জ্বলদর্চি

মাটিমাখা মহাপ্রাণ- পাঁচ /শুভঙ্কর দাস

মাটিমাখা মহাপ্রাণ- পাঁচ 

শুভঙ্কর দাস 

"আজিও যাহারে কেহ নাহি জানে
দেয় নি যে দেখা আজো কোনখানে, 
সেই অভাবিত কল্পনাতীত
আবির্ভাবের লাগি
মহাকাল আছে জাগি"

সূর্য মহাবিশ্বের আঙিনায় নিজস্ব তেজ ও তাপের বিক্রমে মহাধিরাজ হিসেবে বিরাজিত হলেও ঠাকুরদাসের খোলা-খড় দিয়ে নির্মিত গৃহের নিকানো ছোট্ট উঠোনে তার কাজ একটি কল্পনাপ্রবণ বালকের নিজস্ব ঘড়ির মতো কাজ করে চলে...
আলো ও ছায়ার গতি ও পরিবর্তনশীল স্থানকে নিজস্ব বুদ্ধিতে বালকটি ঘড়ির মতো ব্যবহার করে।
আজ মনোরম একটি সকাল।সূর্যের আলো যেই কলাগাছের পাতার দিকে এগোচ্ছে, ততোই বালকটির উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে!  কারণ আজ একটি অভিনব খেলা  সে ভেবে রেখেছে,তারই বাস্তবোচিত রূপদান হবে।
যথারীতি সূর্যালো কলাগাছের সবুজ চিকন পাতাটি ছুঁয়েছে, অমনি বালক শ্লেট-খড়ি চটের ব্যাগে রেখে দৌড়।
লক্ষ্মীদেবী গোয়ালঘর থেকে লক্ষ্য করেছিলেন।তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন,ওরে, দুধের বাটিটি শেষ করে যা বাবা!
কিন্তু অর্ধেক দুধ থাকা বাটিটি বসে রইল...
খোকন খোকন ডাক ছাড়ি/ খোকন গেছে কার বাড়ি?
ঠিক কারও বাড়ি নয়, 
ঠাকুরদাসের গৃহের ঠিক পশ্চাতের দৃশ্যপট মাঠের পর মাঠ,যা দিগন্তকে ছুঁয়ে যায়। মাঠটি যখন ধানে পরিপূর্ণ থাকত,তখন মাটির জানালা দিয়ে কুমার কতদিন ধানখেত পেরিয়ে বহুদূরের বটগাছটি লক্ষ্য করত।প্রবল বৃষ্টিতে সে লক্ষ্য করত,সারা মাঠে কেউ কোথাও নেই, শুধু ধানের পর ধানের সঙ্গে সে বটগাছটি ভিজছে.. অনেকটা কোনো চাদর-জড়ানো বুড়োর মতো!
আবার যখন সূর্য ডুবত, তখন সেই বটগাছের পেছনে সূর্য চলে যেতো,পাতাগুলিকে কেমন আশ্চর্য সুন্দর দেখাত। যেন কোনো সোনার গহনা পরিহিত ঘোমটাপরা বধূ।
সেই থেকে এই বটগাছটির প্রতি কুমারের একটি আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল।
সবকিছুই ছিল যেন দূরে আঁকা কোনো ছবির মতো...
কতবার কুমার হাতের আঙুলকে দূরবীনের মতো গোল করে বটগাছটিকে স্পষ্ট দেখার চেষ্টা করেছে!
এখন মাঠে ধান নেই, মাঠের পর মাঠ ফাঁকা।একটি বাবলা গাছে নিচে এসে দাঁড়াল কুমার। সেখানে দেখা আরও দুটি সমবয়সী ছেলে-মেয়ে আগে থেকে উপস্থিত। ছোলেটি খালি গা একটি কাপড় পরনে। মেয়েটি একটি শাড়ি পরে তার আঁচলকে কোমরে বেঁধে রেখেছে। দুজনের ছিন্ন,গিঁটবাঁধা পোশাক দেখলে পরিষ্কার বোঝা যায়,এই পোশাক ছাড়া তাদের দ্বিতীয় কোনো পরিধেয় নেই! 

এই নে, তোরা আগে খেয়ে নে
বলে কুমার কোমরে বাঁধা গামছার ভেতর থেকে মুড়ি ও পেঁয়াজ বের করে রাখল।
ছেলে-মেয়ে দুটি আনন্দে তাই খেয়ে নিল।তারপর দাঁড়িয়ে পড়ে ছেলেটি বলল,পেটটা ভরল রে,গতরাতে কিছুই খেতে পাইনি! 

ওরে বিপিন,চিন্তা করিস না,আমি ফিরে এসে দারুণ জিনিস খাওয়াব।

দাদা, মোকে!

তোকেও, চুনি, খাওয়াব, এবার চল.. শুরু হোক আমাদের অন্বেষণ...

অননেশন? কী জিনিস দাদা? অবাক হয়ে বলল চুনি।

ওরে বুঝলি না,সেই রামায়ণে আছে,শুনে নে... 

"দিবাকর নিশাকর দীপ্ততারাগণ। 
দিবানিশি করিতেছে তম নিবারণ।
তারা না হরিতে পারে তিমির আমার।
এক সীতা বিহনে সকল অন্ধকার। 
দেখরে লক্ষ্মণ ভাই কর অন্বেষণ। 
সীতারে আনিয়া দেহ বাঁচাও জীবন।"

দেখলি, সেই রামায়ণে কেমন চলছিল সীতা অন্বেষণ,আমরাও যাব,চল,ঐ দিকে...

বলে কুমার হাত তুলে দূরের রৌদ্রমায়াময় বটগাছটি দেখাল।

অ্যাঁ! সীতাকে এখনও বন্দী হয়ে আছে,ঐ বটগাছে বেঁধে রেখেছে,আমার তো কান্না পাচ্ছে বলে চুনি কেঁদে উঠল

দূর বোকা,ওসব সত্যি নয়। আমরা এমনি এমনি অন্বেষণে যাবো..তবে সীতার কথা বললে,মাঠগুলো পেরিয়ে যেতে কোনো কষ্ট মনে হবে না!

সত্যি নয়, এমনি এমনি!  কী যে কও, এই বলো সীতা অননেশন, এই বলো সীতা নেই!  দূর, গিয়ে লাভ নেই! 
বলে চুনি নিজের কাপড় ধরে দৌড়ে পালিয়ে গেল!

কী বললাম,কী বুঝল,হে রাম! হতাশ গলায় বলল কুমার।

ছাড় ওর কথা,আমরা চল, অতি উৎসাহে বলল বিপিন।

চল

দুটি নিতান্ত সরল বালক, জীবনে প্রথমবার গৃহ ছেড়ে দূরের কোনো স্থানে যাচ্ছে... 
কল্পনার সীতা অন্বেষণে...

সময়দেবী সহসা সুতোতে টান দিলেন।দৃশ্য যেন একই পথের পথিক। 
একজন যুবক পরিব্রাজক হাঁটতে হাঁটতে অন্তরে ডাকে অন্বেষণ করতে গেলেন সোনার সীতারে.. যা একদিন তাঁর দেশের জ্ঞান-বিজ্ঞান-গরিমায় ছিল।কিন্তু পরাধীনতা ও দাসত্বের চাপ চাপ অন্ধকার সেসব ধূলিসাৎ করে দেয়,তবে সেই অন্বেষণ লঙ্কায় নয়, আমেরিকায়। শ্রীরামের মতো গুরু তাঁর,শ্রীরামকৃষ্ণ। তাই সেই যুবক যখন পেনিসুলার জাহাজ চড়ে সমুদ্র পার হচ্ছিলেন,তখন এই শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন,'হুপ হুপ' করে পৌঁছে যাবো।অর্থাৎ রামভক্ত হনুমানের মতো...তাঁর গুরুদেব যে স্বয়ং নবরূপে রামচন্দ্র।  
তারপর বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দেশে শ্রেষ্ঠ ধর্মমহাসভায় উপস্থিত হলেন অপমান-অবহেলা-আক্রমণ সবকিছুকে অলংকার করে।
যে সভাটির আয়তন ছিল একটা হাজার সাঁইত্রিশ একর।নাম ছিল কলম্বিয়ান এক্সপোজিসন।তার মধ্যে ধর্মসভাটি হবে শিকাগো আর্ট ইনস্টিটিউটে। এইখানে একের পর এক অধিবেশন বসবে। দুটি শাখা।মূল শাখা ও বিজ্ঞান শাখা। 
মূল শাখার অনুষ্ঠানগুলি হবে কলম্বাস হলে,যার আসন সংখ্যা চার হাজার।
এমন একটি সভায় তিনি নিজে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ও বক্তা বলে পরিচিত হলেন,সেই সভার কোনো আমন্ত্রণপত্র সেই যুবকের ছিল না! কোনো সংস্থা তাঁকে আহ্বান করেননি! ধর্মমহাসভার কোনো ব্যক্তির সুপারিশ ছিল না! সর্বোপরি, ধর্মসভায় অংশগ্রহণ করার তারিখ অনেক আগেই চলে গিয়েছে। 
শেষ পরিমাণ,একটি রেলস্টেশনে প্যাকিং বক্সের ভেতর নিজেকে আমেরিকার প্রচণ্ড শীত থেকে বাঁচানো এবং সেখানেই শুধু ধর্মসভায় যোগদানের জন্য লড়াই নয়, লড়াই করতে হয়েছে ক্ষুধার সঙ্গে।
তারপর সেই সন্ন্যাসী যুবক আলোকিত মঞ্চে উঠলেন এবং একা নয়, সঙ্গে এক সুপ্রাচীন ভারতবর্ষ। সেই যুবক সেখানে অতি বিশ্বাসের সঙ্গে কাগজ না দেখে আন্তরিকতার সঙ্গে উচ্চারণ করলেন," হে আমেরিকাবাসী বোন ও ভায়েরা..

ব্যাস,সময়দেবী সেই সীতা অন্বেষণকারী যুবকের মাথায় সবার অলক্ষ্যে স্বর্ণদ্যুতিময় তাজ পরিয়ে দিলেন।খুঁজে পেলেন সীতা।তা হল মনন শস্যজাত,আত্মবোধ, আত্ম-জিজ্ঞাসা এবং আত্মোন্নতি। এসব মনের মাঠে কর্ষণ করে ঘরে তুলতে হয় কোনো দলাদলি ও দ্বেষ  না করেএবং একে-অপরকে ছোটো না করে।
সেদিন সেই যুবক বললেন," সাম্প্রদায়িকতা,গোঁড়ামি এবং তার ভয়াবহ ফলশ্রুতি ধর্মোন্মত্ততা বহুদিন এই সুন্দর পৃথিবীকে গ্রাস করে রেখেছে। জগতকে তারা হিংসায় পরিপূর্ণ করেছে,মানুষের রক্তে পৃথিবীকে বারবার সিক্ত করেছে এবং জাতির পর জাতি এর ফলে হতাশায় নিমগ্ন হয়েছে... কিন্তু তাদের অন্তিমসময় উপস্থিত। এবং আমি আন্তরিকভাবে আশা করি,এই সম্মেলনের সম্মানে আজ সকালে যে ঘন্টাধ্বনি হল তা যেন সমস্ত ধর্মোণ্মত্ততা, তরবারি অথবা লেখনীর সাহায্যে অনুষ্ঠিত সর্বপ্রকার অত্যাচারের মৃত্যুঘন্টা হয়।"
তুলুম হাততালির মধ্য সবকিছু হারিয়ে যাবে,শুধু জেগে থাকবে সময়দেবী, তিনি একমাত্র এই মরজগতে জাগ্রত। 
আবার সময়সুতোতে টান পড়ল!

একটি অতি প্রাচীন বটগাছ। তার নিচে হাঁপাতে হাঁপাতে বসল কুমার ও বিপিন।চারপাশটা দেখে মুগ্ধ হল।এতো চারিপাশে রোদ,অথচ সেই বটের প্রতিটি ঝুরি বেয়ে যেন শীতল মাদুরে ছায়া নেমে আসছে।কী আরাম!  বটগাছের পেছনে একটি বড় পুকুর। তাতে শালুক ফুটে আছে। মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে আসছে সেখান থেকে। তারা দুজনেই সেই পুকুরের জল আঁচলা করে খেয়ে নিল।
আহ্ যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেলো।

তুই বল না রামায়ণী গান,আমার শুনতে বড় ভালো লাগে, বলল বিপিন

এতটা মাঠ হাঁটতে হাঁটতে বলতে বলতে এলাম তো, তাই একটু জিরিয়ে নিই..

ঐ জায়গাটা ভারি ভালো লাগে

কোনটারে?

ঐ তুই যখন বলিস,"অনাথের নাথ তুমি পতিতপাবন/ দয়া করে মস্তকেতে দেহ শ্রীচরণ "
কী সুন্দর লাগে।আচ্ছা,ঐ 'দেহ' মানে কী রে?

দেহ মানে হল দাও,দাও শ্রীচরণ। ভগবানের শ্রীচরণ কামনা করছে,তাই ঐভাবে বলছে।

কী ভালো,কুমার, তুই আমাকে রামায়ণী গান শেখাবি?

নিশ্চয়, দাঁড়া,ঐ ওটা কিসের শব্দরে?

বিপিন কান খাড়া করে শুনে বলল,এতো ঘন্টাধ্বনির

কিসের ঘন্টা বাজছে রে?

কী জানি? ঐ দ্যাখ,পুকুরের ওদিকে পর পর কয়েকটি খড়ের ঘর।ঐখানে ঘন্টা বাজছে।

চল, দেখি

যদি বকে দেয়,ওখানে গেলে!

দূর,আয় না 

দুজনে হেঁটে পুকুরের পাশ দিয়ে সেই খড়ের চালার কাছে পৌঁছালো।দুজন মেয়ে একটি ছোট চাকা যন্ত্রে সুতো কাটছে।তার কাছে একটা ছোটো পড়ানোর টোল।তার ঘন্টাধ্বনি।

এটা কী করে?জিজ্ঞেস করল কুমার।

ও এই, আমি জানি, হেসে বলল বিপিন।

কী?

একে বলে চরকা, এতে সুতো কাটে,আমার মা কাটতে দেখেছি

চরকা!এরকম জিনিস সে আগে দেখেনি,তারপর যখন জানল,এতেই সুতো কেটে জামা বানানো যায়,তখন কুমার অবাক হয়ে গেল।

গৃহে ফিরে এসে যখন কুমার মার কাছে উপস্থিত,এতটা পথ একেবারে দৌড়ে এসেছে, মাকে জানাতে হবে একটি আশ্চর্য জিনিস কুমার দেখেছে।সে এসে চেঁচিয়ে বলে উঠল, মা, মা,মোদের আজ দারুণ অন্বেষণ হল,একটা দারুণ জিনিস দেখে এসেছি, মাগো.. সেটা দিয়ে সুতো কাটা যায়!

লক্ষ্মীদেবী রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে উঠোনে দাঁড়ালেন।তাকালেন।গোটা পায়ে-হাতে ধুলায় ধূসরিত। মুখে ধুলো।কাচা কাপড়টি মলিন।কুমারের অবস্থা দেখে তিনি অবাক।

কী হলেরে? কাদের ঘরে মজুর খাটছিলি?

রামচন্দ্রের ঘরে মা,বলেই হেসে ফেলল কুমার।

সঙ্গে ওটি কে?

আমার বন্ধু মা,ওর নাম বিপিন,ঐ ডোমপাড়ায় থাকে,ও আমার সঙ্গে গিয়েছিলো সীতা সন্ধানে...

লক্ষ্মীদেবী একটু সদর দরজার দিলে সচকিত হয়ে দেখলেন।কিন্তু মুখে হাসি রেখে বললেন

তা সীতা পাওয়া গেল? 

সীতা নয় মা,সুতো পাওয়া গেলে কতকিছু করা যায়... আমি দেখে এসেছি, এই বিপিনও জানে,জিজ্ঞেস করো... 

তা বিপিন বাড়ি যাবে না?

না মা,ও আজ এখানেই খাবে,ও বাড়ি গেলে খেতে পাবে না,ওর মা ছাড়া কেউ নেই,খুব গরীব।

আবার সদর দরজার কাছে এগিয়ে পেছন ঘুরে বললেন লক্ষ্মীদেবী, তা ওর মা চিন্তা করবে না কুমার? 

না মা, ও খেয়েই চলে যাবে।ওর খুব খিদে পেয়েছে,আমারও,দাঁড়াও দুজনে ডুব দিয়ে এখুনি আসছি...

বলেই দুটি বালক উঠোনের ঝোলানো বাঁশের গামছা নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল! 

সময়দেবী হাসছেন!

সেই সন্ন্যাসীযুবক যিনি মানুষের মধ্যে আলোকিত আত্মাকে খুঁজে পেয়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন,তিনি ফিরে এলেন নিজের দেশে।মহাজয়ের সেই মহান বাণী জীব সেবাই শিবসেবাকে জীবন্ত করে।যিনি জাত-পাতের সংকীর্ণতা ভেঙে এনেছেন মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের শক্তি।সেই শক্তি জাগ্রত করে সুমহৎ কর্ম সম্পাদন করতে তিনি প্রত্যাবর্তন করেছেন।কী বিপুল সংবর্ধনা মহানগরে...  বৃটিশ সরকারের রাজধানীতে সে এক মহা ধুমধাম!

অথচ সময়দেবীর হাতের পর্দা।একটু সরতেই বাসুদেবপুর নামক অজ পাড়াগাঁয়ের পুকুরঘাটে চলছে সালিসিসভা।

একজন বয়স্ক মহিলা।বিধবা।হাতে লাঠি তুলে মারতে উঠেছেন বিপিনকে।মুখ বিকৃত করে ভাসিয়ে দিচ্ছে অমৃতবাণী, অশিষ্টের বাচ্চা, ডোমের পিলে,তোর সাহস হল কীরে এই পুকুরে নামার,সবে ইষ্টদেবতার নাম করে ডুব দিয়েছি,অমনি দেখি সামনে বিপনে, হারামজাদা,জাতধম্ম সব গুলিয়ে দিল... ছুঁয়ে ফেলল, আমার বুকে যেন আগুন ধরে গেছে,মেরেই ফেলব...

কী হল গা বামনি? রাস্তার পাশে একজন কৌতূহলী জিজ্ঞেস করল,ওমন করে মারতে উঠছো কেন?

আর বলো না,এই যে ঠাকুরদাসের পুত্র,বোকার হদ্দ, কোথা থেকে ফিনে ডোমের পোলাকে এনে চান করছে এই পুকুরে, জানে না,এ পুকুরটা কার? মহাবামুন ক্ষিতি বাঁড়ুজ্জের, একদিন যার নামে এক ঘাটে গরু-বাঘ জল খেত!

ছিঃ ছিঃ এরা এ পাড়ায় এলো কী করে?

ঐ ঠাকুরদাসের ব্যাটা এনেছে 

এমন কাজের শাস্তি হওয়া উচিত

এই কথায় উৎসাহ পেয়ে বামনি বুড়ি লাঠি নিয়ে বিপিনকে পিটিয়ে দিলেন।আবার মারতে যেতেই কুমার তার ওপর শুয়ে আড়াল করার চেষ্টা করল।

বেশ লোকজন জমে গেল।গাঁয়ের লোকেরা সব শুনে নানারকম শাস্ত্র ও পুরানকে পুকুরপাড়ে এনে ফেলল।এবং এর ফলে কবে কোন অতীতে কী অঘটন ঘটেছিল,তার ফিরিস্তি কেউ দিল।আবার এক প্রস্থ জমিদার ব্রাহ্মণ ক্ষিতি বাঁড়ুজ্জের তেজের কথা স্মরণ করা হল।এবং একজন মাতব্বর এই জঘন্য কাজের জন্য শেষ পর্যন্ত রায় দিল বামনি বুড়ির অভিযোগ সঠিক।এবং বিপিনকে এর জন্য শাস্তি পেতে হবে। এই প্রখর রৌদ্রে দশটা ইট ওর মাথায় তুলে দাঁড় করিয়ে রাখা হবে।ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে,যতক্ষণ বিপনে মাথা ঘুরে পড়ে যায়!
কুমার কচিকণ্ঠে  প্রতিবাদ করল।সে সেই বামনি বুড়ির পায়ে ধরে ক্ষমা চাইল।বন্ধু বাঁচাতে নিজেই সব দোষ মাথায় নিয়ে শাস্তি চাইল।কিন্তু কেউ কর্ণপাত করল।
এদিকে গৃহে ঠাকুরদাস নেই।কুমারের দাদারা বাড়িতে নেই।ফলে কুমার পক্ষে বলার কেউ ছিল না।
কিন্তু যেই একটা ইট হাত-পা বাঁধা বিপিনের মাথায় তোলা হল,অমনি একটা কাণ্ড হতে লাগল।
কুমার তার পাশে দাঁড়িয়ে নিজেই একটা ইট মাথায় তুলে নিল।মুখে শুধু বলল,ও যদি দোষ করে থাকে,আমিও সমান দোষী।
দুটো উঠল তো,কুমারও আবার একটা ফেলে দিয়ে দুটো মাথায় তুলল।

আরে আরে,এ আবার কী? সেই বামনি চেঁচিয়ে উঠল,তোকে তো শাস্তি দেওয়া হয়নি,তুই কেন এমন করছিস?

কিন্তু কে শোনে কার কথা?
সহসা গাঁয়ের লোকজন একটু সতর্ক হয়ে পড়ল।ভিড়ও পাতলা হয়ে গেল। কারণ দেখা গেল,কুমারের পেছনে লক্ষ্মীদেবী এসে দাঁড়িয়েছেন।
একটি কথা মাত্র উচ্চারণ করেছেন,ছোটো ছোট শিশুদের শাস্তি দিয়ে তাহলে শাস্তের বিধান রক্ষা হচ্ছে হোক,কিন্তু এরপর বড়দেরও পালা আসবে... সেদিন!
বামনি বুড়ি আবার ঝাঁঝিয়ে উঠল,দ্যাখ নক্ষী, তোর ছেলে যা করেছে,তা নিয়ে মুই কিছু বলতে চাইনি,তার মাথায় ইট তুলতে বলিনি,কিন্তু এই সুমুন্দির ব্যাটা,জাতে ডোম,এই হারামজাদা মোর গায়ে ছুঁয়ে দিয়েছে,তার বেলা!

বেলা তো তোমার অনেক গড়িয়েছে ঠাকুরঝি,এখনও তো আলো ফুটলনি, সবের সামনে কী বলব,এই ডোমের ব্যাটা, যখন খেতের আলুটা মুলটা, শাকপাতা তুলে এনে তোমাকে দেয়, তখন তো বেশ খাও,সেই সময় কীরকম জেতের বিচার করো!

ব্যাস!  সব চুপচাপ।

দুপুরের শেষদিকে ঠাকুরদাস গৃহে ঢুকলেন। পুকুরঘাটে গিয়ে জল নিয়ে মুখহাত ধুয়ে এলেন এবং সবকিছু জানলেন।নীরবে ফিরে এসে দেখলেন,কুমার ও বিপিন একসঙ্গে  খাওয়া শেষ হয়ে গেছে।এখন মাদুরে শুয়ে গল্প করছে। পাশে বসে লক্ষ্মীদেবী তেলাকুচা বেটে বাটিতে নিয়ে, বিপিনের ফুলে ওঠা পায়ে লাগিয়ে দিচ্ছেন।
সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরদাসের মনে পড়ল রামায়ণী গান,

"জানকী বলেন রে বিলম্ব কী কারণ।
কোন কার্যে লবকুশ ব্যাজ এতক্ষণ। 
লবকুশ বলে মাতা না জানি বিশেষ। 
মৃগয়া করিয়া রাজা গেল নিজ দেশ।।

এই রাজা কে? শ্রীরামচন্দ্র? পরাধীন দেশ? সেই সন্ন্যাসী যুবক? নাকি আসছে একজন মাটির পৃথিবীর নায়ক,যিনি ধূলার সিংহাসনে বসে মানুষের সাম্রাজ্য তৈরি করবেন?

ক্রমশ....

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments