জ্বলদর্চি

আগডুম রাজ্যে - ২ /অলোক চট্টোপাধ্যায়

আগডুম রাজ্যে - ২ 

অলোক চট্টোপাধ্যায়

-হঠাৎ দেখি সামনে লোকজনের ভিড়ে বেজায় হট্টগোল হচ্ছে। কার নাকি পকেট কাটা গেছে। পকেটমারটা ধরাও পড়েছে। হাটুরে লোকেরা যে পারছে তাকে মারছে। আমি উঁকি মেরে দেখতে গিয়ে বড় মায়া হল। ছোটো ছেলে একটা। তা ওখানে কয়েকজনকে ডেকে বলতে গেলাম, ওরকম না মেরে পুলিশের কাছে জমা করে দিলেই তো হয়। আর যাবে কোথায়? কে একজন ভিড়ের মধ্যেই বলল – এ নিশ্চই দলের লোক। হঠাৎ দেখি আমাকেই সবাই মারতে লেগেছে। কি বিপদ বলুন তো?
-সত্যিই ভীষন বিপদের কথা। দাদু চিন্তিত মুখে বললেন। - তা বাপু তোমারই বা কি দরকার পড়েছিল অজানা অচেনা জায়গায় খামোকা এসব ব্যাপারে নাক গলানোর? এমনিতেই আজকাল লোকেরা চোর পকেটমার পেলে আর পুলিশের অপেক্ষা করেনা। পিটিয়ে মেরেই ফেলে অনেক সময়েই।
-সেটাই তো ভুল হয়ে গিয়েছিল। কাঁচুমাচু মুখে স্বীকার করল নিতাই। - এমনিতেই অতগুলো লোকের মারবার জন্যে মোটে একটা বাচ্চা চোর। আদ্দেক লোক তো তার ধারেকাছে পৌঁছোতেই পারছিল না। তাই মারবার জন্যে আর একটা লোক পাওয়া যেতে লোকেরা বেশ উৎসাহ নিয়ে আমাকে মারতে শুরু করেছিল। তবে আমিও তো পড়ে পড়ে মার খাবার লোক নই। দু একটা কিল ঘুষি গায়ে পড়তেই ভিড় ঠেলে দৌড় লাগালাম। পেছন পেছন লোকগুলোও ধর ধর করে ছুটতে লাগল। অচেনা জায়গা, তাও আমি আন্দাজে এ গলি সে গলির মধ্যে দিয়ে ছুটলাম। পেছনে অন্তত জনা পঞ্চাশেক হাটুরে, বুঝতেই পারছি ধরা পড়লে একটাও হাড়গোড় আস্ত থাকবেনা। এদিকে দমও ফুরিয়ে আসছে ক্রমশ। হঠাৎ একটা গলিতে বাঁক নিয়ে দেখি সামনেই একটা পাঁচিল ঘেরা পোড়ো বাড়ি। পাঁচিলের ওপারে ঘন গাছের জঙ্গল। প্রানের দায়ে খলবলিয়ে পাঁচিল বেয়ে উঠে পড়লাম আর তেড়ে আসা লোকগুলো বাঁকের মুখ অবধি আসার আগেই কোনোদিকে না তাকিয়েই লাফিয়ে পড়লাম ভেতর দিকে।
নিতাই কাকা একটু দম ফেলার জন্যে থামতেই এতক্ষন মুখের সামনে কমিক্স নিয়ে বসে থাকা পাপাই বই টই ফেলে বলল – তারপর? তারপর?
-বোধহয় একটা পুরোনো কুয়ো গোছের কিছু ছিল সেখানে। নিতাইকাকা আবার গল্পের খেই ধরল। - কারণ পাঁচিল থেকে পড়ে ঠিক পায়ে মাটি পেলামনা। কেমন যেন হুশ হুশ করে নিচে তলিয়ে যেতে লাগলাম। তারপর আর আমার কিছু মনে নেই।
-মানে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে। দাদু বললেন। - তা, চোট লাগেনি?
-চোট লেগেছিল কিনা বলতে পারব না। তবে জ্ঞান ফেরার পরে ব্যাথা যন্ত্রণা কিছু টের পাইনি। অবিশ্যি সেসব ভাববার অবস্থাও তখন ছিলনা।
-মানে? দাদুর জিজ্ঞাসা। 
-বলছি। সেখান থেকেই তো সব অদ্ভুত ঘটনাগুলোর শুরু। নিতাইকাকা বলল।
-যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমার মাথার মধ্যে  কেমন যেন একটা ঝিম ঝিম ভাব। সারা শরীরটা ভীষন ভারী লাগছে। অবেলায় খুব ঘুমিয়ে উঠলে যেমনটা লাগে সেরকম অনেকটা। এখানে কি করে এলাম সেটাও ঠিকমত মনে পড়ছিল না। একবার ওঠার চেষ্টা করে শুয়ে পড়লাম আবার। ঘুমিয়েও পড়তাম হয়তো, কিন্তু একটা বিরক্তিকর হাঁকডাকে ঘুমটা কেটে গেল। এতক্ষনে খেয়াল করলাম একটা বিচিত্র চেহারার মানুষ আমার মাথার দিকে দাঁড়িয়ে। পরনে ডোরাকাটা পাজামার মত কিছু আর চৌকো খোপ কাটা ফতুয়ার মত জামা। কোমরে লাল নীল হলুদ রঙের দড়ি বাঁধা। মস্ত চেহারা, তার ওপর বিশাল একজোড়া গোঁফ। হাতে লাঠি। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ধমকে বলল – অ্যাই, খবরদার। ভেবেছো ঘুমের ভান করে পার পেয়ে যাবে? 
ভারি উৎপাত। পাগল টাগল নাকি? চেঁচিয়ে লোক জড়ো করার কথা ভাবতেই মনে পড়ে গেল আমাকেই তো লোকজন মারবার জন্যে খুঁজছে। ভাবছি হঠাৎ লাফিয়ে উঠে আবার দৌড় লাগাব কিনা। কিন্তু উঠে বসতেই লোকটা হাঁই হাঁই করে লাফিয়ে পড়ে আমায় জাপটে ধরল। আমি কোনোমতে ধাক্কা দিয়ে তার হাত ছাড়াবার চেষ্টা করতে মহা বিরক্ত হয়ে বলল – ধরা পড়ে এখন আবার পালাবার চেষ্টা! ভারী বেয়াক্কেলে লোকতো তুমি। আগডুম রাজ্যে চোর দায়ে ধরা পড়ে পালানো অত সোজা নাকি? 
আমি ভারী অবাক হয়ে বললাম – আগডুম রাজ্য? সেটা আবার কি?
লোকটাতো তাই শুনে চটে কাঁই। - আগডুম রাজ্যে ঢুকে সেখানকার সেপাইকেই বলছো ‘সেটা আবার কি!’ আস্পদ্দা তো কম নয়! তুমি তো বড় বেয়াদব লোক। ঠিক আছে, আগে চলো বিচার সভায়, তারপর দেখছি।
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। আগডুম রাজ্যটা আবার কোথা থেকে এল? বিচার সভাটাই বা কি বস্তু? ছিলাম গড় ধুপকুড়ি না চিন্তামনিপুর কোথায় যেন। আর এ লোকটা বলে কিনা আগডুম রাজ্য ! লোকটা নির্ঘাৎ পাগল। জোরসে ধমক লাগাতে যাচ্ছি এমন সময়ে একটা ব্যাপার দেখে আমার তো চক্ষু চড়কগাছ।
বেশ মনে আছে, পাঁচিল টপকে নেমেছিলাম একটা গাছপালা ভরা জঙ্গল মত জায়গায়। সময়টা ছিল বিকেল। এখন দেখছি ধু ধু মাঠের ভেতর একটা পায়ে চলা পথের ধারে আমি বসে আছি। সুর্য্যটা আকাশের একপাশে হেলে আছে বটে কিন্তু রোদ্দুরটার মধ্যে কেমন যেন সকাল সকাল গন্ধ। স্বপ্ন দেখছিনা তো? ভ্যাবাচ্যাকে খেয়ে চোখ টোখ রগড়ে আবার দেখলাম। নাঃ, কোনো ভুল নেই। হাতের ঘড়িটা দেখি চারটে বেজে পঁয়তিরিশ মিনিট হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে।
বেশ বুঝতে পারলাম কোথাও কিছু একটা বড় ধরণের গন্ডগোল হয়ে গেছে। আমি জানি এ পাড়ার অনেকেই আমাকে নিতাই ক্ষ্যাপা বলে- না না পাপাইদাদা তোমাকে বইএর আড়ালে মুখ লুকোতে হবে না। সে যে যা বলে বলুক, খানিকটা হতেও পারে মানছি, কিন্তু আমি সত্যি সত্যি তো আর অতটা পাগল নই। তবু আমার মাথা টাথা কেমন যেন গুলিয়ে যেতে লাগল। এদিকে লোকটা তখন আমার গড়িমসি দেখে দস্তুর মত হাত ধরে টানাটানি শুরু করেছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে আমাকে সেই বিচারসভা না কোথায় যেন না নিয়ে গিয়ে সে কিছুতেই ছাড়বে না।
পুরো ব্যাপারটা লোকটাকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম। সেসব শুনে তো লোকটা হেসেই খুন। - কিসব হিজিবিজি বকছো হে? গড় হুড়মুড়ি, সিদ্ধিনাথপুর ও সব আবার কোন জায়গা? আর গাছপালার জঙ্গল? সে তো রাজ্যের পুবদিকে। এটা তো পশ্চিমদিক, মরুভুমির পাড়া। বলি, পাগল-টাগল নও তো? অবিশ্যি চুরি করে ধরা পড়লে অনেকেই এরকম ভুলভাল বকে।
মোট কথা, সে আমার কোনো কথা শুনতে রাজি নয়। খালি তাড়া লাগায় – চলো চলো, দেরি হয়ে গেলে আবার বিচার সভা ভেঙে যাবে না? তখন রাজামশাই শাস্তি দেবেন কি করে?
অগত্যা যেতেই হল তার সঙ্গে। সেই মেঠো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সমানে তাকে বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগলাম। - আচ্ছা, তুমিই বল, আমি তো চুরিও করিনি কিছু। এভাবে ধরে নিয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? তাছাড়া আমি নেহাৎই গোবেচারা মানুষ, কোত্থেকে কি করে যেন এই জায়গায় এসে পড়েছি।
তাই শুনে লোকটা একটু নরম গলায় বলল – তুমি কি তাহলে এখানকার নও? বাইরে থেকে এসেছো ? মানে বহিরাগত?
-খুব সম্ভবত। আমি আশায় বুক বেঁধে বললাম।
-তাহলে তো আরো মুশকিল। সে খুব দুঃখিত ভাবে ঘাড় নাড়ল। - সব্বাই জানে, যেখানে যা কিছু গন্ডগোল হয় সব কিছু বাইরের লোকেরাই করে। তার শাস্তি আরো কড়া।
চুপসে গিয়ে বললাম – সে আবার কি?
-বুঝলে না? ধর, নকুলতলায় দু দল লোক মারপিট করল, বাড়িঘর ভাঙচুর করল। আর আমরা গিয়ে হাজির হবার আগেই তারা নিজেদের মধ্যে মিটমাট করে ফেলল। আমরা বললাম, তাহলে গোলমালটা করল কারা? তারা তখন বলে দিল অনেকগুলো বাইরের লোক এসে করে গেছে। ব্যাস, ধরো কাকে ধরবে। বাইরের লোক শনাক্ত করা খুব মুশকিল। 
-তবে তোমায় বলে রাখি, বিচার সভায় কক্ষোনো বলে ফেলো না যে তুমি বাইরের লোক। অনেক ঘটনার জন্যে এখন বাইরের লোক খোঁজা হচ্ছে। ঘোঁতলদাঙ্গার বাজারে সেই যে কজন লোক গুঁফোকাঁঠালের ভুতি বিক্কিরি করছিল বলে একটা দোকানে লুটপাট করল, শিক্ষালয়ের বাগানের গাছের ডাল ভেঙে কারা বনভোজনের রান্না করেছিল, ক’দিন আগেই বিচার সভার দরজাতেই কে বা কারা ছিঁচকে পটকা জ্বেলে পালিয়েছিল, সে সবকিছুর জন্যে পেয়াদারা এখন বাইরের লোক খুঁজে বেড়াচ্ছে। দু একটাকে পেলেই হয়। কোনোমতে বিচার সেরেই শুলে চড়িয়ে দেবে হয়ত।
শুলের কথা শুনেই আমার বুক ধড়ফড় করে উঠল। বললাম – না না, আমি কিছুতেই বলব না যে আমি বাইরে থেকে এসেছি। কিন্ত চুরির ব্যাপারটাও তো –
সে ভারি খুশি হয়ে বলল – চুরির শাস্তিটা এমন কিছু তো নয়। ওটুকু তুমি ঠিক সামলে নিতে পারবে। না হয় মেজো কোতোয়ালকে বলে তোমার সাজাটা একটু কম করিয়ে দেব,  কিন্তু খবর্দার বহিরাগত হতে যেওনা। তাছাড়া তোমাকে চোর বলে নিয়ে যাচ্ছি। এখন হঠাৎ যদি ফোড়নদাস ধরে ফেলে যে তুমি বাইরের লোক, এই অবেলায় আমরা আর একটা চোর খুঁজে পাবো কোথায়?
আমি বললাম – অবেলায় আবার চোর খোঁজারই বা এত কি দরকার?
সে বলল – নাঃ, তুমি সত্যিই বাইরের লোক। নাহলে এসব নিয়ম তো সবাই জানে। এ রাজ্যে ইদানীং ভীষন চোরের উপদ্রব বেড়েছিল। তাই প্রধান কোতোয়াল নিয়ম জারি করলেন রোজ সাতাশটা করে চোর ধরে বিচার সভায় জমা করতে হবে। রাজামশাই তাদের শাস্তি দেবেন। তা আজকেও সাতাশজনকেই ধরা হয়েছিল। রাজামশাই বিচার করার সময়ে হঠাৎ ফোড়নদাস তাকে বুঝিয়ে দিল ওদের ভেতর একজন চোর নয়, ডাকাত। কারণ চুরি করার সময়ে তার হাতে একটা লাঠি ছিল। সে লোকটা অবশ্য অনেকবার বোঝাবার চেষ্টা করেছে যে তার পায়ে মচকানোর ব্যাথা আছে বলে সে লাঠি নিয়েই চলাফেরা করে। কিন্তু রাজামশাই শুনলেন না। চোরেদের কাছে বড় জোর গর্ত খোঁড়ার কাঠি থাকতে পারে, লাঠি থাকলেই সে ডাকাত। তাই তো প্রধান কোতোয়াল আমাকে এই রোদ্দুরের ভেতর চোর খুঁজে আনতে পাঠালে।
আমি শুধোলাম – কিন্তু বারবার যে ফোড়নদাসের কথা বলছো, সে কে?
সে ভারি বিরক্ত গলায় বলল – সে হোল মহামন্ত্রির নিজের ছোটো শালা। তার কাজ হল প্রধান কোতোয়ালের কাজের ভুল ধরা। যাতে রাজামশাই বিরক্ত হয়ে প্রধান কোতোয়ালকে বরখাস্ত করে তাকে ঐ পদে বহাল করেন। তার জন্যেই আমরা সবসময়ে তটস্থ হয়ে থাকি। এখন যেমন, সময়মত চোর খুঁজে আনতে না পারলে আমারই একদিনের মাইনে কাটা পড়বে। এ রাজ্যে বড় কড়া নিয়ম। ভ্যাজাল চোর চলবে না। গাঁটকাটা বা ঠগবাজ ধরে চোর বলে চালানো ঘোর বে-আইনি। ওদিকে আবার বেলাও গড়িয়ে যাচ্ছে। তাই আর কাউকে না পেয়ে তোমাকেই –
শুনে আমার মাথার মধ্যে কেমন যেন ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। হাত পা এলিয়ে এল। আমি রাস্তার ওপরেই ধপ করে বসে পড়লাম। 
কিন্তু চোর বলে কথা। তাকে পথে বসিয়ে রাখলে তো সেপাইজির চলবে না। তবে এখন আর আমাকে বকে ধমকে নয়, বরং কিছুটা কাকুতি মিনতি করেই চোর হতে রাজি করিয়ে ফেলল। সেপাইজির সঙ্গে কড়ার হোল, আমি বলব যে আমি চোর, আর তার বদলে সেপাইজি মেজো কোতোয়ালকে বলে আমাকে খুব কম সাজা দেওয়াবে। 
তারপর আবার আমরা রওনা হলাম বিচার সভার দিকে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments