জ্বলদর্চি

নীরদচন্দ্র ও ঈশ্বরচন্দ্র /সুগত ত্রিপাঠী

নীরদচন্দ্র ও ঈশ্বরচন্দ্র

সুগত ত্রিপাঠী


শ্রীশ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী মহোদয় সমীপেষু—

পরমপূজ্যপাদ,
চরণযুগলে শতকোটি প্রণামান্তে অধমের নিবেদন এই,আপনি,স্বনামধন্য শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী মহোদয়, 'ঈশ্বরচন্দ্র অবশ্যই মহাপুরুষ, শ্রেষ্ঠ বাঙালি নন' শীর্ষক একখানি প্রবন্ধ রচনা করিয়াছেন এবং উক্ত প্রবন্ধে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে শ্রেষ্ঠ বাঙালি বলিয়া স্বীকার করিতে অস্বীকৃত হইয়াছেন। প্রবন্ধটিতে আপনি যে ছয় জন বাঙালিকে 'শ্রেষ্ঠ' শিরোপা দিয়াছেন তাঁহারা আপনার ভাষায় 'শ্রেষ্ঠত্ব অনুযায়ী পরপর' এইরূপ --- রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, কেশবচন্দ্র সেন, বিবেকানন্দ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও সুভাষচন্দ্র বসু। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের স্থান ইঁহাদের মধ্যে হয় নাই।
                            কেন আপনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে শ্রেষ্ঠ বাঙালি বলিয়া স্বীকার করেন নাই,তাহার পশ্চাতে কিছু যুক্তি দিয়াছেন। সেই যুক্তিগুলির মধ্যে যেগুলি বিসদৃশ  বলিয়া মনে হইয়াছে, সেগুলি লইয়া আলোচনা করাই বর্তমান পত্রের উদ্দেশ্য।
                            নীরদবাবু, আপনার প্রথম যুক্তিটি এইরূপ:"তিনি সংস্কৃতে মহাপন্ডিত ছিলেন, কিন্তু তাঁহার প্রথম সংস্কৃত শিক্ষা গতানুগতিক হইলেও তিনি চিরপরিচিত বাঙালি টোলের পন্ডিত হন নাই। একটি দৈহিক ধর্মেই উহার পরিচয় পাওয়া যাইত --- সারা জীবনেও তাঁহার ভুঁড়ি হয় নাই, অথচ ভুঁড়িবিহীন সংস্কৃত পণ্ডিত অকল্পনীয়, এইরূপ পণ্ডিতের লৌকিক আখ্যাই ছিল 'ভুঁড়ে ভটচাজ'।"
                                 ভুঁড়িবিহীন সংস্কৃত পণ্ডিত যদি আপনার নয়নগোচর না হইয়া থাকে, মদীয় বাসগৃহে সাদর আমন্ত্রণ রহিল। এ নরাধম আপনাকে অনেকগুলি ভুঁড়িবিহীন ভটচাজ দেখাইয়া দিতে সমর্থ হইবে। ইংরেজি খানা হয়তো খাওয়াইতে পারিব না, তবে ডাল, ভাত, টাটকা মৎস্যের ঝোলের বন্দোবস্ত থাকিবে --- এ আশা রাখি। মূলকথা, বহু সংস্কৃত টুলোপণ্ডিত আছেন, যাঁহাদের ভুঁড়ি নাই,পরন্তু তাঁহারা কৃশকায়। এ অদ্ভুত যুক্তির অবতারণা করিয়া আপনি নিজের কোন্ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলেন ?
                         ঈশ্বরচন্দ্রের 'বর্ণপরিচয়' প্রথম ভাগের বহু পরিচিত রাখাল ও গোপালের গল্পে গোপাল সম্পর্কে আপনি যে উক্তি করিয়াছেন তাহা --- " 'সুবোধ'গোপাল হাস্যাস্পদই হইয়াছিল।" আপনি বোধকরি বাড়ি বাড়ি গিয়া শিশু ও তাহাদের পিতামাতাদের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া এই সিদ্ধান্তে আসিয়াছেন। অথচ বাস্তব যা তাহা হইল, সুবোধ গোপালকে সকলেই ভালোবাসিত। সকল ছাত্র-ছাত্রীর সমর্থন ছিল গোপালের আচরণের প্রতি, কেহই হাসিত না। সম্ভবত একা একা বসিয়া আপনি নিজেই হাসিতেন। একা একা বসিয়া যে আপনমনে হাসে তাহাকে কী বলে, বলিয়া দেওয়ার প্রয়োজন নাই বোধকরি।
                               মন্তব্য করিয়াছেন এইরূপ:" তাঁহাকে বাংলা সাহিত্যের স্রষ্টা বলিতে হইলে কেবলমাত্র 'সীতার বনবাস' ও 'শকুন্তলা'র উল্লেখ করিতে হয়।... এই দুইটি বই বাঙালি বালকেরা ও মেয়েরা পড়িয়া অভিভূত হইয়া পড়িত সত্য, তবে কেহই সীতা বা শকুন্তলা হইতে চাহিত না,...।"
                           কোনও কাহিনী পাঠ করিলে সেই কাহিনীর চরিত্রের ন্যায় নিজেকে হইতে হইবে, এ ভাবনাটাই তো অদ্ভুত।
                              তাহা হইলে ' জুলিয়াস সিজার ' পড়িতে বসিলে নিজেকে কী ভাবিব,বলিয়া দিন।সিজার?ব্রুটাস? ক্যাসকা? ' শ্রীকান্ত ' পড়িতে বসিলে? কী ভাবা উচিত নিজেকে? রাজলক্ষ্মী? শ্রীকান্ত?ইন্দ্রনাথ?
                         আশ্চর্য!
                          ঈশ্বরচন্দ্রের অ-বাঙালিত্ব লইয়া আপনার পরবর্তী মন্তব্য: "তিনি পুত্র নারায়ণচন্দ্রের আচরণে বিরক্ত হইয়া তাঁহাকে ত্যজ্যপুত্র করিতে চাহিয়াছিলেন। উহা হিন্দুর ধারা নয়; পুত্র সম্বন্ধে হিন্দুর মোহ ধৃতরাষ্ট্রীয়।উহার ব্যতিক্রম ভারতবর্ষে আধুনিককালেও দেখা যায় নাই।"
                               মিথ্যা বলিলেন।
                              ভিন্ন ধর্মে (বিশেষত ইসলাম, কিয়দংশে খ্রিস্টানও) বিবাহ করার কারণে পিতা পুত্রকে ত্যজ্য করিয়াছেন, এরূপ দৃষ্টান্তের অভাব নাই। আলস্য ছাড়িয়া খোঁজ করুন।
                         আপনার একটি মন্তব্য:"ঈশ্বরচন্দ্রের দ্বিতীয় মহত্ব দানপরায়ণতায়। হিন্দু সমাজে দানপরায়ণতা যে ছিল না তাহা নয়, তবে উহার একটা প্রথাগত দিক ছিল, যেমন, ধর্মের জন্য দান, ব্রাহ্মণের জন্য দান, ইত্যাদি। মানুষের দুঃখ বা অভাব দেখিয়া অর্থসাহায্য করা সচরাচর দেখা যাইত না।" অন্তত একজন লোকের নাম করিতে পারি, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, যিনি আপনার নির্ধারিত দুটি কারণের কোনওটির জন্যই দান করেন নাই। দাতা হিসাবে চিত্তরঞ্জন দাশ-এর পরিচয় নিশ্চয়ই আপনার মতো পণ্ডিতপ্রবরকে প্রদান করিতে হইবে না।'সচরাচর' শব্দটি প্রয়োগ করিয়া এতবড় দানশীল ব্যক্তির নাম কী সুকৌশলে এড়াইয়া গেলেন। 
                        আপনি বলিতেছেন,"দীন বাঙালি ভিন্ন অন্য কেহ ঈশ্বরচন্দ্রকে দানের জন্য ভক্তি করিত না।"
                                  তাহাই যদি হয়, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস কেন বিদ্যাসাগরের সমীপবর্তী হইয়া তাঁহাকে প্রশংসায় ভরাইয়া দিয়াছিলেন? শ্রীরামকৃষ্ণ বলিয়াছিলেন বিদ্যাসাগরের অসামান্য দয়ার কথা। এই দয়ার পরিচয় তিনি পাইলেন কিরূপে? দাতা বিদ্যাসাগর হইতেই তো। শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে আপনার জ্ঞানের স্বল্পতা থাকিতে পারে, কিন্তু তিনি আর যাহাই হউন,' দীন বাঙালি 'বলিতে যাহা বুঝায়, তাহা ছিলেন কি?' চালকলা প্রত্যাশী ' হইয়া শ্রীরামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগরের নিকট গিয়াছিলেন,এরূপ তথ্য পাওয়া যায় নাই।আপনার কাছে যদি থাকে এরূপ কিছু,জানাইবেন,কৃতজ্ঞ থাকিব।
                            পরবর্তী মন্তব্য:"ঈশ্বরচন্দ্রের অবাঙালি শ্রেষ্ঠত্বের প্রসঙ্গে তাঁহার পুস্তক ক্রয় এবং পুস্তকসংগ্রহের কথাও বলিব। বাড়িতে পুস্তক রাখা বাঙালির লৌকিক জীবনে ছিল না।"অথচ কিছু পরেই বলিতেছেন,"ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে লাইব্রেরী করিবার ধারা কলিকাতার নব্য বড়লোকদের মধ্যে দেখা দিল। তবে প্রথমে উহা গৃহসজ্জা হিসাবে, বড়লোকপনা দেখাইবার জন্য, পড়িবার জন্য নয়। এই নতুন ধারার বিবরণ ১৮২৩ সনে প্রকাশিত ' কলিকাতা কমলালয়ে ' আছে।"
                          অর্থাৎ আপনার বলা উচিত ছিল, পড়িবার উদ্দেশ্যে বাড়িতে পুস্তক রাখা বাঙালির লৌকিক জীবনে ছিল না, ছিল গৃহসজ্জার উপকরণ হিসাবে রাখা। 'পড়িবার উদ্দেশ্যে'কথাটি অনুল্লিখিত থাকার ফলে অর্থ পাল্টাইয়া গিয়াছে।
                            কিন্তু প্রায় সমসাময়িক একজনের কথা উল্লেখ করিতেই হয় যাঁহার পুস্তকাগারটি সুসমৃদ্ধ ছিল। তিনি স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়।
                             মজ্জাগত(প্লাজমাগতও) ইংরেজ স্তাবকতার কারণে আপনি ইংরেজদিগের পুস্তকপ্রীতির প্রসঙ্গ আনিয়াছেন, কিন্তু এ তথ্যটি দিতে বিস্মৃত হইয়াছেন। 
                                    প্রবন্ধে বিদ্যাসাগর-প্রসঙ্গের অন্তিম উক্তিটি:"কেহ চরিত্রবলে বিদ্যাসাগরের অনুকারী হইতে চাহিতেছেন না," --- বড় বালখিল্য হইয়া গেল। কারণ একথা শুধু বিদ্যাসাগর কেন, সকল মহামানবের ক্ষেত্রে তো সত্য। এবং ইহার মধ্যে তো কোনও অস্বাভাবিকতা নাই, অপরাধ বলিয়াও মনে হইতেছে না। উক্তিটিই হাস্যকর।
                       শুনা যায় না, অতি নিষ্ঠাবান খ্রিষ্টানও উৎকট অত্যাচারিত হইতে হইতে'প্রভু, তুমি ইহাদের মার্জনা করো, ইহারা কী করিতেছে, ইহারা জানে না' স্মরণ করিয়া সহিষ্ণুতার সহিত সে অত্যাচার সহ্য করিয়াছে। এক গালে চড় খাইয়া অপর গালটি  বাড়াইয়া দিবার কাহিনীও কিছু নাই।
                        রবীন্দ্র-চর্চাকারী, মানুষের প্রতি বিশ্বাস প্রতিনিয়তই হারাইতেছে এবং ইহার জন্য কণামাত্রও পাপবোধ তাহার নাই (বলা হইল এই কারণে যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁহার এই উক্তি নিজের জীবনে প্রতিফলিতও করিয়াছিলেন)। অপর রবীন্দ্র অনুরাগীটি ঘোরতর সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন।
                        সক্রেটিস-বিশেষজ্ঞ দর্শনের অধ্যাপক প্রথম বিবাহ গোপন করিয়া দ্বিতীয় বিবাহ করেন। মুদি-মসলা বিক্রেতা ভুলক্রমে তৈলের দামটি লইতে ভুলিয়া গেলে নিরতিশয় আহ্লাদিত হন। --- সেই সক্রেটিস যিনি সত্যকে পরিত্যাগ না করার কারণে বিষপান করিয়া আত্মহননে বাধ্য হইয়াছিলেন।
                শ্রীচৈতন্যের জীবনী পাঠ করার পর কেহ প্রেমভক্তি বিতরণের জন্য বাহির হইয়াছে, জানা যায় না।
                    'তাত্ত্বিক' কমিউনিস্ট রাজনীতিক সন্ধ্যা- আহ্নিক না করিয়া জলস্পর্শ করেন না পাপের ভয়ে।
                  শ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্ত বলাৎকারের অপরাধে কারাবন্দি।
               অলমতিবিস্তরেণ ------      
                                        
                                
   ভবদীয়
     দাস
 সুগত ত্রিপাঠী।
মুগবেড়িয়া, পূর্ব মেদিনীপুর।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments