জ্বলদর্চি

ইউরোপ (ইংল্যাণ্ড)এর লোকগল্প /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প--ইউরোপ (ইংল্যাণ্ড)

চিন্ময় দাশ

বুড়ির বাড়ি ফেরা

এক বুড়ি তার উঠোন ঝাঁট দিচ্ছিল। তখনই দলা পাকানো ছয় পেনির একটা নোট উঠে এল ঝাঁটার মাথায়। কী করা যায় এটা নিয়ে? ভেবে ভেবে একটা বুদ্ধি এল বুড়ির মাথায়। 
এই পয়সায় একটা শূকরছানা কিনলে, কেমন হয়। সময়ও কাটবে ছানাটাকে নিয়ে। বড় করলে, দুটো পয়সারও মুখ দেখা যাবে।
শুভস্য শীঘ্রম। ঝাঁটা রেখে, বাজারে রওণা হোল বুড়ি। ঘুরে ঘুরে, অনেক বাছাবাছি করে, ছোট্ট একটা  শূকরছানা কিনেও ফেলল। মনে বেশ পুলক। কিছু একটা নিয়ে থাকা যাবে বেশ। একা থাকবার কষ্টটা ঘুচবে এবার।
বাড়ি ফিরছে বুড়ি। পথে ছোট একটা সাঁকো পেরোতে হয়। পুরানো সাঁকো, একটু ভাঙাচোরা। সেই সাঁকোর মুখে এসেই ঘটল বিপত্তি। শূকরছানাটা কিছুতেই সেই সাঁকোয় উঠবে না। 
প্রথমে বাবা-বাছা। তারপর গাল-মন্দ। শেষে টানা-হ্যাঁচড়া। কিন্তু কিছুতেই কিছু হবার নয়। কেবল ঘোঁত ঘোঁত করে, আর মাটি আঁচড়ে পিছিয়ে যায়। 
ফ্যাসাদে পড়ে গেল বুড়ি। রাস্তাও কম নয়। রাত নেমে যাবে সময় নষ্ট করলে। 
কী করা যায়, কী করা যায়? ভাবছে, এমন সময় এক কুকুরকে আসতে দেখল সেই পথে। বুড়ির শূকরটাকে টানাটানি দেখে, কুকুর জানতে চাইল—হোলটা কী? এমন টানা-হ্যাঁচড়া কেন? 
--দূরের পথ। বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা নেমে আসবে। এ হতভাগা শূকর সাঁকো পেরোতে চাইছে না। তুমি আমার একটা উপকার করবে, বাছা? 
কুকুর বলল-- বলো, শুনি।
বুড়ি বলল—আচ্ছা করে একটা কামড় বসাও তো এটার দাবনায়। কেমন সাঁকো না পেরোয়, দেখি। 
--ভয় পেয়েছে। তাই সাঁকোয় উঠতে চাইছে না। তাছাড়া, আমার তো কোন ক্ষতি করেনি। অহেতুক কেন কামড়াতে যাব ওকে? কুকুর চলে গেল মাথা নেড়ে। 
একটু এগিয়ে, একটা লাঠি পড়ে থাকতে দেখল বুড়ি। লাঠিকে বলল—সপাং সপাং করে দুটো ঘা বসাতে পারো কুকুরকে? 
লাঠি বলল—সে তো পারি। কিন্তু কেন, সেটা শুনি। 
বুড়ি বলল—কুকুরটাকে কত করে বললাম। সে শূকরকে কামড়াল না। শূকর কিছুতেই সাঁকোয় চড়বে না। এদিকে ঘরে ফিরতে রাত হয়ে যাবে আমার। 
--আমার তো কোন ক্ষতি করেনি কুকুর। লাঠি রাজি হোল না। 
আর একটু এগিয়ে, এক জায়গায় আগুন দেখতে পেয়ে বুড়ি বলল—আগুন ভাই! চলো তো, লাঠিটাকে পুড়িয়ে দেবে। 
আগুন বলল—কেন, কেন? হঠাত করে লাঠিটাকে পোড়াতে যাব কেন 
বুড়ি বলল—লাঠিকে কত করে বললাম, কুকুরকে কষে দু’ঘা বসাতে। কুকুরটা শূকরকে কামড়ায়নি। শূকর কিছুতেই সাঁকোয় চড়বে না। এদিকে ঘরে ফিরতে রাত হয়ে যাবে আমার।
আগুন রাজি হোল না বুড়ির আবদারে। 
খানিক এগিয়ে একটা ডোবা চোখে পড়ল বুড়ির। সে জলকে বলল—বড্ড গুমোর হয়েছে আগুনের। চলো তো, ওকে নিভিয়ে দেবে। 
--আগুন আবার কী করেছে তোমার? জল জানতে চাইল।
বুড়ি বলল—আগুনকে কত করে বললাম, লাঠিকে পুড়িয়ে দিতে। লাঠি কুকুরকে দু’চারটা ঘা লাগায়নি। কুকুরটা শূকরকে কামড়ায়নি। শূকর কিছুতেই সাঁকোয় চড়বে না। এদিকে ঘরে ফিরতে রাত হয়ে যাবে আমার।
জল বলল—ঠিকই তো করেছে আগুন। আমি কেন তাকে নেভাতে যাব? 
ডোবা ছেড়ে এগিয়ে, একটা ষাঁড়ের সাথে দেখা। বুড়ি ষাঁড়কে থামিয়ে বলল—জলটাকে শুষে নেবে চল তো?
নাদুস-নুদুস জীব। ভর পেট খেয়ে, হেলতে দুলতে ঘরে ফিরছে এখন। দাঁড়িয়ে পড়াটা তেমন পছন্দ হয়নি তার। সে বলল—হঠাত করে জলের দোষটা কী হোল?
বুড়ি বলল—জলকে কত করে বললাম, আগুনকে নিভিয়ে দাও। আগুন লাঠিকে পোড়ায়নি। লাঠি কুকুরকে কষে দু’ঘা বসায়নি। কুকুরটা শূকরকে কামড়ায়নি। শূকর কিছুতেই সাঁকোয় চড়বে না। এদিকে ঘরে ফিরতে রাত হয়ে যাবে আমার। 
ষাঁড় এপাশ-ওপাশ মাথা দুলিয়ে বলল—না বাপু, ভরা পেট আমার। এখন আমি জল গিলতে পারব না। 
 এবার বুড়ির সাথে দেখা এক কসাইর। বুড়ি বলল—হ্যাঁগো, ভালো মানুষের পো। ষাঁড়টাকে মারবে চলো তো। 
লোকটা অবাক হয়ে বলল—ষাঁড় কি গুঁতোল না কি তোমাকে? তাকে মারতে বলছ কেন? 
বুড়ি বলল—ষাঁড়কে কত করে বললাম, জলকে খেয়ে নাও। সে খেলো না। জল আগুনকে নেভায়নি। আগুন লাঠিকে পোড়ায়নি। লাঠি কুকুরকে কষে দু’ঘা বসায়নি। কুকুরটা শূকরকে কামড়ায়নি। শূকর কিছুতেই সাঁকোয় চড়বে না। এদিকে ঘরে ফিরতে রাত হয়ে যাবে আমার।
কসাই তো হেসে অস্থির-- মূল কথা হোল, তোমার ছোট্ট শূকরছানা ভয়ে সাঁকোয় চড়বে না। তার জন্য অত বড় ষাঁড়টাকে মেরে ফেলতে হবে? কী যে বলো, তার নাই ঠিক। গজগজ করতে করতে নিজের রাস্তায় চলে গেল লোকটা। 
কী আর করে বুড়ি? কয়েক পা এগিয়েছে, একগোছা দড়ি পড়ে আছে রাস্তার পাশে। বুড়ি বলল—তুমি কসাই লোকটাকে বেঁধে এই গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিতে পারো? 
কে না অবাক হয় এমন কথায়? দড়ি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে দেখে, বুড়ি বলল--লোকটাকে কত করে বললাম, ষাঁড়কে জবাই করতে। ষাঁড়কে বলেছিলাম,  জলকে খেয়ে নাও। সে খেলো না। জল আগুনকে নেভায়নি। আগুন লাঠিকে পোড়ায়নি। লাঠি কুকুরকে কষে দু’ঘা বসায়নি। কুকুরটা শূকরকে কামড়ায়নি। শূকর কিছুতেই সাঁকোয় চড়বে না। এদিকে ঘরে ফিরতে রাত হয়ে যাবে আমার। 
দড়ি বলল—এজন্য একটা নির্দোষ লোককে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেব? আমার দ্বারা হবে না। 
বুড়ির এবার মাথা  গরম হতে শুরু করেছে। কেউ তার কথা শুনছে  না। এগোতে যাবে, হঠাত একটা ইঁদুর সামনে হাজির। বুড়ি বলল— তোমার দাঁতে নাকি ভারি ধার? এই দড়ির বোঝাটা কেটে কুচি কুচি করে দাও তো। 
গোঁফ জোড়া নেড়ে, বিজ্ঞের মত জানতে চাইল ইঁদুরটা—দোষটা কী দড়ির? 
বুড়ি বলল-- হতভাগাটাকে কত করে বললাম, কসাইকে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিতে। করল না কাজটা। কসাই ষাঁড়কে জবাই করেনি। ষাঁড় জলকে খেলো না। জল আগুনকে নেভায়নি। আগুন লাঠিকে পোড়ায়নি। লাঠি কুকুরকে কষে দু’ঘা বসায়নি। কুকুরটা শূকরকে কামড়ায়নি। শূকর কিছুতেই সাঁকোয় চড়বে না। এদিকে ঘরে ফিরতে রাত হয়ে যাবে আমার। 
ইঁদুর মাথা নেড়ে বলল—দড়ি তো কোন দোষ করেনি দেখছি। আমি তাকে কাটব কেন?
কিছুটা এগিয়ে একটা বিড়ালের সাথে বুড়ির দেখা। বুড়ি বলল—ইঁদুরটার ভারি দেমাক। অকে খেয়ে ফেলবে চল তো।
বিড়ালও জানতে চাইল—করেছে কী ইঁদুরটা?
বুড়ি বলল—তাকে কত করে বললাম, দড়ির গোছাটা কেটে দাও। কাটল না। দড়িকে বলেছিলাম, কসাইকে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিতে। করল না কাজটা। কসাই ষাঁড়কে জবাই করেনি। ষাঁড় জলকে খেলো না। জল আগুনকে নেভায়নি। আগুন লাঠিকে পোড়ায়নি। লাঠি কুকুরকে কষে দু’ঘা বসায়নি। কুকুরটা শূকরকে কামড়ায়নি। শূকর কিছুতেই সাঁকোয় চড়বে না। এদিকে ঘরে ফিরতে রাত হয়ে যাবে আমার।
ইঁদুরের নামে বিড়ালের জিভে জল এসে গেছে। এদিকে সে এটাও বুঝেছে, জব্বর ঠ্যালায় পড়েছে বুড়ি। চাপ দিলে, আরও কিছু আদায় করে নেওয়া যেতে পারে।
বিড়াল বলল—মাংস খেয়ে খেয়ে, জীবনে ঘেন্না ধরে গেছে গো। মাংস আর ভালো লাগে না। তবে বলছ যখন, তোমার কাজটা করে দেব আমি। কিন্তু—
বুড়ি এতক্ষণে একটু ভরসা এল মনে। সে বলল—আবার কিন্তু কিসের? 
বিড়াল বলল—পাশেই গিয়ে দ্যাখো, একটা গোয়ালঘর আছে। দুধেল গাইও আছে সেখানে। যদি এক বাটি দুধ এনে দাও আমাকে, তাহলে ইঁদুরটাকে মেরে দেব আমি।
সত্যিই পাশেই একটা গোয়ালঘর। বুড়ি গোয়ালে গিয়ে গাইকে বলল—বাঁট থেকে একবালতি দুধ দেবে, বাছা? 
গাই সাতকাহনের মধ্যে গেল না। সে বলল—আমার মালিক গেরস্ত মানুষ। হাজার কাজের চাপে, বড় একটা আসতে পারে না এদিকে। সেই সকাল বেলায় এক আঁটি খড় ফেলে দিয়ে, সেই যা গেছে। এদিকে পেট একেবারে চুঁইচুঁই করছে আমার। 
বুড়ি বলল—তোমার দুঃখের কথা শুনলাম। কিন্তু আমি কী করতে পারি? 
গাই বলল—বেশি কিছু নয়। পাশের ঘরটায় যাও একবার। বিচালি ডাঁই করা আছে সেখানে। দুটো আঁটি এনে দাও যদি, দুধ দব তোমাকে। 
বুড়ি তো আনন্দে আটখানা একেবারে। তাড়াতাড়ি কয়েক আঁটি খড় এনে ধরে দিল গরুর সামনে। গরুটারও ভারি আনন্দ তাতে। এক বাটি দুধ দিয়ে দিল বুড়িকে। 
মুখের সামনে এক বাটি টাটকা দুধ পেয়ে, সে কী ফূর্তি বিড়ালের! পেট ভরে দুধটা খেয়ে, সে দৌড়ল ইঁদুর মারতে। বিড়ালকে ছুটে আসতে দেখে, ইঁদুরের বুক ধুকপুক। সে দৌড়ল দড়ি কাটতে। যেই না ইঁদুর কামড় বসিয়েছে, অমনি দড়ি দৌড়তে লাগল, কসাইকে বেঁধে গাছে ঝোলাবে বলে। তা দেখে, বেঘোর প্রাণ যাওয়ার ভয়ে কসাই দৌড়াল ষঁড়ের দিকে। লোকটাকে ঝুরি বাগিয়ে তেড়ে আসতে দেখে, লেজ উঁচিয়ে সে কী দৌড় ষাঁড়ের! ষাঁড়কে দৌড়ে আসতে দেখে, জল তার বিপদ বুঝতে পেরেছে। তড়িঘড়ি করে দৌড় লাগাল আগুন নেভাতে। জলকে দেখে আগুন ছুটল লাঠি পোড়াবে বলে। অমনি লাঠি এগিয়ে কুকুরের দিকে। দু’ঘা বসিয়ে দিয়ে এ যাত্রা বাঁচবে আগুনের হাত থেকে। তখন আর কুকুরকে দ্যাখে কে। মারকে বাঘও ভয় পায়। কুকুর ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে এল শূকরছানাটার দিকে। যত নষ্টের গোড়া এই হতভাগা। এর জন্যই এমন হুলুস্থুল কাণ্ড। এতজনের এই হয়রানি। একটা ঠ্যাংই কেটে নেব আজ ওর। 
কুকুরের কামড় বলে কথা। কে না ভয় পায়? শূকরছানাও পেয়েছে। কেউ কিছু বুঝে উঠবার আগেই, তিড়িং করে জোর এক লাফ। এক লাফে সাঁকো পার। একেবারে ওপারে গিয়ে পড়ল শূকরটা।
কী আনন্দ তখন বুড়ির! সব কিছু মিটে গেছে ভালোয় ভালোয়। বাড়ির পথে পা চালাল সে। নিজের উঠোনে পৌঁছে পা রাখল যখন, তখনও সন্ধ্যে নামেনি ভালো করে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments