জ্বলদর্চি

মাটিমাখা মহাপ্রাণ --২/শুভঙ্কর দাস

মাটিমাখা মহাপ্রাণ -দুই

শুভঙ্কর দাস 

"এখনো অঙ্কুর যাহা
তারি পথ পানে,
প্রত্যহ প্রভাতে রবি
আশীর্বাদ আনে"

বাসুদেবপুর গাঁয়ের মেঠোপথটি ধরে যেন একটি খুশির তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছিল।মাঠে মাঠে শিশিরভেজা কড়াইশুঁটির দল উত্তরে হওয়ার সঙ্গে খেলাধূলাতে মগ্ন। সেই সঙ্গে গাঁদা,সূর্যমুখী,চন্দ্রমল্লিকা ফুলেরা অভিভাবকের মতো কড়াইশুঁটিদের দৌরাত্ম্য লক্ষ্য করে যাচ্ছিল...অন্যদিকে ছোলা,মুসুরি,মটর এই জাতীয় দুর্বল গাছগুলো শান্ত বালকের যেমন মাঝেমধ্যে দুষ্টুমি করার ইচ্ছে জাগে,তেমনি কড়াইশুঁটিকে দেখে মাঝেমধ্যে বেচাল হয়ে উঠছে!
সেই মাঠের পর মাঠে,তার মাঝখানে সরু সিঁথির মতো রাস্তায় গেঁয়ো ভিখারি, তাদের মুখে-চোখে অপ্রত্যাশিত আনন্দ।বড় পুকুরের ধারে নিম্নবিত্ত চাষী জানাদের গৃহ।সেখানে ভিক্ষা করতে গিয়ে একটি দৃশ্য দেখে অনেকের মুখে কথা সরেনি! আঁতুড়ঘর থেকে ছোট্টশিশুর হাসি ও কান্নার মাঝখানে তাদের প্রত্যকের ঝুলি মা অন্নপূর্ণায় ভরে যাচ্ছিল।
গৃহকর্তা ঠাকুরদাস নিজের হাতেই এক বস্তা চাল এনে এই গৃহের দরজার পাশে রেখেছেন, যারাই কাছে এসে হাত পেতে দাঁড়াচ্ছে, তাকেই নতুন অতিথির নাম করে চাল বিতরণ করছেন।না,না,ঠাকুরদাস মোটেই জমিদার নয়, বরং এই চাল-বিতরণের জন্য তাঁকে পরবর্তী সময়ে তিনগুণ পরিশ্রম করতে হবে।কিন্তু আজকের দিনটি অন্যরকম যে, তাঁদের বাড়িতে আজ উৎসব, এমন দিনে পথের মানুষজন যাতে খালিহাতে ফিরে না যায়, সেইজন্য তিনি সদা সতর্ক, এটাই তাঁর কাছে আনন্দের সত্যিকারের মানে।
ঠাকুরদাসের বড়পুত্রটির নাম দেবেন্দ্রনাথ। একটু হিসেবী ধরণের,সংসারের কঠিন লড়াইটা সে অনেকদিন ধরে দেখছে এবং লড়ছে।সে একটি জমিদারের বাড়িতে মহুরির কাজকর্ম করে।হিসেবের খাতা ফেলে গিয়েছিল বলে আবার বাড়ি ফেরার পথে ফকির আবদুলের সঙ্গে দেখা,লোকটি খাসা গান করে,

"কোথায় ভুলে রয়েছ ও নিরঞ্জন নিল্লয় করবে রে কে,
তুমি কোনখানে খাও কোথায় থাক রে মন অটল হয়ে
কোথায় ভুলে রয়েছ?
তুমি আপনি নৌকা আপনি নদী,আপনি দাঁড়ি আপনি মাঝি
আপনি হও যে চরণদারজী, আপনি হও যে নায়ের কাছি
আপনি হও যে হাইল বৈঠা।"

এমন গান যেন গাঁয়ের প্রতিটি গাছের পাতা,পুকুরের জল, তার ওপর রোদের প্রথম লালিমা স্থির হয়ে  শোনে...

আরে ভাইটি,তুমি তো তোমার নতুন ভাইটিকে ছেড়ে কোথা গিয়েছিলে?আবার এতো হন্তদন্ত হয়ে কোথা ফিরে যাও?একটু ভাইয়ের পাশে বসে কালোচাঁদের আলো দেখে নয়ান সুখ করো

গান থামিয়ে বলল আবদুল। 

দেবেন্দ্রনাথ বেশ অবাক হল।সচারাচর এমন করে গান থামিয়ে আবদুল ফকির কারও সঙ্গে কথা বলে না!
কী হল গো? এতো খুশি কীসের জন্য?

সে কি! যার ঘরে দরজা সোনার, সেই জিজ্ঞেস করে সোনার দোকানের খবর! হাঃ হাঃ হাঃ

মানে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না,সেই ভোরে কাজে বেরিয়েছিলাম তো!

তোমার বাবা তোমার ভাইয়ের নামকরণের খুশিতে যে লোক দ্বারে যাচ্ছে, তাকেই সোনার ফসলে সেলাম দিচ্ছে গো! এই দেখো

বলেই আবদুল নিজের পাঁচ-ছয়টি গাঁটবাঁধা ময়লা কাপড়ের থলের ভেতর দেখাল।তাতে সোনার শস্য, ধান।

বড়ভাইটি একটু মনে মনে বিরক্ত  হল, এমনি বেশ বড় সংসার,বাবা নিজেই সারাদিন পরিশ্রম করে,নিজেই গরুর গাড়ি চালিয়ে চাল হাটে নিয়ে যায়,আবার যখন ধানের অভাব হয়,তখন সেই গরুর গাড়িতে করে মালপত্র বহন করে পয়সা জোগাড় করতে হয়।তাহলে কী এমন হল?

বেশ আশ্চর্য হয়ে গেল!পুকুরধার দিয়ে না ঘুরে সে গৃহের পেছন দিক দিয়ে প্রবেশ করল।দৃশ্যটি দেখে সে অবাক হল।শুধু আবদুল নয়,আবদুলের মতো এরকম আরও দশবারো জন প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আছে এবং তাঁদের মুখেচোখে সরপড়া পুকুরে সহসা  আলো পড়ার আনন্দ। ঠাকুরদাস খুব আনন্দে এই কাজটি সম্পন্ন করছেন।লক্ষ্মীরানী তার মা,আঁতুড়ঘর থেকে এই ঘটনা দেখে বেশ খুশি।
দেবেন্দ্রনাথ নীরবে পারিবারিক আনন্দ দর্শন করে ঘরের ভেতর থেকে খাতাটি নিয়ে যাওয়ার সময় পিতার মুখোমুখি হল।

ওরে দেবেন,আজ একটা কাণ্ড হয়েছে রে! দারুণ এক কাণ্ড হয়েছে! 

কী বাবা?  ভাই আবার কিছু করল নাকি? সবাই দেখছি, ভাইয়ের কথা বলছে! কথাগুলো বিরস কণ্ঠে বলল।

আরে বাবা,তুই এতো চিন্তিত হয়ে আছিস কেন? কী হল? তুই তো ভালো হিসেবী,তোর মতো ভুল হওয়ার কথা নয়, তাহলে কী? 

কিছুই না বাবা,এই সবে হেমন্তের শুরু,এখনও রোয়ার নতুন কাজ শুরু হয়নি,এই চাল তো সবচেয়ে সরু ও দামি,তুমি সেই চাল দান করছ!

আরে তাতে কী? আবার এই চাল উগাবো,মা অন্নপূর্ণা মুখ তুলে চাইলে,আমরা তো রাজা-বাদশা নই,আমাদের সিংহাসন থেকে পড়ার ভয় নেই,তা এই মাটি আমাদের সিংহাসনের চেয়েও বেশি,এ কোনোদিন মাটিতে ধপ্ করে ফেলে দেবে না!চিন্তা কী রে!

কিন্তু চাল তো মজুত কমে আসছে!

আরে চিন্তা করিস না,তোরা চিন্তা করিস না,আজ কী কাণ্ড হয়েছে শোন...

পাশে দাঁড়িয়েছিল মেজপুত্র, মধুসূদন, সে লাফিয়ে উঠল,বাবা,বাবা, আমি বলব,আমি বলব

আচ্ছা, তুই তোর দাদাকে শোনা,হেসে বললেন ঠাকুরদাস। 

জানো দাদা,ভাইয়ের নামকরণ কী হবে, এই নিয়ে মা-বাবা যখন কথা বলছিল,সেই সময় ছোট ভাই কাঁথা থেকে গড়িয়ে মাটিতে চলে আসে.. তারপর...

তারপর?

তারপরে বাবা হাট থেকে কয়েকটা বই এনেছিল,সেগুলো পাশে রাখা ছিল,তার মধ্যে একটা বইয়ের ওপর ভাই হাতটি রাখে.. এমন ভাব,যেন তার ঐ বইটি চাই... 

কী বই?

দাদা,সেই বই তো বাবা আমাদের পড়ায় রোজ সন্ধ্যেতে...

এবার ঠাকুরদাস মুখ খুললেন,বিদ্যেসাগরের 'বর্ণপরিচয়।'লালরঙের বইটির ওপর হাত রেখে হাসছিল, তা দেখে আমি নাম ভেবে নিলাম।ঈশ্বরচন্দ্রের নামে যদি নাম রাখি, এই নামের মতো পবিত্র নাম আর কী হয়?

তাহলে?

তোর মা আবার বিষ্ণুভক্ত,বললে,ঐ নামে তো একজন ভুবন আলো করেছে,তুমি অন্য কিছু ভাবো।আমার তো পছন্দ নারায়ণ। আহ্ আমার নারায়ণ। খুব সুন্দর নাম হবে।ছেলেকে ডেকে ডেকে নিজের ইষ্টকেও ডাকতে পারব।এবার আমি বিপাকে পড়লুম।

কেন মা'তো ভারি সুন্দর নাম দিয়েছে, আমি দেবেন্দ্রনাথ, মেজো মধুসূদন, সেজো ভবনাথ, তারপর নারায়ণ, ভালোই তো! 

আরে হা,হা,তোর মায়ের কথাই ঠিক। বলেই ঠাকুরদাস একবার আঁতুড়ঘরের দিকে চেয়ে নিলেন।তারপর বলে উঠলেন,একটা কথা জেনে নামটি দেওয়া মুসকিল হচ্ছে! 

কী? 

তোর খুড়িমার পুত্রের নামও নারায়ণ, তাই আমি দেখলাম,তোর মায়ের কথা রাখতে হবে,আবার দেশের সিংহাসনহীন রাজা বিদ্যেসাগরের নামও চাই,তিনি সত্যিকারের মায়ের সত্যি রাজার কুমার,তাই দিলাম কুমারনারায়ণ।
কেমন? 

বেশ! এবার হাসি ফুটল দেবেনের।অতি ছোটোবেলা থেকে সে তার বাবাকে দিনান্ত খাটতে দেখেছে,তাদের মুখে দুবেলা দুমুঠো ভাত তুলে দিতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে দেখেছে,পয়সার জন্য কখনো কারও সামনে হাত পাততে দেখেনি,যেদিন ঘরে চাল নেই,মায়ের বেড়ে দেওয়া বাসি মুড়ি অম্লান বদনে খেতে দেখেছে,সেই সহজ সরল মানুষটিকে এই ছোট ছোট ঘটনায় খুশিতে মেতে উঠতে দেবেন্দ্রনাথের বুক ভরে গেল,চোখে জল এসে যাচ্ছিল!
বাবা,খুব ভালো নাম হয়েছে, কুমারনারায়ণ ! এতো মায়ের-বাপের মন থেকে দেওয়া নাম,এ কি কখনো খারাপ হতে পারে! কখনো হতে পারে না।বলেই খাতাটি বুকে চেপে বেরিয়ে গেল।
বড়োপুকুরটি পেরিয়ে দেবেন মাঠের মধ্যে নেমে গেল,এই পথটি যাতায়াতের সুবিধা। আসার সময় একজন শিউলিকে দেখেছিল,তাকে সে চেনে,তার নাম শম্ভু। সে জমিদার বাড়িতে চাল চাইতে গিয়েছিল,তার ঘরে বড্ড অভাব।কারণ শীতকালে সে রসের সন্ধান করে,খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধে।সেদিন তিনটি রসপূর্ণ হাঁড়ি গরুর গাড়ির ধাক্কায় ভেঙে যায়, রস বিক্রি করতে পারেনি! তাই খিদের জ্বালা সহ্য করে আজও খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধতে লেগেছে,কারণ জমিদার বাড়ি থেকে কোনো চাল জোগাড় করতে পারেনি,বরং জমিদারের নায়েব জোর করে বাদবাকি রসের হাঁড়ি কেড়ে নিয়েছে, দেবেন শম্ভুর কাছে গিয়ে হাসিমুখে দাঁড়াল।খুশিমনে বলে দিল,---ভাই শম্ভু, আজ আমার বাড়ি যেও,হাঁড়ি বাঁধার পর,গেলে চাল পাবে,তার জন্য কোনোকিছু বাঁধা রাখতে হবে না,পয়সাও দিতে হবে না।
শম্ভু শুনে গাছের অর্ধ-ওঠা থামিয়ে আবার নীচে নেমে দেবেনকে গড় করল,মুখে তার নতুন গুড়ের রঙ।
সে ককিয়ে উঠে বলল,বাপরে বাঁচালে, দাদা, বাচ্চাগুলো খিদের জন্য যখন কাঁদে,বুকটায় খেজুরের কাঁটার মতো বিঁধে যায়,গুণে গুণে দশমুঠো চাল দিলেই হবে গো.. আহ্ আজ পেট ভরে ভাত খাব'খন..

দশ কেন? আজ গেলে দ্বিগুণ চাল পাবে, অবশ্যই যেও, অবশ্যই যেও...

বলে দেবেন জমিদারের বাড়ি ছুটে গেল।

এদিকে ঠাকুরদাস দেখল, মেয়েটি একটা কাপড়ে কোঁচড়ে কিছু এনেছে, গোপন করে রেখেছে সবার চোখের সামনে,কিন্তু ঠাকুরদাস ধরে ফেললেন---মা রে,কী তোর কোঁচড়ে?

বলব না,আমি ভাইয়ের জন্য এনেছি,উপহাট... 

উপহাট!  হাঃ হাঃ দূর বোকা, ওটা বলে উপহার, তা কার জন্যে?

ভাইয়ের জন্য

কী এনেছিস? এই সকালে?

তারপর ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে ছেঁড়া আঁচলটি তুলে দেখাল মেয়েটি,কড়াইশুঁটি।যার বেশির ভাগই ঘাস,শস্যকম।  

ঠাকুরদাস এক অদ্ভুত আনন্দে বিহ্বল হলেন।কেউ জানে না,ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যেসাগর তাঁর জীবনে কী মানুষ!কত বড় উপহার! তিনি ছোটোবেলায় সেই ভারতজোড়া মানুষটির কথা শুনে শুনে বড় হয়েছেন।ভাবতেন,যদি হতে হয়,সেই আলোকোজ্জ্বল মানুষের মতো হবেন।তাঁর বই ঠাকুরদাসের প্রিয় বই,সেই বইয়ে হাত রেখেছে অজান্তেই কুমারনারায়ণ।

সেই ছোট হাতটি আসলে রেখেছিল ঠাকুরদাসের সেই চলে যাওয়া স্বপ্নদেখার জীবনে,যা তিনি হতে পারেননি,যদি তাঁর এই ছেলেটি হতে পারে!

অজানা অজ পাড়াগাঁয়েও এক শিক্ষানুরাগী চাষার সতেজ সবুজ হৃদয়ের কথা হয়তো বিদ্যাসাগর মহাশয় কোনোদিন জানবেন না,কিন্তু এই ঘটনা জাগিয়ে রাখবে পরাধীন দেশের ভেতর এক স্বাধীন স্বপ্নকে,যার কোনো মৃত্যু নেই! 

ক্রমশ....

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments