গ্রামের শহুরে রূপকথা
দ্বিতীয় পর্ব: ঢেঁকিছাটা চাল
সুরশ্রী ঘোষ সাহা
জেঠিমা বলে চলল—
শৈশবে আমাদের শ্রাবণ - ভাদ্রের বর্ষার দিনগুলো ছিল খুব দুঃখের। একে খালি পা, তার উপর চারিদিকে শুধু কাদা। সেই কাদা মাড়িয়ে মানপাতা মাথায় দিয়ে হাঁটু পর্যন্ত কাদা ছিটিয়ে পাঠশালা যেতুম। ছাতা নামক বস্তুটি যখন এল তখন আমি অনেক বড়। সন্ধ্যায় ব্যাঙের গ্যাঙর-গ্যাং ডাক, ঝিঁ-ঝিঁ পোকার ডাক সঙ্গীতের মত চলতেই থাকত চারিপাশে। জমি থেকে তখন পাট উঠছে রোজ। ডোবায় পচাতে দেওয়া চলছে। যত পচে উঠছে, ততই বিশ্রী গন্ধ। একসময় যদিও সেই গন্ধও সয়ে যেত। ভেজা পচা পাটকাঠি থেকে বুড়ির রূপালি চুলের মতন রোঁয়া রোঁয়া করে বেরিয়ে আসত পাট। বিরাট লম্বা লম্বা সেই কাঠি থেকে পাট ছাড়াতে অসুবিধা হত। তাই ডগা কিংবা তার খানিক উপর থেকে ভেঙে ফেলা হত কাঠি। এসময় রাস্তাঘাটে, সবার উঠোনে একদিকে পাট, আর অন্যদিকে কাঠি জমিয়ে রাখা হত সারি সারি। এ দৃশ্য আজও দেখতে পাওয়া যায়। নরম কাঠি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হত খুব ভাল। শক্তেরা আরো কত কাজে আসে। বর্ষায় কী প্রচন্ড মশার উপদ্রব হত, তবে তখনও মানুষ মশার কামড়জনিত অসুখের কোন নাম শোনেনি। ম্যালেরিয়া - ডেঙ্গির নাম জানতে সচেতন হতে ঢের সময় লেগেছে।
আমাদের শীতকাল যে খুব আরামপ্রদ ছিল তাও নয়। সাপেদের মত শীত ঘুম দিয়ে সারা শীতকালটা কাটিয়ে ফেলতে মন চাইত। তখন পাড়া গাঁয়ে শীত পোশাকের তেমন চল ছিল না। একটা চাদর মাত্র। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঐ এক সম্বল। গায়েই গন্ধ হয়, গায়েই রোদ পেয়ে গন্ধ কেটে যায়। পৌষ-অগ্রহায়ণে জমি থেকে আমন ধান উঠত। জলা নাবলা জমিতে মোটা ধানের চাষ হত। আর ডাঙা জমিতে সরু ভাসা মানিক মোটা ধান, মেগি ধান। এখন আর সেসব কিছু নেই। এখন মিনিকেট, রত্না, চল্লিশো-চুরানব্বই কত কী চাষ হয়।
ফাল্গুন আর চৈত্র মাস যদিও গ্রাম জীবনে বড় মধুর মাস। শীতের শেষ থেকে বিঘের পর বিঘে তখন সর্ষে ফুলের হলুদ কার্পেটে ঢেকে থাকে। শিমুল - পলাশ গাছগুলোও তাদের লজ্জায় রাঙা মুখ দেখায়। উপরে তাকালে নীল আকাশ। আর নিচে হলুদ ফুলের চাদরের ফাঁকে শিমুল - পলাশের লাল কারুকাজ। এসময় কৃষাণের ভাঁড়ার ভরে ওঠে নতুন নতুন শস্যে। বোরো ধান পেকে ওঠার সময়। সোনালি গমও পেকে গিয়ে ঘরে তোলার সময় হয়। আলু চাষিদের মুখ আলো করে উঠোন, ছাদ, বারান্দা, খাট-চৌকির তলা ভরে ওঠে আলুতে।
জেঠিমার মুখে শোনা গল্প বলার ফাঁকে আমার জীবনের একবারকার একটা ঘটনা বলি। এমনই আলু ওঠার পরে পরে সেবার আমি বাবা-মায়ের সাথে গ্রামের জেঠুর বাড়ি গেছি। বাবা গ্রামের জমি বেচে দিয়েছে তার কিছু আগেই। আমরা পাকাপাকি শহরের বাসিন্দা। মাঝে মধ্যে শুদ্ধ বাতাসের সন্ধানে গ্রাম্য পরিবেশে প্রকৃতির সান্নিধ্যে ছুটি কাটাতে যাওয়া হয় শুধু। সঙ্গে করে নিয়ে আসা হয়, বেশ কয়েক মাসের জন্য চাল - আলু - ডাল, শীতের ফুলকপি, বাঁধাকপি আরো অনেক কিছু সারবিহীন টাটকা সব্জি।
গ্রামের বাড়িতে খাটগুলোর পায়ার নিচে ইঁট, কাঠ দিয়ে উঁচু করে রাখা হত। যাতে খাটের তলাটা ব্যবহার করা যায়। জেঠিমার খাটটাও তেমন অনেক উঁচু করা। খাটের তলায় ছড়িয়ে থাকে আলু, পেঁয়াজ অন্যান্য সব্জিরা। তখন আমার আট, কী নয় বয়স। রাতে ঘুমানোর সময় ঘুমের ঘোরে খাট থেকে নিচে পড়ে যাই। কপাল ফুলে ঠিক মাঝারি সাইজের আলু হয়ে ওঠে। কয়দিন পর গ্রামের বাড়ি থেকে যখন শহরের বাড়িতে ফিরি তখন সবাই দেখে হাসে। দ্যাখে, বস্তায় করে আলুই শুধু আসেনি, কপালে করে আলুও নিয়ে এসেছি। যে আলুতে রান্না হয় না বরং টিপলে ব্যথা করে।
ধান পোঁতার সময় থেকে পেকে ওঠা পর্যন্ত টানা দুমাস বাপ-কাকাদের কর্মব্যস্ততা বেড়ে যেত তখন। এখনও আমার ছেলেপুলেদের এমন পরিশ্রমে দিন কাটে। তবে এখনকার মত তখন সারাবছরের জন্য নাগাড়ে অর্থাৎ লেবার রাখা থাকত না। যাদের এখন ক্ষমতা আছে তাদের ঘরে সারাবছর আদিবাসী নাগাড়ে থাকে। আমাদেরও আছে চারজন। কিন্তু আগে নিজেদেরই মাঠে নামতে হত। ধান চারা পুঁতে জল দেওয়ার জন্য ডোঙা ব্যবহার করা হত। ডোঙা দেখতে ছিল অনেকখানি নৌকার মত। প্রথমে দড়ি ধরে টেনে একদিকে কাত করে ডোঙায় নদীর জল ভরা হত, তারপর দড়ি ছেড়ে দিলে ডোঙা অপরদিকে কাত হয়ে জমিতে সেই জল ঢেলে দিত। যা ছিল অনেক পরিশ্রমের কাজ। আজকের চাষি ভাইরা অনেক সুখ পেয়েছে। এখন পাম্প করেই জমিতে জল ছড়িয়ে দেওয়া চলছে। সবুজ ধান পেকে উঠলে যখন সোনালি রঙ আসত তখন আবার কয়দিন চলত প্রচন্ড ব্যস্ততার দিন। একবার অকাল বর্ষণ হলেই যে সব শেষ হয়ে যাবে, তাই ঠাকুর স্মরণ করে জমিতে নেমে পড়ত সব। প্রথমে ধান কেটে বিছিয়ে রাখার কাজ। তারপর জমিতে দাঁড়িয়েই চলত হাত দিয়ে আছড়ে আছড়ে ঝাড়ার কাজ। এখন সেটাও মেশিন দিয়ে করা হচ্ছে। জমি থেকে ঝাড়া ধান আগে গরুর গাড়ি করে বাড়িতে এসে পৌঁছত। আজ আসে ইঞ্জিনের গাড়িতে ভটভট ভটভট আওয়াজ তুলে। উঠোনে বিছিয়ে দেওয়া হয় সেই ধান। তারপর আমার বৌমারা পা দিয়ে উল্টে পাল্টে নীচের ধান উপরে, উপরের ধান নিচে করে রোদ খাওয়ায়। আগে আমি করেছি। এখন আর পারি না। এখন আমার দায়িত্ব নাতিগুলোকে নিয়ে পাখি তাড়ানো। পায়রা, ঘুঘু, ছাতারে, শালিখ সব চারিদিকে এসে ঘুরঘুর করে। একটু নজর সরালেই ঠোঁটে করে ধান তুলে নিয়ে চলে যায়, বট - অশ্বত্থ গাছের ডালে নিজের বাসায়। আর ঘুঘু-পায়রার ছানাগুলো আশেপাশে বাড়ির ফাঁক-ফোকরেই লুকিয়ে মুখ বাড়িয়ে থাকে।
ধান যখন রোদে ওলোট পালোট করে শুকিয়ে ওঠে, তাকে ডেকের ভাপে সেদ্ধ করে জলে চুবিয়ে রাখা হয়। যে ধান থেকে মুড়ি বের করা হবে, তারবেলা এমন ভাবে দু'বার, কখনো তিনবার করা হয়। আর চাল বের করার জন্য একবার সেদ্ধ করে ভিজিয়ে রাখলেই চলে। আগে সেদ্ধ ধান মাটিতে করে রাখা গড়ে বা গর্তে ঢেলে মুসুলি দিয়ে পেষা হত। দু'জন মহিলা মিলে ঢেঁকিতে পা দিতাম। এই কাজ মা-কাকিমাদের করতে দেখে গ্রামের সব মেয়েরাই ছোটবেলা থেকে শিখে নেয়। একজন ঢেঁকির মাথার কাছে বসে সুকায়দায় খোসা ছাড়ানো সেই চাল গড় থেকে তুলে পায়ড়ায় মানে কুলোয় ঝাড়ে। কী অভিনব তার প্রশিক্ষণ। মুসুলি ঢুকছে বেরুচ্ছে গড়ে, আবার হাতও ঢোকানো হচ্ছে খোসা ছাড়ানো চাল তুলতে, কিন্তু হাতে এসে মুসুলির আঘাত লাগছে না। এমনই সময় ধরে পুরো কাজটা চলত। তারপর চ্যাঙারি করে তুলে তিন চারবার এভাবেই পুনরাবৃত্তি চলত।
ঢেঁকিঘর মুখর হয়ে থাকত মা-কাকিমাদের গানের মধ্যে দিয়ে -
“ও ধান ভানিরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া
ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া-দুলিয়া
ও ধান ভানিরে..”।
আমি যখন বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি আসি আমার সাথে যৌতুক হিসেবে একটা দামি কাঠের ঢেঁকি দিয়েছিল বাবা। আমি, আমার জা, শাশুড়ি সবাই মিলে দিনের পর দিন সেই ঢেঁকিছাটা চাল বের করেছি। কিছু বছর আগে পর্যন্ত ঢেঁকিটা বছরে একবার করে পাতা হত পৌষ - পার্বণের পিঠের সময়। এখন তুলে রাখা রয়েছে। ঢেঁকির কাঠে ঘুণ ধরেছে। মাটির গড়ও বুজে গিয়েছে। এখন ঘরে ঘরে শুধু হাস্কিং মেশিন থেকে চাল ভাঙিয়ে আনা হচ্ছে আর খাওয়া হচ্ছে।
জেঠিমার মুখে কথাগুলো শুনতে শুনতে মনে পড়ে যাচ্ছিল, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি কমলকান্তকে। যিনি ঢেঁকির প্রয়োজনীয়তা চিন্তা করে বলেছিলেন,
“আমি ভাবি কি, যদি পৃথিবীতে ঢেঁকি না থাকিত, তবে খাইতাম কি? পাখীর মত দাঁড়ে বসিয়া ধান খাইতাম? না লাঙ্গুলকর্ণদুল্যমানা গজেন্দ্রগামিনী গাভীর মত মরাইয়ে মুখ দিতাম? নিশ্চয় তাহা আমি, পারিতাম না।”
ভাগ্যিস, কমলাকান্ত ঢেঁকি লুপ্ত হওয়ার আগে নিজে লুপ্ত হয়ে গিয়েছিলেন। নইলে আজকের হাস্কিং মেশিনে ভাঙানো চাল খেয়ে কী না কী বলতেন ভাবলেই ভয় গায়ে কাঁটা দেয়।
(ছবি : লেখিকা)
ক্রমশ....
0 Comments