জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের রসায়ন বিজ্ঞানী ড. সৌভিক মাইতি এবং এক সত্যিকারের 'ফেলুদা'-২ /পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৫০


মেদিনীপুরের রসায়ন বিজ্ঞানী ড. সৌভিক মাইতি এবং এক সত্যিকারের 'ফেলুদা' ―২

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

'দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায়...' 

বাইরে আকাশে তখন বাঁকা চাঁদ আর ছেঁড়া কালো মেঘের লুকোচুরি খেলা জমে উঠেছে। ঝিঁঝিঁ ডাকে একনাগাড়ে। 'বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বাণ'― ঘুমপাড়ানি গান গাইতে গাইতে কাছে পিঠে কেউ ছেলেকে ঘুম পাড়ায়। তার মৃদুমন্দ সুরেলা কণ্ঠ বাতাস ভেদ করে ঢুকে পড়ে একটেরে মাটির ঘরে। টিনের ছাউনি দেওয়া সে-ঘরের এক কোণে একটি কাঠের চেয়ার আর একটি টেবিল। টেবিলের উপরে ঝিমিয়ে পড়া হ্যারিকেনের টিমটিমে আলো জ্বলে। কেরোসিন তেলে জ্বলে পুড়ে কালো কালি ছেয়ে গেছে কাচ-ফানুসের ভেতর, শীর্ষদেশ। কালচে সে-আলোকে ফ্যাকাসে সাদা পৃষ্ঠায় আঁকচিরা কেটে চলেছেন চেয়ারে বসা প্রৌঢ় গবেষক। পাশের খাটে তাঁর বছর সাত-আটের কৌতূহলী ছেলে। অত্যন্ত মেধাবী। তীক্ষ্ম বুদ্ধির অধিকারী। একমনে নিজের পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত। একনিষ্ঠ মেধাবী ছাত্র সে। তার কচি দু'চোখে খালি অপার বিস্ময়! দিন দিন কী এত লিখে যাচ্ছে তার বাবা! কখনও কোনও প্রশ্ন করে না। মাঝে মাঝে শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আর বুঝবার চেষ্টা করে যায়― বাবার এত পড়াশুনার কী দরকার?

একদিনের ঘটনা। টেবিলের পাশে রুগ্ন আলোয় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাবার লেখা পর্যবেক্ষণ করে সৌভিক। মাথামুন্ডু কিছুই বোঝে না। ছেলেকে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খাতা থেকে মুখ তুলে চাইলেন সুকুমার বাবু। ছেলের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলেন
―কেন দাঁড়িয়ে আছিস রে?
―তুমি এত কী লিখছ বলত? ছাত্রদের দেবে?
―না রে। গবেষণা প্রবন্ধ লিখছি। 
―গবেষণা প্রবন্ধ! সেটা কী জিনিস? ছেলের সোজাসাপ্টা জিজ্ঞাস্য।
―এখন বুঝতে পারবি না। আরও একটু বড় হলে ঠিক বুঝবি। এম. এ. কিংবা এম. এস. সি. পাস করার পর নতুন কিছু আবিষ্কার করে লিখে বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিলে ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়। একেই বলে রিসার্চ বা গবেষণা।  এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে বেশ কিছুক্ষণ ছেলের মুখের'পর তাকিয়ে থাকে প্রৌঢ়। এতক্ষণে যেন মনের মত উত্তর মিলল সৌভিক-এর; তার মুখমণ্ডলের ভূগোলে তৃপ্তির ছাপ স্পষ্ট। এবার ধীরে ধীরে নিজের পড়ার জায়গায় ফিরে বসে পড়ে সে। গবেষক পিতার মন দোদুল্যমান― ছেলেটার অজানাকে জানার তীব্র কৌতূহল। ওর মধ্যে নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কারের নেশা ঢুকিয়ে দিলে কেমন হয়? শিশু কাল থেকে এর প্রস্তুতি, যত্ন নেওয়া দরকার। 

     

এ হেন ছেলের নিত্য নতুন জিনিস আবিষ্কারের নেশা বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। ছেলের তখন ক্লাস ফাইভ কী সিক্স! একদিন হোম টাস্ক দিয়ে বসলেন সুকুমার বাবু। ছেলেকে পরখ করে দেখে নেওয়াই লক্ষ্য। 
―তুই তোর নিজের ভাবনার মতন করে গুছিয়ে একটা লেখা আমায় লিখে দে তো। কেমন হয় দেখব― বাবার আপাত ভাবলেসহীন-মার্কা অর্ডার।
―আচ্ছা। মুখচোরা ছেলের ছোট্ট জবাব।
বিষয় বাছাইয়ের বালাই নেই। সময়ের কড়াকড়ি বাহুল্য মাত্র। তবুও দু-একদিন বাদের ঘটনা। সুন্দর হস্তাক্ষর সমেত এক পাতার একটি প্রবন্ধ লিখে সে বাড়িয়ে ধরল বাবার সম্মুখে। সাদা কাগজে শিরোনাম লেখা 'অন্বেষণ'। ভ্রু কোচকালেন বাবা। অন্বেষণ! কীসের অন্বেষণ? আস্তে আস্তে বিষয়ের গভীরে ঢুকে পড়লেন তিনি। ব্যাস! ইউরেকা! ক্ষণিকের মধ্যে তাঁর মুখের বলিরেখা চিহ্নিত অংশগুলি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। গালের নরম মাংসপেশিতে খুশির ঝিলিক। মুখমণ্ডলে মৃদু হাসির আভা। এখন বেশ নিশ্চিন্ত লাগছে। পরিতৃপ্ত তিনি। যাক, বিষয় বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বেশ মুন্সিয়ানার পরিচয় রেখেছে ছেলে। ছেলেবেলায় দূরন্ত নরেন, যখন বিবেকানন্দ হননি; তখন কেমন করে ভগবানকে খুঁজতেন তিনি, 'ধ্যান ধ্যান' খেলা খেলতেন―তা জানবার বড্ড কৌতূহল ছোট্ট সৌভিক-এর। এ হেন মৌলিক বিষয় নিয়ে কিশোর বয়সে তার লেখা প্রথম প্রবন্ধ 'অন্বেষণ'। বিষয় নির্বাচনে যেমন মৌলিকত্ব আছে, লেখার হাতটা তেমনি পক্ক। যারপরনাই খুশি সুকুমার বাবু। আনন্দিতও। তমলুক-এর একটি কিশোর পত্রিকা 'ঝিকিমিকি'। উদীয়মান গ্রাম্য কিশোর-কিশোরীদের আত্মপ্রকাশের পীঠস্থান। গর্বিত পিতা লেখাটি সে-পত্রিকা অফিসে দিলেন পাঠিয়ে। পত্রিকায় লেখা ছাপিয়েই শুধু ক্ষান্ত হননি তিনি। প্রকাশিত পত্রিকার একটি কপি তিনি পাঠালেন রবীন্দ্র পুরস্কার বিজয়ী সাহিত্যিক ড. অমলেন্দু মিত্র মশায়ের নিকট। কিশোর সৌভিক-এর আর্টিকেল পড়ে ড. মিত্র-এর অকপট স্বীকারোক্তি―
'এ যে দেখছি একদিন ওর বাপকে ছাড়িয়ে যাবে।'

মৌলিক সৃষ্টির প্রতি এ নেশা তৈরির মূল কারিগর একান্তই তাঁর মা গীতা দেবী। অল্প বয়স থেকে ক্রিয়েটিভ রচনাকর্মের প্রতি ছেলের অমোঘ এই টান বাড়িয়ে দিতে তিনি সদা সচেষ্ট ছিলেন। লোকাল প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা হোক কিংবা কবিতা আবৃত্তি; সবেতেই মায়ের তীক্ষ্ম নজর। বিষয় নির্বাচনে স্বতন্ত্র। শিশুবেলা থেকে আবৃত্তি কম্পিটিশন জিতে প্রচুর পুরস্কার পেত সে আর তার দিদি পাপিয়া। এলাকায় ভাই-বোনের খুব সুনাম ছড়িয়ে পড়ে সেসময়। পড়াশুনাতে সমান পারদর্শী সৌভিক। হাতে ধরে ভূগোলে ম্যাপ আঁকা হোক অথবা বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলি বোঝানো― সবেতেই মা অনুপ্রাণিত করত। আর অত্যন্ত মেধাবী ছেলে সে-পাঠ সহজেই করায়ত্ত করে ফেলত অনায়াসে।

(২)
সপ্তাহে বেশির ভাগ দিন রামচন্দ্রপুর রাইসুদ্দিন হাইস্কুলের মাটির তৈরি হোস্টেল ঘরে গবেষণা-প্রবন্ধ লেখালেখিতে দিন কাটে সুকুমার বাবুর। কী হোস্টেল, কী বাড়ি― একবিন্দু বিশ্রামের অবকাশ নেই। কাজ পাগল ব্যতিক্রমী এক শিক্ষক। সাংসারিক টানাপোড়েন চলে। সারাক্ষণ ব্যস্ততা। একদিনের ঘটনা। স্ত্রী'র মুখের উপর বলেই ফেললেন শেষমেশ―
'প্রতিদিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আমি সংসারের। রাতের খাওয়া পর্যন্ত বাকি সময়টা একান্তই আমার ব্যক্তিগত। নিজের লেখাপড়ার জন্য।'
সাতপাঁচ না-ভেবেই কথাগুলো বলেছিলেন সুকুমার বাবু। সামান্য ক্ষুন্ন গীতা দেবী। ছেলে-মেয়েরা স্কুলে ভর্তি হয়েছে। তাদের মানুষ করতে গিয়ে নাজেহাল দশা তাঁর। সংসার সামলে দশদিক দেখাশুনা চাট্টিখানি কথা নয়! দৈনন্দিন যাবতীয় কাজ শেষে সন্তানের লেখাপড়া তদারকি নিয়ম করে করেন সকাল-সন্ধ্যে। কোনও অজুহাত নয়। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা রোজকার একই রুটিন। শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরে রাখেন তিনি। অসম্ভব তাঁর মনের জোর। প্রাইভেট টিউটোরিয়ালের রমরমা তখন ছিল না। গেরস্থালির কাজ শেষ করে ছেলে মেয়েদের পড়াতে বসেন তিনি। এ হেন মায়ের কাছেই ছোট্ট সৌভিক-এর লেখাপড়ায় হাতেখড়ি। যত্ন সহকারে মা অ-আ-ক-খ পাঠ শেখায়। মায়ের মুখে শুনে শুনে অর্ধেক পাঠ মুখস্থ হয়ে যায় সৌভিক-এর। বুদ্ধিমান ছেলে এক চান্সে আয়ত্ত করে ফেলে সব। 

১৯৭৭ সাল। সৌভিক-এর বয়স তখন মাত্র ছয় বছর। গ্রামের মধ্যে বাড়ির কাছাকাছি প্রাথমিক বিদ্যালয় তিলখোজা প্রাইমারি স্কুল। প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে যায় সে। পড়াশুনায় খুব আগ্রহ। দিনরাত বাবাকে চোখের সামনে পড়াশুনায় ব্যস্ত থাকতে দেখে সে। নতুন উদ্যমে জোর কদমে চলে তার লেখাপড়া। তাল কাটল পরের বছর। স্কুলের পাঠ সাময়িকভাবে ছিন্ন হল। কারণ আটাত্তরের বন্যা। ময়নার ভূমি অঞ্চল বেশ নিচু। এলাকার চারপাশ দিয়ে বেড়ার মত ময়না ঘিরে বয়ে গেছে কাঁসাই, ক্ষীরাই আর চন্ড্যা নদী। নদী সংলগ্ন নীচু ভূমি রূপ হওয়ার জন্য প্রতি বর্ষায় কিংবা অতিবৃষ্টিতে জলমগ্ন হয়ে পড়ে ময়না। 

সেদিনটা ছিল ৫-ই সেপ্টেম্বর ১৯৭৮ সাল। শিক্ষক দিবসের পুণ্য দিন। সেদিন সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। কালো মেঘে ঢাকা। যে কোনও সময় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উল্টো ঘটনা ঘটল। বাংলার বুকে আছড়ে পড়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়। তার সঙ্গে যোগ হল অনর্গল বৃষ্টিপাত। মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টি। দুপুর থেকে বিকেল, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত যত বাড়ে; বৃষ্টির ধারা তত বেড়ে চলে। থামার নামগন্ধ নেই। ময়নার মানুষের শিয়রে সংক্রান্তি। বিপদের আঁচ গোনে সবাই। এভাবে চললে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হবে। একটানা বৃষ্টিতে যে হারে জল বাড়ছে; ভোর হতে না হতেই চারিদিক জলমগ্ন! সে মূহুর্তে ময়না এক মহাসমুদ্র আর গ্রামগুলি যেন এক একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। জলভাসি দ্বীপগুলির সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম তখন কাঠের নৌকা কিংবা সস্তার কলার মান্দাস। অতি বর্ষণে একটিও মাটির বাড়ি আর আস্ত দাঁড়িয়ে নেই। হয় ধসে পড়ে মাটিতে মিশে গেছে নতুবা জলের তলায় অন্তর্হিত হয়েছে। লণ্ডভণ্ড অবস্থা। গাছপালা ভূপাতিত। বেশির ভাগ গবাদি পশু মৃত। দিনের আলো থাকতে মানুষ রওনা দেয় নিরাপদ আশ্রয়ে। গোদের উপর বিষফোঁড়া― নদী বাঁধ ভাঙল বলে। গ্রামের মহিলারা একযোগে জোর শঙ্খধ্বণী করে চলেছে। একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। থামার নামগন্ধ নেই। পোটলা পুঁটলি বেঁধে, বুক সমান জলের ভিতর দিয়ে সাঁতরে বেশির ভাগ লোক নদী বাঁধ অভিমুখে ছুটে চলেছে। জল বাড়ছে। যেখানে যেটুকু ডাঙা ডুবতে বাকি ছিল, তাও আর আস্ত থাকবে না হয়তো। দু-একদিনে সব জলের তলায় চলে যাবে।
       

দিন দুই-তিন এমন অচলাবস্থা চলে। বৃষ্টি থেমেছে, কিন্তু জলের স্তর বাড়ছে হু হু করে। ঢের হয়েছে। আর নাহ! ছিন্ন ভিটাবাড়িতে থাকা নিরাপদ ঠেকছে না। যেকোনও সময় ডুবে যাবে। পরিবার সমেত বেরিয়ে পড়লেন সুকুমার বাবু। নৌকায় চেপে নদী পেরিয়ে, ময়না পেরিয়ে পাকা রাস্তা। সেখান থেকে বাস ধরে সোজা তমলুক। বন্যার ভয়াবহ আকার প্রত্যক্ষ করে এগিয়ে এল তমলুকের হ্যামিল্টন স্কুল। ঐতিহ্যবাহী স্কুলবাড়িটি এখন বন্যার্তদের নিরাপদ আশ্রয়ের স্থান। এ হেন স্কুলে সদ্য আংশিক সময়ের জন্য শিক্ষকতা করছেন সুকুমার বাবু। সপ্তাহে দু'দিন সকালে বাংলা পড়াতে আসেন এখানে। হ্যামিল্টন স্কুল ছুটির পর বাকি সময় রামচন্দ্রপুর হাইস্কুলের জন্য বরাদ্দ। হ্যামিল্টন স্কুলে শিক্ষকতার সূত্রে স্কুল পরিচালক সমিতির পরিচিত তিনি। হেডমাস্টারের বিশেষ স্নেহভাজন সুকুমার বাবু। সেজন্য মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলল স্কুলের হোস্টেলে। সাকুল্যে দুটি কক্ষ। সারা হোস্টেলে সর্বসাকুল্যে তারা পাঁচটি প্রাণী। আর কোনও জনপ্রাণী নেই। সে-রুমে গড়ে উঠেছে তাদের অস্থায়ী সংসার। এত সমস্যার মধ্যেও পড়াশুনায় খামতি নেই সৌভিক-এর। হোস্টেলের ছোট রুমে মন দিয়ে চলছে স্টাডি। ঘুমানোর সময় হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় স্কুলের বন্ধু কথা। কত নতুন নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে সে। স্কুলের টিউবওয়েলে বন্ধুদের নিত্য দিন লম্বা লাইন। খাওয়ার জলের কাড়াকাড়ি, ঝগড়াঝাটি। সে সব দৃশ্য কচি বয়সের সৌভিকের মনে গভীর দাগ কেটে যায়। বন্যা পীড়িত মানুষের কষ্টে তার কোমল মন কেঁদে ওঠে। পাড়ার খেলার বন্ধু, নিজের বাড়ি, ধানক্ষেত, ডোবা-পুকুর, নারকেল গাছ সবকিছু মনে পড়ে যায়। মনখারাপের আকাশ আবার এক পশলা বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়। এমনিতে কম কথা বলা তার স্বভাব। মুখচোরা সে-ছেলের স্মৃতির পাতায় কখন যে একটা বেদনার গাঙচিল কিংবা পানকৌড়ি ডুব দিয়ে ওঠে, তা ঠাহর করতে পারে না কেউ। দু-এক পশলা মনখারাপের বৃষ্টিতে তখন অজান্তে জলে-ডোবা-তিলখোজার ছবি ভেসে উঠে নিমেষে মিলিয়ে যায় অন্ধকারে।

(৩)
দুই মাস কেটে গেল। পুজোর মরসুম শেষ। ধীরে ধীরে জল নামছে তিলখোজা'য়―খবর পাওয়া গেল। এইবার ফিরতে হবে দেশের বাড়ি। ধরতে হবে হাল। চাষ জমি আর ভিটেমাটির বেহাল দশা সারিয়ে তুলতে অনেক ঘাম ফেলতে হবে। তাছাড়া, যে রামচন্দ্রপুর রাইসুদ্দিন হাইস্কুলের নীচতলা পুরো জলে ডুবে ছিল এতদিন, সে-জল আর নেই। নেমে গেছে ঘোলা জল। এবার স্কুল খোলার সময় হয়েছে। সুকুমার বাবু মনস্থির করলেন বাড়ি ফিরবেন। মাস দুয়েক তমলুকে কাটিয়ে পরিবারের সঙ্গে ছোট্ট সৌভিকও ফিরে আসে তিলখোজায়। 

যতদূর দৃষ্টি যায়, খাঁ খাঁ করছে চারদিক। বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ হৃদয়ে ছুরির মত বিঁধছে যেন। কিছু দিন আগে পর্যন্ত নদী বাঁধের দুপাশে খোলা আকাশের নিচে শত শত অস্থায়ী ছাউনি ছিল। ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। একদল কচিকাঁচা মনের সুখে খেলা করত বাঁধের উপরে ফাঁকা জায়গায়। তাদের হাতে, পায়ে, গোটা গা'য়ে কাদা লেগে থাকত। শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত মাটির সে-প্রলেপ। কোনও দিকে ভ্রুক্ষেপ থাকত না তাদের। বন্ধুদের সঙ্গে খুনসুটিতে মত্ত হত সকলে। বয়ষ্কদের কেমন চিন্তিত মুখ! কীভাবে বিঁড়ির ধোঁয়ায় ফেলে-আসা ভিটেমাটির কথা, জীবনের কথা উদাসী দৃষ্টিতে আউড়ে যায় তারা! এখন সবাই গ্রামের ভেতরে ঢুকে গেছে। মাথা গোঁজার বাড়ি সারিয়ে তুলতে ব্যস্ত। 
         
ফেরার পথে যখন নদীবাঁধ ধরে হেঁটে বাড়ির দিকে চলেছে সৌভিক আর বাড়ির সকলে, বাঁধের এঁটেল নরম পলিমাটিতে পায়ের ছাপ পড়ে গর্ত হয়ে যায়। এমন কত শত পায়ের দাগ মিশে আছে ভালোবাসার এ মাটিতে, তার ইয়ত্তা নেই। সে-দাগ সহজে মুছে যাবার নয়। সভ্যতা যতই আধুনিক হোক না কেন, যত দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াই আমরা, মাটির সে-টান ভুলতে পারে না কেউ। ভোলা যায় না কখনও। অবশেষে, নিজেদের ভিটেমাটিতে এসে পৌঁছয় সকলে। এ কী দশা! সকলের চক্ষু চড়কগাছ! এখনও কোথাও কোথাও হাটু সমান জল। রাস্তা গেছে ভেসে। এক হাঁটু কাদা পেরিয়ে এসে তারা দেখে মাটির দেওয়াল ধসে মাটিতে মিশে গেছে। টিনের চালা কাদায় গড়াগড়ি খায় অবলীলায়। মাথার উপর কোনও ক্রমে ঠাঁই গুঁজে পুনরায় দৈনন্দিন জীবন শুরু করার স্বপ্ন দেখেন গীতা দেবী। এ কঠিন সংগ্রাম! বেঁচে থাকার অসম লড়াই। আপাতত সে লড়াই জিতে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় ফেরাই সংকল্প। তারপর সময় এগিয়ে যায়। ছোট্ট সৌভিক কৈশোরে পা রাখে। ওয়ান-টু-থ্রি-ফোর পেরিয়ে এখন সে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। ভর্তি হয়েছে তিলখোজা গ্রামের বৈকুন্ঠ বিদ্যায়তনে। বাংলা-ইংরেজি-গণিত-বিজ্ঞান-ইতিহাস-ভূগোল মন দিয়ে পড়াশোনা করে। রেজাল্ট ভালো। ক্লাসে সবার মধ্যে প্রথম। প্রথম হওয়া অভ্যাসে পরিনত করে ফেলেছে সে। অনায়াসে মাস্টার মশায়দের সমীহ আদায় করে নিয়েছে তার পরীক্ষার ফলাফল। স্যাররা খুব স্নেহ করেন। 

১৯৮৪ সাল। আষাঢ়-শ্রাবণের ভরা বর্ষা। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে সৌভিক। আরও একবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাড়া করে বেড়ায় কিশোর সৌভিক-এর ছেলেবেলা। সে বছর এক শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে বাংলায়। সেই সঙ্গে ভারী বর্ষণ। এ দুয়ের দানবিক তাণ্ডবে আবারও লণ্ডভণ্ড ময়না। বন্যা কবলিত তিলখোজা। আবার গৃহত্যাগ কিশোরের। এবার খড়গপুরে মামা বাড়িতে মাসাধিক কাল ব্যয় পুরো ফ্যামিলির। মাতুলালয়ে অযাচিত ছুটি কাটানোর এই অভিজ্ঞতা বেশ আরামদায়ক। মামাদাদু ছিলেন খুব গুণী মানুষ। বেশ কিছু বিষয়ে ডিসটিঙ্কসন নিয়ে গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন। ছোট্ট সৌভিক-এর প্রতিভা তিনি প্রথম লক্ষ্য করেন। রোজ সকালে তিনি চার-পাঁচটি অঙ্ক কষতে দিতেন নাতিকে। সময় বরাদ্দ ছিল তিরিশ মিনিট। আধঘণ্টা পরে ফিরে এসে তিনি দেখেন অনেক আগেই সৌভিক অঙ্কের সমাধান করে ফেলেছে। খুব অবাক হতেন দাদু। 

দু-দুটি অতিশয় বন্যা কিশোর সৌভিক-এর পড়াশুনায় সামান্য প্রভাব ফেললেও জলে ডোবা ময়নার চিরন্তন যে ছবি তার স্মৃতিপটে আজীবন গাঁথা হয়ে থাকল, আজও তাড়া করে বেড়ায় ছোটবেলার সেই স্মৃতি। 
       

পরের বছর, ১৯৮৫ সালে, সৌভিক-এর ক্লাস নাইন। বাবা ঠিক করলেন ভেমুয়া অটলবিহারী হাইস্কুলে ভর্তি করবেন ছেলেকে। যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। বাড়ি থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে, বাবা-মা'র স্নেহাঞ্চলের বাইরে পিংলা থানার ভেমুয়া'য় চলে আসে সৌভিক। টিনের ট্যাংক সাইকেলে বসিয়ে পাড়ি দেয় সে, বাবার সঙ্গে। ভেমুয়া হাইস্কুলের রেজাল্ট তখন আকাশছোঁয়া। একশো শতাংশ পাশের হার মাধ্যমিকে। প্রতি বছর যত স্টুডেন্ট পাশ করে, স্টার মার্কস পায় আশি শতাংশ ছাত্র। ভেমুয়া হাইস্কুলের নামডাক তখন মেদিনীপুর জেলার চৌহদ্দি ছাড়িয়ে কলকাতাসহ দুই চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলি বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়েছিল। লোকালয় বর্জিত নির্জন সে-স্কুলে বাইরের মেধাবী ছেলেমেয়েরা বেশ ভীড় জমাত। ঐতিহ্যের সে-স্কুলবাড়িতে ছিটেবেড়া ঘেরা হোস্টেলের রুমে আস্তানা গড়ে ওঠে সৌভিক-এর। মাটির মেঝেতে নিজের হাতে বিছানা পেতে শুতে হয়। জলের মতো স্বচ্ছ ডাল আর এক-দুটো তরকারির সঙ্গে গ্রাসাচ্ছাদন করতে হয় রোজ দুবেলা। মাঝে সাঝে খাবারের পাতে একটুকরো মাছ স্বাদ বদল ঘটায়। তারপরেও দুর্দান্ত রেজাল্ট করে সৌভিক। মাধ্যমিক পরীক্ষায় স্টার মার্কস পায় ১৯৮৭ সালে। একঝাঁক ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট সেবছর স্কুলের উজ্জ্বল মুখ আরও উজ্জ্বল করে তোলে। (চলবে)


তথ্য-সহায়তা :
●শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের পিতা ড. সুকুমার মাইতি মহাশয়
●সুকুমারচর্চা : সম্পাদনা শ্রী শ্যামল বেরা
●আনন্দবাজার, আজকাল, দি টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকাসহ অন্যান্য প্রিন্ট মিডিয়া

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments