তো এইসব কমিক্স দেখেই।
৪. কমিক্সগুলোর ভাষাও ছিল খুব রম্য। ছোটো ছোটো বাক্য এবং মজা থাকত তার মধ্যে। কিছু উদাহরণ রইল। প্রথমে কিছু শব্দের উদাহরণ দিই – দ্যাখো তো শব্দগুলো পড়ে বুঝতে পারো কিনা কোনটা কীসের শব্দ - ফট্-ফট্-খ্যাড়াং, চাকুম্-চুকুম্, দমাস-দমাক, ফরাৎ ফোঁরর!
বাঁটুলের কমিক্স থেকে
“প্রেসটিজ একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে গেলো”
নিষ্কর্মাপুরের রাজবাহাদুর
“এই যে দাদা পালের গোদা”
“তোমার খেল খতম গুপি গুঁই, এবার জেলে বসে কুঁই কুঁই করো।”
দুই আদিবাসির ঘড়ি দেখে কথোপকথন
“দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টিক্টক্ শব্দ করছেন, ইনি নিশ্চয়ই কোন দেবতা!”
“ইনি বোধহয় টিক্টক্ দেবতা।”
হাঁদা-ভোঁদা থেকে
নিষ্কর্মা সমিতি,
জাদুকর ফালতুকুমার,
“ইগলি-মিগলি-গুগলি খা, ওপর পানে উঠে যা”।
নন্টে আর ফন্টে থেকে
হোঁদল এন্টারপ্রাইজ,
“ওর ঐ জাঁক ফাঁক করতেই হবে”
“… তোরা কি সং সেজে ঢং দেখাতে আসছিস না কি রে…”
“ওরে ছুঁচো, কেল্টু! … যান্ত্রিক চাঁট মেরে তোর ডাঁট ভেঙে দিলুম”
৬. অনেক সময় চরিত্র অনুসারে নানা ডায়ালেক্ট ব্যবহার করা হত যা ছিল খুব উপভোগ্য, যেমন
নন্টে-ফন্টে থেকে, “তুলবো তো লিচ্চয়। আমি য্যাখন ইখানে হাজির রইচি ত্যাখন আর ডর নাই। কিন্তুক আপুনাদের কে উখানে কাদাতে স্যাঁদায়ে দিলো ইটা তো বুঝতে লারছি!”
হাঁদা-ভোঁদা থেকে, “আরে বদমাস! হাঁথ মে পাই তো ডান্ডা পিটুৎ পিটৎ তোহার হাড্ডি তোড় দি।”
বাঁটুল থেকে, “ওই সেই দুষমণ! যে বেত্মিজদের আমরা শায়েস্তা করছি, ও তাদের মদত দিতে এসেছে। মার ডালো উস্কো!”
৭. মাঝে মাঝে সাধু-ঘেঁষা ভাষা বা তৎসম শব্দ ব্যবহার করে মজা জমিয়ে দেওয়া হতো, যেমন বাঁটুল একজনের ওপর পড়ে গিয়ে বলছে, “আহারে কোন হতভাগ্যের ওপর পতিত হলুম কে জানে!” আবার একজায়গায় লাথি মারবে না মারবে না সেই প্রসঙ্গে বাঁটুল বলছে, দিই লাথি মেরে। কিন্তু যে ভাষায় বলছে সেটা হল, “দিই পদসঞ্চালন করে”। চলিত কথার মাঝে মাঝেই এই সাধু-ঘেঁষা ভাষা ব্যবহার খুব আকর্ষণীয় হয়ে উঠত। এই প্রসঙ্গে বলি, আমরাও কিন্তু এই ভাষা বন্ধুদের মধ্যে মজা করে ব্যবহার করতাম। আমার এক বাল্য বন্ধু ইংরাজি মাধ্যমে পড়ত এবং খুব স্বচ্ছন্দভাবে ছোটোবেলায় বাংলা পড়তে পারত না। সে কিন্তু আমার কাছ থেকে নিয়ে বাঁটুল পড়েছিল সহজ ভাষার জন্য এবং মাঝে মাঝেই ওই ভাষা ব্যবহার করত। বহু পরে পরিণত বয়সে সে কিছু চিঠি লেখে আমাকে, বাংলাতেই (যা একটা দারুণ ব্যাপার)। আমি খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছিলাম সেই ভাষায় একেবারে বাঁটুলের ভাষার ছাপ আছে এমনকি রঙ্গ-তামাশাটিও ষোলোআনা বর্তমান।
যখন বাঁটুল, নন্টে-ফন্টে, হাঁদা-ভোঁদা কমিকস্ বই হিসাবে বেরোতে থাকে (বাই কালার এবং সাদা কালো, এখনকার মতো রঙিন নয়) প্রতিটির প্রথম তিনটি বা চারটি খন্ড বাবা আমাকে কিনে দিয়েছিলেন। এ’ছাড়া পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে সেই সময়ের আরেক জনপ্রিয় কমিক্স সিরিজ, ইন্দ্রজাল কমিক্স-এর কিছু সংখ্যা কিনে দিয়েছিলেন। তাতে ছিল অরণ্যদেব, ম্যানড্রেক, ফ্ল্যাশ গর্ডন, বাহাদুর, রিপ কার্বি ইত্যাদি। পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে এইজন্য যে, তখন এগুলো আর পাওয়া যেত না।
আমার এই স্বল্প কমিক্স-সম্ভার আমি রাখতাম যে তাকে তার পাশেই একসময় রাখা হয় ইনভার্টার ব্যাটারি। এই ইনভার্টার এখনকার ইনভার্টারের মতন এত অ্যাডভান্স আর স্মার্ট ছিল না। একবার এই ব্যাটারির ভেতরের অ্যাসিড মিশ্রিত জল উপচে পড়ে এবং সেই ভয়ানক অ্যাসিড-জল আমার বেশ কিছু বইয়ের ধ্বংস-সাধন করে যার মধ্যে ছিল কমিক্সগুলোও। কিন্তু আশ্চর্য! ইন্দ্রজাল কমিক্সগুলোর গঙ্গাপ্রাপ্তি হলেও তার ঠিক নিচে থাকা নারায়ণ দেবনাথের চরিত্ররা বেঁচে যায়। আমি দেখেছিলাম সবার ওপরে ছিল বাঁটুলের কমিক্সগুলো। এই ঘটনা আজো আমার কাছে বড় আশ্চর্য লাগে, তাহলে কি বাঁটুল-ই বুক পেতে অ্যাসিড ঠেকিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছিল অন্যদের!!
এ হেন বাঁটুলকেও দেখছি হেরে যেতে মোবাইলের কাছে, আধুনিক বিনোদনের কাছে, ঝকঝকে-চকচকে প্রচুর কমিক্সদের কাছে! সেই বাঁটুল, সেই নন্টে-ফন্টে, সেই হাঁদা-ভোঁদা — কত বিনিদ্র দুপুর যাদের সঙ্গে কেটেছে। গ্রীষ্মের দাবদাহে, বর্ষার ঝমঝম শব্দের মধ্যে, লোড-শেডিং-এর সময় হ্যারিকেন বা চিমনির হলদে মায়াবী আলোর সঙ্গে, জ্বরের ঘোরে একলা শুয়ে থাকার সময় যাদের সঙ্গে কাটিয়েছি তারা আজ কোথায়? এখন থেকে তারা তো আরও একা। আর কোনো নতুন গল্প রচিত হবে না। তাদের যাত্রা কি তাহলে এখানেই ফুরলো? এর উত্তর আমার কাছে নেই, এর উত্তর তোমাদের কাছে আছে।
আমি শুধু একটা কথাই জানি, বাঁটুল কখনো অ্যাসিডে পোড়ে না। হাঁদা-ভোঁদার রেষারেষি কখনো থামে না। নন্টে-ফন্টে আর কেল্টুদার কান্ডকারখানা চলবেই। আমি বিশ্বাস করি এই মুহুর্তে কোথাও না কোথাও তোমাদের মতোই কেউ না কেউ হাতে তুলে নিয়ে দেখছে এদের কান্ডকারখানা আর হাসছে — অমলিন এক হাসি। আর সেই হাসি দেখে কোথাও নারায়ণ দেবনাথ খুব আনন্দ পাচ্ছেন। আমরা ‘স্ট্যান লি’ কে পাইনি বটে কিন্তু নারায়ণ দেবনাথকে পেয়েছিলাম। হে শিল্পী আমাদের প্রজন্মের পক্ষ থেকে আপনাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম।
গুপ্তধন
আবেশ কুমার দাস
১৮ জানুয়ারি, বেলা এগারোটা। হঠাৎ মনে পড়ল আমাদের বাড়িতে গুপ্তধন আছে। তিরিশ বছরের বেশি হয়ে গেছে গুপ্তধন রয়েছে আমাদের বাড়িতেই। একা আমিই এতকাল জেনে এসেছি যার হদিস। এত লোক যায় আসে। ফটকের পর একফালি চাতাল পেরিয়ে সড়সড় করে উঠে আসে বারান্দায়। টেরটিও পায় না পায়ের তলায় মাড়িয়ে এল গুপ্তধন। আমারই কি মনে ছিল!
গুপ্তধনই তো। সম্রাট আকবরের যুগের মোহর কি আজ হাতে নিয়ে দেখা যাবে ইচ্ছে করলেই? তেমনি হাজার টাকা খরচা করলেও ঝট করে আজ হাতে পাওয়ার উপায় নেই পঁচিশ বছর আগেই অচল হয়ে যাওয়া তিন বা পাঁচ পয়সা। সেটা কত সাল হবে? ওই ১৯৯০-৯১। সে ছিল অন্য এক পৃথিবী। লম্ফ জ্বলত সন্ধ্যার মফস্সলে। ক্যামেরা দিয়ে একটা ছবি তোলার পর তিন মাসও কেটে যেত তার চেহারা দেখতে। চৌমাথার জগবন্ধু সুইটসে আট আনায় পাওয়া যেত একখানা বড়সড় রসগোল্লা।
মাটির তলায় গুপ্তধন লুকিয়ে রাখার বুদ্ধিটা সেই যুগে আমাকে দিয়েছিল দুই সমবয়সি বন্ধু। যে বুদ্ধিতে ওরা কুপোকাত করেছিল স্কুল বোর্ডিং-এর মিচকে সিনিয়র শ্রীমান কেল্টুকুমারকে। রাতের অন্ধকারে কোদাল কাঁধে ছুটেছিল কেল্টু। নকশা মিলিয়ে পোড়ো মন্দিরের লাগোয়া জমিতে গুপ্তধনের খোঁজ করতে। পরিণামটা সুখকর হয়নি যদিও। ‘ক্রোয়াঁক ক্রোয়াঁক’ (এমন অনেক অদ্ভুত শব্দই খুঁজে পাওয়া যাবে নারায়ণ দেবনাথের চিত্রসাহিত্যে) শব্দ ছেড়ে গুপ্তধনের পেটিকা থেকে লাফিয়ে এসেছিল একরাশ কুনোব্যাঙ। সারা রাতের খাটুনিতে এমনিতেই নাকাল কেল্টুকে পালিয়ে বাঁচতে হয়েছিল গুপ্তধনের পেটিকা উদ্ঘাটনের লোভ দেখিয়ে বিছানা থেকে তুলে আনা সুপারিন্টেন্ডেন্ট পাতিরাম হাতি স্যারের নাগাল থেকে। তার মধ্যেই অবশ্য বিরলকেশ সুপারিন্টেন্ডেন্টের একপাটি জুতো এসে পড়েছিল তার মাথায়। বিনা দোষে ক’দিন আগেই শাস্তি ভোগ করার দুঃখটা গল্পের শেষে বেশ সুদে আসলেই মিটিয়ে নিয়েছিল আমার সেই দুই বন্ধু। নন্টে আর ফন্টে। মনে পড়ে, অনাবিল আনন্দ পেয়েছিলাম কেল্টুর বেইজ্জতে। অবশ্য এই একটা গল্পেই নয়, সংলাপ আর সাদাকালো ছবিতে ভরপুর সেই পাতলা পাতলা কমিক স্ট্রিপের বইগুলোর আরও কত গল্পেই যে বদমাশ কেল্টুকে নাজেহাল হতে হয়েছে নন্টে-ফন্টের বুদ্ধির প্যাঁচে। আবার চুরি করে শশা খেতে গিয়ে সাপে কাটা বাগান-মালিকের জীবন বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুই বন্ধু প্রমাণ রেখে গেছে নিজেদের মহত্ত্বের। তবে চুরির বস্তুটা যদি হয় উপাদেয় খাবার তবে যে সাতখুন মাফ (বিশেষ করে ছোটদের), সেই ব্যাপারটাও কেমন করে যেন সেদিন আমাকে টের পাইয়েই দিয়েছিলেন নারায়ণ দেবনাথ।
জ্বলদর্চির ছোটবেলার বন্ধুদের অনেকের কাছেই অচেনা নয় নন্টে-ফন্টে। তোমাদের বয়সে আমারও বন্ধু ছিল ওরা। তার আগে যেমন ওদের বন্ধুত্ব ছিল আমার মণিমাসির সঙ্গে। ওরা অমনই। আমার জন্মের অনেক আগেই সেই ১৯৬৯-এ কিশোর ভারতীর পাতায় আত্মপ্রকাশ ঘটিয়ে পরবর্তী পঞ্চাশ বছরেও একটুও বাড়তে দেয়নি নিজেদের বয়স। আমাদের পর তোমাদের সঙ্গেও দিব্যি পাতিয়ে নিয়েছে দোস্তি। বয়স বাড়তে না দেওয়ার এমন মহামন্ত্রটার থেকে বড় গুপ্তধন আর কী আছে দুনিয়াতে!
আমার সেদিনের জহরত যদিও ছিল ক’টা ময়লা তামার পয়সা। জমিয়েছিলাম বাড়িতেই থাকা একটা জং-ধরা কৌটোতে। তারপর নন্টে-ফন্টের বুদ্ধিতেই একদিন বাবার বাগান করার খুরপিটা দিয়ে কাঁচা উঠোনে গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে রেখে এসেছিলাম আমার সেই রত্নপেটিকা। রোজ যাতায়াতের পথে আড়চোখে খেয়াল রাখতাম বিশেষ জায়গাটা। নারায়ণ দেবনাথের আঁকা ছবির মতো লাগছে নাকি। যদিও ছবির মতো কী আর হয় অবিকল! একটা সাদাসিধে বোর্ডিংবাড়িও নারায়ণ দেবনাথের তুলির টানে হয়ে উঠত কেমন ছিমছাম সুন্দর।
কত বছর কেটে গেল তারপর। রাস্তা উঁচু হল। উঁচু করতে হল আমাদের ফটক। কাঁচা উঠোন বদলে গেল পাকা চাতালে। মাটির আরও নীচে তলিয়ে যেতে যেতে সেই ফালি চাতালের তলায় এত বছর শুয়ে রইল আমাদের কৈশোরেই বাজার থেকে হারিয়ে যাওয়া সেই তিন পয়সা-পাঁচ পয়সাদের কিছু শেষ প্রতিনিধি। সেভাবে দেখলে আমার শৈশবটাও তো বাজারে পাঁচ পয়সা চালু থাকার যুগেরই শেষ প্রতিনিধি। ইতিহাস বইতে পড়া হরপ্পা-মহেঞ্জোদড়োর প্রত্নসামগ্রীর মতোই মাটি খুঁড়ে তাদেরও কি ঘটমান বাস্তবের সামনে তুলে আনা যাবে কোনও দূর ভবিষ্যতে? তবে সেই দিনগুলোকে অমর করেই রেখে গেছেন নারায়ণ দেবনাথ। তাঁর আঁকায় লেখায় নন্টে-ফন্টে, হাঁদা-ভোঁদা বা দ্য গ্রেট বাঁটুলদার কাণ্ডকারখানায়। গোয়েন্দা কৌশিক বা বাহাদুর বেড়ালের কমিক স্ট্রিপও পড়েছি। তবে এই তিন সিরিজের ধারেকাছে আর কিছুই আসে না।
নন্টে-ফন্টের গল্পের মূল আকর্ষণ আমার কাছে ছিল বোর্ডিংবাসের মজা আর ছলে কৌশলে উপাদেয় খাবার কবজা করার হাজারো ফিকির। হাঁদা-ভোঁদার গল্পে ভাগ্যের ফেরেই হোক বা বুদ্ধির প্যাঁচে মোটাসোটা ভোঁদাকে বারেবারে জিতিয়ে দেওয়াতেই যেন ধরতে পারতাম যে করেই হোক ভালমানুষকে নারায়ণ দেবনাথের জিতিয়ে দেওয়ার সদিচ্ছা। আর বাঁটুলদার মজা ছিল অতিমানবিক শক্তিতে ঘটিয়ে ফেলা তার অসাধ্যসাধনে। অবশ্য খাইয়ে কম ছিল কি বাঁটুলদাই? নইলে আর ফুঁ দিয়ে কামানের গোলাকে ফেরত পাঠানো বা হানাদারদের প্যাটন পেটা করার শক্তি পায় কোত্থেকে! দুধ-পাউরুটি দিয়ে সকালের জলখাবার সারা বয়সে হাঙর দিয়ে একটা লোককে প্রাতরাশ সারতে দেখার মজা কী করে ভুলি! নন্টে-ফন্টেকে অনুসরণের সাধ জাগলেও বাঁটুলদাকে নকল করতে যাওয়ার দুঃসাহস অবশ্য হয়নি কোনওদিনই। টফির মশলা দিয়ে পুরসভার লোক রাস্তা বানিয়ে যাওয়ার পর দিবানিদ্রা থেকে ওঠা যে মানুষটা একটানে তুলে নিতে পারে গোটা রাজপথটাকেই তাকে আর কে অনুকরণ করতে যায়! এই সিরিজের গল্পে আসে পোষা উটপাখি বা কাউবয়দের ধারার কিছু মানুষ। কিন্তু বিদেশি পরিবেশের এমনি প্রভাবও সংলাপের গুণে হয়ে যায় বাঙালিয়ানায় ভরা।
১৮ জানুয়ারি। চলে গেলেন নারায়ণ দেবনাথ। ছিঁড়ে গেল শৈশবের আরও একটা সুতো। মনে পড়ল আমাদের বাড়িতে গুপ্তধন আছে। তিরিশ বছরের বেশি হয়ে গেছে গুপ্তধন রয়েছে আমাদের বাড়িতেই। পরক্ষণেই কিন্তু মনে হল গুপ্তধন আসলে ছিল নারায়ণ দেবনাথের সৃষ্ট সেই চরিত্রেরাই। যারা রাঙিয়ে দিয়েছিল আমার মতো নয়ের দশকের আরও অনেক কিশোরের ছেলেবেলাটুকুকেই।
আমার বন্ধু বাঁটুল দি গ্রেট
বিশ্বদীপ দে
‘ছোটোবেলা’র ছোট্ট বন্ধুরা,
মনটা খুব খারাপ, জানো? তোমাদের মধ্যে অনেকেই তো নারায়ণ দেবনাথের নাম শুনেছ। ওঁর সৃষ্ট চরিত্রদেরও চেনো। হ্যাঁ, বাঁটুল, হাঁদাভোঁদা, নন্টে আর ফন্টে, বাহাদুর বেড়াল— এদের কথা বলছি। কমিক্স হোক আর কার্টুন— দেখেছ এদের কীর্তিকলাপ। সেই নারায়ণ দেবনাথ আর নেই। আমাদের সকলকে টা টা করে চলে গিয়েছেন এমন এক দেশে যেখান থেকে কেউ ফেরে না। তাই মন তো খারাপ হবেই। হবে না, বলো?
এই অবস্থায় ইচ্ছে হল তোমাদের একটা চিঠি লিখি। কেননা এই সব কথা বলতে বসলে তোমাদের কথাই মনে পড়ে। সুকুমার রায়ের ‘হযবরল’ তোমরা নিশ্চয়ই পড়েছ। সেই গল্পের শেষ লাইনটা মনে পড়ে? ‘মানুষের বয়স হলে এমন হোঁৎকা হয়ে যায়, কিছুতেই কোনো কথা বিশ্বাস করতে চায় না।’ তবে আমরা যারা ‘হযবরল’ পড়েছি, তারা বয়সটা ঘুরিয়ে দিতে জানি। ফলে ছোটবেলাটা আমরা ঠিক জমিয়ে রেখে দিতে পেরেছি। খরচ করিনি। সময় সময় একটু একটু করে ঝাঁপি খুলে উঁকি মারি। আর দেখতে পাই সেই ঝাঁপির মধ্যে যেমন সুকুমার সমগ্র রয়েছে, তেমনই রয়েছে নারায়ণ দেবনাথের বইও। আরও অনেকেই অবশ্য রয়েছেন। কিন্তু আজ আমরা বাঁটুলদের নিয়েই গল্প করব। আর সেটা তোমাদের সঙ্গেই। ওই যে বললাম, এই সব গল্প আসলে তোমাদের সঙ্গেই করা যায়।
আমি যখন খুব ছোট, সবে হয়তো স্কুলে ভরতি হয়েছি— তখন তো এত কিছু ছিল না। আজ তোমাদের সামনে কত রকম মজার অপশন। টিভি, কম্পিউটার, স্মার্টফোন কত কী! আমার ছোটবেলায় টিভিরও ছোটবেলা চলছে। সাদা-কালো ছবি আসত। একটাই চ্যানেল। পরে আরেকটা হল। তাতেও সব সময় অনুষ্ঠান হত না। সিনেমাও কালেভদ্রে যাওয়া হত। হ্যাঁ, রেডিও শুনতাম খুব। আর ছিল বই। নানা রকমের বই। বইমেলায় কিনতাম। লাইব্রেরি থেকে আনা হত। খবরের কাগজওয়ালার থেকেও নেওয়া হত— পুজোসংখ্যা কিংবা ইন্দ্রজাল কমিকস।
ছিল বাঁটুল দি গ্রেট। কিংবা নন্টে আর ফন্টে। হাঁদা ভোঁদা। বাহাদুর বেড়াল। কখনও শুকতারার পাতা থেকে মা পড়ে শোনাত। কখনও আস্ত বই-ই পেতাম উপহার হিসেবে। পড়তে পড়তে মুখস্ত হয়ে যেত। বইগুলোর গায়েও কী সুন্দর গন্ধ। সব হোমটাস্ক হয়ে গেলে মায়ের পারমিশনের অপেক্ষা। ব্যাস! টেনে বের করে আনতাম বইগুলো। কী যে আনন্দ হত পাতাগুলো স্রেফ উলটে গেলেই!
এইভাবে একটু একটু করে বড় হতে লাগলাম। কিন্তু এক ক্লাসে থেকে অন্য ক্লাসে উঠতে উঠতেও এই বইগুলোর আকর্ষণ একটুও কমেনি। বরং বাড়তে থাকল। বন্ধুদের থেকে নিয়ে আসতাম। বদলাবদলিও হত। আমার দুটো বাঁটুল কেউ নিল। বদলে সে দিল দুটো নন্টে আর ফন্টে। আবার অন্য বইয়ের সঙ্গেও বদলাবদলি হত। কখনও ফেরত দেওয়া হত। কখনও তাও দেওয়া হত না। পড়তে পড়তে মলাট ছিঁড়ে একসা। কোনা মুড়ে যেত। তাই সই। খেতে খেতেও চলত পড়া।
সেই সময় আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও ওদের স্বপ্ন দেখেছি। বিশেষ করে বাঁটুলকে। কেবলই মনে হত, আমার যদি ওরকম একটা বন্ধু থাকত! না, আমার কখনও বাঁটুল হতে ইচ্ছে করেনি। কিন্তু বাঁটুলের মতো বন্ধু পেতে ইচ্ছে করত। ঠিক যেমন স্পাইডারম্যানকে ভালোবাসতাম। কিংবা বেতাল। অথবা মিকি মাউস। তেমনই বাঁটুল। যে আস্ত বাড়ি দু’হাত দিয়ে অনায়াসে তুলে ফেলতে পারে। কী জোর রে বাবা! সিংহ পর্যন্ত ওকে কামড়ে দিলে বেচারির দাঁতগুলো খুলে পড়ে যায়। এমন একখানা লোক, অথচ পরে আছে আমারই মতো একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট। কথা শুনলেও মনে হয় আমার থেকে খুব বেশি বড় হবে না। ভাবতে খুব ভালো লাগত, বাঁটুল সত্যিই আছে। একদিন দেখা হয়ে যাবে। কিন্তু সে আর হল কই? তবে স্বপ্নে বাঁটুলের সঙ্গে আমিও ঘুরে বেড়াতাম। দেখতাম বাঁটুল আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। এমনিতেও স্বপ্নের কথা কারও মনে থাকে না। তার উপর কবেকার স্বপ্ন! তাই এর বেশি মনে নেই। কিন্তু ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরে হওয়া মনখারাপটা মনে আছে এখনও।
মাঝে মাঝে বাঁটুলের ছবি আঁকতাম। আমি একবার একটা কী যেন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দারুণ সব পোস্টার পুরস্কার পেয়েছিলাম। টিনটিন, শচীন, মাইকেল জ্যাকসন। পোস্টার আমার খুব ভালো লাগত। ভাবতাম বাঁটুলেরও যদি একটা পোস্টার হয়, বেশ হয়। কিন্তু কোনওদিন পাইনি। তবে আমার এক দাদা আমাকে পাতাজোড়া বাঁটুল এঁকে দিয়েছিল। খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। সেসব কোথায় হারিয়ে গেছে! কেন যে হারিয়ে ফেললাম!
যাই হোক, তারপর তো বড় হয়ে গেলাম। মানে উঁচু ক্লাসে উঠতে লাগলাম। পড়াশোনার চাপ বাড়ল। আর সেই সঙ্গে বাড়ল গল্পের বইয়ের সংখ্যাও। ফলে একটু একটু করে বাঁটুলের সঙ্গে বন্ধুত্বটা কমে গেল। যদিও শুকতারা কিনলে আগে বাঁটুলই পড়তাম। তবুও অনেক কিছু পড়তে পড়তে বাঁটুলকে যেন ভুলেই গেলাম।
এরপর আরও অনেক দিন কেটে গেছে। কলেজ-টলেজ সব পাশ করে গেছি। একদিন দুম করে উপরের বাঙ্কে কী একটা খুঁজতে গিয়ে একটা কবেকার ছেঁড়াখোঁড়া বাঁটুল হাতে এল। প্রথম পাতার উপরে আমার মায়ের হাতে লেখা আমার নাম। সঙ্গে লেখা আমার ক্লাস। দ্বিতীয় শ্রেণি। ভাবতে পারো?
বইটা হাতে নিয়ে চুপ করে বসে রইলাম। তোমাদের হয়তো একটু মনখারাপ করে দিচ্ছি। তবু বলি। আমার মা ততদিনে আমাকে ছেড়ে সেই না ফেরার দেশটায় চলে গেছে। চাইলেই আর তার দেখা পাওয়ার উপায় নেই। কিন্তু ওই যে বললাম। সুকুমার রায়ের উদো-বুদোর থেকে বয়স ঘোরানোর কায়দাটা শিখে নিয়েছি ততদিনে। তাই দুম করে বইটার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে অবিকল সেই ছোটবেলায় ফিরে যেতে লাগলাম। হ্যাঁ, গলার কাছে একটু ব্যথা করছিল। চোখটায় জল আসছিল। তবু... কেমন একটা আনন্দও হচ্ছিল।
নারায়ণ দেবনাথের চলে যাওয়ার খবরেও মনটা খারাপ হয়ে গেল সেভাবেই। ওঁরই মনের মধ্যে তো লুকিয়ে ছিল বাঁটুলরা। কত বছর ধরে উনি ওদের এঁকেছেন আর ওদের আশ্চর্য সব কাহিনি বলে গিয়েছেন। আমার মা-বাবাও নাকি ছোটবেলায় পড়ত সেসব। আবার আমিও পড়েছি। তোমরাও নিশ্চয়ই পড়ো অনেকেই।
এই মনখারাপেও একটা কথা ভেবে ভালো লাগছে। বাঁটুলরা তো আর আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে না। ওরা থাকছে। ওদের আমাদের জিম্মাতেই রেখে গিয়েছেন ওদের স্রষ্টা। আমি এখনও সময় পেলে বাঁটুলের সঙ্গে দেখা করি। হাজার হোক, ছোটবেলার বন্ধু। তোমাদের মধ্যে কেউ আছ নাকি বাঁটুলের বন্ধু? না হলেও কোনও ব্যাপার নয়। বন্ধু এখনও করে নিতে পারো। তারপর আমরা সবাই মিলে বেরিয়ে পড়ব অ্যাডভেঞ্চারে। কেমন হবে?
সূর্যাস্তের সত্যি রং
শ্রীপর্ণা ঘোষ
সপ্তম শ্রেণী, জওহর নবোদয় বিদ্যালয়, পশ্চিম মেদিনীপুর
এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। কেউ কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। বিরোধী পক্ষ এক্ষুনি হামলা করবে। আমাদের আর কোনো সৈন্য বেঁচে নেই। সবাই যুদ্ধে মারা গেছে। ওদের এত বিপুল অস্ত্র আর সৈন্য এর বিরুদ্ধে আমরা কি করে লড়ব?
সেনাপতি চিফ-কে বললেন, “তাহলে আমাদের কাছে এখন একটাই রাস্তা আছে আমাদের ক্যাপ্টেন ইভানার এর কাছ থেকে সাহায্য নিতে হবে।”
চিফ ক্যাপ্টেন ইভানার কাছে গিয়ে সাহায্য চাইলেন। ক্যাপ্টেন ইভানা জিজ্ঞেস করল, “কার সৈন্য?”
চিফ বললেন, “ইথারের।”
এবারে কত সৈন্য নিয়ে এসেছে ?
চিফ, “এক হাজার।”
ক্যাপ্টেন ইভানা বলল, “ঠিক আছে আমি পারব।” তারপর ক্যাপ্টেন ইভানা একাই লড়তে গেল।
এক ধারে ইথার তার ট্যাঙ্ক-এর উপরে সঙ্গে তার সৈন্য। তার বিপরীতে ক্যাপ্টেন ইভানা একা।
ইভানা তার দুটো বন্দুক নিয়ে অসাধারণ দক্ষতায় প্রচুর সৈন্য কে ঘায়েল করে দিচ্ছে।
ইথার এবার একটু ভয় পেয়ে গেল। ইভানা যখন সৈন্যদের সঙ্গে লড়তে ব্যস্ত ছিল তখন ইথার তার ট্যাঙ্ক থেকে একটা গোলা ছুড়ল ক্যাপ্টেন ইভানার দিকে। সেই গোলা ভীষণ বেগে আগুন হয়ে ছুটে চলেছে।
এই কমিক্স সিরিজ-এর পরবর্তী অংশ পরের সপ্তাহে আপলোড করা হবে।
* * *
মিলি কমিক স্ট্রিপটা পড়তে পড়তে সবকিছু ভুলে গেছিল। সে আর থাকতে না পেরে, পাশের ঘরে তার দিদির কাছে গেল।
আমি আমার ড্রইং প্যাড-এ স্টাইলাস দিয়ে আঁকছিলাম। তখন মিলি ডাকাডাকি শুরু করল, “দিদি বলো না পরের ভাগে কী হবে?
আমি বললাম, “সেটা পরের ভাগেই দেখতে পাবি।”
“না দিদি বলো না” বলে মিলি বায়না করতে লাগল। আমি বললাম, “জানি না। এবারে হয়ত ক্যাপ্টেন ইভানাকে বাঁচাতে পারবো না।”
মিলি বলল, “না দিদি এরম করো না। আমি জানি তুমি ঠিক কিছু একটা করবে, ক্যাপ্টেন ইভানাকে বাঁচাবে” এই বলে সে চলে গেল।
* * *
আমি প্যাড-এ একটা নতুন পেজ খুলে আঁকতে শুরু করলাম। এখনো ভাবিনি কী করব। হয়ত ক্যাপ্টেন ইভানাকে এবার মরতে হবে। আকার সিন-টা এইরকম যে — ক্যাপ্টেন ইভানার দিকে একটা গোলা ছুটে আসছে কিন্তু সে সেটাকে খেয়াল করেনি। ঠিক করলাম বাকিটা কাল আঁকব।
পরের দিন সকালে ড্রইং-প্যাডটা খুলে আমি অবাক হয়ে গেলাম। এ কী করে সম্ভব! আঁকাটায় সব কিছু আছে কিন্তু শুধু ক্যাপ্টেন ইভানা নেই!! এমনকি আগের কমিক স্ট্রিপেও ইভানা নেই!!! কোথায় গেল সে?
অন্যদের কাছে এটা যতটা অবিশ্বাস্য আমার কাছে ততটা নয়। কারন আমি এই জগতের কথা জানি। আমি ঠিক করলাম ‘অ্যানিমি’ জগতে যাব। আমি সেই জগতে আগেও গেছি।
আমি আমার চেনা কিছু কার্টুন চরিত্রদের নিয়ে একটা মিটিং ডাকলাম। সেখানে সিন-চ্যান, কাসামা, নোবিতা, সিজুকা, ডোরেমি, মিকি মাউস ছিল। প্রথমেই আশ্চর্য হলাম, ডোরেমন নেই কেন? নোবিতা বলল, তাকে খুঁজে পাচ্ছে না।
সিন-চ্যান কে ইভানার কথা জিজ্ঞেস করলাম, “সিন-চ্যান এটা তোমার কোন বদমাইসি নয়তো?” সে বলল, সে কিছুই জানে না ওর ব্যাপারে।
সিজুকা বলল, “আমার মনে হয় ও ডোরেমনের কাছে গেছে। যুদ্ধ করার জন্য কিছু গেজেট নিতে গেছে।”
মিকি মাউস বলল, “আমি ওদের দুজনকে একসঙ্গে দেখেছিলাম তো!”
ডোরেমি বলল, “দাঁড়াও আমি এখুনি ডোরেমনকে ধরে আনছি।” তারপর সে পকেট থেকে একটা ‘এনিহোয়ার ডোর’ বার করল। ডোরেমনকে নিয়ে এল।
ডোরেমন একটু ভয় পেয়ে আছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “ক্যাপ্টেন ইভানা কোথায়?”
“আমি জানি না।”
“তাহলে লুকিয়ে ছিলে কেন?”
“না, আমি লুকাইনি তো।”
“নাটক করো না। মিকি তোমাদের একসঙ্গে দেখেছে কালকে।”
ডোরেমন কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল, “সত্যি বলছি আমি জানিনা ইভানা কোথায়। সে আমার কাছে এসেছিল কিন্তু তারপর কতগুলো বদমাস ছেলেপুলে আর একটা বজ্জাত বেড়াল এসে ক্যাপ্টেন ইভানাকে নিয়ে গেল। আর একটা লোকও ছিল খুব শক্তিমান, বাবাগো।”
আমি বিভ্রান্ত হয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “তাদের নাম কী?”
“আমি জানিনা। তাদের এই জগতে আগে কখনো দেখিনি। তারা এই জগতের মনে হয়না। অন্য জগতের।”
আমি কিছু বুঝতে না পেরে ডোরেমনকে বললাম তাদের এঁকে দেখাতে।
ডোরেমন তক্ষুনি কিছু মুখ এঁকে দিল। তাদের দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। এদের তো আমি চিনি! এরা আমার ছোটোবেলার সঙ্গী বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা, বাচ্চু-বিচ্ছু, নন্টে-ফন্টে, কেল্টুদা আর বাহাদুর বেড়াল। সর্বনাশ! ডোরেমন বাঁটুলকে বজ্জাত বলছিল! আমি অজান্তেই হেসে উঠলাম। অনেক কথা মনে পড়ে গেল। ছোটোবেলায় আমার প্রথম কার্টুন আর কমিক বলতে এরাই ছিল। বাঁটুল দি গ্রেট, নন্টে-ফন্টে, হাঁদা-ভোঁদা, বাহাদুর বেড়াল। এদের কমিকস বইগুলোর এক বান্ডিল ছিল আমার। আমি সারাদিন ওগুলো দেখে দেখে এঁকে যেতাম। তারপর একটু বড়ো হতেই টি ভি তে কার্টুন চলে এল। ভুলেই গেলাম তাদের কথা। ঘরের কোণায় পড়ে পড়ে ধুলো জমতে থাকল।
আমি আমার পুরোনো স্মৃতি থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম। কিন্তু তারা আমার কমিকস চরিত্র ইভানাকে নিয়ে গেল কেন! আমি এই জগত থেকে বেরিয়ে এলাম। বাড়িতে অনেক খোঁজা খুঁজি করে সেই পুরোনো কমিকসগুলো খুঁজে বার করলাম। কিন্তু কমিকসগুলো খুলে আমি অবাক! কমিকসের প্রধান চরিত্রগুলো সবাই কোথায়? সব ঘরগুলো ফাঁকা। তারা কোথায় গেল তাদের বই ছেড়ে!!
ভাবতে ভাবতে আমার ঘরে গেলাম। আমার ঘরটা আমি সাজিয়েছি আমার নিজের আঁকা দিয়ে। দেওয়াল গুলোয় সুন্দর করে আমার আঁকা টাঙানো আছে। ঘরে ঢুকেই আমার দেওয়ালে চোখ পড়ল দেখলাম আমার টাঙানো একটা পাতা ফাঁকা। এ কী করে সম্ভব? সব পাতাতেই কিছু না কিছু আঁকা। মনে পড়ল এতে আমি আঙুর এঁকে ছিলাম। পাশের আঁকাটার দিকে চোখ পড়ল। সেখানে আমি একটা বাগানের সিনারি এঁকেছিলাম। তাতে দোলনা ছিল। এখন দেখি দোলনায় বসে হাঁদা দোল খাচ্ছে। তারপাশেই ভোঁদা বসে বসে আঙুরগুলো খাচ্ছে। আরেকটা আঁকায় দেখি সেখানে আমার আঁকা কুকুরটার সঙ্গে বাচ্চু-বিচ্চু খেলছে। তারপর দেখি আমার আঁকা ফুড-আর্টের পাতাগুলো ফাঁকা তাতে একটাও খাবার নেই। সব খাবার বাঁটুল খেয়ে বুক ফুলিয়ে, নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আর একটা আঁকায় দেখি বাহাদুর বেড়াল আর কেল্টুদা কেমিক্যাল দাদুর সঙ্গে কী একটা এক্সপেরিমেন্ট করছে। এই দৃশ্যটা দেখে আমার ভয় ভয় করতে লাগল। কারণ যখন দুটো অত্যন্ত ঘাঘু আর একজন খ্যাপা একসঙ্গে থাকে তখন চিন্তা হওয়ারই কথা। যা ভাবছিলাম তাই হল। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা বিস্ফোরণ হল আর সেই পাতাটার সব রং উঠে কালো হয়ে গেল।
আমি সবাইকে বলতে লাগলাম, “এ তোমরা কী করছো? আমার সব আঁকাগুলো নষ্ট করে দিচ্ছ কেন? তারা সবাই হাজিরা দেবার মতো একটা পাতায় হাজির হল। আমি বাহাদুর বেড়াল আর কেল্টুদাকে খুব বকলাম, তাদের পাকামোর জন্য। আর বাঁটুলকে, আমার আঁকা খাবারের ছবিগুলোর থেকে সব খাবার খেয়ে নেবার জন্য বকলাম।
“এবার তোমরা বল ইভানা কই। কোথায় রেখেছ ওকে?”
নন্টে বলল, “আমরা ওকে কোথাও রাখিনি। ও নিজের ইচ্ছায় ঐ আঁকাতে বসে আছে মনমরা হয়ে।”
আমি দেখলাম ইভানা আমার আঁকা সূর্যাস্তের দৃশ্যটায় বসে আছে। আমি তাকে বললাম, “ফিরে এসো আমার ট্যাবে।”
সে বলল তার আর ভালো লাগছে না ডিজিটাল দুনিয়ার উজ্জ্বল আলোতে থাকতে। তার ভালো লাগছে এই সূর্যাস্তের হালকা আলোর আভায় থাকতে।
আমি ভাবলাম, সত্যি! আমি কতদিন কাগজ-কলম, রং-তুলি দিয়ে আঁকিনি। শুধু ডিজিটালেই এঁকে যাই। আমি তখন ইভানাকে বললাম, “তুমি এখানে থাকলে যুদ্ধ করবে কে?”
সে বলল, “তুমি তো আমায় মেরে দেবে, তাহলে আমি যাবো কেন? ওরা কত ভাল। আমায় বাঁচিয়েছে।”
আমি বললাম, “আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। আমি তোকে মারব না। তুই বেঁচে যাবি। এখন ফিরে চ।” ইভানা খুশি হয়ে টুক করে আমার ট্যাবে ঢুকে পড়ল। তখনি হাঁদা-ভোঁদা, বাচ্চু-বিচ্ছু, বাঁটুল, নন্টে-ফন্টে, বাহাদুর বেড়াল আর কেল্টুদা কেঁদে কেঁদে বলল, “তাহলে আমাদের কী হবে?”
“তোমরা তোমাদের কমিকসে ফিরে যাও।”
ওরা বলল, “কিন্তু নায়ায়ণবাবু তো আর নেই। কে লিখবে আমাদের নিয়ে? আমরা এখন কোথায় যাব?”
ওদের কথা শুনে আমি খুব দুঃখ পেলাম। তারপর আমার মাথায় এক দারুণ আইডিয়া এল। বললাম, “তোদের আর কোনো চিন্তা করতে হবে না।”
* * *
সাংঘাতিক যুদ্ধ চলছে, ক্যাপ্টেন ইভানা আর ইথারের সৈন্যের সঙ্গে। এখন ইথারের ট্যাঙ্ক থেকে একটা গোলা ধেয়ে আসছে ক্যাপ্টেন ইভানার দিকে। বাঁটুল এক ঘুষি মেরে সেই গোলাটাকে বিপরীত দিকে ইথারের ট্যাঙ্কের ওপর ফেলে দিল। ইথার তো চিতপটাং। বাচ্চু-বিচ্ছু ইথারের হাত বেঁধে ফেলল। বাহাদুর বেড়াল আর কেল্টুদা মিলে ইথারের দলের সব ট্যাঙ্কের স্ক্রু খুলে ফেলে ট্যাঙ্কগুলোকে ভেঙে ফেলল। হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টে তাদের গুলতি দিয়ে বাকি সৈন্যদের অজ্ঞান করে দিল। এইভাবে তারা সবাই মিলে বিরোধী পক্ষকে হারিয়ে দিল। এবার থেকে ক্যাপ্টেন ইভানা আর তারা সবাই একসঙ্গে মিশনে যাবে। তাদের সবার নতুন বাড়ি আমার কমিক্স। আর তাদের বাকি বন্ধুদেরও এই কমিক্সে এনেছি।
এবার নতুন মিশনের পালা। এর পরের গল্প তোমরা দেখতে পাবে পরের ভাগে। আমি আমার ড্রয়িং ট্যাবটা বন্ধ করে দিলাম। তারপর একটা কাগজে পেনসিল দিয়ে স্কেচ শুরু করলাম। পরের কাহিনি কাগজের বুকেই গড়ে উঠবে, সত্যিকারের রং-মেখে। একদিন সেখানে এক সূর্যাস্তের দৃশ্যে আমি ক্যাপ্টেন ইভানাকে নিয়ে যাবই।
স্মৃতি শুধুই স্মৃতি
রুম্পা প্রতিহার
২০১০ সালের এপ্রিল মাসে মায়ে ও পোয়ে তখন শিবপুরে। হঠাৎ জ্বলদর্চি'র সম্পাদকীয় দপ্তর থেকে স্বয়ং সম্পাদকমশায়ের ফোন, যে স্মৃতি সংখ্যার জন্য নারায়ণ দেবনাথের লেখাটা নিয়ে আসতে হবে। বাড়িটা কি জানো? হাওড়ার এই ঠিকানায় বাড়ি। অগত্যা বাবার শরণাপন্ন হলাম। যে হাওড়ার শহুরে অংশটা হাতের তালুর মতই চেনে। ঠিকানাটা দেখে বলল মন্দিরতলা বলছে বটে তবে শিবপুর বাজারের শেষপ্রান্তের অমুক জায়গাটা হবে বলে মনে হচ্ছে।
বিকালবেলা, আমার এক এবং অদ্বিতীয় সঙ্গী ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাঁটুলের স্রষ্টার বাড়ির খোঁজ করতে। উদ্দেশ্য ছিল,আজকে না হয় বাড়িটা দেখে আসি, কালকে গিয়ে লেখাটা নিয়ে আসব। বাবা যে জায়গাটা বলেছিল, সেখানে গিয়ে এক পানগুমটির মালিককে জিজ্ঞাসা করতে বলল, এইতো পিছনের বাড়িটা। এত সহজে শিবপুর বাজারে বাড়ি খুঁজে পেয়ে যাওয়াতে হাতে চাঁদ পেলাম মনে হল। সেই আনন্দে চার বছরের ছেলেকে নিয়ে বিনা দ্বিধায় বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেলাম। এক আলাদা শূন্যতাময় অনুভূতি -- হঠাৎ দেখলাম হাঁদাভোঁদার স্রষ্টা আমার সামনে দাঁড়িয়ে। উৎসাহের আতিশয্যে নিজে একটা ঠকাস করে প্রণাম করে যখন ছেলেকে প্রণাম করতে বললাম, প্রণাম তো দূরের কথা, ভরসন্ধেবেলা দীঘলদেহী অচেনা অজানা লোক দেখে সে যে গোঁজ হয়ে দাঁড়াল, এতটুকু তাকে নড়াতে পারলাম না। আমার নাছোড় মনোভাব দেখে শেষে তিনিই হেসে বললেন : বাচ্চাকে কোনো কাজ জোর করে করাতে যেও না... ইত্যাদি আরো নানান কথা, আজ আর সব মনে নেই। তারপর তাঁর লেখার ঘরে গিয়ে বসলাম। তিনি স্মৃতি সংখ্যার জন্য 'স্মৃতি শুধুই স্মৃতি' লেখাটি দিলেন। একটা ছবিও দিতে বলায় তিনি তখনই টেবিল থেকে একটা ছোট আর্ট পেপার ও পেন নিয়ে আমার ও ছেলের সামনেই বাঁটুলের অবয়ব কলমের এক টানে এঁকে দিলেন। আর আমার মুগ্ধতাবোধ তখন দিশেহারা। স্রষ্টাকে দেখব, না তাঁর সৃষ্টিকে....।
নারায়ণী শৈশব
সন্দীপন রায়
উড়নচণ্ডী ছেলেবেলায় রঙিন আঁকিবুকি।
পড়ার বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে মনের উঁকিঝুঁকি।
নন্টে সে তো বন্ধু আমার, ফন্টে খেলার সঙ্গী।
পাওয়ার প্লে তে বজ্রমুষ্টি বাঁটুলের ভাবভঙ্গি।
হাঁদার সঙ্গে শীতের দুপুর, ভোঁদার সাথে কুস্তি।
কেন শুধু ছেলেবেলা? এতো চিরকালের দোস্তি।
নিত্যদিনের পিসেমশাই, হেডস্যারও কি কম?
পাড়ার রকে আড্ডাতে কে? কেল্টুদা একদম।
এসব নিয়েই ছেলেবেলা স্বপ্নের ধারাপাত।
কল্পরাজ্যে চিরজাগরূক নারায়ণ দেবনাথ।
স্মরণীয়
(নারায়ণ দেবনাথ)
কলমে - পীযূষ প্রতিহার
হাঁদা-ভোঁদা-বাঁটুল-নন্টে-ফন্টে-সুপারিন্টেন্ডেন্ট পাতিরাম হাতি-ডানপিটে খাঁদু-কেমিক্যাল দাদু-ডিটেকটিভ কৌশিক রায়-ব্ল্যাক ডায়মন্ড ইন্দ্রজিৎ রায় এদের কথা শুনে কি ভাবছো বলো তো? কি মনে পড়ছে কিছু? হ্যাঁ আজকের স্মরণীয়তে আমি শোনাবো এই বিখ্যাত চরিত্রগুলোর স্রষ্টার কথা। তিনি এক এবং অদ্বিতীয় নারায়ণ দেবনাথ। ১৯২৫ সালের ২৫ নভেম্বর হাওড়ার শিবপুরে এক স্বর্ণকার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নারায়ণ দেবনাথ।ছেলেবেলা থেকেই বাড়িতে বাবা-কাকাকে সোনার উপর নকশা ফুটিয়ে তুলতে দেখে আপন মনে তিনিও কাগজে ফুটিয়ে তুলতে শুরু করেন গয়নার নানা নকশা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হঠাৎই খেয়াল বশত ভর্তি হয়ে গেলেন আর্ট কলেজে। কিন্তু পাঁচ বছরের ডিগ্রি কোর্সের শেষ বছরে ছেড়ে দেন আঁকা শেখার ক্লাস। একটি প্রিন্টিং প্রেসে কাজ করতে শুরু করেন। সেখান থেকেই দেব সাহিত্য কুটিরের হাত ধরে প্রবেশ করেন বাংলার প্রকাশনা এবং কমিকসের জগতে। পাঁচের দশকে শুকতারায় 'হাঁদা ভোঁদার কান্ডকারখানা' নামে একটি কমিকস বেরোত অনিয়মিত ভাবে। দেব সাহিত্য কুটীরের হাত ধরে ছবিসহ পরিমার্জিত 'হাঁদা ভোঁদা' এল ১৯৬২ তে। তারপর একে একে ১৯৬৫ তে 'বাঁটুল দি গ্রেট'(শুকতারা), ১৯৬৯ এ 'নন্টে ফন্টে'(কিশোর ভারতী) এবং ১৯৮২ তে এল 'বাহাদুর বেড়াল'। এছাড়াও তিনি সৃষ্টি করেছেন আরো অনেক কমিকস স্ট্রিপ, যেমন- 'ম্যাজিসিয়ান পটলচাঁদ', 'পেটুক মাস্টার বটুকলাল', 'শুঁটকি আর মুটকি' ইত্যাদি। গত প্রায় সাত দশক ধরে বাঙালির ছেলেবেলা মজে আছে নারায়ণ দেবনাথের সৃষ্টিতে। তিনি যে সমস্ত সিরিয়াস ও মজার কমিকস সৃষ্টি করেছেন তার প্রায় সবগুলির কাহিনী,চিত্রনাট্য,সংলাপ এবং অঙ্কন তাঁরই নিজস্ব। এমন নজির বিশ্বসাহিত্যের আঙিনায় বিরল দৃষ্টান্ত। তিনি কমিকস শিল্পী হিসেবে জনপ্রিয়তা পাবার আগে থেকেই অলঙ্করণ শিল্পী হিসেবে সাহিত্য জগতে পরিচিত ছিলেন। অগুনতি বই এর প্রচ্ছদ এঁকেছেন এবং অলঙ্করণ করেছেন সমকালীন প্রায় সব বিখ্যাত সাহিত্যিকের লেখার। তাঁর আঁকা স্বপনকুমার ও ঠাকুরমার ঝুলির প্রচ্ছদ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা কাজ। নব্বই পেরিয়েও তাঁর কম্পিত হাতে এঁকেছেন একের পর এক ছবি। 'এই অসুস্থ শরীরে এখনও কেন আঁকছেন?' প্রশ্ন শুনে বলে উঠেন, 'ছোটোদের খুব ভালোবাসি, তাই। তাদের জন্য তুলি-কলম ছাড়তে পারিনি'।
তাঁর সৃষ্টির জন্য নানান সম্মান পেয়েছেন তিনি। ২০০৭ সালে পেয়েছেন রাষ্ট্রপতির বিশেষ পুরস্কার। ২০১৩ সালে সাহিত্য একাডেমী এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্বোচ্চ সম্মান বঙ্গবিভূষণ। ২০১৫ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে সাম্মানিক ডি লিট পান তিনি। ভারত সরকারের থেকে মৃত্যুর কয়েকদিন আগে পেয়েছেন পদ্মশ্রী সম্মান।
মহান এই স্রষ্টা গত ১৮ই জানুয়ারি ২০২২ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
পাঠ প্রতিক্রিয়া
(জ্বলদর্চি ছোটোবেলা ৬৬ পশ্চিম মেদিনীপুরের নবোদয় বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর স্নেহা দাস যা লিখল)
ছোট্ট বন্ধুরা আজ আমি তোমাদের জ্বলদর্চি পত্রিকার ছোটবেলার সংখ্যা ৬৬ পড়ে আমার অভিজ্ঞতার কথা জানাবো।
প্রথমেই আসা যাক রাকেশ আংকেলের তোলা ছবিটাতে যেখানেই ঋতুজা নামের একটি মেয়ে দুটো টুসু পুতুল
ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মৌসুমী আন্টি যখন তাকে জিজ্ঞেস করলেন যে ওই দুটো কি। ঋতুজা বলল ওগুলো টুসু পুতুল সে ও গুলো উৎসবের জন্য কিনেছে। টুসু উৎসব অর্থাৎ মকর উৎসব এ উৎসব সম্বন্ধে মৌসুমী আন্টি তার সম্পাদকীয়তে প্রথমে কিছুটা বলেছেন। আর বাকিটা তো পত্রিকা পড়ে জানা যাবে। আর কিছুদিন আগেই তো স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন গেল করোনার জন্য গত দু'বছর ধরে স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন ভালো করে পালন করা হয়নি এ বছর যদিও কিছু কিছু জায়গায় ভার্চুয়ালি করা হয়েছে।
আর তার সাথে স্নিগ্ধার এত সুন্দর ছবিটা পত্রিকা পড়ার উৎসাহটাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
এরপর আসা যাক রেনেসাঁর লেখা "আজ মকরের দিন" কবিতাটিতে যেখানে সে একটি দোয়েল পাখির মকর উৎসবে আনন্দের কথা বলেছে । আর ভোর বেলায় উঠে দোয়েল পাখির খুব ঠান্ডা লাগছে এটা শুনে তো আমারও খুব ঠান্ডা লাগছে। আর রেনেসাঁ কিন্তু আরেকটা খুব ভালো কথা বলেছে
"পিঠে না থাক তবুও পরব
মকরের দিন আজ"
অর্থাৎ পিঠে থাক আর না থাক উৎসবের আনন্দ একই থাকে।
উৎসব এর মাঝেও আমার মন খারাপ। কারণটা হলো রতনতনু জেঠুর লেখা ফুল কুসুমপুর খুব কাছে উপন্যাসটি এই সংখ্যাতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে দাদু, অনিচ্ছে ঠাকুমা, বুম্বা,তিন্নি, বিন্নি এদের সাথে সামনের পত্রিকায় আর দেখা হবে না। কিন্তু কোন কিছুর শেষ হলো নতুন কিছুর আরম্ভ এই আশা নিয়ে পরের নতুন উপন্যাসটির অপেক্ষায় রইলাম। যাইহোক অনিচ্ছে ঠাকুরমার পাখিটা কথা বলতে শিখেছে আর বাইরের কাউকে খিরিশ গাছের সামনে এসে দাড়িয়ে লোককে জিজ্ঞেস করতে হবেনা ফুলকুসুমপুর কোন দিকে, সবাই বুঝতে পারবে যে ফুলকুসুমপুর খুব কাছে। বিলম্বদাদু তিন্নি বিন্নি বুম্বারা কাজটা খুব ভালো করল তাই না?
আর অনুশ্রুতি আর অসিতাভর সুন্দর করে আঁকা ছবিটা মনে করিয়ে দিচ্ছে যে শুধু মকর উৎসবই নয় কদিন আগে স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন গেল। যিনি বর্তমান যুব সমাজের অন্যতম পথপ্রদর্শক।
এবার চলো মিঠির চিঠি পড়া যাক যেটা সুদীপ্ত আঙ্কেল আমাদের পাঠিয়েছেন। এখন লকডাউন এর জন্য আমরা সবাই বাড়ীতে একা যদি মিঠির মতই মেঘের ডানায় চিঠি লিখে গাছ, নদী, মাছ, পাখি, পাহাড় আর চাঁদকে নিজের বন্ধু বানাতে পারতাম তাহলে খুব ভালো হতো।
তাই না?
এবার আসা যাক সুমেধা আন্টির লেখা "ভালোবাসার ওম" গল্পে। এটা একটা ভূতের গল্প আর ভূতে তো আমি প্রচন্ড ভয় পাই। গল্পের শুরুটা পড়ে আমার খুব ভয় হচ্ছিল কিন্তু শেষের অংশে যখন পুষ্কর কাকা ধৃতির জেঠিদিদার সম্বন্ধে বলল তখন আমার খুব কষ্ট হল। কিন্তু আমি ধৃতির মতই জানতে পারলাম সে সব ভূত ভয় দেখায় না।
এবার চলো বাসবদত্তা আন্টির সাথে কেরালা যাওয়া যাক। এই গল্পটা পড়ে আমি কেরালার ইতিহাস সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। আর এটাও জানতে পেরেছি যে একটা হাউসবোটের মধ্যে বারখাদা ঘর হতে পারে। ভাবতেই অবাক লাগছে তাইনা।
এবার চলো পীযূষ আঙ্কেলের লেখা আশাপূর্ণা দেবীর জীবনী পড়া যাক যেখানে তিনি আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে শুধু স্বামী বিবেকানন্দের নয় কিছুদিন আগেই আশাপূর্ণা দেবীরও জন্মদিন গেল। পীযূষ আঙ্কেলের লেখা পড়ে আমি আশাপূর্ণা দেবীর সম্বন্ধে এমন অনেক কিছু জানতে পারলাম যেগুলো আমার জানা ছিল না , তাঁর সম্বন্ধে এত তথ্য জানতে পেরে আশাপূর্ণা দেবীর প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেল। আরে সবকিছু আমাদের জানানোর জন্য প্রত্যেক আঙ্কেলকে অনেক ধন্যবাদ জানাই।
উৎসব আসে যায়। সময় থেমে থাকে না প্রত্যেক যুগেই স্বামী বিবেকানন্দ ও আশাপূর্ণা দেবীর মত মহান ব্যক্তিরা এ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন। আর দেখনা এমন মনে হচ্ছে যেন কিছুদিন আগেই "ফুল কুসুমপুর খুব কাছে" উপন্যাসটি শুরু হলো আবার শেষও হয়ে গেল। আর মৌসুমী আন্টি তো আছে প্রত্যেক সপ্তাহে আমাদের নতুন নতুন গল্প উপহার দেওয়ার জন্য। বড়দের আমার প্রণাম ও ছোট্টো বন্ধুদের আমার ভালোবাসা জানিয়ে আমি আমার পাঠ প্রতিক্রিয়া এখানেই সমাপ্ত করলাম।
আরও পড়ুন
0 Comments