জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৬৪

  
সম্পাদকীয়,
শুরু হল ইংরাজী নববর্ষ। বাড়িতে বাড়িতে দেওয়ালে টাঙানো হবে নতুন ক্যালেন্ডার। ক্যালেন্ডার শব্দটিকে বাংলায় বলে বর্ষপঞ্জী। তোমাদের জানা আছে বর্ষপঞ্জী কটি আছে? হ্যাঁ, ঠিকই গুনছো, ইংরাজী, বাংলা, চীনা, ইসলামি, হিব্রু,...... মোট কটা হল? ২৬ টা নিশ্চয়ই? ঠিক গুনেছো। নতুন বছরের প্রথমদিনটি কেমন কাটলো লিখে জানিও কিন্তু? জয়তী আন্টি তার ছোটোবেলার বড়দিন আর নিউ ইয়ার্স নিয়ে লিখেছেন। অমিতাভ আঙ্কেল তো দারুণ ছড়া পাঠিয়েছে। অদিতি আন্টি নিউ ইয়র্কের নিউ ইয়ারের গল্প বলেছে। ছোট্টো সমাদৃতা অপূর্ব কবিতা লিখেছে। আর বড়দিনের ছবি পাঠিয়েছে, বানীয়া দিদি, স্নেহা, পৃথা, আর মধুরিমা। বাসবদত্তা আন্টি নতুন বছরে আমাদের নতুন জায়গায় ঘুরতে নয়ে যাবে বলেছে। কোথায়? বলব কেন? তবে নতুন বছর মানেই কিন্তু কেবলই খুশির খবর নয়। নতুন ভাবে ওমিক্রণ ধেয়ে আসছে।  আর রতনতনু জেঠুর ধারাবাহিক উপন্যাস প্রায় শেষের পথে। তোমরা কি সেই  শুনে ঋপণ দাদার তোলা ছবিটার মেয়েটার মতো দরজা জানলা ভিজিয়ে রাগ করে বসে থাকবে নাকি? আরে না, রাগ কোরো না। কিছুর শেষ মানেই, অন্য কিছুর শুরু। এই যেমন দেখনা একটি বছর  শেষ হতেই পরের বছর শুরু হয়ে গেল। শুভ নববর্ষ।  --- মৌসুমী ঘোষ।




উৎসবের শেষ ও শুরু

জয়তী রায় মুনিয়া
🎈🎈🎈🎈🎈🎈
      
মেরী ক্রিসমাস 🍁 উচ্চারণ মাত্রেই পবিত্র শীত, জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে উঁকি দিয়ে আদর করবে গালে। আধো ঘুম আধো জেগে লেপের বাইরে থাকা নাকে ঢুকবে বাড়িময় ভেসে বেড়ানো কেক বেক হবার সুগন্ধ। মা আর মিসেস কোরা, মানে রীনা স্টিফেন কোরা , যিনি থাকেন আমাদের বাড়ির গা ঘেঁষা বাড়িতে ,দুজনের কেক বানাবার নীরব প্রতিযোগিতায় জমে উঠত ক্রিসমাস সপ্তাহ। 
   দিদিমা বকুনি দিতেন__
      তুই পুলি পিঠা বানা দেহি। ওই খেরেস্টান বোকা বইন্যা যাইবো। তা না ক্যাবল ওই সব ডিমের অখাদ্য।
  মা মিষ্টি হেসে ঘরে রাখা পুরনো ক্রিসমাস ট্রি বাইরে বার করে, ঝেড়ে পুঁছে তকতক করে রাখবে, প্লাস্টিকের তৈরি সবুজ পাতা ঝলমল করে উঠবে খুশিতে।  রূপালি তারা, ছোট ছোট টুনি লাইট, রাংতার ফুল -- গাছের মাথায় হাসিমুখের সান্তা,সবুজে লালে সোনালী রুপালি স্বপ্নে মাখামাখি ক্রিসমাসের গাছ...সেজে উঠবে যেন, ঘুম থেকে উঠে দেখলেই মনের আকাশে  ঝুর ঝুর তুষারপাত হয়! 
*******
ছোটবেলায় ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর পরিকল্পনা ছিল উৎসবের মত। রঙিন কাগজ নিয়ে কাটতে বসে যেত মা, আমরা তিন ভাইবোন মাকে ঘিরে বৃত্ত তৈরি করে ফাই -  ফরমাশ শুনতে শুনতে কত যে কিছু শিখে যেতাম, তার শেষ নেই। কাগজ ভাঁজ করে এদিক ওদিক কেটে নিয়ে যেই না কাগজ খুলতাম , ওমা! গোল চৌকো কত রকমের ডিজাইন তৈরি হয়ে স্বপ্নপুরীর চিঠির মত হয়ে গেল সেই সাধারণ কাগজ। হাতে হাতে কাজ আর মুখে মুখে গল্প। মা বলতেন: এই দেখো, এখন আসছে বড়দিন, তার গল্প ত জানো তোমরা, আজ শোনো, ক্রিসমাস ট্রির গল্প। 
    শীতের দুপুরের বেলা শেষ হয় তাড়াতাড়ি, কুয়াশার সঙ্গে নেমে আসে অল্প অল্প অন্ধকার, মা বলে চলেন,  গরীব কাঠুরের গল্প। 
    রোম শহর ধনীদের শহর। তবু , তার মধ্যে ছিল এক গরীব গলি, সেখানে বাস করত পিটার নামের এক কাঠুরে, খুব খুব কষ্ট করে দিন চলত তার। একবেলা খেলে আরেকবেলা পেটে কিছু জুটত না। বাড়িতে লোক ছিল মোট ছয় জন, পিটার নিজে, বুড়ো বাবা - মা, পিটারের বউ , আর ছোট্ট ছোট্ট দুটি ফুটফুটে ছেলে। এত কষ্ট, তবু পরিবারটি হাসি খুশি থাকে। পিটার কাঠ বিক্রি করে যেটুকু রোজগার করে, তাই দিয়ে কোনোমতে জীবন কাটায়। ছেলে দুটি ভারি শান্ত। এই দাও ওই দাও বলে বায়না করে না কক্ষনো। যা আছে তাই নিয়ে খেলা করে, পেট ভরে খেতে না পেলেও কিছুই বলে না, পিটার রোজ রাতে শুতে যাবার আগে, ঈশ্বরের কাছে বলে -- তুমি কত ভালো , আমাকে কত কিছু দিয়েছ। হে পরমকরুণাময় যিশু, তোমাকে প্রণাম। 
 এইভাবে চলতে চলতে এসে গেল ডিসেম্বর মাস। সেইবার খুব ঠান্ডা পড়েছে রোম দেশে। এক রাত্তিরে তো বাড়াবাড়ি শুরু হল।  জোরে জোরে বাতাস বইছে, শরীরের ভিতরে ঢুকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে , বরফ পড়ছে ঝিরঝির ঝুরঝুর। সাদা হয়ে গেছে চারিদিক। ভয়ে বুক শুকিয়ে গেছে পিটারের। এরকম আর দুদিন চললে না খেয়ে মরে যেতে হবে সবাইকে। কোথায় কাঠ, কোথায় কী, ঘর থেকে এক পা বেরুনোর উপায় নেই ... রাত বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাতাসের বেগ, শরীর জমে যাচ্ছে ঠান্ডায়, পেটে খিদে, ঘরে আছে এক মুঠি পরিজ, আর কিছু আলু, পিটারের বউ ভাবছে , সেটাই একটু সিদ্ধ করে নেবে না কি, এমন সময় বাইরের দরজায় টুকটুক করে শব্দ শুনে সকলে চমকে উঠল, এই ভয়ঙ্কর সময়ে শব্দ করে কে? কে এলো রে? আবার শব্দ হল, আবার...! পিটার আর দেরি করে না, কোনোমতে দরজা খুলে দিয়ে হতবাক হয়ে যায়, বছর ছয়েকের ছোট্ট ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, শীতে কাঁপছে, নীলচোখ দুটো বুজে এসেছে প্রায়, ঠোঁটদুটো সাদা, যেন মরে যাবে এক্ষুনি। ছেলেটিকে কোলে তুলে নিয়ে দরজা বন্ধ করে পিটার, থরথর করে কেঁপে ওঠা বাচ্চাটিকে জড়িয়ে চেঁচিয়ে ওঠে পিটার -- শিগগির জল গরম করো, যা পারো খাবার দাও, হে প্রভু যীশু রক্ষা করো, রক্ষা করো। 
 গরীব পিটারের আদর যত্নে শিশুটি চাঙ্গা হয়ে উঠে বলে -- পিটার, আমিই হলাম যীশু। তোমার কিছুই নেই, তবু ভয় না পেয়ে পরের বিপদে এগিয়ে এলে, এর পুরস্কার তুমি পাবে।গাছের একটি ডাল তোমায় দিয়ে গেলাম, তুমি মাটিতে পুঁতে দিও।
কাঠুরে পিটারের চোখে জল এলো। গাছের শুকনো ডাল হ'ল পুরস্কার? যাক, পুরস্কারের জন্য তো আর সেবা করে নি , আর প্রভু যীশু নিজে এসেছেন, এর চাইতে বড় কথা আর কি হতে পারে? 
   দেখতে দেখতে এসে গেল ক্রিসমাস। পুঁতে রাখা শুকনো গাছের ডাল ততদিনে ঝাঁপিয়ে উঠেছে, আর গাছ ভর্তি হয়ে উপচে পড়ছে সোনালি আপেল। 
গল্প শেষ করে মা, মায়ায় ভরা দুটিচোখ তুলে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন -- ক্রিসমাস ট্রি হল ঈশ্বরের আশীর্বাদের মত। ভালো কাজ করার অভ্যাস গড়ে উঠলে এইরকম আশীর্বাদ পাওয়া যায়। 
*******
    আমাদের ছোটবেলা ছিল অদ্ভুত রঙিন। প্রতিটি উৎসব পালন করা হত, এবং প্রতিটি উৎসবের পিছনের কারণ গল্পের মত করে বলে দেওয়া হত। মনে পড়ে, বড়দিনের উৎসব পালনের আগে গল্প শুনতে শুনতে সেজে উঠেছে  বাড়ি। বসার ঘরের কোনায় ঝলমল করছে ক্রিসমাস ট্রি, নিচে রাখা আছে অনেক অনেক উপহার, ডাইনিং টেবিলে লেস আর কুরুশের অপূর্ব চাদর , বড় ট্রের উপরে কেক রাখা।  ছোট ছোট সাদা ফিনফিনে বাটি ভরে পুডিং ক্রিসমাসের সন্ধ্যেবেলা।
     মোমেরআলো   টুনিলাইট দিয়ে সাজানো একটুকরো হিমেল স্বর্গে  মা মেরীর সেই করুণাঘন মূর্তির সামনে বসার ঘরের কার্পেটে বসে পড়তাম বাড়ির সকলে। 
 ঠিক কি ধরণের প্রার্থনা হত বলা মুশকিল, তবে কিছু ভালো ভালো কথা , ভালবাসবার মন্ত্র শুনতাম। যীশুর মত মহামানবের জন্ম দিয়েছেন যে মা, তার কথা যেন মন্ত্রের মত সুন্দর। শুনতাম সেই অপূর্ব ভালোবাসার বাণী: 
  " পিতা ওরা  জানে না ওরা কি করছে, ওদের ক্ষমা করুন পিতা।" যীশু তাঁর হত্যাকারী দের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। ক্ষমা শব্দটির অসীম গভীর তাৎপর্য বোঝার ক্ষমতা তখনো ছিল না, এখনো নেই। ক্ষমা করতে শেখা জীবনের কঠিনতম সাধনা।  তবু, ওই মোমের আলো, ছোট টুনি লাইট দিয়ে সাজানো নির্জন বাড়ি, মায়ের গলায় গান 
    তুমি নির্মল করো মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে 
     আহা! বোঝা না বোঝার সেই আধো অন্ধকারের দিন গুলি বড় পবিত্র সুন্দর ছিল।
 
   দিদিমাও সেই পবিত্র সময় চুপ করে সোনা মুখ করে খেয়ে নিতেন তাঁর জন্য ডিম ছাড়া বানানো বিশুদ্ধ ব্রাউনি! 
*********
এখন বছর শেষ হতে চলেছে, আসছে ইংরেজি নতুন বছর। ছোটবেলায় খুব উত্তেজিত থাকতাম। নতুন বছরে কি কি হবে, হতে পারে -- এমন সমস্ত কল্পনা করতাম মনে মনে, ডিসেম্বরের শেষ দিনটায় বন্ধু বান্ধব পার্টি যত কিছুই থাক না কেন, বাবার কিছুতেই বারণ ছিল না, শুধু একটা অমোঘ আদেশ ছিল, রাত ঠিক বারোটায় প্রার্থনা করতে বসতে হবে। প্রদীপ মোমবাতি জ্বালিয়ে মিনিট দশেকের প্রার্থনা, ব্যাস, তারপর যা খুশি করো, কোনো অসুবিধে নেই। তখন বিরক্ত লাগত, আজ বুঝি ওই একটা ভাবনায় আমরা ছিলাম আলাদা, সকলের থেকে আলাদা, পৃথিবীর যে দেশেই যাই না কেন, রাত বারোটার সময় প্রার্থনা করতে কিছুতেই ভুল হত না।



বন্ধুরা ভালো থেকো
অমিতাভ দাস

বললাম খুঁজে দেখি স্মৃতিগুলো সব
খুঁজে খুঁজে রাত কাবার
জমে আছে কতগুলি কলমের শব।

ছোটবেলা ছিল আমাদের বড়দিন
পিকনিক পিকনিক
শীতরাতে হ্যারিকেন, আলো অতি ক্ষীণ!

বছরের শুরু হবে টুনির সাজানো আলোয়
ফুটবল ম্যাচ হবে মাঠে, রথতলায়

ভোম্বল, সাথে নিয়ে কম্বল 
খেয়ে এলো দিদিমার বাপানো সে অম্বল

৩১ ডিসেম্বর রাতে
কামারথুবার মাঠে
শুনলুম বাজি উৎসব হবে
চললুম বন্ধুরা হাতমোজা পায়ে মোজা পরে
আহা আহা আতশবাজির মজা--
রোশনাই কতো
পোলাপান তুমি আমি আর ছিল যত...

গ্রীটিংস কার্ড দিতে হবে
প্রিয়বন্ধুকে জেনো
জানুয়ারি শীত করে, জ্বর আসে আজো
বন্ধুরা ভালো থেকো, হাত রেখো হাতে... 


নিউইয়র্কে নিউইয়ার
অদিতি ঘোষ দস্তিদার

ইরাদের নতুন বাড়ির পাশেই যে অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং, তার নিচের তলায় থাকেন গ্র্যান্ড পা আর গ্র্যান্ড মা। ইরারা নতুন বাড়িতে এসেছে এই জুন মাসে, সামারে - যখন খুব ভালো ওয়েদার।  
ওহ! তোমাদের তো বলাই হয়নি ইরা কে আর সে থাকেই বা কোথায়?

ইরা তোমাদের মতোই একটা ছোট্ট মেয়ে - থাকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক রাজ্যের একটা ছোট শহরে। পড়ে  ক্লাস ফোরে- এদেশে বলে ফোর্থ গ্রেড। ইরারা আগে একটা দুকামরার ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকত - এখন ওদের নিজেদের বাড়ি। 
এখানে আসার পর ইরার মন বেজায় খুশি। আগে ওরা যেখানে থাকত সেখানে ইরার খেলার সঙ্গী বলতে তেমন কেউ ছিল না। এখন ইরাদের বাড়ির পাশেই এই যে বড় অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স - তাতে অনেক বাচ্চা। সবাই প্রায় ইরাদের স্কুলেই পড়ে। দু’একজন ইরাদের ক্লাসেও। তাই বিকেলে খেলা জমে খুব।  
সামারেই আলাপ হয়েছিল গ্র্যান্ড মা আর গ্র্যান্ড পা র সঙ্গে - ওনাদের নাতি নাতনি তখন এসেছিল গরমের ছুটিতে 
- ওদের সূত্রেই পরিচয়। 
গ্র্যান্ডমা গরমকালে টবে প্রচুর সবজি করেন, বিশেষ করে টমেটো, উল বোনেন - আর প্রচুর বই পড়েন। এখানে লাইব্রেরিতে কী কী ভালো বই ছোটদের আছে - সব ওনার জানা। অনেক সময় এমনও হয়েছে ইরারা খেলা শেষে গল্প শুনেছে গোল হয়ে বসে গ্র্যান্ডমার কাছে – গ্র্যান্ডমা কিন্তু গল্পটা শেষ করেননি – বলেছেন, “এবার শেষটা জানতে হলে লাইব্রেরি থেকে এনে পড়তে হবে তোমাদের।” 
গ্র্যান্ডপা মানুষটা শান্ত শিষ্ট, ইতিহাসের প্রফেসর ছিলেন, তাই নানান দেশের কালচার নিয়ে খুব উৎসাহ ওনার। এখানে ভারতীয়দের সংখ্যা বলতে গেলে কমই, বিশেষ করে বাঙালি। ইরা গ্র্যান্ডপাকে দুর্গাপুজোর ছবি, দীপাবলির গল্প করেছে। 
মাসখানেক হল ইরার দাদু দিদা এসেছেন। কানাডায় ইরার মামার বাড়ি - ওখানে এসেছিলেন সামারে - এখন এখানে কিছুদিন থেকে জানুয়ারির মাসের শেষের দিকে দেশে ফিরে যাবেন।
সবে চলে গেছে ২৫শে ডিসেম্বর - সামনেই আসছে নিউ ইয়ার! ইরার বাবা মায়ের এখন কাজের চাপ কম। ইরার স্কুলে তো ছুটিই, মায়ের কলেজও – আর বাবা এখন বছর শেষের কয়েকদিন ছুটি নিয়েছেন। গ্র্যান্ড পা আর গ্র্যান্ড মায়ের নাতি নাতনি জন আর রুবিও এসেছে ছুটি কাটাতে - তাই আজ ইরার বাবা মা ওনাদের সবাইকে ডিনারের নেমন্তন্ন করেছেন।  
শীতের ছোটবেলা। সাড়ে চারটে বাজতে না বাজতেই অন্ধকার। এদেশে ডিনার হয় তাড়াতাড়িই - এখন গল্প জমেছে চা কফি আর স্ন্যাক্স এর সঙ্গে। 
খানিক পরেই খাবার গরম শুরু হবে।
ইরার দাদুই প্রশ্নটা তুললেন, 
"নিউ ইয়র্কে এই যে বলড্রপ হয় নিউ ইয়ারের আগের রাতে - এ কী অনেক পুরোনো নিয়ম!" 
গ্র্যান্ডপা বললেন, "একশো বছরের কিছু বেশি - ২০০৮ সালে একশো বছর হল - টাইমস ম্যাগাজিনের মালিকের ইচ্ছেতেই শুরু এই অনুষ্ঠান -যদিও এখন আর টাইমস ম্যাগাজিনের হেড কোয়ার্টার আর ওখানে নেই - কিন্তু জায়গাটার নাম টাইমস স্ক্যোয়ারই।"
গ্র্যান্ড মা এবার হাসি হাসি মুখে বললেন, "আমেরিকায় এই যে নিউ ইয়ারের সেলিব্রেশন, এ কিন্তু শুরু করে জার্মানরা - ব্রুকলিন শহরে, দুশো বছর আগে!"
গ্র্যান্ড পা দুষ্টুমির হাসি হেসে বললেন, "আমার গিন্নির খুব গর্ব জানেন, ওর তো জার্মান অরিজিন, ওর পূর্বপুরুষেরা এসেছিলেন জার্মানি থেকে!"
গ্র্যান্ড মা একটু গর্বের সঙ্গে বললেন, “শুধু এই আমেরিকায় কেন, এই যে ক্রিসমাস ট্রি নিয়ে সেলিব্রেশন - এ ও তো জার্মানরাই শুরু করেন- আগে নিজেদের দেশে,  তার বছর তিরিশ পরে এখানে। এখন তো সারা পৃথিবীতে!"
ইরার চোখ বড়বড়! 
"তাই গ্র্যান্ড মা! দারুন ব্যাপার তো!"
ইরার দিদাও বেশ অবাক! 
"দুশো বছর মোটে! তার মানে তো খুব বেশিদিন নয়!"
"এইভাবে ঘরে ঘরে ক্রিসমাস ট্রি আলো আর অর্নামেন্টস দিয়ে সাজানোর ব্যাপারটা নতুন হলেও এসেছে কিন্তু প্রাচীন পেগান কালচার থেকে!"
গ্র্যান্ডপা এবার খুলেছেন তার ইতিহাসের ঝুলি।
"কী রকম?" উৎসুক ইরার মা। 
 "যীশুর জন্মের অনেক আগে থেকেই গোটা ইউরোপ জুড়ে পেগানিসম (paganism) নামে এক প্রাচীন সংস্কৃতি চালু ছিল, পরে খ্রীষ্টান কালচারের সঙ্গে সেই নিয়মের অনেক কিছু মিলেমিশে গেছে। আচ্ছা বলতো তোমরা বাচ্চারা - সবচেয়ে ছোট দিন কবে?"
ইরা, জন আর রুবি একসঙ্গে বলে উঠল, “২১শে  ডিসেম্বর- এই তো সবে গেল!"
"একদম ঠিক! তবে উত্তর গোলার্ধে - এই দিনের পর থেকেই তো  সূর্যের দক্ষিণায়নে যাত্রা শুরু মানে একটু একটু করে দিন বাড়বে - রাত ছোট হবে, তো পেগানরা করত কী, সব এভারগ্রিন মানে চির হরিৎ গাছে মোমবাতি ঝুলিয়ে দিত ওই দিন। কেন জানো?"
"কেন?" আগ্রহী সব শ্রোতার এবার সমস্বরে প্রশ্ন। 
"ওরা এমনি করে সূর্যকে খবর পাঠাত -বলত এবার আমাদের দিকে ফিরে এসো!"
"ওমা কী মিষ্টি ভাবনা!" ইরার দিদার মন্তব্য। বাকিরা সবাই একমত। 
চা কফি শেষ হয়ে এবার ডিনারের তোড়জোড়! ইরার মা আর বাবা একটু ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। 

আড্ডা কিন্তু চলছিল। ইরার দিদা প্রশ্ন করলেন, “নিউ ইয়ার ইভের কী প্ল্যান আপনাদের? কিছু স্পেশ্যাল ব্যবস্থা?"
"ওই নানা রকম মজা করার চেষ্টা করি। এক একটা জিনিস বারোটা করে খাই -"
ইরার চোখ গোল গোল, “বারোটা করে? ওরে বাবারে! পেট ফেটে যাবে তো!" 
"আরে বারোটা বড় জিনিস নাকি? তুই ও যেমন!" রুবি ফুট কাটল।
"তবে?"
"ছোট ছোট জিনিস, মানে কড়াইশুঁটি বা ছোট আঙ্গুর এই সব খাই রে – তবে নিয়ম নাকি একসঙ্গে বারোটা খাওয়া। গ্র্যান্ড মা বলেন একটা একটা করে খেতে, যাতে গলায় আটকে না যায়!" উত্তর নাতিটির। 
গ্র্যান্ড মা হাসছিলেন নাতি নাতনির কথায়। 
"আমি ওদের বলি বারোমাস ধরে যা যা দুষ্টুমি করেছিস, সব বল একটা একটা করে খাবার সঙ্গে সঙ্গে। সে ভারী মজা হয়!"
ডিনার রেডি! এবার গল্প খাবার টেবিলে!
সবাই হাজির! খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে ইরার বেশ ঝামেলা। 
"ইরা, আজ কিন্তু তুমি সব খাবে, সবার সঙ্গে বসে, বুঝলে!" মায়ের গলায় আদেশের সুর!
"আহা, বকিস না, শোন ইরাদিদি, নতুন বছরের রেসোলিউশন নাও যে সব রকমের খাবার খাবে, বুঝলে!"
দাদু আদর করে বললেন। 
"তোমাদের গ্র্যান্ড মা একটা মজার জিনিস করেন, ২৫ তারিখের পর ক্রিসমাস ট্রি থেকে অর্নামেন্টসগুলো খুলে ফেলে ছোট ছোট কাগজে রেসোলিউশন লিখে ফ্রেমে আটকে টাঙিয়ে দেন। উৎসবের শেষে ক্রিসমাস ট্রির বাক্সের মধ্যেই রেখে দেয় সেই কাগজগুলো - পরের বছর খুলে দেখে কার কটা ঠিকঠাক পালন হয়েছে! খুব মজা হয় তখন!"
গ্র্যান্ডপার কথায় চোখ পাকালেন গ্র্যান্ডমা!
"তোমার তো একটাও রেজোলিউসনও পালন হয় না!" 
গ্র্যান্ডপার মুখ কাঁচুমাচু। 
সবাই হেসে উঠলেন। 
"আরো একটা দারুন মজা হয় আমাদের জানো ইরা! তোমরাও করতে পারো!" জন আর রুবি বলে ওঠে। 
"কী গো!"
"এদেশে তো আমরা সবাই ইমিগ্র্যান্ট, মানে বিভিন্ন দেশ থেকেই তো সবাই কোন না কোন সময় এসেছেন- এই ধরো তুমি এসেছ ইন্ডিয়া থেকে - গ্র্যান্ডমা জার্মানি, গ্র্যান্ডপা চায়না, আমার বাবা সুইডেন থেকে..." 
"আমরা যে দেশের যে সময় নিউ ইয়ার হচ্ছে সেই সময় সেই সেই রকম পোশাক পরি - সেই সেই ভাষায় নিউ ইয়ার বলার চেষ্টা করি - খুব খুব মজা হয়!" জনের কথা কেটে রুবি ঢুকে পড়ল।
"দারুন তো! শোন সবাই, ইন্ডিয়াতে তো অনেক আগে হয়ে যাবে নিউ ইয়ার, কত আগে যেন বাবা!” ইরার প্রশ্ন। 
"সাড়ে দশ ঘন্টা আগে!"
"হ্যাঁ, তখন আমরা ইন্ডিয়ান এথনিক জামা কাপড় পরব -বাংলা গান চালাব, তারপর আবার টিভিতে বল ড্রপ দেখতে দেখতে রাতে সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠব হ্যাপি নিউ ইয়ার বলে, বুঝলে!” এবার মায়ের উৎসাহী গলা।
“কেক কাটব না!” ব্যাকুল ইরা!
"নিশ্চয়ই! আর তো তিনদিন বাকি! কাল থেকেই কেক বেকিং শুরু করতে হবে! মা এবার কেক বানাবে! দারুন বানায় মা কেক, জানেন আন্টি!" ইরার মা বললেন গ্র্যান্ড মাকে। 
দিদার লজ্জা লজ্জা মুখ!
সবাই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল," ইয়েএএএ!"




সমাদৃতা রায়
দশম শ্রেণী, উত্তরপাড়া গার্লস হাই স্কুল, হুগলি

আকাশের তারাগুলি  যেন করিছে ঝলমল।।
চারিদিকে শোনা যাচ্ছে যেন
পাখির কোলাহল।।

পৃথিবী যেন  কাকে ডাকিল 
আয় আয় আয়।।
সেই দিন এক দেবদূতের
জনম হয়ে যায়।।

কে যেনো সেই দেবদূত
কোনো এক আলোর দেশের শিশু।।
তিনি হলেন আর কেও নয় 
মাদার মেরি ও জোসেফ এর পুত্র যীশু।।

যীশু করিল খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার
ফরাসিদের কাছে সেটা হলো অনাচার।।
মেরে ফেলা হলো ক্রুশবিদ্ধ করে 
মৃত্যু স্থানে বললো "ক্ষমা করো এদের। এরা জানে না এরা কি করে।।" 

এই করি সে মিলিয়ে গেলো হওয়ায়।।
কেই বা তাকে কোথায় খুঁজে পাই।।
আনন্দে পালিত হবে তার জন্মদিন। 
সবাই এক হয়ে শ্রদ্ধা জানায় তাকে শুভ জন্মদিন।।



ফুলকুসুমপুর খুব কাছে ২৯

রতনতনু ঘাটী

শুধুকাকা, গল্পকাকা আর বড়বাবু হযবরল স্টলটাকে ফুল দিয়ে দারুণ করে সাজিয়েছেন। স্টলের মেঝেতে নরম সবুজ ঘাস বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাধাগোবিন্দকে স্টলে ছেড়ে দিয়েছে বিলম্বদাদু। পাতলা কাঠের ছোট্ট ঘর এনে রাখা হয়েছে কুমির জন্যে। বিংগো যেন এদের সকলের সিনিয়ার, এমন ভঙ্গিতে গোটা স্টলের চারপাশে পায়চারি করছে। মিঁউয়ের জন্যে স্টলের মাঝখানটায় একটা ছোট্ট গর্ত খুঁড়ে পুকুর মতো বানিয়ে তাতে কয়েকটা পুঁটি মাছও ছেড়ে রাখা হয়েছে। খলবল করছে পুঁটি মাছগুলো। মিঁউয়ের সেদিকে অত নজরই নেই।
   প্রেসকে দেওয়ার জন্যে ডি টি পি করে ‘হযবরল চিড়িয়াখানা’র কথা বিস্তারিত ভাবে লিখে নিজের কাছে রেখেছেন গল্পকাকা। রিপোর্টাররা এলেই ওঁদের হাতে তুলে দেবেন। 
   একধারে দাঁড়িয়ে রিপোর্টারদের কী বলবেন, মনে-মনে রিভাইজ করে নিচ্ছেন শুধুকাকা। মেলার মাইকে ঘনঘন হযবরল স্টলের কথাই ঘোষণা করা হচ্ছে বেশি করে। গমগম করে মেলায় লোক আসছে।
   তক্ষুনি মন্ত্রীমশাই এসে গাড়ি থেকে নামলেন। সাদা পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরেছেন। তার উপর মেঘছাই রঙের হাফহাতা জ্যাকেট। ইচ্ছেদাদু আর বিপদভঞ্জনস্যার তাঁকে নিয়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। অমন সময় মন্ত্রীমশাই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন ‘হযবরল চিড়িয়াখানা’র সামনে। গল্পকাকা চটপট করে তাঁর সামনে এগিয়ে গেলেন। গলা নামিয়ে শুধুকাকা মন্ত্রীমশাইকে বুঝিয়ে দিলেন পশু-প্রাণীর একসঙ্গে থাকার ভালবাসার কথা।
    বুম্বা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, ওদের নৈবেদ্য স্কুলের দয়াল, চিকলু, নীলূফার এবং আরও অনেক ছাত্রছাত্রীই মেলার মাঠে চলে এসেছে। এমন সময় বিপদভঞ্জনস্যার বুম্বাকে চোখের ইঙ্গিতে মঞ্চের একধারে ডেকে নিয়ে নিলেন। তারপর ওর হাতে একটা ফুলের মালা তুলে দিলেন। ততক্ষণে মঞ্চে মন্ত্রীমশাইকে নিয়ে চলে এসেছেন ইচ্ছেদাদু। তিন্নি এক চাঙাড়ি ভরতি লাল-সাদা-হলদে ফুল ছড়িয়ে দিল মঞ্চের উপর। 
   বুম্বার কাছে এগিয়ে গিয়ে স্যার গলা নিচু করে বললেন, ‘বুম্বা, যাও, মন্ত্রীমশাইকে মালা পরিয়ে বরণ করে নাও!’ 
   বুম্বা মঞ্চে উঠে মন্ত্রামশাইয়ের গলায় মালা পরিয়ে দিল। অমনি হাততালিতে মুখরিত হয়ে উঠল মেলা প্রাঙ্গণ। বুম্বা মন্ত্রীমশাইয়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে নেমে এল মঞ্চ থেকে। 
   এবার ইচ্ছেদাদু নীলূফারের হাতে একটা ফুলের মালা দিয়ে চোখের ইঙ্গিতে ডি এম সাহেবকে বরণ করে নিতে বললেন। বরণ করা হল ডি এম সাহেবকে। এবার বিন্নিকে বিপদভঞ্জলস্যার বললেন, ‘তুমি মালা পরিয়ে আমাদের অঞ্চলপ্রধানকে বরণ করে নাও।’ বরণ করার সময় বুম্বা, নীলূফার, তিন্নি আর বিন্নির ছবি উঠল টিভির ক্যামেরায়। 
   মন্ত্রীমশাইয়ের কোথাও আরও একটা জায়গায় যাওয়ার কথা। তাই তিনি তড়িঘড়ি ভাষণ দিতে উঠলেন। কথায় কথায় তিনি বললেন, ‘এই মেলা গত তিন বছর করা যায়নি কোভিডের জন্যে। এবার কোভিড কমেছে। আজ শুরু হয়েছে মেলা। তাই মানুষের মুখে হাসি দেখতে পাচ্ছি। গ্রামীণ মেলা যতই করা যাবে ততই গ্রামের কথা পৌঁছে দেওয়া যাবে শহরের মানুষের কাছে। গ্রামের কৃতিত্বের কথা, গ্রামের গর্বের খবর তুলে ধরা যাবে বাইরের জগতের কাছে। আজ টিভি চ্যানেলের লোকজন এসেছেন। প্রিন্ট মিডিয়ার লোকজনকেও দেখতে পাচ্ছি সামনে। ওঁরা এই মেলার কথা লিখবেন কালকের কাগজে। আজই সন্ধেবেলার খবরে টিবিতে দেখানো হবে আমাদের এই গ্রামীণ কৃষিমেলাকে। খবরে বলবে এক আশ্চর্য হযবরল চিড়িয়াখানার কথা। আমি দেখে এলাম, এতগুলো পাখি, প্রাণীদের একসঙ্গে কেমন করে আছে! এ মানুষের অকৃত্রিম ভালবাসা ছাড়া কখনওই সম্ভব নয়। এর থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে, ভালবাসলে বনের পাখি আর প্রাণীও মানুষের আপন হয়ে ওঠে।’ তারপর দর্শকদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনারা সকলে ভাল থাকুন। পশু-পাখিকে ভালবাসতে শিখুন। মাস্ক পরতে কখনওই ভুলবেন না!’
   হাততালিতে ফের মুখরিত হল মেলার চারপাশ। মন্ত্রীমশাই চলে গেলেন। টিভি চ্যানেল অনেক ছবি তুলল হযবরল চিড়িয়াখানার। ইচ্ছেদাদুর ইন্টারভিউ নিলেন রিপোর্টাররা। তখন বিলম্বদাদু চুপটি করে ইচ্ছেদাদুর পাশটিতে দাঁড়িয়েছিল। সে ছবিও উঠল। গল্পকাকা, শুধুকাকা আর বড়বাবুও বাদ পড়লেন না। আলাদা করে অনিচ্ছে ঠাকুরমারও ইন্টারভিউ নেওয়া হল চেয়ারে বসিয়ে। রাধাগোবিন্দ চুপটি করে ঠাকুরমার আঁচলের কাছটিতে বসে থাকল। সে ছবিও তোলা হয়ে গেল।
   মেলা ভেঙে পড়ছে লোকে। শ’য়ে শ’য়ে লোক আসছে। বেশি ভিড় হযবরল স্টলের সামনে। অবাক চোখে সকলে দেখছে পশু-পাখির এণন আজব কাণ্ড!
    ফুলকুসুমপুর গ্রামীণ কৃষি মেলা থেকে ত্রিপাঠী বাড়ির সকলে ফিরে গেলেন বাড়িতে। পশু-পাখিদের দেখভালের জন্যে পরিপালনকাকা মেলার মধ্যেই থেকে গেলেন। বিলম্বদাদু মেলার স্টলে থাকতে চেয়েছিল। ইচ্ছেদাদু বললেন, ‘বিলম্ব, তুই মেলার মধ্যে থেকে আবার কোত্থেকে একটা কিছু বাধিয়ে বসবি। সে এক লজ্জার একশেষ কাণ্ড হবে। তার চেয়ে তুইও আমাদের সঙ্গে বাড়ি চল।’
   গোমড়া মুখে বিলম্বদাদু সকলের পিছন-পিছন  বাড়ি চলে এল। বাড়ি ফিরে ইচ্ছেদাদু তড়িঘড়ি টিভি চালিয়ে দিলেন। ও মা, তখুনি দেখানো শুরু হয়েছে ফুলকুসুমপুর গ্রামীণ কৃষিমেলার খবর। রাধাগোবিন্দ, কুমি, বিংগো আর মিঁউদের ছবি দেখাচ্ছিল টিভিতে। একফাঁকে দেখতে পাওয়া গেল বিলম্বদাদুকেও। 
   ব্যস, সঙ্গে-সঙ্গে বিলম্বদাদুর গোমড়া মুখে হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ল। ইচ্ছেদাদুর পাশটিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে গাল ভরতি হাসি নিয়ে বলল, ‘দেখলেন বড়বাবু, টিভিতেও আমাকে দেখাল? দেখলেন তো?’ 
   অনিচ্ছেঠাকুরমা পাশেই দাণনইয়েছিলেন। তবু গলা তুলে অনিচ্ছে ঠাকুরমাকে চেঁচিয়ে ডেকে বিলম্বদাদু বলল, ‘ও বড়মা, আপনার বিলম্বকে এক্ষুনি টিভিতে দেখাল গো। আপনি এবার থেকে বড়বাবুকে বলে দেবেন তো, একটু-আধটু ভুল বিলম্ব যদি কোনও কাজ করতে গিয়ে করেও ফেলে, তখন অমন মনে দাগা দিয়ে যেন না বকেন!’
   ঘরভরতি সকলে হো-হো করে হেসে উঠলেন। তখনই টিভির খবরে বলল, ‘খবরে প্রকাশ--একজন প্রকৃতিবিদ এবং পরিবেশকর্মী অনিলেন্দু দত্ত হযবরল চিড়িয়াখানার কথা গিনেস বুক অফ রেকর্ড বইতে তোলার জন্যে আজই সুপারিশ পাঠিয়েছেন। তিনি বলেছেন—‘পাখি-পশুপ্রাণী আর মানুষের এমন করে একটা বাড়িতে উন্মুক্ত সহাবস্থান এক বিরল ঘটনা। এই চিড়িয়াখানা মানুষকে নতুন করে পাখি আর প্রাণীকে আপন করে নেওয়ার শিক্ষার দৃষ্টান্ত তৈরি করল। আমি গিনেস রেকর্ড বইয়ে হযবরল চিড়িয়াখানার এন্ট্রির সুপারিশ পাঠালাম।’
   সঙ্গে-সঙ্গে শুধুকাকা গল্পকাকার দিকে তাকিয়ে হাততালি দিয়ে বলে উঠলেন, ‘কী রে দাদা, আমি তো আগেই বলেছিলাম, একদিন না একদিন আমাদের বাড়ির কথা গিনেস বইতে জায়গা করে নেবে? হল তো?’
   বুম্বা, তিন্নি আর বিন্নি হাততালি দিয়ে উঠল। ইচ্ছেদাদু হতচকিত হয়ে পড়লেন সাময়িকভাবে। তারপর বললেন, ‘ছোটরা, তোমরা এখনই অত আনন্দ কোরো না। শুধুকাকা, তুমি অত খুশি হোয়ো না এক্ষুনি। অনিলেন্দু দত্ত আমাদের দেশের বিখ্যাত পরিবেশবিদ। তাঁর সুপারিশ গৃহীত হলেও হতে পারে। তবে গিনেস কর্তারা নিশ্চয়ই যাচাই করে দেখবেন। তা হোক, এই খবরটা আমাদের বাড়ির পক্ষে নিশ্চয়ই আনন্দের।’
   ছোটরা আনন্দে লাফাতে লাগল। সকলে হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘হযবরল চিনিয়াখানা, হিপ-হিপ-হুররে!’ 
   বিলম্বদাদু মুখ তুলে ইচ্ছেদাদুকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা বড়বাবু, গিনিসটা কী জিনিস গো? সেটা কি লাড্ডুর মতো ভাল কিছু?’
   ইচ্ছেদাদু ধমকে উঠলেন বিলম্বদাদুকে, ‘আচ্ছা বিলম্ব, সব কথার মধ্যে তোর না থাকলে কী চলে না? তুই একটু চুপ করবি?’
   বিলম্বদাদু অনিচ্ছেঠাকুরমার দিকে তাকিয়ে বিচার চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘আচ্ছা বড়মা, আপনেই বলেন তো, আমি কী এমন অন্যেয় কথা বললাম যে, বড়বাবু অমন মনে দাগা দিয়ে কথা বললেন?’
   সে কথার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলেন না কেউ। টিভির খবরে ইচ্ছেদাদুর বাইট শোনাল। অনিচ্ছে ঠাকুরমাকেও দেখাল দু’বার। বিপদভঞ্জনস্যারের বক্তব্য শোনালও। গল্পকাকা, শুধুকাকা আর বড়বাবুর কথাও শোনাল। স্টলের একধারে দাড়িয়েছিল বুম্বা, বিন্নি আর তিন্নি। ওদেরকেও দেখাল টিভিতে। মাধুরীজেম্মা, করবীকাকি আর বকুলকাকিকেও দেখাল চিড়িয়াখানার খবর দেখাতে গিয়ে। এমনকী, এক পলক কুয়াশামাসিকেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল টিভিতে।
   টিভির খরব শেষ হতে তক্ষুনি ইচ্ছেদাদুর ফোন বেজে উঠল। ফোন করছেন বিপদভঞ্জনস্যার। তিনিও এক্ষুনি টিভিতে হযবরল চিড়িয়াখানার খবর দেখেছেন। গিনেস রেকর্ড বুকের কথা শুনে তিনিও ভীষণ উত্তেজিত। তাঁর ফোন শেষ হতে না হতেই ফের দাদুর ফোন বেজে উঠল। দাদু ফোন ধরলেন। ওদিক থেকে ফোন করেছেন গান্ধী আশ্রমের সেক্রেটারি অনন্ত দণ্ডপাট। তিনিও আনন্দে টগবগ করে ফুটছেন।
   শুধুকাকা আর গল্পকাকা তাঁর সাংবাদিক বন্ধুদের ফোন করে ফুলকুসুমপুর গ্রামীণ কৃষিমেলার খবর প্রচার করার জন্যে ধন্যবাদ জানালেন। আজ সন্ধেবেলার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল বুম্বাদের। অনিচ্ছে ঠাকুরমা তক্ষুনি দুমকায় ফোন করলেন ছড়াপিসিকে। ত্রিপাঠীবাড়ির এমন আনন্দের খবরটা ছড়াপিসিকে না দিলে কি চলে?
   ত্রিপাঠী বাড়িতে এক তুমুল উত্তেজনা আর আনন্দের বন্যা বইছে যেন। গ্রামের অনেকে টিভির খবর দেখেছেন। তাঁদের কেউ-কেউ বাড়িতে চলে এলেন অভিনন্দন জানাতে। কেউ-কেউ ‘কনক মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ থেকে মিঠাই কিনে এনে ইচ্ছেদাদুর হাতে তুলে দিলেন। ইচ্ছেদাদু গলা তুলে ঠাকুরমাকে ডাকলেন, ‘কই অনিচ্ছে, শিগগির এদিকে এসো! দ্যাখো, কতজন কত মিষ্টি এনেছে। সকলের হাতে তুলে দাও!’
   ঠাকুরমা তাড়াতাড়ি এসে সকলকে মিষ্টি বিতরণ করতে শুরু করলেন। ফুলকুসুমপুর গ্রামের মানুষ এতটাই ভালবাসে ত্রিপাঠী বাড়িকে। তা দেখে ইচ্ছেদাদুর মুখের উপর এক পরিতৃপ্তি ছড়িয়ে থাকল কতক্ষণ। বিলম্বদাদু কয়েকটা মিঠাই নিয়ে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। মুখে বিড়বিড় করে বলতে-বলতে গেল, ‘মাধুরীজেম্মারা এই আনন্দে দিনের মিষ্টি পাবে না, তা কি হয় নাকি?’
   ভিড় কমে গেল একটু-একটু করে। বুম্বারা পড়ার ঘরে গল্প করছিল। ঠাকুরমা আনন্দের খবরটা মন সময় বিলম্বদাদু এসে ঢুকল পড়ার ঘরে। বুম্বা বলল, ‘দেখলে তো বিলম্বদাদু, আমাদের বাড়িটা কত বিখ্যাত হয়ে গেল একদিনে?’
   বিলম্বদাদু বলল, ‘আমাকেও তো টিভির খবরে দেখাল গো?’
   বিন্নি বলল, ‘তাই তো! তুমিও বিখ্যাত হয়ে গেলে গো বিলম্বদাদু!’
   সেই রাতে ত্রিপাঠীবাড়িতে ডিনার খেতে বসতে অনেক দেরি হয়ে গেল। ঘড়িতে তখন রাত এগারোটা বাজে। অত দেরি ইদানীংকালে আর কখনও হয়নি। 
   অনিচ্ছে ঠাকুরমা দাদুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার তো আজ ডিনার খেতে অনেক দেরি হয়ে গেল। শরীর ঠিক রাখতে হবে তো? তুমি বরং আজ একটা অম্বলের ওষুখ খেয়ে নিও। বলা তো যায় না, এত রাতে তো তোমার খাওয়ার অভ্যেস নেই আজ কতদিন।’
   দাদু হাত তুলে বললেন, ‘রাখো তো শরীর! অনিচ্ছে, এমন আনন্দের দিনে অত ‘শরীর-শরীর’ করলে চলে? জীবনে এমন আনন্দ ক’বারই বা এসেছে বলো? এমন আনন্দ কিআর দু’বার আসবে গো অনিচ্ছে?’
   একটু চুপ করে থাকার পর দাদু বললেন, ‘অনিচ্ছে, এমন আনন্দের খবরের পরেও মনটা বেশ ফাঁকা-ফাঁকা লাগছে গো!’
   ঠাকুরমা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন?’
   ইচ্ছেদাদু বললেন, ‘আজ আমাদের হযবরল চিড়িয়াখানার মেম্বাররা বাড়িতে নেই। এই আনন্দ ওদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারলাম না! খুব খারাপ লাগছে। ওরাই তো আমাদের বাড়ির এমন জগৎজোড়া সুনাম এনে দিল?’
   ডিনার টেবিলে খেতে বসেছেন সকলে। দাদু গল্পকাকাকে বললেন, ‘গল্প, তোরা কাল না হয় আমাদের চিড়িয়াখানার মেম্বারদের সন্ধেবেলা বাড়ি নিয়ে চলে আয়?’ 
   গল্পকাকা বললেন, ‘না। তা হয় না বাবা! আজ টিভির খবর আশপাশের কত গ্রামের মানুষই দেখেছে। যারা হযবরল চিড়িয়াখানার রাধাগোবিন্দ, বিংগো, মিঁউ বা কুমিকে দেখেনি, তারা সব দলে-দলে আসবে কাল মেলায়। পরশুও অনেকে আসবে। স্টল বন্ধ করে ওদের নিয়ে আসা যাবে না বাবা!’
   শুধুকাকা বললেন, ‘ঠিকই বলেছিস! অমন করা যাবে না। তিন্নির বাবা বললেন, ‘তা ছাড়া মেলার মূল আকর্ষণ এখন আমাদের চিড়িয়াখানা। তা বন্ধ করে দিয়ে সকলে হতাশ হয়ে যাবে। না, বাবা! আর তো মাত্র দুটো দিন?’
   দাদু নিমরাজি ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়লেন। 
   সমান উত্তেজনা ছোটদের মধ্যেও। ঘুমোতে গিয়ে বুম্বা গলা নামিয়ে তিন্নিকে বলল, ‘তিন্নিদি, কাল স্কুলে গিয়ে দারুণ মজাই হবে, বল? সকলে তো টিভিতে হযবরল-র খবরটা দেখেছে কিনা?’
   বিন্নি বলল, ‘দেখিস, কাল সকালে হয়তো নীলূফার আমাদের বাড়িতেই না চলে আসে!’
   ‘তা যদি বলিস, তবে...’ বুম্বা বলল, ‘চিকলুদা স্কুলে গিয়ে একটা প্রথমেই একটা হইচই বাধিয়ে দেবে ঠিক।’
  ছোটদের চোখ জুড়ে যখন ঘুম নেমে আসছিল, তখন ইচ্ছেদাদু বিছানা থেকে উঠে বসলেন। তারপর বারান্দায় বেরিয়ে গেলেন। বাইরে তখন একটা মেঘভাঙা জ্যোৎস্না ভাসিয়ে দিচ্ছে চারপাশ।
   ঠাকুরমার তন্দ্রা মতো জড়িয়ে এসেছিল চোখে। দাদুকে বিছানা ছেড়ে উঠে যেতে দেখে তন্দ্রা ভেঙে গেল। ধড়ফড় করে বিছানা থেকে উঠে অনিচ্ছে ঠাকুরমা বারান্দায় গিয়ে দাদুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী গো, তোমার শরীর খারাপ করছে নাকি? অম্বলের ওষুধটা খেয়েছ তো?’ 
   ইচ্ছেদাদু ঠাকুরমার কাছে সরে এসে ধীর গলায় বললেন, ‘অনিচ্ছে, আজ সারারাত জেগে থাকতে ইচ্ছে করছে গো! বাইরে দ্যাখো না, কী মনোরম জ্যোৎস্না! তোমার মুখের উপর ছাতিম গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে এক টুকরো জ্যোৎস্না এসে পড়েছে! তোমাকে চাঁদের আলোয় খুব ফরসা লাগছে!’
   ঠাকুরমা হেসে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন, ‘রাখো তোমার কাব্যি! আমি আবার কবে ফরসা ছিলাম? চলো, শুতে যাবে চলো!’
   ইচ্ছেদাদু হাত ধরে ঠাকুরমাকে পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। গলা নামিয়ে দাদু বললেন, ‘আর একটুখানি বসে থাকি। কতদিন এমন করে চাঁদ দেখার সুযোগ হয়নি! আর একটুক্ষণ বসে থাকি!’
   এমন সময় চাঁদের মুখের উপর থেকে ভেলার মতো দেখতে একটা সাদা মেঘ সরে গেল। তার পরই চারদিক আরও ঝিকমিক করে উঠল ধবধবে জ্যোৎস্নায়।
(এর পর পরের রোববার)



চলো যাই (কেরলা)
পর্ব - ১
কলমে - বাসবদত্তা কদম

রাঁচি বেড়ানো তো হল। এবার চল অন্য কোথাও যাই। তোমরা তো আমার সঙ্গে ১৯৮২/৮৩ তেই রয়ে গেছ, সময় যে অনেক আগে চলে গেছে। এবার তাকে কিভাবে ছোঁয়া যাবে বলত? দাঁড়াও বলি, চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নাও আর ধীরে ধীরে ছাড়। এভাবে তিনবার করেছ? ব্যাস্‌ এবার চোখ খোল। এবার দেখ দেখি সামনের মাঠে টুকটুকে একটা ছোট্ট লাল যান দাঁড়িয়ে আছে কি? আছে! তাহলে তো হয়েই গেল। উঠে পড়ো। না, না ড্রাইভার লাগবে না, ও অনেক এডভান্সড। ড্রাইভার ছাড়াই চলবে। উঠেছ তো এবার শুধু বলে দাও ‘যান’ ‘এবার চলো কেরালা’। বসে আছ তো আছই! সেকি! চোখ খোল। 
-দেখ তো কি দেখা যাচ্ছে? 
-একটা স্টেশন? 
-বেশ। কি নাম তার? 
-আলাপুZhআ! 
-আরে তাহলে তো আমরা তো পৌঁছে গেছি কেরালায়। -চলো নেমে পড়। 
কেরালার গল্প প্রথম আমি শুনেছিলাম আমার মাসির কাছে, সেদেশে নাকি জল শুধু জল। দেখে দেখে মাসির আমার চিত্ত হয়েছিল বিকল। সে দেশে নৌকা চলে জলের মধ্য দিয়ে আর দুদিকের গাছ নুয়ে এসে পড়ে নৌকার গায়ে। আর দেখেছিলাম কেরালা ট্যুরিজিমের বিজ্ঞাপন আমার ছোটবেলায়, ‘God’s own country Kerala’ এসব দেখে শুনে আমার মনে হয়েছিল, ভগবান ভদ্রলোকের বাড়ি তাহলে কেরালায়! ভগবানই যে গড এ আর কে না জানে।
আমার যখন কেরালা যাবার সময় সুযোগ দুটোই হোল, খোঁজ পত্তর নিয়ে দেখলাম, কেরালা রাজ্যে, অনেকগুলো জায়গাই বেশ বেড়ানোর আর দেখবার মতো। কয়েকখানা নাম দেখে আলেপ্পি নামখানা আমার বেশ পছন্দ হয়ে গেল। তাহলে আলেপ্পি দিয়েই শুরু করা যাক। যথা ভাবনা তথা কাজ। আমাদের কেরালা যাত্রা শুরু হল এই আলেপ্পি থেকেই। 
আলেপ্পি বা আলাপুZhআ। আলাপুZhআ তার নিজের নাম। সম্ভবত ব্রিটিশ উচ্চারণে হয়ে দাঁড়িয়েছিল আলেপ্পি। এখন সে আবার নিজের আসল নামেই পরিচিত, তবে ডাকনামখানাও রয়ে গেছে। কেরালা রাজ্যের একটি জেলা এই আলাপুZhআ। এই জেলা থেকে প্রতিদিন সকালে অগুনতি ‘হাউসবোট’ ট্যুরিস্ট নিয়ে রওয়ানা হয়। সাধারনত চব্বিশ ঘন্টার এই ট্যুরে, তারা পেরিয়ে যায় বেশ কিছু ব্যাকওয়াটারের খাল আর বিশাল বিশাল হ্রদ। তবে ছোট ছোট দুতিন ঘন্টার ট্যুরও হয়। একসাথে অনেক ঠাসাঠাসি প্যাসেঞ্জার নিয়ে অনেকটা আমাদের সাটলট্যাক্সির মতন। 
হ্রদ জানত? সেই যে গো যাকে আজকাল আমরা সবাই লেক বলি। আলেপ্পিতে ঘুরলে তোমাদের মনে হবে রাস্তাগুলো সব জল দিয়ে তৈরি। লঞ্চগুলোই সব বাস বা রিক্সা অটো টোটো গাড়ি। লঞ্চে করে ছেলেমেয়েরা স্কুল কলেজে যাচ্ছে। তাদের বাবা মায়েরা অফিসে ইস্কুলে যাচ্ছে। কত যে রকমারি নৌকা, ঠিক যেন নানারকম গাড়ি। কি মজা না! 
আলেপ্পির রাস্তাগুলোর অনেকটাই জলের মধ্যে। তার মানে এমনটা নয় কিন্তু রাস্তাগুলো জলে ডুবে গেছে। তাহলে আবার জলের মধ্যে রাস্তা মানে কি? (ক্রমশঃ)



স্মরণীয়
(সত্যেন্দ্রনাথ বসু)
কলমে - পীযূষ প্রতিহার


বিজ্ঞান সাধক সত্যেন্দ্রনাথ বসু ১৮৯৪ সালের ১লা জানুয়ারী উত্তর কলকাতার গোয়াবাগান ২২ নম্বর ঈশ্বর মিত্র লেনে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বসু ও মাতা আমোদিনী দেবী। তাঁদের আদি নিবাস ছিল ২৪ পরগনার বড়োজাগুলিয়া গ্রামে। পড়াশোনা শুরু করেন কলকাতার বাড়ির নিকটবর্তী নিউ ইন্ডিয়ান স্কুলে। এরপর এন্ট্রান্স ক্লাসে ভর্তি হন হিন্দু স্কুলে। ১৯০৯ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পঞ্চম স্থান অর্জন করে পাশ করেন ও ভর্তি হন প্রেসিডেন্সী কলেজে। এই কলেজে পড়ার সময় আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ও জগদীশ চন্দ্র বসুর সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৯১১ তে আই এস সি, ১৯১৩ তে বি এস সি ও ১৯১৫ তে মিশ্র গনিতে এম এস সি পাশ করেন প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে।
স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠা করলে ১৯১৫ সালেই সেখানে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। এখানে তিনি বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সঙ্গে মিশ্র গণিত ও পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করেন। ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডার হিসেবে যোগদান করেন। তিনি কিছু সময় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। দেশবিভাগের প্রাক্কালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে এসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে যোগদান করেন। ১৯৫৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে এমিরেটস অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ করে। ১৯৫৬-৫৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। 
১৯২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা কালীন প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তেজস্ক্রিয়তার উপর একটি প্রবন্ধ লিখে পদার্থ বিজ্ঞানের বিশ্বখ্যাত জার্নাল Physics Journals এ প্রকাশের জন্য প্রেরণ করেন।তারা প্রবন্ধটি প্রকাশ না করলে তিনি তা পাঠিয়ে দেন আলবার্ট আইনস্টাইনের কাছে। আইনস্টাইন ব্যাপারটির গুরুত্ব উপলব্ধি করে নিজেই একটি প্রবন্ধ লেখেন ও সত্যেন্দ্রনাথের প্রবন্ধটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। আইনস্টাইন বসুর এই ধারণাটি পরমাণু গবেষণায় প্রয়োগ করলে যা উঠে আসে তা বর্তমানে বোস-আইনস্টাইন সংখ্যাতত্ত্ব নামে পরিচিত। এই প্রবন্ধটি প্রকাশ হলে তিনি দু'বছর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গবেষণার সুযোগ পান ও লুই ডি ব্রগলি, মারি ক্যুরি এবং আইনস্টাইনের সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৯৯৫ সালে বিজ্ঞানী পল ডিরাক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামানুসারে এক বিশেষ ধরনের ফোটন (যে কনাগুলোর ঘূর্ণন পূর্ণ সংখ্যার) কণাকে 'বোসন' কণা নামে নামকরণ করেন। 

     তিনি দেশমাতৃকার প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। অনুশীলন সমিতির সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখতেন ও সশস্ত্র সংগ্রামে সাহায্য করতেন। মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার অগ্রণী সৈনিক ছিলেন। মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার জন্য ১৯৪৮ সালে তাঁর নেতৃত্বে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ গঠন করেন। এই বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের মুখপত্র হিসেবে বাংলা ভাষায় 'জ্ঞান ও বিজ্ঞান' পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই পত্রিকার পাতায় তিনি লিখেছেন, "যারা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা সম্ভব নয় তারা হয় বাংলা জানেন না অথবা বিজ্ঞান বোঝেন না"। বিজ্ঞান সাধনায় আজীবন নিয়োজিত থাকলেও সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ ছিল তাঁর। অবসর সময়ে সেতার ও এসরাজ বাজাতে ভালোবাসতেন।

      ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দে তিনি ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের পদার্থ বিজ্ঞান শাখার সভাপতি হন। ১৯৫৪ সালে ভারত সরকার তাঁকে 'পদ্মবিভূষণ' সম্মাননা প্রদান করেন। ১৯৫৮ তে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। তিনি ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৯ এ ভারত সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক পদে মনোনীত করেন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে 'দেশিকোত্তম' সম্মান দেয়। কলকাতায় তাঁর নামে সত্যেন্দ্রনাথ বসু জাতীয় মৌলিক বিজ্ঞান কেন্দ্র স্থাপন হয় ১৯৮৬ সালে।
   ১৯৭৪ খ্রীষ্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারী কলকাতায় এই মহান বিজ্ঞানীর জীবনাবসান হয়।


আরও পড়ুন

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments