জ্বলদর্চি

আগডুম রাজ্যে ১ /অলোক চট্টোপাধ্যায়

আগডুম রাজ্যে ১ 

 অলোক চট্টোপাধ্যায়

যে কোনো ছুটির দিনের সকালটা বেশ ভাল কাটে ঝিমলির। রোজকার মত সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার তাড়া থাকেনা। স্কুল যাবার হুটোপাটি নেই। হোমটাস্কটা আগের দিন করা থাকলে সকালে পড়তে বসার ব্যাপারটাও সেরকম কিছু থাকেনা। একটু দেরিতে ব্রেকফাস্ট খাওয়া হয় একসঙ্গে সবাই মিলে। সবাই মানে ঝিমলি আর তার দাদা পাপাই, বাবা, মা, দাদু আর ঠাম্মা। এ বাড়ির নিয়ম ছুটির দিন সকালে সবাই একসাথে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসবে। কারো বিশেষ কোনো কাজ না থাকলে দুপুরের খাওয়াটাও একসঙ্গে। এই একসঙ্গে খাওয়ার নিয়মটা নাকি দাদুরও বাবার আমল থেকে চলে আসছে এ বাড়িতে। যাই হোক, নিয়মটা ঝিমলির বেশ পছন্দের।

তবে ছুটির দিনের আসল আকর্ষণটা দাদুর কাছে গল্প শোনার। ঝিমলির দাদু ডাক্তার। সরকারি হাসপাতাল থেকে অবসর নেবার পর বাড়ির বাইরের একটা ঘরে চেম্বার বানিয়ে সকাল সন্ধ্যে রুগী দেখেন। ছুটির দিনগুলো চেম্বার বন্ধ থাকায় ফুল টাইম গল্প শোনা যায় দাদুর কাছে। বিশেষ জরুরী কোনো রুগী না এলে গোটা দিনটাই দাদু কাটান ঝিমলি আর পাপাইএর সঙ্গে গল্প করে। পাপাই অবশ্য এবারে ক্লাস ফাইভে উঠেছে। রাক্ষস খোক্কোশ, রাজপুত্র মন্ত্রীপুত্রের গল্প তার আর পছন্দ হয় না। তার জন্যে আজকাল নানা অ্যাডভেঞ্চারের গল্পও শোনাতে হয় দাদুকে।
মা অবশ্য একটু দেরিতে খেতে বসে। আজকে যেমন, মা রান্নাঘরে লুচি ভাজছে আর হারানদা সেগুলো এনে পাতে পাতে দিয়ে যাচ্ছে। সবকটা ভাজা হলে মা এসে বসবে। ঝিমলি পাপাই এরই মধ্যে খাওয়া প্রায় শেষ করে এনেছে। দাদুর কাছে গল্প শোনার তাড়া আছে। লুচি বেগুন ভাজা শেষ করে সবে ঝিমলি দুধের গ্লাসে একটা চুমুক দিয়েছে, এমন সময়ে হঠাৎ বাইরের থেকে ডাক শোনা গেল –ডাক্তার কাকা, ডাক্তার কাকা আছেন নাকি?
-রবিবার দিনে আবার কোন পেশেন্ট এল? দাদু বললেন। ঝিমলি কিন্তু গলাটা চিনে ফেলেছে। লাফিয়ে উঠে বলল – নিতাই কাকা! পাপাইও আওয়াজটা চিনে ফেলে বলল – যাক, ক্ষ্যাপা নিতাই ফিরে এসেছে তাহলে। এবার বেশ অনেকদিন নিরুদ্দেশ ছিল।
মা ইতিমধ্যে নিজের প্লেট নিয়ে খাবার টেবিলে চলে এসেছে। পাপাইএর দিকে তাকিয়ে একটু ধমকের সুরেই বলল – তোমাকে অনেক দিন বলেছি না, ওকে ক্ষ্যাপা নিতাই বলবে না, নিতাই কাকা বলবে। আর ঝিমলি, দুধটা অত হুড়মুড় করে খাচ্ছো কেন? নিতাই এখন থাকবে । হারান দা, তুমি বাইরের ঘর খুলে নিতাইকে বসতে বল। আমি খেয়ে উঠে ওর জলখাবার পাঠাচ্ছি।
নিতাই কাকাকে শুধু পাপাই কেন, ঝিমলি জানে, পাড়ার অনেকেই ক্ষ্যাপা নিতাই বলে। যদিও দাদু বলেন, আর ঝিমলিও জানে যে নিতাই কাকা ঠিক পাগল নয়। ছেলেবেলায় সে নাকি দিব্যি স্বাভাবিক ছিল। স্কুলে ভাল রেজাল্ট করত, খেলাধুলোতেও নাম ছিল। তাছাড়া গান গাইতে পারত, নাটকে অংশ নিত। মেমারি নাকি বেজায় ভাল ছিল, লম্বা লম্বা ডায়ালগ অনায়াসে মুখস্থ করে ফেলতে পারত। একবার রাস্তায় একটা গাড়ির ধাক্কা খেয়ে মাথায় চোট লেগে কিরকম যেন সব গোলমাল হয়ে যায়। এমনিতে বিশেষ অসুবিধে নেই। ওর দাদা রতনের বেশ চালু মুদির দোকান আছে। তার কাছেই থাকে নিতাই। ওর বৌদি ওকে খুবই স্নেহ করে। যত্ন আত্যিরও অভাব হয়না। নিতাই কাকা এমনিতে কিছু করেনা বটে কিন্তু পাড়ার লোকেদের যে কোনো দরকারে না ডাকলেও এগিয়ে যায়। দাদার মুদি দোকানেও বসে মাঝেমাঝে। গান গায় চমৎকার, এখনো খুব সুরেলা গলা। পাড়ার ছোটোখাটো ফাংশানে ওকে গাইতে দেওয়া হয়। ছোটোছোটো ছেলেমেয়েরাও ওকে খুব পছন্দ করে। ও তাদের সঙ্গে ক্রিকেট বা ফুটবল খেলাতেও নেমে পড়ে মাঝে মাঝে। সব মিলিয়ে এ অঞ্চলের সবাই ওকে ভালবাসে।

এমনিতে সব ঠিকঠাক। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ কি যেন হয়ে যায়। একদিন আচমকা দেখা যায় নিতাই কাকা পাট ভাঙা জামাপ্যান্ট পরে তে-রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে গান ধরেছে – ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা, কিংবা – ধনধান্য পুষ্পে ভরা। অথবা গলা ফাটিয়ে আবৃতি করছে – 
দাঁড়ারে দাঁড়ারে ফিরে দাঁড়ারে যবন, 
দাঁড়াও ক্ষত্রিয়গন। 
যদি ভঙ্গ দাও রণ, 
সবান্ধবে যাবে সবে শমন সদন - - -
 ইত্যাদি। তখন সবাই সতর্ক হয়ে যায়। বাড়ির লোকজন সবাই সাধ্যমত চোখে চোখে রাখে নিতাই কাকাকে। কিন্তু দু-এক দিনের মধ্যেই সবার পাহারার ফাঁক দিয়ে কোথায় যেন উধাও হয়ে যায় সে। প্রথম প্রথম ওর দাদা, তার বন্ধুবান্ধবেরা, পাড়ার লোকেরাও এদিক ওদিক দৌড়োদৌড়ি করে খোঁজখবর করত। পুলিশেও খবর দেওয়া হত। এখন অবশ্য ব্যাপারটা সবার কাছে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ও নিয়ে আর কেউ বিশেষ মাথাও ঘামায় না। শুধু ওর বৌদি বারান্দায় বসে চোখের জল মোছে আর রতন মুদি তার বন্ধু বান্ধবদের কাছে চেঁচামেচি করে রাগ দেখায়, - আসুক এবার ফিরে। ঘাড় ধরে নিয়ে গিয়ে পাগলা হাসপাতালে ভর্তি করে দেব। বুঝবে মজা।

তারপর কিছুদিন অজ্ঞাতবাসের পর, সেটা পনেরো দিনও হতে পারে বা দু আড়াই মাস, আবার একদিন নিতাইকাকা নিজেই ফিরে আসে। তখন তার চেহারা উস্কোখুস্কো, গাল ভর্তি দাড়ি গোঁফ। জট পাকানো চুল, চিরুনির আঁচড় পড়েনি কতদিন। চান-টান না করায় গায়ে ধুলো ময়লার পলেস্তারা। জামা কাপড় সাধারণত ছেঁড়াখোঁড়া, বেহদ্দ নোংরা। কোথায় গিয়েছিল জিগ্যেস করলে আবোল তাবোল বকে। অসম্ভব আজগুবি সব গল্প বলে। বলা বাহুল্য সে সব কেউ মোটেও বিশ্বাস করেনা। শুধু দুজন ছাড়া। ঝিমলি আর তার দাদু। কিছুটা পাপাইও, তবে মুখে মানতে চায় না। কিন্তু গল্প শোনার সময়ে নিতাইকাকার সামনে থেকে নড়ে না। আর সেই জন্যেই নিতাই কাকা ফিরে এসেই ওদের বাড়িতে হাজির হয়। দেরি হলে নাকি ওর অভিজ্ঞতার গল্পগুলো ভুলে টুলে যেতে পারে।

একবার নাকি একটা জঙ্গলের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে ও হারিয়ে গিয়েছিল। সেই জঙ্গলে আবার সত্যিকারের দুজন রাক্ষস রাক্ষসী থাকত। ওকে ধরেও ফেলেছিল তারা। অমাবস্যার দিন খাবে বলে বন্দি করে রেখেছিল। শেষে এক কাঠকুড়ুনি বুড়ি ওকে উদ্ধার করে। পরে অবিশ্যি নিতাইকাকা জানতে পারে সেই বুড়ি আসলে এক ছদ্মবেশি পরি। আর একবার মাছ ধরার ট্রলারে চেপে গভীর সমুদ্রে গিয়ে ভয়ানক বিপদে পড়েছিল। প্রচন্ড ঝড়ে ওদের ট্রলার ডুবে যায়। নিতাইকাকা একটা কাঠের পাটাতন আঁকড়ে তিন রাত্তির জলে ভেসেছিল। ডুবেই মারা যেত, কিন্তু হঠাৎ কোত্থেকে আদ্দেক মাছ বাকিটা মানুষ দুটি অদ্ভুত প্রাণী এসে ওকে উদ্ধার করে রাতের অন্ধকারে তালসারির সমুদ্রতটে পৌঁছে দিয়েছিল। নিতাই কাকা নিরুদ্দেশ থেকে ফিরে এলেই এইসব গল্প শুনতে পায় ঝিমলি। আর বিশ্বাস করুক বা না করুক, পাপাইও।

কাজেই যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি দুধের গেলাস খালি করে একদৌড়ে ঝিমলি হাজির হোল বাইরের ঘরে। পাপাইও এল, তবে ধীরেসুস্থে। যতক্ষন নিতাইকাকার গল্প চলবে ও ততক্ষণ বইএর তাক হাঁটকাবে, একা একা লুডোর চাল দেবে। কানটা পড়ে থাকবে এদিকে, তবে সেটা দেখাবে না। বাইরের ঘরে এসে ঝিমলি দেখে দাদুর রকিং চেয়ারের পাশে একটা বেতের মোড়ায় বসে আছে নিতাইকাকা। একটু যেন রোগা হয়ে গেছে কিন্তু মুখটা বেশ হাসিখুশি। ঝিমলিকে দেখে হাসিটা আরো একটু যেন চওড়া হয়ে গেল।
-কোথায় চলে গিয়েছিলে নিতাইকাকা? জানো না সবাই কত চিন্তা করে? 
-জানি তো। সেই জন্যে তো ফিরেও আসি। একটু ম্রিয়মাণ মুখে নিতাইকাকা বলল। - তাছাড়া সেই সব বেড়ানোর গল্পগুলো তোমাদের বলতেও হবে তো।
-এবারে কোথায় গিয়েছিলে?
-বলব তো। ডাক্তার কাকাকে আসতে দাও –
ঝিমলির দাদু এলেন একটু পরেই। এসেই রুটিন মত নিতাইকাকার হাতের নাড়ি দেখলেন, বুকে স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে কিসব যেন শুনলেন, যন্ত্র দিয়ে প্রেশার মাপলেন। তারপর বেশ সন্তুষ্ট মুখে মাথা নেড়ে বললেন – কলকব্জা সব ঠিকঠাকই আছে মনে হচ্ছে। কবে ফিরলে?
নিতাই লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল – কাল দুপুরে। তারপর চান খাওয়া সেরে টেনে ঘুমিয়েছি। তাই কাল আর আসা হয়নি।
-তা, এবারে এতদিন কাটালে কোথায়?
-সে এক লম্বা গল্প। নিতাইকাকা এবার ছিপি খোলা কোল্ডড্রিঙ্কসএর বোতলের মত ভসভসিয়ে উঠল। - এবারের ঘোরাটা বেশ জব্বর হয়েছে। তবে ভয় ধরে গিয়েছিল ফিরতে পারব কিনা। আপনাদের আশীর্বাদে কোনোক্রমে ফিরেছি।
-তা এতই যদি ভয় তাহলে হুটহাট করে এখানে সেখানে চলেই বা যাও কেন? দাদু একটু ধমকের সুরেই বললেন। ---তোমার দাদা বৌদির কত কষ্ট হয় বোঝোনা? নিতাইকাকার মাথা নিচু। পাপাই অন্যদিকে সোফায় বসে একটা কাগজ ভাঁজ করে আপনমনে এরোপ্লেন বানাচ্ছিল, তাড়াতাড়ি বলল – দাদু ওকে এখন বোকো না। যা যা গল্প ঠিক করে এসেছে সব গুলিয়ে যাবে। তারচেয়ে আগে সেগুলো শুনে নিই। দাদুও হাসি চেপে বললেন – হ্যাঁ হ্যাঁ। আগে বল কোথায় গিয়েছিলে।
-বলছি বলছি। দাদুর প্রশ্নগুলো আপাতত চাপা পড়ায়  নিতাই হাঁপ ছেড়ে অন্য কথা পাড়ল। - ডাক্তারকাকা, আপনি যে আমায় একটা ঘড়ি দিয়েছিলেন, মনে আছে?
দাদু মাঝেমাঝেই ওষুধের কোম্পানি থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া পেন, লেখার প্যাড ইত্যাদি লোকজনদের বিলিয়ে দেন। নিতাইও পায় এটা সেটা। গত বছর আস্ত একটা হাতঘড়ি দিয়েছিলেন তাকে।
-মনে আছে। দাদু গম্ভীর মুখে বললেন। - তা সেটা তো হাতে দেখছিনা। হারিয়েছো নিশ্চয়ই?
নিতাই মাথা টাথা চুলকে আমতা আমতা করে বলল – হারিয়েছি, মানে ঠিক হারাইনি, তবে হারিয়েছিও বলা যায়। আসলে সেটা দিয়েই দিয়েছি একজনকে। মানে না দিয়ে ঠিক উপায়ও ছিল না।
সে আবার কি? দাদুর গলা এখনো গম্ভীর। - খোলসা করে বল।
-সেই নিয়েই তো গল্প। নিতাই জানাল। - সেটা বলতেই তো সকাল সকাল চলে এলাম এখানে। তাড়াতাড়ি কাউকে সবটা বলতে না পারলে খুঁটিনাটিগুলো আবার গুলিয়ে যাবে। তা ঝিমলিদিদি পাপাইদাদা, তোমাদের সকালের পড়াশুনো সব হয়ে গেছে তো? নাহলে সে সব সেরে এসো। আমার তাড়া নেই, বসে থাকব’খন।
গম্ভীর ভাবটা ঝেড়ে ফেলে দাদুও এবারে হেসে ফেললেন। -  না না ওদের এখন পড়া নেই। তোমার গপ্পো শুরু করতে পারো।
আর বলার দরকার ছিলনা। নিতাই সরাসরি ঢুকে পড়ল তার গল্পে।

-সেদিন সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে কেমন যেন একটা ঘোর লেগে গেল। ঐ মাঝেমধ্যে যেমন হয় আরকি। আপনমনে হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন ধর্মতলা পৌঁছে গেছি। দুরপাল্লার বাস ছাড়ছিল, উঠে পড়লাম তারই একটায়। কন্ডাক্টার জিগ্যেস করল – কোথায় যাবে? বললাম – তা তো জানিনা। সে বলল – পাগল নাকি? কি আর বলি, বললাম – অনেকে বলে বটে। সে কি বুঝল কে জানে, আর কিছু বলল না। টিকিটও কাটতে বলল না। বললে একটু অসুবিধেই হত, পকেটে তেমন  পয়সাও  ছিলনা। সে যাই হোক অনেকক্ষন বাস চলার পরে একটা জায়গা দেখে বেশ পছন্দ হয়ে গেল। বাসটা থামতে সেখানে নেমে পড়লাম। বেশ ঘিঞ্জি বাজারের মত একটা জায়গা। গড় ধুড়বুড়ি না বদ্যিনাথপুর কি যেন নাম। তা সেখানে একটা চায়ের দোকানে বসে চা আর ফুলুরি খাচ্ছি, তখনই হল গোলমাল।
নিতাইকাকা দম নেবার জন্যে একটু থেমেছিল। ঝিমলি বলল – কি গোলমাল হল? ও নিতাইকাকা, থামলে কেন? বল না।

(এরপর সামনের মধ্যে মঙ্গলবার) 

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments