জ্বলদর্চি

গ্রামের শহুরে রূপকথা -৪ /সুরশ্রী ঘোষ সাহা

গ্রামের শহুরে রূপকথা -৪

সুরশ্রী ঘোষ সাহা 



চতুর্থ পর্ব - জাঁতা পেষা গম আর চাকি ভাঙা ডাল 

'আঙুল দিয়ে টান রে জাঁতা, নখ বাগিয়ে টান,
মধুলপানা দুধ খেয়েছি, আমার মায়ের দান।'

অন্ধকার থাকতেই আমার মা-কাকিমা-জেঠিমারা ঘুম থেকে উঠে পড়ত। উঠোন ঝাঁট দিয়ে, দুয়োরে জল ছিটিয়ে শুরু হয়ে যেত কাজ। কাঠ-কুটো, খড়-প্যাকাটি আর ঘুটে দিয়ে উনুন ধরিয়ে চায়ের জল চাপাত কেউ। কেউ আবার অন্যদিকে করে রাখা আরেক উনুনে বিরাট বড় কালো হয়ে যাওয়া লোহার কড়াইয়ে মুড়ি ভাজতে বসত। গ্রামের তখন বেশিরভাগ বাড়িতেই একান্নবর্তী সংসার। বাবা-জ্যাঠা-কাকা সবার সংসার মিলিয়ে বিরাট হাঁড়ি চড়ে। সাথে সারাবছর জমিতে চাষ করার নাগাড়ে থাকে। তারাও পরিবার নিয়েই খাটতে আসে। স্বামী - স্ত্রী হাতে-হাত, কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে জমিতে খাটে। আমার শ্বশুর বাড়িতেও নাগাড়ে চিরকাল আছে। এখানেই তাদের খাওয়া, শোয়ার ব্যবস্থা হয়। বছরে একবার নিজেদের গ্রামে যায়। আবার ফিরে আসে। তাই প্রায় ছোট এক বালতি মাপের একবেলার জন্য চাল চড়ে হাঁড়িতে। সাথে আট-নয়টা পদ। দু - তিন রকমের শাক ভাজা, কড়াইয়ের ডাল, ঢেঁড়স - বেগুন ভাজা, পাঁচ-মিশেলি তরকারি, পুকুরের মাছ, চুনো মাছের টক এমন আরো কত রকমের পদ। আগের চেয়ে পরবর্তী কালে সকল পরিবারের অবস্থাই অনেক ভাল হয়েছে। ঘরে ঘরে খাওয়া পরার অভাব অনেকখানি ঘুচেছে। 

 জমি থেকে ধান - গম উঠলে, ডাল -ছোলা উঠলে সব সংসারেই কাজ আরো বাড়ত। কারণ তখন ঢেঁকিতে ধান পেষা হত। জাঁতাকলে গম পেষা হত। যার জন্য প্রচুর সময় চলে যেত। এখন সেসব কিছুই আর ঘরে করা হয় না। 

 বাড়ির মহিলারাই তখন মূলত শরীরের সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে জাঁতা পিষত। গম পিষে আটা বের করতে যত বেশি শক্তি লাগত, তত বেশি লাগত সময়। ধান থেকে চাল বের করার পর্বটা বিরাট হলেও, গম থেকে আটা বা ছোলা থেকে ছাতু পেষাইয়ের পর্ব ছিল হাল্কা। মাঠ থেকে গম ঝাড়াই হয়ে বাড়িতে আসলে একটু রোদ খাইয়ে বেছে পরিষ্কার করে জাঁতাকলে পিষতে বসতাম আমরা। ডাল বা ছোলা পিষতে একবার জাঁতার হাতল ঘোরালে শুধু খোসা ছাড়িয়ে যেত। আর যদি বারবার ঘোরানো হত, তখনই পাওয়া যেত আটা বা ছাতু।

 জলখাবারে আমরা সাধারণত মুড়ি আর তরকারি খেতাম। কিন্তু রাতে হত আটার রুটি। উনুনের ভিতরে লাল আগুনে ঢুকিয়ে দেওয়া হত হাতে বেলা রুটি। কী সুন্দর ফুলে উঠত সেখানেই। সাঁড়াশি করে চিপে ধরে বাইরে আনা হত। অথচ খেতে বসে তা থেকে কাঠ - কয়লার কোন গন্ধ বেরুত না। কখনো বাড়ির বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের জল দিয়ে ছাতুকে হাল্কা হাল্কা করে মেখে লবন ছিটিয়ে খেতে দেওয়া হত। বাটিতে হাত ঢুকিয়ে মুঠো করে ছাতু মাখা তুলে মুখে ভরতো সব। সেভাবে চামচের ব্যবহারও আসেনি তখন। 

 আজ হেঁসেলে ভরা থাকে বাচ্চাদের জন্য চাউমিন, ম্যাগি, পাস্তা এমন সব বিদেশী খাবার। কাঁটা-চামচ দিয়ে মুখে ভরে সেসব। গ্রামের স্কুল ছেড়ে শহরের ইংরেজি মিডিয়ামে তারা পড়াশোনা শেখে। শেখে শহুরে খাদ্যাভাস ও আদবকায়দা। 

 আগে হামানদিস্তার ব্যবহার ছিল সবার ঘরে ঘরে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হত, প্রতি বাড়ি থেকে লোহার হামানদিস্তায় ঠুকঠুক ঠুকঠুক করে কিছু না কিছু মশলা গুঁড়ো ও বাটার কাজ চলত। কিংবা ঘড়র ঘড়র শব্দ তুলে শিলে নোড়া ঘুরত। বাড়ির পুরুষরা উঠোনে খারকোল পাতা, গিমে শাক, মানকচুর ডাঁটা, ওল নিয়ে এসে রেখে বলত, 'আজ একটু কষে ঝাল দিয়ে বাটো দিখিনি, কতদিন খাইনি। ঐ ডুমুরতলা দিয়ে যাওয়ার পথে চোখ পড়ল। গিয়ে কেটে নিয়ে এলুম। ভাল করে ধুয়ে বেছে কোরো, পটলার মা।' নিত্য দিনই এমন কিছু না কিছু নিয়ে আসা চলত। 

 কারুর পেটের সমস্যা দেখা দিলে থানকুনি পাতা বাটা কিংবা কালমেঘ পাতা বাটা হত হামানদিস্তায় বা শিলনোড়ায়। সেটাকে ছোট ছোট বড়ি করে রোদে শুকানো হত। তারপর সকালে খালি পেটে একটা করে বড়ি জল দিয়ে খাওয়ানো হত পেটের সমস্যার রোগীকে। তখন পাড়া - গাঁয়ে বেশি ডাক্তার বদ্যি তো ছিল না, লোকমুখে শোনা টোটকা দিয়েই রোগ সারানোর চেষ্টা চলত। জ্বর হলেই সেবাজল ট্যাবলেট গিলিয়ে দেওয়া হত। এখন যেমন ডাক্তাররা প্যারাসেটামল দেয়। আজ গ্রামের বাচ্চারাও জানে জ্বর কোন রোগ নয়, উপসর্গ মাত্র। ডাক্তাররা হাজার টেস্ট দিয়ে বের করে নেয় রোগীর কী হয়েছে! টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, নাকি ডায়রিয়া! এইসব নাম তখনকার মানুষ শুনেছে নাকি কখনো! তখন জ্বর কী পাতলা পায়খানা হলেই শুধু সাবু-বার্লি। রবিনসন বার্লি, পিউরিটি বার্লি কত সব নাম। সর্দিকাশি হলেই বাসক পাতা, তুলসী পাতা, গোলমরিচ, লবঙ্গ ও মধুর পাঁচন ব্যাস্। পরের দিকে আমাদের গ্রামে একজন ডাক্তার হল, নাম হরিদাস পাল। তিনি এসে সিরাপ দিয়ে যেতেন। আমার মামার বাড়ির গ্রামে ছিলেন একজন জটাধারী ডাক্তার, যিনি নিজের ঘরে বসে সিরাপ বানিয়ে বোতলের গায়ে এক দাগ, দু'দাগ করে রাখতেন। রোগী সেই দাগ দেখে মেপে মেপে ওষুধ খেত। মনে পড়ে, আমার ছোটবেলায় বাপের বাড়ির গ্রামে তখন মাটির হাঁড়িতে করে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘোল বেচতে আসত একজন। নাম ছিল মধু বুড়ো। যার ঘোল খেলে গরমের দিনে শরীর ঠান্ডা হয়ে যেত। পেটখারাপ হলে তাও সেরে যেত। গ্রামে সেই মধু বুড়ো ঢুকলেই কত কত বাচ্চা তার পিছন ধরত। দল বেঁধে কুচোকাচারা সারাদিন খালি পায়ে বুড়োর পিছু পিছু হেঁটে চলত। তিনিও ফেরার পথে বাচ্চাদের খুশি করে মুখে হাসি ফুটিয়ে তবে গ্রাম ছাড়তেন। 

 এখন গ্রামের ঘরে ঘরে একটু অবস্থাপন্ন যারা, তাদের সবার ঘরেই মিক্সার গ্রাইন্ডার ব্যবহার হচ্ছে। তবে একান্নবর্তী পরিবারগুলো কিছু বাটনা বাটতে আজও শিল নোড়া পেতেই বসে। প্যাকেট মশলা গুঁড়োর স্বাদ কি আর মেশিনে পাওয়া যায়! নোড়ায় পেষা মশলার   স্বাদ যে অমৃত তুল্য। 

 তবে এখন কটাই-বা একান্নবর্তী পরিবার টিকে আছে! শহরের মতন গ্রামেও যে এখন বহু সংসার ভেঙে ছোট ছোট হয়ে গেছে। 'ভাগের মা গঙ্গা পায় না' প্রবাদ গ্রামেও ঘরে ঘরে ফলে যাচ্ছে। বুড়ি মাকে তিন - চার ছেলের সংসারে ঘুরে ঘুরে একমাস একমাস করে খেতে হয়। 

 এবার জেঠুর বাড়িতে গিয়ে তা নিজের চোখেই চাক্ষুষ করে এলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ছোট থেকে দেখে আসা এক বয়স্ক মানুষ যিনি একসময় একাই কত বড় সংসার টানতেন। সকাল থেকে উঠে ঢেঁকিতে ধান ভানতেন, হামানদিস্তায় বাটনা বাটতেন, জাঁতাকলে গম পিষতেন। আজ বুড়ো বয়সে সংসারের জাঁতাকলে নিজেই পিষছেন দিনরাত। ভাগ হয়ে যাওয়া সন্তানদের ঘরে ঘুরে ঘুরে বুড়ির পেট ভরছে। 

 আমাকে দেখে জানতে চাইলেন, 'আমায় চিনতে পেরেছ, মা? কত বড় হয়ে গেছ তুমি।' 

 ঝাপসা ভাবে মনে পড়ল মানুষটার সেই রূপসী চোখমুখ। যা এখন পাটের মত সাদা চুল, দাঁতহীন ফোকলা মুখের আড়ালে হারিয়ে গেছে। তবু মুখে হাসি রেখে বললাম, 'আপনি যে আজও দারুণ সুন্দরী। আপনাকে ভুলি কী করে!' 

 বুড়ি আঁচলে চোখ মোছেন। বলেন, 'আমার হল গিয়ে শিঙুল (শিউলি) ফুলের জীবন, মা। যতই সুন্দর গন্ধ থাকুক, পড়ি আমি গোবরেই।'
                                                                      (ক্রমশ...) 

ছবি : লেখিকা

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments