জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি- ৪
শিলদা রাজবংশ
সূর্যকান্ত মাহাতো
আগে জায়গাটার নাম ছিল ঝাটিবনি। জঙ্গলমহলে এই "ঝাটি" শব্দের অর্থ হিসাবে বনের গাছের সরু সরু ডাল বা শাখা-প্রশাখাকে বোঝায়। জ্বালানির কাজে এগুলো ব্যবহৃত হয় বলে এখানকার বিপুল সংখ্যক আদিবাসী মানুষেরা বন থেকে ঝাটি সংগ্রহ করে বান্ডিল বেঁধে বিক্রি করত। তাই ঝাটিময় গভীর বনভূমির নাম থেকে 'ঝাটিবনি' নাম হয়ে থাকতে পারে (ঝাড়গ্রাম ইতিহাস ও সংস্কৃতি, মধুপ দে)। একসময় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের আদি বাসস্থান ছিল এই 'সাতভূম' বা 'সাঁওন্তভূম' বা সামন্তভুমি। ইংরেজদের লাগাতার শাসন আর শোষণকে ভয় না পেয়ে বরং তাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন এখানকার অধিবাসীরা। চোখে চোখ রেখে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের আগুন ছড়িয়ে ছিল তারা। এই ঝাটিবনি বা পরবর্তী কালে 'শিলদা'ই হয়ে উঠেছিল একসময় সেই বিখ্যাত ঐতিহাসিক চুয়াড় বিদ্রোহের মূল ঘাঁটি। বিদ্রোহের প্রভাব এতটাই ছিল যে, সেই সময় এখানকার রাজা ও রাণীও এই বিদ্রোহে প্রত্যক্ষ ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তারপর এল ২০১০ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির সেই অভিশপ্ত রাত্রি। যেদিন ই. এফ. আর. ক্যাম্পে মাওবাদীদের ভয়ঙ্কর সেই হামলায় ২৪ জন সেনার রক্তে এই বিদ্রোহ ভুমিই হয়ে উঠেছিল বধ্যভূমি। সেদিনের সেই ঘটনা গোটা জঙ্গলমহলের মেরুদন্ডকে একরকম কাঁপিয়ে দিয়ে একটা হিমেল স্রোতের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল। হ্যাঁ। ঠিকই ধরেছেন, এই জঙ্গলমহলে বারংবার সংগঠিত বিদ্রোহের কেন্দ্রভূমি এবং পূণ্যভূমির নাম হল- শিলদা।
ঝাটিবনি বা শিলদা। ঝাড়গ্রামের মল্ল রাজবংশের অদূরেই উত্তর-পশ্চিম ভাগে অবস্থিত এই শিলদা স্থান। জঙ্গলমহলের একাধিক বিদ্রোহের এই চারণভূমিতেও একসময় রাজা ছিলেন, রাজবংশ ছিল। যদিও এখন আর এ দুটির কোনও কিছুই অবশিষ্ট নেই। রাজাও নেই, আর সেই রাজত্বও নেই। পড়ে আছে কেবল রাজপ্রাসাদের অস্তিত্ব স্বরূপ কিছু ক্ষয়ে যাওয়া পুরানো দিনের ইঁট আর ইঁটের দেওয়াল। সেগুলোই রাজবংশের ইতিহাসের শেষ সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিথ্যে অহংকারের হাসি নিয়ে।
শিলদার রাজ-ইতিহাসে যদি চোখ ফেরানো যায়, তাহলে দেখা যায়- এখানে একসময় ডোম জাতির রাজবংশের রাজত্ব ছিল। তারপর পরবর্তী সময়ের রাজা বিজয় সিংহের কোনও এক পূর্বপুরুষ এই ডোমরাজাকে পরাজিত করে শিলদার রাজা হয়ে উঠেছিলেন। রাজা বিজয় সিংহ পরবর্তীকালে রাজা হয়েছিলেন। এবং স্বমহিমায় রাজ্য শাসন করেছিলেন। শিলদা থেকে উত্তরে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত "ওড়গোন্দা" ছিল রাজা বিজয় সিংহের রাজবংশের রাজধানী। সেই রাজবংশের রাজারা ছিলেন শৈব। কারণ রাজপ্রাসাদের বা রাজবংশের কিছু স্মৃতিচিহ্ন, কিছু শিবলিঙ্গ, ষন্ডমূর্তি আজও ধুলোমাখা হয়ে পড়ে আছে গ্রামের মধ্যে। যেমন পাথরের একটি বড় ষন্ডমূর্তি এখনও সেখানে রয়েছে। সেই স্থানের পাশে এখন একটি হরি মন্দির নির্মিত হয়েছে।
তারপর একটা দীর্ঘ সময় কালের করাল গ্রাসে ঢুকে পড়েছে। পরে ৯৩১ বঙ্গাব্দে (১৫২৪ খ্রিস্টাব্দে) মেদিনীমল্ল রায় সুদূর দক্ষিণ প্রদেশ থেকে তার সেনাবাহিনী নিয়ে এসে তৎকালীন রাজা বিজয় সিংহকে পরাজিত করে শিলদা রাজ্য জয়লাভ করেন। (একথা পরবর্তী সময়ে রাজা মানগোবিন্দ মল্লরায় ১৭৮৭ সালের ২রা মার্চ মেদিনীপুর কালেক্টর সাহেবকে তার কিছু প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিলেন।) এরপর ৪১ বছর ধরে তিনি রাজত্ব করেছিলেন। তারপর তার পুত্র মঙ্গলরাজ রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এবং তিনি ৫৭ বছর ধরে রাজ্য শাসন করেছিলেন। মঙ্গলরাজের মৃত্যুর পর রাজ্যের ভার গ্রহণ করেন তাঁর পুত্র গৌরহরি। তিনিও ৬৭ বছর ধরে রাজত্ব করে মৃত্যুবরণ করেন। গৌরহরির তিনজন পুত্র ছিল- বলরাম, হরিশচন্দ্র, ও মানগোবিন্দ। গৌরহরির মৃত্যুর পর যথাক্রমে বলরাম ও হরিশচন্দ্র একে একে বয়জ্যৈষ্ঠ অনুযায়ী রাজা হয়েছিলেন। কিন্তু তারা দুজনেই ছিলেন নিঃসন্তান। তাই তাদের মৃত্যুর পর প্রকৃত রাজা হয়ে উঠেন মানগোবিন্দ মল্লরায়। ইংরেজ শাসনের দশশালা বন্দোবস্তের(১৭৯০) সময় রাজা মানগোবিন্দ শিলদার রাজা ছিলেন। মানগোবিন্দের সাতজন রানী ছিলেন। ১৮০৬ সালে রাজার মৃত্যুর পর তার অন্যতমা রানী 'কিশোরমণি' রাজ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে উঠেন। রাজত্ব করেন ১৮০৬-১৮৪৮ সাল পর্যন্ত। কিন্তু রানী কিশোরমণি নিঃসন্তান ছিলেন। তাই তার বিশ্বস্ত দেওয়ান এর পুত্র শ্রীনাথ চন্দ্রকে তিনি দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
এতদূর পর্যন্ত রাজশাসন ঠিকঠাক চলেছিল। কিন্তু রানী কিশোরমণির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই রাজবংশের পতনের ঘন্টাও বেজে গিয়েছিল। পরে রাজ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে রাজবংশে যে মামলা মোকদ্দমার লড়াই শুরু হয়েছিল, তাতেই রাজ বংশের ঐতিহ্য একরকম শেষ হয়ে গিয়েছিল বলে মনে করা হয়। কীভাবে?
রানী কিশোরমণির মৃত্যুর পর অবধারিতভাবেই পরবর্তী রাজা হওয়ার অধিকার ছিল দত্তক পুত্র হিসেবে শ্রীনাথ চন্দ্রের। কিন্তু দেওয়ানের পুত্র বলে মানতে অস্বীকার করেন মানগোবিন্দের এক জ্ঞাতি জগন্নাথ মল্ল। উত্তরাধিকার নিয়ে দুজনের মধ্যে মোকদ্দমা শুরু হল। শ্রীনাথ চন্দ্র অবশেষে সেই মোকদ্দমায় জয় লাভ করেন। এবং রাজ্যভার অধিকার করেন। কিন্তু তাতেও সমস্যা মিটল না। মানগোবিন্দের অন্য এক স্ত্রীর কন্যার পুত্র মুকুন্দ নারায়ন ফের উত্তরাধিকার নিয়ে মোকদ্দমা রুজু করলেন। তিনি ছিলেন বাঁকুড়া জেলার ফুলকুসমা পরগনার রসপাল গড়ের জমিদার। এবার মোকদ্দমায় তিনি জয়লাভ করলেন। এবং শিলদার অধিকার লাভ করলেন ১৮৫৭ সালে। শুধু তাই নয় শ্রীনাথ চন্দ্রকে এরপর তিনি রাজ্যচ্যুতও করান।তবে মুকুন্দ নারায়ন বেশিদিন ক্ষমতা ভোগ করতে পারেননি। দেনার দায়ে অধিকাংশ জমিদারিই তার হাত থেকে হস্তান্তরিত হয়ে পড়েছিল। তারপর তার পুত্র সুন্দর নারায়ণের হাতে যদিও বা পড়েছিল অবশিষ্ট জমিদারিটুকু, সেটাও অবশেষে নানাভাবে হস্তান্তরিত হয়ে পড়েছিল। শেষে একসময় অবশিষ্টটুকুও চলে যায় মেদিনীপুর জমিদারি কোম্পানির অধিকারে।
বর্তমানে সুন্দর নারায়ণের বংশধরেরা ফুলকুসমার রসপাল গড়ে এবং তার ভাই যজ্ঞেশ্বর নারায়ণের পুত্রেরা শিলদায় বসবাস করেন।
শিলদা রাজ বংশের রাজারা ছিলেন শাক্তধর্মে বিশ্বাসী। শিলদার কিছুটা অদূরেই ওড়গোন্দায় "ভৈরব" থানের প্রাধান্য থাকায় সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। এছাড়াও একটি বিশাল পাথরের তৈরি ষন্ডমূর্তি গ্রামের রাজবাটির ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দেখা যায়। এত বছর পরেও যাকে অবিকৃত এবং জ্যান্ত বলে মনে হয়। যাকে শিবেরই অনুচর বলে মনে করা হয়। রাজবংশের ধর্ম ও কীর্তিকথা নিয়ে শিক্ষক অমরেন্দ্রনাথ মজুমদার তার "ভৈরব-রঙ্কিণী মাহাত্ম্য" নামে এক বইয়ে লিখেছেন---
"শিব ভৈরবের মাটি শিলদা পরগণা।
গ্রামে গ্রামে শিবলিঙ্গ এখানে অর্চনা।।
শৈব রাজা ছিল হেথা প্রাচীন যুগেতে।
তাঁরই কীর্তি এসকল বিশ্বাস মনেতে।।"
অন্যান্য রাজবংশের তুলনায় শিলদার রাজারা একটু ব্যতিক্রমী ছিলেন। তার কারণ হল, কী বীরত্বে, কী দানে- ধ্যানে-দয়ায়, কী প্রজাবাৎসল্যে, কী মহৎ কীর্তিগাথা সবেতেই রাজাদের তুলনায় রাণীমাতারা ছিলেন বেশি শ্রেষ্ঠ। বিশেষ করে রাণী কিশোরমণি-র কথা তো সর্বজন বিদিত। "ভৈরব-রঙ্কিণী মাহাত্ম্য" বইয়ে তার কিছুটা নমুনাও আছে--
"জননী কিশোরমণি ছিলা রাজমাতা।
এ-সামন্তভূমে তাঁর আছে কীর্তিগাথা।।
দেশ রক্ষণে কত শক্তি ছিল তাঁর।
যুদ্ধে কেটেছেন মাথা পাঁচশ ভূঞার।।
এখনও সে কাটা মুণ্ড 'ইঁদকুড়ি' ভূমে।
অস্ত্র সহ কবরস্থ আছে শিলদা গ্রামে।।"
রাণী কিশোরমণি এক সময় চুয়াড় বিদ্রোহে প্রত্যক্ষ ভাবে অংশগ্রহণ করে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর অবদানও অনেক, শিলদা রাজবাড়িতে একটি দেবালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৮২০ সালে। মন্দিরের গায়ে এখনও লেখা আছে- '১৭৪২ শকাব্দ' কথাটি। এখন "শিলদার বাঁধ" নামে পরিচিত যে বড় জলাধারটি সেটিও রাণী কিশোরমণিই প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।
শিলদা অঞ্চলের বিখ্যাত দেবতা হলেন 'ভৈরব' দেবতা। এই দেবতার প্রভাব এতই গভীর যে পুরো শিলদা এলাকাটি 'ভৈরবভূমি' নামেও খ্যাত। যেখানে একটি উঁচু বেদীর উপর ভৈরবদেবের মূর্তি স্থাপিত আছে সেই বিশাল ফাঁকা মাঠটি 'ভৈরবডাঙা' নামে পরিচিত। যোগেশচন্দ্র বসু এই স্থানটি সম্পর্কে বলেছেন, "যে ভগ্ন মঞ্চটির প্রস্তর-স্তূপের উপর ভৈরব আছেন ঐ স্থানের ধ্বংসাবশেষ দেখিলে মনে হয়-- এক সময় সেখানে একটি বৌদ্ধ বিহার ছিল।" এই দেবতার পূজা প্রসঙ্গে বিনয় ঘোষ "পশ্চিমমবঙ্গের সংস্কৃতি"(দ্বিতীয় খন্ড) গ্রন্থে লিখেছেন,"প্রতি বছর জিতাষ্টামী জাগরণের নবমী তিথিতে অকালে কল্পারম্ভ হয়। একপক্ষকাল ধরে দশভুজা দেবীর পূজা হয়ে বিজয়াদশমীর দিন শেষ হয় পূজা। ঐদিন নাকি ভৈরবী রঙ্কিনী দেবী তাঁর স্থান ধলভূমগড়-ঘাটশীলা থেকে ভৈরবভূমি শিলদায় গমন করেন এবং সেখানে ভৈরব-ভৈরবীর মিলন হয়।"
দেবতা ভৈরবের আবার একজন ভৈরবীও আছেন। তিনি শিলদাতে নয়, থাকেন ধলভূমগড়ে। এই ভৈরবীর নাম 'রঙ্কিণী'। জনশ্রুতি বিজয়াদশমীর দিন ভৈরব ও ভৈরবীর মিলন ঘটে। তাই ওই মিলন উৎসবের দিন শিলদার ভৈরবডাঙায় জঙ্গলমহলের সবথেকে বড় আদিবাসীদের উৎসব পালিত হয়। এটি "পাতা বেঁদা" নামেও পরিচিত। (এই পরবের কথা অন্য এক পর্বে আলোচনা করা হবে।)
তথ্যসূত্র: ১) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, দ্বিতীয় খণ্ড: বিনয় ঘোষ
২) মেদিনীপুরের ইতিহাস: যোগেশচন্দ্র বসু
৩) ঝাড়গ্রাম ইতিহাস ও সংস্কৃতি: মধুপ দে
1 Comments
Great
ReplyDelete