জ্বলদর্চি

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি- ৩(ঝাড়গ্রাম রাজবংশের ইতিকথা)/সূর্যকান্ত মাহাতো


জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি- ৩

ঝাড়গ্রাম রাজবংশের ইতিকথা

সূর্যকান্ত মাহাতো

অনেকদিন আগে এক রাজা ছিলেন। রাজার নাম রঘুনাথ মল্লদেব। প্রজাদের খুব প্রিয় রাজা ছিলেন তিনি। কারণ প্রজাদের যেমন ভালবাসতেন, তেমনই তাদের মনোরঞ্জনও করতেন। লেখাপড়াতে নিজে যেমন ছিলেন খুবই উৎসাহী, অন্যদেরকেও তেমন উৎসাহ দিতেন। তিনিই ছিলেন ঝাড়গ্রামের প্রথম এফ. এ. পাশ ব্যক্তি।দানশীলতার জন্য তিনি তো আরও বিখ্যাত ছিলেন। এই রকম একজন গুণী রাজার কীর্তিকলাপও ছিল বেশ অদ্ভুত রকমের। বিশেষত তার শারীরিক শক্তি প্রদর্শনের কথা তো আরোই বেশি কিংবদন্তি হয়ে আছে। রাজসভায় উপস্থিত ব্যক্তিবর্গরা মাঝেমাঝে সে সব চাক্ষুষও করতেন। তো কেমন ছিল সেই শক্তি প্রদর্শন? আসুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক তার শারীরিক সক্ষমতার কয়েকটি পরিচয়। যেমন তিন থেকে চার মণ ওজনের একটা বিরাট শাল কাঠের মুগুরকে হাত দিয়ে তুলে ৫০ থেকে ৬০ রকম কসরত করতে পারতেন। আর তিন চার হাতের উঁচু খেজুর গাছগুলোকে তাদের ডালগুলো পাকিয়ে দড়ির মতো করে ধরে এক টানে উপড়ে ফেলতে পারতেন। শুধু কি তাই! লোহার গরাদগুলোকে বাঁকিয়ে ইচ্ছেমতো বাংলার অক্ষরে পরিণত করতে পারতেন। আর সব থেকে শ্রেষ্ঠ ছিল, নিজের শক্তিশালী বক্ষের উপর আস্ত একটা হস্তী তুলে ধরতে পারতেন। এমনই সব অদ্ভুত অদ্ভুত কৌশল দেখিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করে তুলতেন।

সবাই ভাবলেন, এ আর নতুন কী! রাজাদের এমন সব অলৌকিক কাহিনী তো কতই শুনেছি। যত্তসব আজগুবি গপ্প! আমিও প্রথমে এমনটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু একটা তথ্যসূত্র দেখে আর অবিশ্বাস করতে পারিনি। ১৮৯৭ সালে কাঁথি থেকে প্রকাশিত  "কান্তি" মাসিক পত্রিকা এবং তৎকালীন অন্যান্য পত্র পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়েছিল রাজা রঘুনাথ মল্লদেবের এই সব বীরত্বের কাহিনী। এই রাজা আর কেউ নন, তিনি হলেন ঝাড়গ্রাম মল্ল রাজবংশের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা।

"এক যে ছিল রাজা/বা অনেকদিন আগে এক রাজা ছিল," গল্পের এই প্রথম লাইনটা পড়েনি এমন মানুষ বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেই ছোটবেলা থেকে বড় বেলা এমন কতসব রাজার গল্প যে সবাই পড়েছি তার ইয়ত্তা নেই। তবুও রাজকাহিনী বা রাজার ইতিহাস জানতে মন এখনো কল্পনার রাজপ্রাসাদে ছুটে চলে বারবার। হ্যাঁ, অনেক দিন আগে এই জঙ্গলমহল জুড়ে ছিল একাধিক  রাজশক্তি। এককালে এই জঙ্গলমহলে রাজা ছিল, এবং তাদের রাজত্বও ছিল। আজ সেই রাজাও নেই আর সে রাজত্বও নেই। কেবল  রাজপ্রাসাদগুলো এখনো আছে। তবে কোথাও সশরীরে, আবার কোথাও বা মেরুদন্ড ভাঙ্গা অবস্থায়, কোথাও বা ধ্বংস স্তূপের মাঝে কঙ্কালসার হয়ে। তাই জঙ্গলমহলের ইতিহাসে চোখ ফেরাতে হলে জঙ্গলমহলের রাজ কথাকে এড়িয়ে গেলে অনেকটা ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার মতো হয়ে যাবে। তাই জঙ্গলমহলের রাজবংশের ইতিহাস ও  রাজাদের পরিচয় একটু জেনে নেওয়া ভালো। তাহলে অতীতের আয়নায় জঙ্গলমহলের বর্তমান মুখটিকে আরো ভালো পর্যবেক্ষণ করা যাবে।

জঙ্গলমহলের রাজাদের কথা বলতে গেলে ঝাড়গ্রাম রাজবংশ, নয়াগ্রাম রাজবংশ, জামবনি রাজবংশ, ঝাটিবনি বা শিলদা রাজবংশ, রামগড় ও লালগড় রাজবংশ, বালিয়াবেড়া প্রহরাজবংশ, জামিরাপাল গড়ের জমিদার বংশ এবং গোপীবল্লভপুর এর জমিদার বংশের কথা বলতেই হয়। তবে এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ঝাড়গ্রাম রাজবংশ।

সবার প্রথমে যে রাজার গল্পটি দিয়ে লেখাটি শুরু হয়েছিল সেই রঘুনাথ মল্লদেব ছিলেন ঝাড়গ্রাম রাজবংশের একজন উল্লেখযোগ্য মল্ল রাজা। 

ঝাড়গ্রাম। জঙ্গলমহলের এক অরণ্য সুন্দরী শহর। বিরাট মাপের পরিধি যুক্ত গগনচুম্বী শালগাছগুলো এই শহরের অলংকার। সবুজ খেকো আধুনিক সভ্যতার উগ্র আগ্রাসনকে এবং তার আগ্রাসী হাওয়াকে চপেটাঘাতে দূরে সরিয়ে সর্বক্ষণ যেন পাহারা দিচ্ছে প্রাণের এই শহরকে। তাদের শাখা-প্রশাখার সুশীতল ছায়ায় শহরকে আরো বেশি নির্জন এবং দূষণমুক্ত শান্তির পরিবেশ গড়ে দিয়েছে। এমন অরণ্য সুন্দরী শহরের কোলেই স্বমূর্তিতে বিরাজ করছে দুটি শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান "কুমুদ কুমারি ইনস্টিটিউশন" এবং "রাণী বিনোদমঞ্জরী বালিকা বিদ্যালয়।" এই দুটো বিদ্যালয়ের কথা উঠলেই একজন রাজার কথা স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে। তিনি হলেন রাজা নরসিংহ মল্লদেব। তাঁর অসীম অবদান না থাকলে এই দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েই উঠত না। রাজমাতা অর্থাৎ রাজা নরসিংহ মল্লদেবের মা ছিলেন, কুমুদ কুমারি দেবী। তাঁর নামেই এই বিদ্যালয়ের নামকরণ। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে রাজা নরসিংহ মল্লদেব নিজস্ব জমি ও প্রচুর অর্থ দান করেছিলেন। শুধু তাই নয় মেয়েদের শিক্ষা বিস্তারেও তার অবদান ছিল বিরাট। রাজপত্নী অর্থাৎ রাজার প্রথমা পত্নী রাণী বিনোদ মঞ্জরীর নামেই এই বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। শুধু শিক্ষা নয় খুব সাহিত্যানুরাগীও ছিলেন। তাই সাহিত্য পরিষদের দুর্দিনে বিশিষ্ট লেখকদের বই প্রকাশের জন্য একটি তহবিল গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদকে তিনি তখনকার দিনে দশ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। পরে সেই তহবিল থেকেই "বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী" ও  সজনীকান্ত দাস এর সম্পাদনায় "নবীনচন্দ্র সেনের গ্রন্থ ৫ খণ্ডে" প্রকাশিত হয়েছিল। পরিষদের দুর্দিনে রাজার এই সহযোগিতা ভোলার নয়। তাই কৃতজ্ঞতায় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি হীরেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয় রাজা নরসিংহ মল্ল দেবকে পরিষদের 'বান্ধব" ঘোষণা করে বলেছিলেন, "ভারতে চিরকালই বিদ্যোৎসাহী বিক্রমাদিত্যের ন্যায় নৃপতিবর্গ ও সম্ভ্রান্ত  ভূম্যধিকারীরাই সাহিত্যিক ও সাহিত্যসেবীকে প্রতিপালিত করিয়া আসিতেছেন। ঝাড়গ্রামরাজ আজ সাহিত্যের এই দুর্দিনে মুক্ত হস্তে যে দান করিয়াছেন, সমস্ত বাংলাদেশ কৃতজ্ঞ অন্তরে তাহা চিরকাল স্মরণ রাখিবে।"

এবার  তবে ঝাড়গ্রাম রাজবংশের ইতিহাসের দিকে একটু চোখ ফেরানো যাক। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকের কথা। সময়টা ১৫১৯ সাল। তখন শ্রীচৈতন্যের স্বর্ণযুগ। কৃষ্ণপ্রেম নামে সকলকে করে তুলেছেন মাতোয়ারা। গোটা দেশ শ্রীকৃষ্ণ প্রেমের জোয়ারে ভাসছে। ফতেপুর সিক্রি অঞ্চল থেকে সর্বেশ্বর সিংহ ও তার পরিবার পুণ্যতীর্থ লাভের জন্য পুরীর জগন্নাথ ধামে এসেছিলেন। তারপর প্রত্যাবর্তন করছিলেন জঙ্গলমহলের এই পথ ধরে। চৈতন্যদেবও একসময় যাত্রা করেছিলেন এই জঙ্গলমহল দিয়েই। যাই হোক, ফেরার পথে এই জঙ্গলমহলে সর্বেশ্বর সিংহ বেশ কিছুদিন বিশ্রাম নিয়েছিলেন। তখন এখানকার পরিবেশ তার বেশ মনে ধরে যায়। তারপর এখানকার মল্ল বা মাল অনার্য সর্দার কে যুদ্ধে পরাজিত করে সর্বেশ্বর সিংহ ঝাড়গ্রামের রাজা হয়ে ওঠেন। এবং ঝাড়গ্রাম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। মল্ল বা মাল রাজাকে পরাজিত করার জন্যই তিনি মল্লদেব উপাধি গ্রহণ করেন। পরে পরে বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত মল্ল রাজাদের সঙ্গে ঝাড়গ্রামের মল্ল রাজাদের মধ্যে বৈবাহিক আদান-প্রদানের একটা সম্পর্কও ছিল। সেই সূত্রে ঝাড়গ্রাম মল্ল রাজাদের খ্যাতি ও প্রতিপত্তিও বেশ বৃদ্ধি পেয়েছিল।

আবার  যোগেশ চন্দ্র বসুর মতে, এই ঝাড়গ্রাম রাজ্যটি একসময় নাকি প্রাচীন মল্লভূমি রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। মল্ল রাজাদের আধিপত্য যখন কমে আসছিল তখন ঝাড়গ্রাম এর মত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে এভাবেই মল্ল রাজবংশ গড়ে উঠেছিল। বীর বিক্রম নাকি ঝাড়গ্রাম রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি ছিলেন ক্ষত্রিয় রাজা। এখানকার অনার্য দলপতি কে পরাজিত করেই রাজা হয়ে ওঠেন। ঝাড়গ্রামকে তিনি রাজধানী ঘোষণা করেছিলেন।

আরও একটি মত আছে যে, সর্বেশ্বর সিংহ আর কেউ নন, তিনি হলেন সর্বেশ্বর সিংহ চৌহান। তিনি নাকি মুঘল সম্রাট আকবরের নির্দেশে রাজস্থান থেকে বাংলা জয়ের জন্য এসেছিলেন। তারপর এখানকার অনার্য মল্ল রাজা কে পরাজিত করে ঝাড়গ্রাম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

ঝাড়্গ্রাম রাজ বংশের রাজারা যেমন ছিলেন সাহসী তেমনি ছিলেন দানপরায়ণ মানুষ। তাদের এই দুটি মহৎ গুণের জন্য তারা দুটি উপাধিতে ভূষিত ছিলেন, "রাজা" ও "উগালষন্ডদেব" নামে। এই "উগালষন্ডদেব"কথাটির অর্থ হিসেবে বিনয় ঘোষ বলেছেন, "উগালের বা আলবেষ্টিত(গড় ও প্রাচীর) দুর্গের ষন্ডবিশেষ(Bull of the fort)।"  তার মতে, এখানকার 'পরম পাষন্ড' দের পরাজিত করে যারা রাজা হয়েছিলেন তাতে করে তারা 'উগাল ষন্ডদেব' নামে অভিহিত হবেন এটা বিস্ময়ের কিছু নয়। 

আবার মধুপ দের মতে, নিজ রাজ্যের উগাল বা প্রাচীর সীমার মধ্যে রাজা নিজেকে ষাঁড়ের মতই বলশালী হিসাবে ঘোষণা করে "উগালষন্ডদেব" উপাধি ধারণ করেন।  যেমন সর্বেশ্বর মল্লদেব হলেন "সর্বেশ্বর মল্ল উগালষন্ডদেব।"

তখন নয়াবসান পরগনায় 'উগালষন্ডদেব' নামে একটি হাটও ছিল।  বর্তমানে নয়াগ্রাম থানায় এই নামে একটি গ্রামও আছে। সেখানে 'উগালষন্ডদেব' দেবতা হিসাবে পূজিত হন। 

ঝাড়গ্রামের রাজবংশের মল্ল রাজারা শৈব ও  শাক্ত ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। ঝাড়গ্রাম রাজাদের একমাত্র অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন সাবিত্রী দেবী। এই সাবিত্রী দেবীও  শাক্ত দেবীই ছিলেন। কারণ এই মন্দিরে একাধিক লিঙ্গ মূর্তি রয়েছে। রাজবাড়ীর কাছে এখনকার যে সাবিত্রী মন্দিরটি আছে, সেটি নির্মাণের অনেক আগে থেকেই সাবিত্রী দেবী পূজিত হয়ে আসছেন রাজাদের দ্বারা। সাবিত্রী দেবীর মন্দিরে  চতুর্মুখ বিশিষ্ট একটি লিঙ্গ মূর্তি পাওয়া গেছে। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এর মতে, এ ধরনের লিঙ্গ মূর্তি একমাত্র গুপ্তযুগে পাওয়া যেত। আবার বিনয় ঘোষ এর মতে পাল যুগেও এরকম চতুর্মুখ লিঙ্গ মূর্তি পাওয়া গেছে। তবে ঝাড়গ্রামের চতুর্মুখ লিঙ্গ মূর্তিটি গুপ্ত যুগের হওয়া  অসম্ভব কিছু নয়।

অন্যান্য রাজবংশের মত ঝাড়গ্রাম রাজবংশেও জ্যৈষ্ঠত্বের অধিকার নীতি অনুসরণ করা হত। যেমন রাজার জ্যৈষ্ঠপুত্রকে বলা হত- যুবরাজ, দ্বিতীয় পুত্রকে বলা হত- হিকিম, তৃতীয় পুত্রকে বলা হত- বড় ঠাকুর, চতুর্থ পুত্রকে বলা হত- কুমার, পঞ্চম পুত্রকে বলা হত- মুসারেন, আর অবশিষ্টদের বলা হত বাবু।

ঝাড়গ্রামের রাজারা এমনিতেই দানশীল, প্রজাবৎসল ও বিদ্যোৎসাহী ছিলেন। সেই সঙ্গে বীরত্বেও শ্রেষ্ঠ ছিলেন। ঝাড়গ্রাম উন্নয়নে ও  সমাজসেবামূলক কাজে সব থেকে শ্রেষ্ঠ অবদান রেখে গেছেন রাজা নরসিংহ মল্লদেব। ১৮৭৫ সালের পর দু'বার রাজ্যের ভার 'কোর্ট অফ ওয়ার্ডস' এর হাতে চলে গিয়েছিল। একবার রাজা রঘুনাথ যখন ছোট ও অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন সেই সময়। আর একবার ১৯০৭ সালে। রাজা রঘুনাথ মল্লদেব দেউলিয়া হয়ে পড়েছিলেন বলে। নানা কারণে তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তার ওপর রাজস্ব দানের ৬ লক্ষ টাকা বকেয়া হয়ে পড়েছিল সময়মতো পরিশোধ করতে না পেরে।  টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে, সেই টাকা তিনি ঋণ করে পরিশোধ করেছিলেন। এই  কারণেই রাজা দেউলিয়া হয়ে পড়েছিলেন। ১৯১২ সালে মারা গিয়েছিলেন রাজা রঘুনাথ মল্লদেব। এরপর ১৯১৬ সালে নরসিংহ দেবের পিতা চন্ডীচরণ মল্লদেব মারা যান। নরসিংহ দেব তখন ছোট। রাজ্যের ভার তখনও কোর্ট অফ ওয়ার্ডস এর হাতে। নরসিংহ মল্লদেব মেদিনীপুরে আসেন পড়াশোনার জন্য। নরসিংহ দেবের অভিভাবক হিসাবে মেদিনীপুর কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক দেবেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যকে নিয়োগ করা হয়। এই নিয়োগ করেছিলেন তৎকালীন মেদিনীপুরের কালেক্টর সাহেব। পরে ১৯২৯ সালে সাবালক হয়ে নরসিংহ দেব রাজা হয়ে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং দেবেন্দ্রমোহনকে নিজস্ব ম্যানেজারের দায়িত্বভার অর্পণ করেন। দেবেন্দ্র মোহন কলেজের চাকরি ছেড়ে দায়িত্বের সঙ্গে ম্যানেজারী পদ সামলেছিলেন।

ঝাড়গ্রাম শহরে তখন প্রচুর জলের কষ্ট। তাই জল কষ্ট দূর করতে রাজা নরসিংহ দেব ঝাড়গ্রাম শহরে জলের কল বসিয়েছিলেন। নরসিংহ দেব এর অবদানের কথা বলে শেষ করা যায় না। তার কিছু পরিচয় আগেও দেওয়া হয়েছে। তবে রাজা নরসিংহ দেবের যেমন সুখ্যাতি ছিল, তেমনই কিছু কিছু অখ্যাতিও ছিল। অনেকটা জীবনের ওঠা-পড়া ধর্মের মতোই। রাজার অতিরিক্ত ইংরেজ তোষণ রাজ্যবাসীর কাছে একেবারেই পছন্দ ছিল না। রাজা সেটাকে তেমন একটা পাত্তাও দিত না। তাই ১৯৩৭ এর বিধানসভা নির্বাচনে ইংরেজ সরকার যখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে, এলাকার সবথেকে প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরকে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রার্থী করা হবে। সেই মতো রাজা নরসিংহ দেবকে কংগ্রেস এর বিপক্ষে প্রার্থী করা হয়েছিল। কিন্তু ভোটের সময়  ইংরেজ ও রাজশক্তির সমস্ত শাসানির উপর ঝামা ঘষে দিয়ে কংগ্রেস প্রার্থী কিশোরপতি রায়কে ভোটে জিতিয়েছিলেন ঝাড়গ্রামের প্রজাবৃন্দ। সুতরাং ক্ষমতা ও পদমর্যাদা সবসময় যে শ্রেষ্ঠ হতে পারে না, তারই যেন এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নরসিংহ দেবের এই পরাজয়।

সর্বেশ্বর মল্ল উগালষন্ডদেবের রাজ্য লাভ থেকে শুরু করে ১৯৫৩ সালে শেষ রাজত্ব পর্যন্ত মোট ১৭ জন রাজা ছিলেন। এরা হলেন--
১) রাজা সর্বেশ্বর মল্লদেব
২) রাজা বিক্রম মল্লদেব
৩) রাজা ভীম মল্লদেব
৪) রাজা পৃথ্বীনাথ মল্লদেব
৫) রাজা সংসার মল্লদেব
৬) রাজা ছকু বা চাকু মল্লদেব
৭) রাজা গদাধর মল্লদেব
৮) রাজা শত্রুঘ্ন মল্লদেব
৯) রাজা আনন্দ মল্লদেব
১০) রাজা মানগোবিন্দ মল্লদেব
১১) রাজা বিক্রমজিৎ মল্লদেব
১২) রাজা শ্যামসুন্দর মল্লদেব
১৩) রাজা বিক্রমাদিত্য মল্লদেব
১৪) রাজা নারায়ণ মল্লদেব
১৫) রাজা রঘুনাথ মল্লদেব ( যিনি ঝাড়গ্রামের প্রথম এফ.এ. পাশ ব্যক্তি)
১৬) রাজা চন্ডীচরণ মল্লদেব
১৭) রাজা নরসিংহ মল্লদেব

এছাড়াও পরের কয়েকজন উত্তরাধিকারী হলেন-- বীরেন্দ্র বিজয়, শিবেন্দ্র বিজয়, জয়দীপ, বিক্রমাদিত্য প্রমুখ।

১৯৩১ সালে ঝাড়গ্রামের বর্তমান রাজপ্রাসাদটি গথিক শিল্পরীতিতে রাজা নরসিংহদেব নির্মাণ করেছিলেন। এই রাজবাড়ী বর্তমানে সারা বিশ্বের পর্যটকদের কাছে জঙ্গলমহলের মূল আকর্ষণ বিন্দু। অপূর্ব সৌন্দর্যময় এই রাজপ্রাসাদটিকে দর্শন করার সঙ্গে সঙ্গেই মল্ল রাজবংশের ইতিহাস আপনার রক্তে চলকে উঠবে, এবং আপনাকে শিহরিত করে তুলবে। দর্শনের সময় রোমাঞ্চিত হবেন এই ভেবে, রাজপ্রাসাদের কোনও গোপন স্থান থেকে হয়তো এখনও আপনাকে কোন এক রাজার শাসন ভরা দুটি চোখ যেন অদৃশ্যভাবে লক্ষ্য করছে। আর আপনি মনে মনে তখন বিস্ময় প্রকাশ করবেন, রাজ শক্তি বা ক্ষমতার প্রকাশ ও তাদের আভিজাত্য ভরা জীবনের কথা ভেবে।

 ঝাড়গ্রামের রাজা এবং প্রজাদের সব থেকে বড় উৎসব ছিল ইঁদ উৎসব। এখনও প্রতি বছর এই উৎসব পালিত হয়। ইঁদকুড়ির মাঠে ৪০-৫০ ফুট লম্বা একটি শাল গাছের গুঁড়িকে ডগায় একটি ছাতা বেঁধে উত্তোলন করা হয়। সব প্রস্তুতি সারার পর রাজা আসেন। অনেকটা এখনকার ফিতে কাটার মতো। রাজা এসে গাছের গুঁড়িকে স্পর্শ করা মাত্র চারিদিকে ঢোল ধামসা বেজে উঠত। তারপর সাড়ম্বরে উত্তোলন করা হত সেই গাছের গুঁড়িকে। দড়ি টেনে টেনে পতাকা উত্তোলনের মতোই উত্তোলন করা হত। তারপর নাচে-গানে, আনন্দে-উৎসবে, মদ ও হাঁড়িয়া খেয়ে সেই গাছের গুঁড়ির চারপাশে ঘুরে ঘুরে চলত রাতভর নাচ আর গান। 

যাইহোক অরণ্য সুন্দরী ঝাড়গ্রামের মানুষ এই রাজবংশের রাজাদের থেকে প্রভূত উপকার পেয়ে এসেছেন সেই অতীত কাল থেকেই। তাই এই রাজপরিবারের গৌরবময় ভূমিকা কখনও ভোলার নয়। তা চিরকালই জনমানসে আর ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

তথ্যসূত্র: ১) ঝাড়গ্রাম ইতিহাস ও সংস্কৃতি: লেখক- মধুপ দে
২) মেদিনীপুরের ইতিহাস: লেখক- যোগেশচন্দ্র বসু
৩) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি দ্বিতীয় খন্ড: লেখক বিনয় ঘোষ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments