জ্বলদর্চি

মাটিমাখা মহাপ্রাণ -১/ শুভঙ্কর দাস

মাটিমাখা মহাপ্রাণ 
শুভঙ্কর দাস 

এক

" প্রথম দিনের সূর্য 
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নূতন আবির্ভাবে
কে তুমি?"

চার্চের সুউচ্চ ঘন্টা-তোরণের পেছনে অস্তমিত সূর্য। দেখলে মনে হয়,সুদীর্ঘ ও সুতীব্র অন্ধকার দূর করতে করতে নিজেই তীরবিদ্ধ যোদ্ধার মতো ক্লান্ত, রক্তাক্ত এবং একাকী।সেই চার্চে এখনি ঈশ্বর-বন্দনা শুরু হবে।তার জন্য ঘন্টাধ্বনি হচ্ছে। বিছানায় একপাশে জানালার দিকে মুখ বাড়িয়ে তাকিয়ে আছেন আরও এক সূর্য,তিনি সমগ্র বঙ্গদেশের এই সময়ে সূর্যের মতো আলোকোজ্জ্বল। তাঁর নাম শোনেনি এমন লোক বাংলাদেশ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর!  তাঁর ব্যক্তিত্বে বিস্মিত হয়নি,এমন ইংরেজ-বাঙালি-বাচ্চা-বুড়ো এমন কেউ নেই! তাঁর জীবন মানুষের মুখে মুখে হয়ে যাওয়া জীবন্ত প্রবাদ!সেই  তিনি যেন এক দৃষ্টিতে সূর্যের ডুবে যাওয়া দেখছেন!এ যেন তাঁর জীবনের প্রতীক। ডাক্তার বলে দিয়েছিল,স্বাস্থ্য-উদ্ধার করার জন্য বাইরে তাকে যেতেই হবে।কারণ কলকাতা তাঁর পক্ষে থাকাটা সঠিক স্থান নয়!

তাঁর সঠিক স্থান কোথায়?কবে নির্ধারণ হবে? কে নির্ধারণ করবে?
বিছানা ছেড়ে একটি প্রসস্থ বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন, হালকা শীত  থাকলেও তিনি গায়ে চাদরটা নিলেন না!একদিন পিতার হাত ধরে কলকাতায় এসে একটি ছোট্ট বাসাঘরে উঠেছিলেন, তখন সেই গৃহের যে বারান্দা ছিল,তা এতই ছোট সেখানে কোনো মানুষ লম্বালম্বি শুতে পারবে না,তবুও স্থানাভাবে তাঁকে সেখানেই রাতের পর রাত ঘুমোতে হয়েছিল।তাই শুধু নয়, এক ফোঁটা রোদ পড়ে না সেখানে।তার ওপরে রান্নাঘরের পাশেই নরককুণ্ড। মলমূত্র আর কৃমিকীটে ভর্তি।দুর্গন্ধ তো আছেই,তার ওপর আরশোলার ভারি উৎপাত।দরিদ্র সন্তানের শিক্ষালাভের কী নিদারুণ কষ্ট ও কৃচ্ছসাধন। পরে অবশ্য বোঝা গিয়েছিল,অন্ধ ও অন্ধকারাছন্ন জাতিকে শিক্ষিত করতে একজনকে তো পড়তেই হবে।
সেজন্য প্রশস্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে লোকটি কিছুক্ষণ থমকে গিয়েছিলেন।এখানে দাঁড়াতে একটি করুণ কণ্ঠ যেন তাঁর কর্ণকুহরে নদীর মৃদুতরঙ্গের মতো আছড়ে পড়ল,তাতে ভেসে উঠছে,"বাবা,তোমার দুঃখিনী মায়ের এমন কি দোষ দেখলে যে,একেবারে নিষ্ঠুর হয়ে ভুলে বসে আছে? তোর মতো দিগ্ বিজয়ী ছেলে যদি মায়ের দোষকে দোষ বলে রাগ করে,তবে আর যারা কুপুষ্যি নিয়ে ঘরে করে তাদের কি দশা হবে বল্ দেখি?বাপ্ তুমিই তো বহিতে লিখে ছেলেদের শিক্ষা দাও,কে একজন দিগবিজয়ী রাজা মাকে অবোধ ও প্রখরা জেনেও পাশে মায়ের চোখে জল পড়ে,এই জন্য সৎ মন্ত্রীর সুমন্ত্রণারও শুনতেন না!তুমি যে আমার তাদের চেয়েও সদ্ গুণের আধার"

এগুলো যেন তীরের মতো বিদ্ধ করছে অসুস্থ ব্যক্তিকে,কেঁপে কেঁপে উঠছেন,তারপর যখন এই কথাগুলো মনের পাতায় ঢেউ তুলল,তখন আর তিনি অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না!"এখন বাপ,একবার এসে দেখা দে,এই সময় আয় বাবা।এরপর এলে আর চোখে দেখতে পাব না।তোর জন্য কেঁদে কেঁদে এখনই দেখতে পাইনি,যে মেয়ে দিগবিজয়ী বেটা পেটে ধরেছে,সেই অভাগিনীকে বেটার জন্য কাঁদতে হয়েছে। সুনীতি ধ্রুবর জন্য কেঁদেছে,কৌশল্যা রামের জন্য কেঁদেছে,আমাকেও তোমার জন্য কাঁদতে হচ্ছে।তাদের ছেলেরা মাকে একেবারে বিসর্জন দিয়ে কাঁদায়নি,তাদের ছেলেরা মা-বাপের কথা ঠেলতে পারে নাই,তুমি বাবা, আমার এই কথাটি রাখ,এক এক বার আমাকে দেখা দিয়ে যাও"। 

সহসা কী মনে পড়তে,গঙ্গার নির্মল বাতাসময় বারান্দায় ককিয়ে উঠলেন তিনি,সেই বাতাসে শোনা গেল,স্বগতোক্তি, মা, আমি আসছি,আমার ভুল হয়ে গেছে, আমি পৃথিবীসুদ্ধ সকলকেই ত্যাগ করতে পারি,কিন্তু তুমি আমার জাগ্রত দেবী,তোমাকে নয়,মা, মা, আমি আসছি...
একছুটে আবার ঘরের ভেতরে চলে গেলেন।বিছানায় পড়ে থাকা চাদরটা তুলে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়তে যাচ্ছেন, দরজার সামনে একজনকে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন।ব্যক্তিটি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। 
একি! একি!  আপনি এই দোসন্ধ্যাবেলায় কোথায় চললেন? ডাক্তার আপনাকে পুরোপুরি বিশ্রাম করতে বলেছেন!

কে?  তুমি কে? ওহ্ হরপ্রসাদ, আরে আমাকে একটা গাড়ি ঠিক করে দিতে পারো? আমাকে এখুনি মায়ের কাছে যেতে হবে,তাঁর চরণের ধুলো মাথায় নিয়ে আমাকে ক্ষমা চাইতে হবে..

সে হবেখন, এখন আপনি ঘরে চলুন,আমি কষ্ট করে নৈহাটির গজা আর রসমুণ্ডি নিয়ে এসেছি, আপনাকে খাওয়াব বলে! 

দোর বাবা,তুমি বোঝো না,আমার কত কাজ, আজই বীরসিংহ পৌঁছাতে হবে,কাল সকালে বালিকা বিদ্যালয়টি আবার নতুন করে খুলে দেব,নতুন নাম দিয়ে..

কী নাম?

আমার মায়ের নামে,ভগবতী বালিকা বিদ্যালয়,আহ্ উচ্চারণ করতেই বুকটা জুড়িয়ে গেল!

তা বেশ,আপনার মতো প্রখর স্মরণশক্তি গোটা ভূভারতে কাহারও নেই, সেই লোকের এই অবস্থা!  এখন আপনি বীরসিংহ যেতে চাইছেন? বাইরে বেরানো নিষেধ, আপনার!

কেনরে?কী হল? আমি কারও কাছে কি টাকা ধার করেছি যে, বাইরে যেতে পারব না!

টাকা ধার! না,আপনি তো উদ্ধার করেছেন,অর্থহীনকে অসম্মান থেকে,মুর্খকে তার মুর্খতা থেকে, থেকে,অবলাকে অন্ধকার থেকে,একটা পোকার মতো কিলবিল জাতিকে সুপ্রাচীন কুসংস্কারের যূপকাষ্ঠ থেকে... আপনাকে এই বঙ্গদেশে কোথায় যেতে বাধা দিতে পারে,এমন বুকের পাটা কার আছে?

ছিঃ ছিঃ এসব কী সব কথা! আমার উদ্ধারে-ফুদ্ধারে কাজ নেই, আমি বাপু, মায়ের দালাম ছেলে,এইটুকু মনে আছে... আর সব ভুয়া-ফক্কিকার!মায়ের কাছে যাব... এখুনি

সে কি একজন মা, শত-সহস্র মায়ের কোল আপনার জন্য অপেক্ষমান,আপনি শুধু সুস্থ হয়ে ওঠুন..

অসুস্থ! কে অসুস্থ! আমি যদি এখন মায়ের আকুল আহ্বানে যেতে না পারি,তাহলে আমার সকল কাজ,সকল পরিশ্রম ব্যর্থ! আমাকে গাড়ি এনে দে,না হলে আমি হেঁটেই চলে যাব

বলেই তিনি দরজার কপাট সরিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইলেন।এবং বুকের কাছে একটা ব্যথা চিনচিন করে উঠল,তিনি দরজার কপাট ধরে দাঁড়িয়ে পড়লেন।তখনি হরপ্রসাদ অতি দ্রুত উঠে গিয়ে ধরে ফেললেন!
হাঁপাতে থাকা বঙ্গদেশের ভাগ্যবিধাতাকে অনুরোধ করে বোঝাতে চাইলেন

এটা কি কলকাতা যে গাড়ি ধরে বীরসিংহ চলে যাবেন,এটা ফরাসডাঙা! 

ফরাসডাঙা!বলেই একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার ঘুরে গিয়ে আপন মনে বলতে থাকলেন,এত দূরে আমি আছি... বীরসিংহ থেকে এতো দূরে... আমি পড়ে আছি...

হরপ্রসাদ হাতে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিলেন।তারপর প্রার্থনা সুরে বললেন,আপনাকে সুস্থ হতেই হবে।গোটা বাঙালি জাতটা যাঁর জন্য অপেক্ষা করে আছে,যাঁর কথা, যাঁর মতামত শোনার জন্য অধীর,যাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ বোঝার জন্য উৎকর্ণ উদগ্রীব, তাঁকে সুস্থ হতে হবে যে,ডাক্তারের পরামর্শে আপনাকে ফরাসডাঙায় আসতে হয়েছে, আপনি সুস্থ না হলে বাঙালি জাতি বাঁচবে না!

দোর্ দোর্, তাদের বয়ে আমার কথা শুনতে,আমার কথা ভাবতে,স্বার্থপর, ঠক,মাথামোটাতে ভর্তি!তারা আমাকে ভুলতে পারলে,মারতে পারলে বাঁচে...

আপনাকে ভুলে গেলে বাঙালি জাতিটা জাহান্নামে যেতে একরাত্রিও পেরোবে না,আপনি তো নতুন পূর্বদিক...

রাখ তোর এই সব বক্তব্য, এই জাতটা যে কতখানি অসার ও অপদার্থ, তা আমার থেকে ভালোরকম কেউ জানে না!কোনো পথ দেখতে পাচ্ছি না! কলকাতার বাবুদের কথা ছেড়েই দিলাম,আমার জন্মভিটে বীরসিংহীর মাটি কি একেবারে ঠান্ডা মেরে গেল! 

হরপ্রসাদ এবার দৃঢ়কণ্ঠে বলে উঠলেন,তা কেন হবে? সূর্যোদয়ের সময় প্রতিটি দিন যাঁকে স্মরণ করা উচিত,সেই বিদ্যাসাগরের পায়ের ধুলো মিশে আছে,যাতে সেই মাটি কি এমনি এমনি ব্যর্থ হতে পারে! আপনি দেখে নেবেন,কেউ না কেউ আসবে,এই পরাধীন দেশের মানুষের দেশ কীভাবে হয়ে উঠতে হয় বোঝাতে...

সেই সময় চার্চে ঘন্টাধ্বনি পড়ল..দূরে কোথাও মসজিদে নমাজের সুর ভেসে আসছিল...

বিদ্যাসাগর জানালা দিয়ে অশ্রুসজল চোখে যন্ত্রণা গোপন করে তাকিয়ে থাকলেন...
সময়কাল ১৮৮৯ নভেম্বরের শেষের দিক,২৮ নভেম্বর ...নিয়তির কী আশ্চর্য গতিপ্রকৃতি... 
সেই সময় মেদিনীপুরের একটি ছোট্ট গ্রাম বাসুদেবপুরে এক কৃষক পরিবারে একটি শিশুর জন্ম হল...মাঠের কাজ শেষ করে এসে সবে মাত্র মাটির দাওয়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন ঠাকুরদাস,সহসা সদ্য আগত শিশুর ক্রন্দনে গোধূলির রঙ ভরে গেল...
সুদীর্ঘকাল আগে এমনই একজন ঠাকুরদাস হাট থেকে ফিরে শুনেছিলেন,ঘরে একটা এঁড়ে বাছুর হয়েছে, তিনি তাড়াতাড়ি গোয়ালে ছুটেছিলেন, গাভি-সহ বাছুরটি দেখতে,তখন নবজাতকের ঠাকুরদাদা,পিতাকে হাতে ধরে আঁতুড়ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন,সেই এঁড়ে বাছুর পরবর্তী সময়ে দিগবিজয়ী বীরসিংহের সিংহ বলে পরিচিত হয়েছিলেন,তেমনি এই 
ঠাকুরদাস,ইনি বন্দ্যোপাধ্যায় নন,জানা, আনন্দে আত্মহারা!গোয়ালের নয়, সরাসরি আঁতুড়ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলেন,দেখলেন,মেদিনীপুরের মাটি দিয়ে তৈরি যেন একটি কৃষনগরের ছোট্ট পুতুল!ছোট ছোট হাত দিয়ে অস্তমিত সূর্যকে ধরার চেষ্টা করছে...
(ক্রমশ) 

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments