জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা /পর্ব ১০/প্রীতম সেনগুপ্ত


শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা
পর্ব ১০

প্রীতম সেনগুপ্ত


 ভগবানের লীলা বোঝা দায়। ঈশ্বরাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ ও তাঁর মানসপুত্র রাখালচন্দ্রের পারস্পরিক ব্যবহার লক্ষ্য করলে ঐহিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া ভার। ঘটনাচক্রে রাখালচন্দ্রের বিবাহ হয়েছিল। যে পরিবারে হয় তা ভক্তের সংসার। তাঁর শ্বশ্রূমাতা শ্রীরামকৃষ্ণ চরণে আশ্রয় পেয়েছিলেন পূর্বেই। তিনি পুত্রকন্যা সমভিব্যাহারে প্রায়ই ঠাকুরের কাছে আসতেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ শ্যালক মনমোহনই ঈশ্বরভক্ত ভগিনীপতিকে সঙ্গে নিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ সন্নিধানে উপস্থিত হন। বাকিটুকু এক অভূতপূর্ব ইতিহাস। সংসারী করে তুলতে কৈশোর অতিক্রমের পূর্বেই পুত্র রাখালচন্দ্রের বিবাহ দেন আনন্দমোহন। কোন্নগরের সুপরিচিত মিত্রগোষ্ঠীতে বিবাহ হয়। আনন্দমোহন ভুলেও ভাবতে পারেননি পুত্রকে সংসারী করার যে চেষ্টা তিনি করেছিলেন সেই সূত্রেই সে মহত্তম আদর্শের সন্ধান লাভ করে সংসার বন্ধন চিরতরে ছিন্ন করবে! রাখালচন্দ্রকে দেখেই শ্রীরামকৃষ্ণ চিনতে পেরেছিলেন এই সেই তাঁর বহু আকাঙ্ক্ষিত ত্যাগী মানসপুত্র। তাঁকে দেখে পরম বাৎসল্যে স্বহস্তে খাইয়ে দিতেন। গোবিন্দ নাম উচ্চারণ করতে করতে সমাধিস্থ হয়ে যেতেন। কখনও কখনও ব্রজের ভাবে বিভোর হয়ে তাঁকে সাক্ষাৎ ব্রজের রাখাল জ্ঞানে নিজ স্কন্ধে তুলে নিতেন। বস্তুতপক্ষে রাখালচন্দ্রের তখন যৌবনোদ্গম ঘটলেও তিনি স্বভাবে শিশুর মতো ছিলেন। ঠাকুর তাঁর সঙ্গে শিশুর মতোই খেলায় মেতে উঠতেন। রাখাল অবাধ্য হলে আনন্দ পেতেন। একদিন আহারের পর তাঁকে বললেন,“ওরে রাখাল, পান সাজ না, পান নেই যে।” রাখাল প্রত্যুত্তরে বললেন,“পান সাজতে জানিনি।” “সে কি রে! পান সাজবি, তার আবার জানাজানি কি? যা, পান সেজে আন।” “পারবো না মশায়।” রাখালের সোজাসাপটা উত্তর। ঠাকুর হেসে আকুল। আবার প্রয়োজনে কড়া শাসনে নিরস্ত হতেন না। কিন্তু অপর কেউ তাঁর দোষের কথা তুললে বলতেন,“রাখালের দোষ ধরতে নেই, ওর গলা টিপলে দুধ বেরোয়।”
                          শ্রীরামকৃষ্ণ ও রাখাল -- উভয়ের এই লীলাবিলাসের চিত্রটি চমৎকাররূপে অঙ্কিত হয়েছে স্বামী গম্ভীরানন্দজী রচিত মীশ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্তমালিকা গ্রন্থটিতে। তিনি লিখছেন--“...মাতৃহীন রাখাল ভাবঘনতনু শ্রীরামকৃষ্ণকে আপন জননীরূপে পাইলেন এবং রাখালের আকৃতি তখন যুবার ন্যায় হইলেও শ্রীরামকৃষ্ণও তাঁহাকে ক্ষুদ্র বালক হিসাবে গ্রহণ করিলেন। তদবধি রাখাল প্রায়ই দক্ষিণেশ্বরে আসিতে লাগিলেন এবং কখনও বা সেখানে থাকিয়া যাইতে লাগিলেন। এইকালের অপূর্ব লীলা সম্বন্ধে ঠাকুর বলিয়াছেন,‘তখন রাখালের এমন ভাব ছিল, ঠিক যেন তিন-চারি বছরের ছেলে। আমাকে ঠিক মাতার ন্যায় দেখিত। থাকিতে থাকিতে সহসা দৌড়িয়া আসিয়া ক্রোড়ে বসিয়া পড়িত এবং মনের আনন্দে নিঃসঙ্কোচে স্তনপান করিত। বাড়ি তো দূরের কথা -- এখান হইতে এক পাও নড়িতে চাহিত না। আমাকে পাইলে আত্মহারা হইয়া রাখালের ভিতর যে কিরূপ বালকভাবের আবেশ হইত তাহা বলিয়া বুঝাইবার নহে। তখন যে-ই তাহাকে ঐরূপ দেখিত সে-ই অবাক হইয়া যাইত। আমিও ভাবাবিষ্ট হইয়া তাহাকে ক্ষীর-ননী খাওয়াইতাম, খেলা দিতাম। কত সময়ে কাঁধেও উঠাইয়াছি। তাহাতে তাহার বিন্দুমাত্র সঙ্কোচের ভাব আসিত না।’ ”
                             ঠাকুর একদিন বলেছিলেন,“রাখালের সাকারের ঘর, নরেনের নিরাকারের।” রাখাল প্রথম প্রথম যখন দক্ষিণেশ্বরে আসেন তখন নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে নিয়মিত ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত করতেন। নরেন্দ্রনাথের কথাতেই প্রাণিত হয়ে তিনি সমাজের প্রতিজ্ঞাপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন। ব্রাহ্মদের পক্ষে মূর্তিপূজা বা দেবদেবীকে প্রণাম করা গর্হিত কাজ। এদিকে শ্রীরামকৃষ্ণের সংস্রবে এসে রাখাল এইসব করতে শুরু করলেন এবং এটা তাঁর স্বভাবের অনুকূল হওয়ায় এতে আনন্দ পেতেন। ইতিমধ্যে নরেন্দ্রনাথও দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে যাতায়াত শুরু করেছেন। ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ অস্তিত্বের খোঁজে তিনি তখন প্রায় দিশেহারা। তৎকালীন ধর্মপ্রবক্তাদের কাছে সরাসরি প্রশ্ন করছেন--“আপনি কি ঈশ্বরকে দেখেছেন?” শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে আসা সেই কারণেই। এই মানুষটিকে সঠিকভাবে বুঝতে প্রয়াসী হলেন তিনি। কিন্তু প্রতিজ্ঞাপত্রের প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করতে দেখে শ্রীরামকৃষ্ণের অগোচরে রাখালকে তীব্র ভর্ৎসনা করলেন। স্বভাবত কোমলপ্রকৃতি রাখাল নরেন্দ্রনাথকে বেশ সমীহ করতেন।পারতপক্ষে তাঁর সঙ্গে কোনোরূপ তর্কে প্রবৃত্ত হতেন না। এই ঘটনার পর নরেন্দ্রনাথের সামনাসামনি হতে সঙ্কুচিত বোধ করতেন। ঠাকুরের নজরে বিষয়টি এড়ালো না, খোঁজ নিয়ে সব জানতে পারলেন। অতঃপর নরেন্দ্রনাথকে বললেন, “দ্যাখ্, রাখালকে আর কিছু বলিস নি। সে তোকে দেখলেই ভয়ে জড়সড় হয়। তার এখন সাকারে বিশ্বাস হয়েছে--তা কি করবে বল? সবাই কি একেবারে গোড়া থেকে নিরাকারে বিশ্বাস করতে পারে?” এইসময়ে একদিন একটি ঘটনায় সাকারোপসনা বিষয়ে বিশেষ অনুভূতি বা ধারণা লাভ করেন রাখাল। বৈষ্ণব মহাজনদের রচিত পদাবলীকীর্তন শুনতে শুনতে ঠাকুর নিজ গাত্র আবরণ ছিন্ন করে ফেলেন এবং তাঁর সর্বাঙ্গে অশ্রু-পুলক-কম্পাদি প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়। মহাভাবে আবিষ্ট হয়ে তিনি বলতে থাকলেন,“প্রাণনাথ হৃদয়বল্লভ কৃষ্ণকে তোরা এনে দে, সুহৃদের কাজ তো বটে! হয় এনে দে, না হয় আমায় ফিরিয়ে নিয়ে চল--তোদের চিরদাসী হব।” এই মহাভাব অতি বিস্ময়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করলেন রাখাল। এটা বুঝলেন নরেন্দ্রনাথ যাই বলুন না কেন, শ্রীকৃষ্ণের সাকাররূপজাত এই অপূর্ব সাত্ত্বিক বিকারের পিছনে এমন এক পরম অস্তিত্ব রয়েছে যা সমস্ত যুক্তিতর্কের অতীত।

                     এদিকে বাস্তব অতি রূঢ়! দক্ষিণেশ্বরে এমন অলৌকিক অনুষঙ্গে রাখাল যখন পরমানন্দে প্লাবিত হচ্ছেন, তখন অন্যদিকে তাঁর নিয়মিত অধ্যয়নের পরিসরটি অমনোযোগিতার কারণে উপেক্ষিত হতে শুরু করল। পিতা আনন্দমোহন স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনায় সুখী হতে পারলেন না। বিষয়ী আনন্দমোহনের মনে আশঙ্কার মেঘ জমা হতে থাকল। পুত্র কি অবশেষে সাধুসঙ্গের ফলে সাধু হয়ে যাবে? তিনি রাখালের দক্ষিণেশ্বর গমন নানাভাবে প্রতিহত করার চেষ্টা করতে থাকলেন। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হল না। শেষমেশ রাখালকে বাড়িতে অবরুদ্ধ করে রাখা হল। বাধা পেয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি তাঁর আকর্ষণ অধিকতর হল। অন্যদিকে ঠাকুরও তাঁকে না পেয়ে জগন্মাতার কাছে সাশ্রুনয়নে প্রার্থনা জানালেন,“মা রাখালকে না দেখে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। মা, আমার রাখালকে এনে দাও।” জগন্মাতা তাঁর এই প্রার্থনা শুনেছিলেন। এক অভাবনীয় উপায়ে বিষয়ী আনন্দমোহনের নজর এড়িয়ে রাখাল শ্রীরামকৃষ্ণসকাশে পুনরায় উপস্থিত হলেন! পুত্রকে পাশে বসিয়ে আনন্দমোহন একটি মোকদ্দমার কাগজপত্র অতি মনযোগ সহকারে দেখছিলেন। অন্য কোনোদিকে লক্ষ্য ছিল না। সুযোগ বুঝে রাখাল মৃদুপদবিক্ষেপে কক্ষত্যাগ করে সোজা দক্ষিণেশ্বরে চলে গেলেন। ব্রজের রাখাল পুনরায় উপস্থিত হলেন তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments