জ্বলদর্চি

আল মাহমুদ / ঈশিতা ভাদুড়ী

স্মৃতি ডট কম ৫

আল মাহমুদ 

 ঈশিতা ভাদুড়ী 

‘সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী / যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি, / আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনোকালে সঞ্চয় করিনি / আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি; / ভালোবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্বন, / ছলনা জানি না বলে আর কোনো ব্যবসা শিখিনি; / দেহ দিলে দেহ পাবে, দেহের অধিক মূলধন / আমার তো নেই সখী, যেই পণ্যে অলংকার কিনি। / বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল / পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না; / তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিয়ো সেই ফল / জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হব চিরচেনা / পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা; / দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা’ – লিখেছিলেন আল মাহমুদ ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যগ্রন্থে, ৬০-এর দশকে লেখা এই কবিতার বই তাঁকে শ্রেষ্ঠ মহাকাব্যের মর্যাদা দিয়েছে। ‘সোনালী কাবিন’ প্রেমের কবিতা হিসেবে বিখ্যাত। সেই প্রেমকে তিনি অভিনব ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। যদিও আমার মস্তিষ্কে প্রাথমিকভাবে আল মাহমুদের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে প্রেমের কবিতার যোজন দূরত্ব মনে হলেও পরবর্তীতে মনে হয়েছিল তাঁর সত্তা আপাদমস্তক প্রেমিক ছিল। শুধু আমার কাছে নয় বাংলা ভাষার মানুষের কাছে আল মাহমুদ প্রেমিক হয়ে থাকবেন তাঁর ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যগ্রন্থ এবং আরও অন্যান্য কবিতার মধ্যে দিয়ে। তিনি বলেছিলেন – আমি প্রেমের কবিতা লিখতে ভালোবাসি, অনেক লিখেছি। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসাই তো শেষ কথা…
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সেই অন্যতম প্রধান কবির সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার বাংলাদেশে গিয়ে। তিনি ‘সোনালী কাবিন’-এর কবি আল মাহমুদ, তিনি ‘কালের কলস’-এর কবি আল মাহমুদ। যদিও জাতীয় কবিতা উৎসবের অনুষ্ঠনে তিনি অনুপস্থিত (অনুপস্থিতির কারণ ইত্যাদি এই লেখার বিষয় নয়)। তাঁর অভিযোগও শুনেছিলাম, তিনি নাকি বলেছেন – কলকাতা থেকে কবিরা এলে কেউ দেখা করতে আসে না…। একথা সত্যি হোক বা না হোক, সময়াভাবে আমারও তাঁর বাড়িতে যাওয়া হয়নি। কিন্তু ২০০৬ সালে যখন পুণরায় ঢাকাতে গেলাম, তখন আমি গিয়েছিলাম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে তাঁর গুলশানের বাড়িতে।
তিনি খুবই আপ্যায়ণ করলেন, তাঁর নাতনী ছুটে ছুটে এসেছে বারবার আমাদের কথাবার্তা, চা-জলখাবারের মধ্যে। আল মাহমুদের সম্বন্ধে অনেক বিতর্কমূলক কথা শুনেছি। কিন্তু আমার সঙ্গে সেরকম কোনও আলোচনা হয়নি।
তিনি বললেন – আমার জীবন আগাগোড়া কবির জীবন। কাব্যচর্চার ভেতরেই বড় হয়েছি। কবিতা দিয়েই আমার লেখার সূত্রপাত। কিন্তু ভালো গদ্যও লিখতে পারতাম। কবিতার পাশাপাশি গদ্য লিখেওছি প্রচুর। তবে কবিখ্যাতি বেশী হয়ে যাওয়ার জন্যে প্রথমদিকে গদ্যে বেশি মন দেওয়া হয়নি। কিন্তু পরে ধীরে ধীরে চর্চা করে বাড়িয়ে দিয়েছি গদ্য লেখা। কেননা কবিদের গদ্য লেখা প্রয়োজন। কবিরা গদ্য লিখলে ভালো হয়। পশ্চিম দুনিয়ায় যারা ভাল কবি তারা সবাই গদ্যও লেখে ভালো। আমাদের এখানে কবিকে কবি হিসেবে আর গদ্যকারকে গদ্যকার হিসেবেই আমরা ভাবার চেষ্টা করি।
--আপনি তো অনেক ভালো ভালো গল্প-উপন্যাস লিখেছেন।
 --‘কাবিলের বোন’ তো খুবই সফল উপন্যাস।
--‘কাবিলের বোন’ মুক্তিযোদ্ধার ওপর পরিপূর্ণ উপন্যাস। আসলে সংবাদপত্রে চাকরি করেছি, তাই গদ্যটা আমি ভালোই লিখতে পারি, মানে আমার অভ্যেস আছে। আমি প্রবন্ধ, ছড়াও লিখেছি। সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রেই আমি আমার কলম ধরেছি। আমি গান লিখিনি কখনও, লিখতে ইচ্ছেও হয়নি। 
--কলকাতাতেও আপনার জনপ্রিয়তা আছে।
--আমি তো সেখানে ছিলাম অনেকদিন। কলকাতার অনেক পত্রিকায় আমি লিখেছি, বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় লিখেছি অনেক, এছাড়া ‘কৃত্তিবাস’, ‘ময়ূখ’ এবং আরও অনেক পত্রিকায় লিখেছি। আমার নামটা জানেন সেখানে সবাই। আমি যখনই কলকাতায় গিয়েছি, সম্মান পেয়েছি অনেক। মনে পড়ে একবার আনন্দবাজারে গিয়েছি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমাকে দেখে এত আনন্দ পেয়েছিল, জড়িয়ে ধরে সে কী চিৎকার! সারাদিন আমার সঙ্গে আড্ডা দিলো, কোনও কাজ করলো না।
--কলকাতায় আপনার লেখা নিয়ে সিনেমাও হয়েছে।
--হ্যাঁ হয়েছে, কিন্তু আমি দেখিনি সেটা। শুনেছি ভালোই হয়েছে। 
--আপনার বাড়িতে এরকম হঠাৎ করে চলে এলাম, বিরক্ত করলাম না তো?
--না-না, আমার বাসায় সারাদিন অনেক লোক আসে ভালোবেসে। আমিও ভালোবাসি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে।
আমার দু-একটি কবিতার বই দিয়েছিলাম তাঁকে, আমার সামনেই উলটে পালটে দেখলেন, ‘এবং হারিঞ্জা ফুল’ বইটির নামকরণ নিয়ে জানতে চাইলেন, প্রচ্ছদ নিয়েও কথা বার্তা বললেন। অনেক বছর আগে শিলং-এ যখন গিয়েছিলাম তখন বাগানে একরকম ফুল দেখে আমরা মালীকে নাম জিজ্ঞেস করায় যা বলেছিল আমরা শুনেছিলাম হারিঞ্জা, মালী কি বলেছিল জানিনা, আসলে ফুলগুলির নাম ছিল হাইড্রেঞ্জিয়া। বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকার সময় শিল্পী শুভাপ্রসন্নকে নাম বলতে পারিনি, ফুলের বর্ণনা দিয়েছিলাম, আর সেই বর্ণনা শুনে নিজের কল্পনা মিশিয়ে সুন্দর প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন। এই কাহিনী শুনে আল মাহমুদ খুব হাসলেন।
তিনি বলছিলেন তাঁর চট্টগ্রামের কথা, তাঁর অভাব-দারিদ্রের কথা, বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে দিয়ে দিনযাপন, নানা সুখ-দুঃখের কথা ইত্যাদি। তিনি বলে চলেছেন –  …অল্প বয়স থেকে কবি হতে চেয়েছি, এখন তো সবাই আমাকে কবি বলেও… কবির জীবনের প্রথম লক্ষ্য হলো লিখে যাওয়া, কবির কাজ হলো দেশকে জাতিকে স্বপ্ন দেখানো, তবে শুধু স্বপ্ন নিয়ে কল্পনার মধ্যে বাস করে কবিতা লেখা যায় না, বাস্তবের মুখোমুখিও হতে হয়, আমরা পঞ্চাশের কবিরা দুর্ভিক্ষ দেখেছি, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ দেখেছি, দেশভাগ দেখেছি, আমাদের ওপর দিয়ে অনেক ঝড় চলে গেছে। তাই আমাদের কবিতার মধ্যে বাস্তবতার ছবি থাকে, আমাদের কবিতার মধ্যে মানুষের হৃৎস্পন্দন থাকে… যা পাইনি তা’ নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই, জীবনে পেয়েছিও তো অনেক। তবে আমি তো মানুষ, মানুষের সবসময়ই কিছু-না-কিছু অতৃপ্তি থেকেই যায়। … জীবনের শেষ দিন অবধি আমি লিখে যেতে চাই, কারণ লেখা ছাড়া আর তো কিছু নেই আমার জীবনে… আমি কবিতা না লিখলে বাংলা সাহিত্যে কোনও ক্ষতি হতো কিনা জানিনা, তবে আমার হতো, লেখালিখি করেই তো আজকের আমি, আমার সব কিছু, এই বাসা, আমার বিদেশ যাওয়া, তারপর তোমরা যে আসো আমার কাছে সে’ তো এই লেখার জন্যেই… আমি জানি কবিতার জন্য আমাকে সবাই মনে রাখবে…

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments