জ্বলদর্চি

গ্রামের শহুরে রূপকথা-৩ / সুরশ্রী ঘোষ সাহা

গ্রামের শহুরে রূপকথা 

তৃতীয় পর্ব - বড় হওয়া

 সুরশ্রী ঘোষ সাহা 


দুটো কাপড়ের টুকরোকে কায়দা করে ভাঁজ করে আর তার সাথে এক কোমর মাপের একটা দড়ি হাতের মুঠোয় গুঁজে নিয়ে মা আমাকে টানতে টানতে নিয়ে এনে হাজির করল ভাঁড়ারের ঘরের পিছনের এক ছোট্ট ঘরে। বাবা - ভাই যাতে শুনতে না পায়, তাই ফিসফিস করে বলল, 'শোন, আজ থেকে তুই আর ছোট্ট মেয়ে নেই। বড় হয়ে গেছিস।'

 আমি অবাক চোখে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিছু মাস হয়েছে আমার আরো একটা ভাই হয়েছে। সে এখন মায়ের বুকের দুধ খায়। বড় ভাই কখনো সখনো বায়না করে। মা দিতে চায় না। রাগ রাগ মুখ করে বলে, 'খালি মাই চাওয়া, তাই না? যা এখান থেকে। এখন ভাত মুখে দিইছো আর মাই নয়।' তারপর মুখ ঘুরিয়ে মা বিড়বিড় করে, 'আমিও তো মানুষ! বছর ঘুরতে না ঘুরতে, বুকের দুধ শুকিয়ে যাওয়ার আগেই আবার মা হওয়া। সংসারে খেটে খেটে একে সার হচ্ছি তার উপর এই ধকল।' আমরা ভাই-বোনেরা বুঝতে পারতাম না, মা এই কথাগুলো কাকে বলত! আমিও বড় দিদির মতন ভাইকে বকা দিতাম, 'যা, পালা এখান থেকে।'

 আমাকে মায়ের তাই বড় হয়ে গেছিস বলায় মনে মনে ভাবলাম, যতই পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি সত্যিই তো আমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছি। আমার একটা বোন, দু-দুটো ভাই।

 কিন্তু মা আমাকে অবাক করে দিয়ে ন্যাকড়াটা পরাতে পরাতে বলল, - 
'যা বলছি শোন মন দিয়ে। তিনদিন এই ঘরের মধ্যে থাকবি। বাপ - ভাইদের ছুঁবি না। গোয়ালে যাবি না। এসময় গরু ছুঁতে নেই। পুকুরে যাবি না। তিনদিন চান করা বন্ধ।' 

 আমি কেঁদে ফেলি। 'কেন মা, আমি কী দোষ করলাম। আমাকে কেন একটা ঘরের ভিতরে বন্ধ থাকতে হবে?' 

 মায়ের গলার স্বর আরো নেমে এল, 'তুই অশুচি এখন। তিনদিন পর মাথায় গায়ে-সাবান মেখে চান করে গোমুত পান করে শুদ্ধ হ'স। তারপর যা কিছু করিস।' 

'গোমুত?' 

 একটা মেয়ের নারী হয়ে ওঠার জ্বালা যে কী, মায়ের জীবনটা না জানলে বুঝতাম না। মায়ের জীবনের কথাগুলো শুনে মনে হল আমি তবু সুখের জীবন পেয়েছি। মায়ের যখন বিয়ে হয়েছিল তখন নয় বছর বয়স। শ্বশুর বাড়ি কী জিনিস বুঝত না। বিয়ে করে এসে  শাশুড়ির সাথে শুতো। হাতে হাতে কাজ শিখত। মা বড় হয়েছিল আমার চেয়েও বেশি বয়সে। বড় হওয়ার পর মাকে বাবার সাথে একঘরে শুতে হয়েছে। আমি তো আজও বাপের বাড়িতে আছি। স্কুলে পড়াশোনা শিখছি। তবু প্রতি মাসের বড় হওয়ার ক'দিন, মন খারাপ করে থাকি। মাকে দেখতাম, তার জীবনের বড় হওয়ার দিনগুলো বাবা, কাকা, জ্যাঠাদের নিজের হাতে জল ও ভাত বেড়ে দেয় না। হয় ঠাকুমা-কাকিমারা দেয়, নয়ত আমার উপর আদেশ আসে। ঐ কয়টা দিন মায়ের সিঁথি সাদা হয়ে থাকে। সিঁদুর পরাও নিষেধ। গাছের ফুল ছুঁত না। ঠাকুর পুজোও দিত না। তখন আনাড়ি আমি তুলসী তলায় এসে সন্ধ্যার আঁধার গায়ে মেখে শাঁখে ফুঁ দিতে শিখলাম। 

 আমার প্রতিবন্ধী বোনও একদিন দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল। মা আমাকে যেমন মেয়েদের বড় হওয়া কী বোঝাতে পেরেছিল, বোনকে পারল না। সে মুখে গোঁ গোঁ আওয়াজ করত। রক্ত দেখে কেটে গেছে ভেবে হাউ-হাউ করে চিৎকার জুড়ত। অনেক কিছু বলতে চাইত, পারত না। মা আড়ালে চোখের জল মুছত। আর ওর নারী হওয়ার সব কাজটুকু করে দিত। ধোয়া - কাচা - রোদে শুকানো সবকিছু। বোনের প্রতি মায়ের আলাদা দুর্বলতা ছিল। সে যেন অন্য গ্রহের জীব। আমাদের ছোট্ট পৃথিবীতে কিছু দিনের জন্য এসেছে। আর বাবার ছিল আমার প্রতি টান। পড়া লেখা শিখছে সেই গ্রামের একমাত্র মেয়েকে নিয়ে বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল। আশেপাশে সব ঘরেই আমারই বয়সী মেয়েরা তখন সংসারের কাজ করে। পুকুরে যায় বাসন মাজতে, কাপড় কাচতে। চাষের জমিতে যায় আলু তুলতে। এছাড়াও মূলো, সিম, বরবটি গাছের সেবা করে। কেউ-বা বাবার ছোট মুদিখানা দোকানে বসে তেল - নুন - আটা বেচে। কেউ-বা সপ্তাহে একদিন হাটে গিয়ে বসে। আর আমি বাবার হাত ধরে হাটে যাই, প্লাস্টিকের চুরি - গায়ে মাখার সাবান - মাথার চুলের রিঠা আনতে। সারারাত রিঠা ভিজিয়ে রেখে পরের দিন সেই রিঠা ভেজানো জলে মাথা ধোওয়া ছিল তখন আমাদের সূক্ষ্ম বিলাসিতা। মায়ের জন্য বছরে একটা কাপড়, আমাদের বোনেদের জন্য ফ্রক আর ভাইদুটোর জন্য একই ছিটের কাপড়ের দুটো শার্ট কিনে এনে দিলে আমরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেতাম। সবার মুখ থেকে জ্যোৎস্নার আলো বেরুতো।

 আমার ভাইগুলোও একে একে স্কুলে ভর্তি হল। কিন্তু আমার প্রতিবন্ধী বোনটা শরীরে বড় হলেও মনের দিক থেকে এবং সামাজিক ভাবে বড় হল না। ওর মুখ থেকে লালার ঝর্ণা বয়েই চলল। হাঁটু পর্যন্ত ফ্রক পরে দুই-পা ছড়িয়ে ও দিনরাত উঠোনে বসে থাকত। কালো কালো পায়ে মশা-মাছি এসে বসত। মা ওকে অ্যালুমিনিয়ামের থালায় মুড়ি খেতে দিয়ে যেত। যত না খেত, তার চেয়ে মাটিতে ছড়াত বেশি। পিঁপড়েরা খবর পেয়ে সারি দিয়ে এসে বোনকে ঘিরে ধরত। তারপর নিজেদের চেয়ে বহরে বড় একটা একটা করে মুড়ি মুখে নিয়ে বাড়ির পথ ধরত। বোন সেই মশা - মাছি - পিঁপড়েদের তাড়াবার কিংবা মারার মিথ্যা ভাণ করত। পারত না। ঝটাস ঝটাস হাত নাড়িয়ে হাওয়া দিত। এক জায়গা থেকে মাছি-মশা উড়ে অন্য জায়গায় গিয়ে বসত। কামড়ানো জায়গাটা বোন খসখস করে চুলকে পায়ে হাতে সাদা আঁচড়ে ভরিয়ে দিত। আমি দেখতে পেলে বোনকে সরিয়ে আমাদের দাওয়ার অন্যদিকে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিতাম। ওকে যেখানে বসিয়ে রাখা হত, দীর্ঘ সময় ধরে ও সেখানেই বসে থাকত। আমাদের বাকি ভাই-দিদিদের মতন ওর জীবনে কোন স্কুল হল না। প্রতিবেশী মিনতির মতন ও দোকানী হল না। বন্ধু সবিতার মতন কৃষাণীও নয়। 

 শুধু প্রতি মাসে প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী ওর সাথেও বড় হওয়ার রক্ত রক্ত খেলা চলতে থাকল। আমাকে ঘরের মধ্যে কাটাতে হলেও ও উঠোনেই ঐ দিনগুলো বসে থাকত। আর মা সেসব পরাতে এলে, খোলাতে এলে হাউ হাউ করে কেঁদে চিৎকার জুড়ত। একদিন গোয়াল ঘর ঝাঁট দিতে দিতে আমার চোখে পড়ল সাদা গরুর পা দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। মাটিতেও রক্ত পড়ে আছে। কিশোরী বয়স তখন। প্রকৃতির নিয়ম বুঝতে পারলাম। জীবন বিজ্ঞান বইতে পড়া কথাগুলো মনে পড়ে যেতে লাগল। কী মনে হতে ছুট্টে গিয়ে বোনের হাত ধরে নিয়ে এলাম গোয়াল ঘরে। আঙুল তুলে দেখালাম সাদা গরুটাকে। জানি না কীভাবে বোন আমার না-বলা ভাষা বুঝতে পেরে গেল। আর কখনো ওর বড় হওয়ার সময়ের দিনগুলো কান্নাকাটি করল না। 

 আজ আমার বোনের বয়স তিয়াত্তর। প্রকৃতির নিয়মে বোন বড় হয়েছে। বুড়িও। বোনের চুল পেকে সাদা হয়েছে। দাঁত পড়ে গেছে। চোখেও ঝাপসা দেখে এখন। একে একে আমাদের বাপ - মাটাও মরে গেল। কিন্তু বোনের জীবনটার বদল হল না কোন। ও আজও উঠোনে বসে মুড়ি খোঁটে। পিঁপড়ে - মশা - মাছি ওর চারিধারে ভিড় জমায়। ভাইয়ের বউয়েরা এখন ওর দেখাশোনা করে। কখনো সখনো আমার সংসারে এসেও কিছু মাস টানা থেকে যায়। ও যদিও বোঝে না, ওর কেন নিজের সংসার হল না। ও তো একদিন আচমকা বড় হতে শুরু করেছিল, আবার আচমকা ওর বড় হওয়া থেমেও গেল। কিন্তু বড় হয়ে কীই-বা লাভ হল ওর! 

আমার বোনের মনে কোন প্রশ্ন জাগে না। 
                                                                      (ক্রমশ...)

ছবি:  লেখিকা

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

2 Comments

  1. আমি, গ্রামের শহুরে রূপকথা ধারাবাহিকটি পড়ছি আমার ভীষণ ভালো লাগছে আশাকরি এটি অনেকদিন ধরে চলবে।

    ReplyDelete
  2. খুব ভাল এগোচ্ছে। সেসময়কার দলিল হয়ে থাকবে এই লেখাটা।

    ReplyDelete