জ্বলদর্চি

গ্রামের শহুরে রূপকথা- ৫ /সুরশ্রী ঘোষ সাহা

গ্রামের শহুরে রূপকথা- ৫

সুরশ্রী ঘোষ সাহা 

পঞ্চম পর্ব : বিশ্বাস- অবিশ্বাসের গল্প


দুপুরে শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ কী মনে হতে জেঠিমার কাছে জানতে চাইলাম, 'আচ্ছা, তুমি ভূতে ভয় পাও?'

 জেঠিমা উত্তর দিল, 'খুউব'...

 আমি হেসে উঠলাম, 'বলো কী? ভূত বলে কিছু হয় নাকি!'

 জেঠিমাও ততোধিক জোর দিয়ে বলল, - 
গ্রাম-গঞ্জে চিরকাল ভূত ছিল। আজও আছে। এই তো কিছুদিন আগেই হারুর ছেলেটাকে ভূতে ধরেছিল। মাটিতে শুয়ে পড়ে ছটফট করছিল। দাঁতে দাঁত লেগে গিয়েছিল। সন্ধ্যাবেলা চুল খুলে বাসন্তী নামের মেয়েটা ছাদে বসেছিল। ভূতে ওর চুল ধরে টান দিয়েছে।

 আমার এসব শুনে খুব হাসি পাচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম, হারুর নিশ্চয়ই মৃগী রোগ আছে। আর বাসন্তীর চুলটা কোন শিক বা পেরেকে আটকে গিয়ে টান পড়েছিল। তবু মুখে কিছু বললাম না। জানি, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। গ্রামের মানুষদের মনে ভূত - পেত্নি - শাঁকচুন্নি - ব্রক্ষ্মদত্যির অস্তিত্ব চিরকালই আছে। বিশ্বাস করি কী না-করি, ভূতের গল্প শুনতে বেশ ভালই লাগে। তাই মুখ গম্ভীর রেখে বললাম, 'বলো না, গো, তোমার দেখা শোনা সেইসব ভূতে ধরা কাহিনি।' 


 জেঠিমা বলল,  - 
ভূতে কি সবসময়ই ধরে বা দেখা যায়? ভূত আছে, তবে দেখা হয়ত সবসময় যায় না। অনুভব করা যায়। সে অনেকদিন আগের ঘটনা। ভরা অমাবস্যা ছিল সেদিন। আমাদের বাড়ির সামনের মাটির রাস্তার পরেই দুটো পুকুর ছিল খুব কাছাকাছি। আর পুকুরদুটোর মাঝে একটা সরু উঁচু আলপথ চলে গিয়েছিল ওপারের মাঠে। তখন গ্রামের এদিককার সব মানুষ এক হাতে গাড়ু ও অন্য হাতে তেলের কুপি নিয়ে ঐ আলপথ দিয়ে ওপারের মাঠে মলত্যাগ করতে যেত। খুব বেশি রাত করে কেউই প্রায় যেতে চাইত না। সন্ধ্যা আটটা কী সাড়ে আটটা মানে তখন গভীর রাত। একদিন অমন সাড়ে সাতটা কী আটটা বাজছে তখন। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। বাড়ির পিছনের বাঁশ ঝাড়ে বসে পেঁচা ডাকছে। পুকুরের পাড়ে ব্যাঙের কলরব। ছোট ভাই মাকে বলল, খুব জোর চেপেছে। মা বকল, সারাদিন হাবিজাবি খাবি আর রাতবিরেতে জ্বালাতন করবি। কিন্তু কী করবে, পায়খানা তো চেপে রাখা যায় না, বাধ্য হয়ে নিয়ে গেল মাঠে। কাজ মিটতে যখন ফিরতে শুরু করেছে, দ্যাখে কিনা, দুই পুকুরের মাঝের যে আলপথ দিয়ে গ্যাছে, সেটা নেই। দুই পুকুর মিলে মিশে বিরাট দীঘি হয়ে গেছে। আলপথ ডুবে গিয়েছে। তাহলে কীভাবে ফিরবে? বর্ষাকালের অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত। চারিদিক থেকে রাতচরা পাখির ডাক ভেসে এসে রাতের নীরবতা ভেঙে খানখান করে দিচ্ছে। এদিকে বেশ অনেকক্ষণ পার হয়ে যাবার পর ঘরে বাবার খেয়াল হয়েছে, ওরা এখনও ফিরল না কেন? এত তো দেরি হবার কথা নয়! বেরিয়ে দ্যাখে, সর্বনাশ হয়েছে। আলপথ সম্পূর্ণ জলে ডুবে গেছে। পাড়ার বিরেন কাকাকে নিয়ে বাবা অন্য পথ ধরে মাঠ থেকে মা আর ভাইকে আনতে বেরিয়ে পড়ে। মাঠে গিয়ে দ্যাখে, মা আর ভাই কোথাও নেই। বিরাট মাঠ। হাতে ধরা হ্যারিকেনের আলোয় যদ্দুর দেখা যায় দু'জনে খুঁজে বেরায়। অনেক ডাকাডাকি করে। কোন সাড়া নেই। শেষমেশ খুঁজে না পেয়ে ঘুরপথে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরে আসে। 

 ঘরে ফিরে দ্যাখে, মা আর ভাই অনেক আগেই চলে এসেছে। পথে তো দেখলাম না তোমাদের, তাহলে তোমরা কীভাবে এলে? জানতে চায় বাবা। মা বলে, পুকুর ঘাটে বসির মাঝির যে ছোট নৌকাটা বাধা থাকে বারো মাস, সেটা করে ফিরেছি। বাবা অবাক হয়ে যায়, বসির তো গতবছরের কলেরায় মারা গেছে। তাই তো ওর ছেলে নৌকাটা নদী থেকে নিয়ে এসে পুকুর পাড়ে বেঁধে রেখেছে। ও নৌকা তো দেখেছি ভাঙাচোরা - অচল। আর তাছাড়া নৌকা টানলই-বা কে? বসিরের ছেলে নাকি! মা বলে, অন্ধকারে তাকে তো চিনতে পারিনি! নৌকাটা আচমকা এসে ওপারে আমাদের সামনে দাঁড়াল। আমার কাছে জানতে চাইল, 'মা, ঘর যাবে নাকি?' বললাম, 'যামু তো, ভাগ্যিস আইলে।' তারপর এপারে নামিয়ে দেওয়ার পর ডাঙায় উঠে দেখি, নৌকাটা খালি বাঁধা আছে। মানুষ কোথাও কেউ নেই!

 জেঠিমা থামল। বলল, এটা তো বাড়ির ঘটনা। এমন বহু বহু অলৌকিক ঘটনা গোটা গ্রামে বহু মানুষের সাথে ঘটে আসছে চিরকাল ধরে। তোকে আরেকটা ঘটনা বলি। যদিও সেটা আমার শোনা ঘটনা। পাড়ার এক বউ সাবিত্রীকে কিছুদিন ধরে ভূতে ধরেছিল। কিছুতেই ছাড়বে না। বউটা থেকে থেকে অজ্ঞান হয়ে যেত। হাবিজাবি কথা বলত। নাম জানতে চাইলে বলত, ওর নাম মন্দিরা। ও গ্রামের পুরনো কালী মন্দিরের দেবদাসী। অথচ আমাদের গ্রামে একটাই কালী মন্দির। এবং তখনকার কোন মানুষজন গ্রামের ঐ কালী মন্দিরে কোন দেবদাসী ছিল বলে দ্যাখেনি কিংবা শোনেনি। গ্রামের সবাই বিষয়টা নিয়ে পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে যায়। তিনি সাবিত্রীর স্বামী শিবুকে ডেকে পাঠান, সে তখন সুদূর দক্ষিণভারতের কর্ণাটকে কাজ করছে। কিছুমাস আগেই একবার এসেছিল পরিবারকে রেখে যেতে। শিবু মাঝে মধ্যে এসে ওর পরিবারকে ওখানকার বাসায় নিজের কাছে নিয়ে যেত, আবার এসে রেখে যেত। সাবিত্রীর অমন আচার আচরণ কর্ণাটক থেকে ফেরার পরপরই শুরু হয়েছিল। শিবু এসে সব দেখে শুনে বলল, নিশ্চয়ই সাবিত্রীকে দক্ষিণভারতের কোন দেবদাসী ভূতে ধরেছে। দক্ষিণভারতে দেবদাসী প্রথা তখন ভাল রকমে চালু আছে। সেখানে নারীদের দেবতার নামে 'উৎসর্গ' করা হয়। প্রায় হাজার বছরের পুরনো এই প্রথা ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতির মাধ্যমে পালন করা হয়। দেবদাসী করার জন্য গরিব ঘরের মেয়েদেরকেই সাধারণত বাছা হয়। গরিব ঘরের মা-বাবা তাঁদের কুমারী মেয়েকে রজঃস্বলা হবার আগেই নিয়ে আসে মন্দিরে৷ প্রথমে কুমারী মেয়েদের নিলাম করা হয়৷ তারপর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত 'উৎসর্গ' করার নামে বিগ্রহের সঙ্গে কুমারী মেয়েদের তথাকথিত বিয়ে দিয়ে দেন৷ উৎসর্গের পর দেবদাসীকে ভোগ করার প্রথম অধিকার হয় মন্দিরের সেই প্রধান পুরোহিতের৷ এরপর অন্য কোনো পুরুষ আর ঐ মেয়েটির স্বামী হতে পারে না৷ খাওয়া-পরার বিনিময়ে মন্দিরে থেকেই তাঁদের সারা জীবন কাটে। সারাদিন প্রচুর শারীরিক পরিশ্রম তো থাকেই, পাশাপাশি মন্দিরের প্রধান পুরোহিত থেকে শুরু করে মন্দিরের অন্যান্য পুরুষদেরও যৌন লালসার শিকার হতে হয়৷ সমাজের উচ্চ বর্গীয় ধনী কিংবা সামন্ত প্রভুদের রক্ষিতার ভূমিকাও পালন করতে হয়৷ মন্দিরের পূজারি ব্রাহ্মণ এবং সামন্ত প্রভুদের যোগসাজশে কৃষক, কারুশিল্পী বা কারিগরদের ওপর ধর্মীয় প্রভাব খাটিয়ে দেবদাসীদের বেশ্যাবৃত্তিকে সেখানে ধর্মীয় শিলমোহর দেয়া হয়৷ মন্দিরে পূজার কাজ ছাড়াও এদের নাচ গান করতে হয়৷ তাই এদেরকে নাচনিও বলে। 

 গ্রামের বয়স্ক অভিজ্ঞ মানুষরা সবাই শিবুর কথা শুনে বুঝতে পারে তেমনি কোন নাচনি দেবদাসীর ভূত আমাদের গ্রামের সাবিত্রীর উপর ভর করে এই বাংলায় চলে এসেছে। গ্রামের মানুষ তখন ওঝা ডেকে আনে। সে সময় ওঝারাই এইসব ভূতের উপদ্রব থেকে মুক্তি দিত। ওঝা সাবিত্রীর উপর ঝাড়ফুঁক করতে শুরু করে। মাটিতে ফেলে ঝাঁটা দিয়ে পেটাতে থাকে। এমনভাবে তিনদিন ধরে টানা সাবিত্রীর ভূত ছাড়ানোর চেষ্টা চলে। অবশেষে সাবিত্রীর দেহটাকে মন্দিরা দেবদাসীর ভূত ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। 


 জেঠিমার মুখে সাবিত্রী নামক সেই মহিলার ভূতে ধরা কাহিনি শুনে খুব মায়া লাগে। সেই ঘটনা ছিল আমার কাছে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের উর্ধ্বে। ভূত আছে কী নেই তা তো তর্কের ব্যাপার। কিন্তু আমাদের ভারতবর্ষে সেবাদাসী বা দেবদাসী প্রথা যে সুদীর্ঘকাল ছিল তা তো সকলেই জানি। হালে ১৯৮৮ সালে, এই কুপ্রথা কর্ণাটক রাজ্য থেকে আইন করে নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়। ভাবা যায়! 
                                                                      (ক্রমশ...) 
ছবি : লেখিকা

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

0 Comments