জ্বলদর্চি

ইউরোপ (পর্তুগাল)--এর লোকগল্প /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—ইউরোপ (পর্তুগাল)

চিন্ময় দাশ 

পাখির পরামর্শ

একদিন এক জমিদার বাবু বেরিয়েছেন বেড়াতে। বড়সড় কয়েকটা আঙুরের খেত আছে বাবুর। তা থেকেই বাবুর জমিদারী। খেতের কাজকর্ম দেখাশোনা করতে দিন কেটে যায়। হাজার রকমের কাজ। হয়রানির একশেষ।

তাই, বিকেল হলেই বাবুর মনটা আনচান করে ওঠে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন।
সেদিন এসেছেন নদীর দিকটায়। ছোট-বড় গাছপালা, ঝোপঝাড়। স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া। তবুও এসেছেন এদিকটায়। লোকজন বড় একটা আসে না এদিকে। একটু নিরিবিলি পাওয়া যায়। সেজন্যই তাঁর এদিকে আসা। 
কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে নদীটা। বাতাসও বইছে ফুরফুর করে। চারদিক জুড়ে সবুজ গাছগাছালির সমারোহ। ভারি শান্ত জায়গাটা। তেমনি নির্জন। 
শব্দ বলতে পাখির ডাক। গাছে গাছে কত না পাখি। তাদের কলকাকলিতে মন জুড়িয়ে যায়। গঞ্জের কোলাহল নাই এখানে। আর, কী নির্মল পরিবেশ! প্রাণ জুড়িয়ে যায় যেন। তাই মাঝে মাঝেই চলে আসেন এদিকটায়।
সেদিনও এসেছেন। হাঁটছেন আপন মনে। হঠাৎই একটা শোঁ-শোঁ আওয়াজ। আর, আচমকাই একটা ছোট্ট পাখি তাঁর সামনে এসে আছড়ে পড়ল মাটিতে। ঠিক তার পিছনে পিছনে ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে এল একটা বাজপাখি। ঝঁপিয়ে পড়তে গেল পাখিটার উপর। 
চোখের পলক পড়তে পেল না। জমিদার বাবু খপ করে তুলে নিলেন পাখিটাকে। তা দেখে, বাজটা সরে পড়ল তাড়াতাড়ি। 

মূহুর্তে ঘটে গেল ঘটনাটা। কিছু বুঝে উঠবার আগেই। 
হাতের পাখিটার দিকে চোখ গেল জমিদার বাবুর। ধূসর পালকে ঢাকা শরীর। তাতে জলপাই রঙের ছোপ। ছোট্ট একটুখানি পাখি। পা জোড়া সরু, কিন্তু লম্বাটে। চোখ দুটো বেশ বড়, আর তেমনি উজ্বল।
--আরে, এ তো নাইটিঙ্গেল! হায় ভগবান, মরতে বসেছিলি তুই! বিড়বিড় করতে লাগলেন মানুষটি।
ঠিকই চিনেছেন। ছোট্ট পাখিটা নাইটিঙ্গেলই। ইউরোপের এই অঞ্চলেই থাকে পাখিগুলো। বিশেষ করে ইংল্যাণ্ড আর সাইবেরিয়া এদের খুব প্রিয় জায়গা। তবে, এদেশেও দেখা যায় এদের। 
কী মিষ্টি যে এদের গলা। সারা দুনিয়া জুড়ে গায়ক পাখি বলে এদের নামডাক। জমিদারবাবু নিজেই তো কতদিন এদের মিষ্টি গলার গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েন।
হঠাৎ করে এমন আস্ত একটা পাখি তাঁর হাতের মুঠোয়। অভাবনীয় ঘটনা একেবারে। যেমন অবাক, তেমনি যারপর নাই খুশীও হয়েছেন বাবুটি। আচমকা ফুটফুটে একটা পাখি হাতের মুঠোয় এসে ঢুকে পড়লে, কার না ভালো লাগে? তাও আবার যে-সে পাখি নয়, একেবারে একটা নাইটিঙ্গেল! 

কিন্তু কী করা যায় এখন পাখিটাকে নিয়ে? কী করা যায়? বাজের চোখ বলে কথা। নিশ্চয় নজর রাখছে আড়াল থেকে। ছেড়ে দিলেই আবার ছোঁ। ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। 
--না, বরং বাড়িই নিয়ে যাই। সোনার খাঁচা বানিয়ে রাখবো মিষ্টি গলার পাখিটাকে। যেমন গুণের জীব, খাঁচাটাও তেমনটাই তো হওয়া চাই। আবার বিড়বিড় করে বলে লাগলেন বাবু।   
 মনের আনন্দে যেই ফিরতি পথ ধরেছেন জমিদারবাবু, অমনি হাতের পাখি কথা বলে উঠল—শোনগো, ভালোমানুষ। একটা কথা শোন আমার।
চমকে গিয়ে বাবু বললেন—বলো, কী কথা? 
--খাঁচায় পুরো না আমাকে। ছেড়ে দাও। 
--আরে বাপু, ছেড়ে দিলে তো আবার পড়বে বাজটার পাল্লায়। এখুনি ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে তোমাকে। তার চেয়ে আমার সাথে চলো। মণি-মুক্তো বসিয়ে, সোনার খাঁচা বানিয়ে দেব তোমার জন্য।
পাখি মাথা নেড়ে বলল—না, না। খাঁচার জীবন অতি মন্দ। 

বাবু আবার বললেন—খাঁচায় শিকারীর ভয় নাই। খেতে পাবে দু’বেলা। আয়েশ করে থাকতে পারবে। শুধু রাত্রি হলে, মিষ্টি গলাইয় গান শোনাবে আমাকে।
--বন্দী জীবন তো মরারই সমান। জীবনভর বন্দী হয়ে থাকার চেয়ে, মরে যাওয়া তো ভাল। তাছাড়া, আমাকে খাঁচায় আটকে রেখে, তোমার কী লাভ?
জমিদার বাবু বললেন—তোমাকে ছেড়ে দিয়েই বা কী লাভ হবে আমার? 
এবার মিষ্টি গলায় হেসে উঠল পাখি—আছে গো, লাভ আছে। কোনও ভালো কাজই বিফলে যায় না। কখনও না। আজ যদি আমাকে ছেড়ে দাও, দুটো পরামর্শ দিয়ে যাব তোমাকে যাবার বেলায়। মেনে চলো যদি, কোনও না কোন দিন উপকারই হবে তোমার। 
পাখির এমন কথায় ভারি কৌতুহল হোল জমিদারবাবুর। পাখি দেবে মানুষকে পরামর্শ! তাও নাকি আবার কাজে লেগে যাবার মতো। বলল—ঠিক আছে, ছেড়েই দেব তোমাকে। বলো শুনি, কী তোমার পরামর্শ? 
পাখি বলল—শোন তাহলে। প্রথম কথা-- যা আর ফিরে আসবে না কখনো, হাতছাড়া হয়ে যাওয়া এমন কোন জিনিষের জন্য, জীবনে আফশোষ কোর না কোনদিন। আর দুই হোল-- কখনো কারও বাজে কথায় কান দিও না। সে তোমাদের মানুষ হোক, বা আমার মত পাখপাখালি।

মন্দ নয় তো কথাগুলো! বাবুর মনেও ধরল বেশ। দেখাই যাক না বিশ্বাস করে। মুঠো খুলে ছেড়ে দিল পাখিটাকে।
সাথে সাথে ডানা মেলে উড়ে গেল পাখি। যেতে যেতে বলতে লাগল—ভারি ভুল করলে গো আমাকে ছেড়ে দিয়ে। তুমি জানতেই পারোনি, দুই ডানার নীচে কত হীরে-মাণিক লুকানো আছে আমার। তুমি তো ছোট-মোট একজন জমিদার। সেসব হাতে পেলে, একেবারে রাজা হয়ে যেতে তুমি। 
আর যায় কোথায়? ভারি আফশোষ হতে লাগল বাবুর। বিড়বিড় করতে লাগল—সত্যিই তো, আর লোক পেলাম না বিশ্বাস করবার? একটা তুচ্ছ একটা পাখিকে বিশ্বাস করতে গেলাম? আচ্ছা আহাম্মক তো। বিপদে পড়লে, প্রাণ বাঁচাবার জন্য কত কথাই তো বলে লোকে। আর, আমি কি না …। ছেড়ে দেওয়াটা সত্যিই ভারি বোকামির কাজ হয়েছে। কিন্তু এখন কী করা যায়? হাতের মুঠোয় পেয়েও, এতগুলো ধনরত্ন খোয়া যাবে?
বড় করে একটা লাফ দিল জমিদার বাবু, পাখিটাকে পাকড়াও করবে বলে। 
তাতে একটুও ভয় পেল না পাখিটা। তাড়াহুড়ো করে ঝটপটিয়ে দূরে সরে গেল না। বরং বাবুর নাগাল থেকে একটু ফারাক রেখে, ঝুপ করে একটা ডালে নেমে, বসে পড়ল। 

বসেই খুব হাসতে লাগল পাখিটা।
তাতে বাবু রেগে গেল যেমন, বিরক্তও হোল তেমনি। বলল—ছাড়া পেয়ে ভারি আনন্দ হয়েছে, তাই না?
পাখি জবাব দিল—কে বলল আনন্দে হাসছি? হাসছি তোমার দশা দেখে।
--আমার আবার কী দশা দেখলে?
হেসে হেসেই পাখি বলল—সত্যি গো, ভারি মজা লাগছে তোমাকে দেখে। তুমি লোকটা যেমন লোভি, তেমনি মুর্খ। আরে বাপু, হাতের পাখি একবার উড়ে গেলে, তাকে ধরা যায় কখনও? এটা বোঝার মত বুদ্ধিও নাই তোমার মগজে? উলটে আফশোষ করতে লেগেছ! তুমি মুর্খ নয়? 
বাবুর মুখে রা-টি নাই। 
--আর দুই হোল, আমার ফালতু কথা বিশ্বাস করে বসলে? কিন্তু এই একটু আগেই তো তোমাকে আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম, কারও বাজে কথায় কান দেবে না। বলিনি? আরে বাপু, আমি হলাম বনের ছোট্ট একটা পাখি। পোকা-মাকড় ধরে খাই। কোথায় পাব আমি হীরে-মাণিক? তাছাড়া এইটুকুন তো শরীর আমার। তোমার এক হাতের মুঠিতেই ধরা ছিলাম। কোথায় লুকিয়ে রাখব এত সম্পদ?
হাঁ করে চেয়ে রইলেন জমিদার বাবু। কথা জোগাল না মুখে। পাখি আবার বলল—বিশ্বাস না হয়, নিজের চোখেই যাচাই করে নাও। 

ছোট ছোট দুখানা ডানা তার। হাসতে হাসতে ছড়িয়ে দিল দু’দিকে। কিছুই লুকানো নাই কোথাও। কিছুই ঝরে পড়ল না।
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন বাবুটি। পাখি আবার বলল—মনে কষ্ট রেখো না। রাগ কোর না আমার উপর। তোমাকে একটু যাচাই করে নিলাম। দেখে নিলাম, পরামর্শ দুটো মন থেকে মেনেছ কি না। আর, মণিমুক্তোর মিছে কথাটা বলেছি, তোমাকে পরখ করবার জন্য। তোমারও তো উপকার হোল তাতে।
ভারি রাগ রাগ গলায় বাবু বললেন—আমার আবার কী উপকারটা হোল এতে? 

--কেন গো, উপকার হোল না? তুমিও তো চিনতে পারলে নিজেকে। মন খারাপ কোর না। ঘরে ফিরে যাও। পারলে, আমার কথা দুটো মেনে চলো। উপকারই পাবে জীবনে। ছোট বলে হেলাফেলা কোর না কাউকে। কারও পরামর্শ উপেক্ষা কোর না। আর হ্যাঁ, দু’বার বাঁচিয়েছ আমাকে। ধন্যবাদ নিও আমার।
এবার সত্যি সত্যি উড়ে গেল পাখিটা। মুগ্ধ দুটি চোখ মেলে আকাশে চেয়ে রইলেন জমিদার বাবু।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments