জ্বলদর্চি

জনগণ ও সংবিধানের বিবাহ বার্ষিকী /সন্দীপ কাঞ্জিলাল

প্রজাতন্ত্র দিবস। ২৬ জানুয়ারি। 
জনগণ ও সংবিধানের বিবাহ বার্ষিকী

সন্দীপ কাঞ্জিলাল


আমাদের দেশ স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট। তদানীন্তন ইংরেজ গভর্নর এই ১৫ই আগস্ট ভারতের হাতে স্বাধীনতা তুলে দেয়। কিন্তু এই ১৫ই আগস্ট কেন? কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান মিত্রশক্তির কাছে তথা ইংরেজদের কাছেও আত্মসমর্পণ করে। তাই এই ১৫ই আগস্টকে স্মরণে রাখতে লর্ড মাউন্টব্যাটেন এই দিনটিকে বেছে নেয়। 
কিন্তু ভারত স্বাধীন হলেও আমাদের কোন নিজস্ব সংবিধান ছিল না। আমাদের হাতে লিখিত বিশাল আকৃতির ভারতের নিজস্ব সংবিধান ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি গৃহীত হয়। এই সংবিধান রচনার জন্য ১৯৪৭ সালের ২৮শে আগস্ট খসড়া কমিটি গঠিত হয়েছিল। যে কমিটির সভাপতি ছিলেন বি.আর.আম্বেদকর। ১৯৪৭ সালের ৪ঠা নভেম্বর এই কমিটি খসড়া সংবিধান গণপরিষদে জমা দেয়। তারপর এই খসড়া নিয়ে ২ বছর ১১ মাস ১৮ দিন ধরে ১৬৬ টি সভার মাধ্যমে, ১৯৪৯ সালে ২৬শে নভেম্বর সংবিধান চূড়ান্ত হয়ে গৃহীত হয়। কিন্তু 26 শে জানুয়ারিকে সম্মান জানানোর জন্য, ১৯৫০ সালে ২৬শে জানুয়ারি থেকে আমাদের সংবিধান কার্যকরী হয়। এই ২৬শে জানুয়ারি কেন? ১৯৩০ সালের ২৬শে জানুয়ারি জহরলাল নেহেরু প্রথম ভারতবর্ষে পূর্ণ স্বরাজ দাবি করেছিলেন, তাই এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ২৬ শে জানুয়ারিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। 

মূল সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে একটি সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বলা হল, ভারত একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র। এই প্রস্তাবনা নিয়ে আমার অনুভূতির দু-চার কথা। 
সার্বভৌমত্ব- রাষ্ট্রগঠনের প্রধান উপাদান সার্বভৌমত্ব! সার্বভৌমত্ব শব্দ দ্বারা চরম ও চূড়ান্ত ক্ষমতাকে বোঝায়। সার্বভৌম রাষ্ট্রের ঐ বৈশিষ্ট্য থাকে, যার ফলে নিজের ইচ্ছা ছাড়া অন্য কোন প্রকার ইচ্ছার দ্বারা রাষ্ট্র আইনসঙ্গতভাবে আবদ্ধ নয়। প্রত্যেক সমাজব্যবস্থায় চূড়ান্ত ক্ষমতা কার্যকরী করার জন্য একটি মাত্র কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ থাকবে, আর এ ক্ষমতাই হল সার্বভৌম ক্ষমতা। সার্বভৌমত্বের বৈশিষ্ট্য হলো-(১) সার্বভৌম ক্ষমতা হস্তান্তরযোগ্য নয় (২) এই ক্ষমতা চরম অবাধ ও অসীম। তাই তো যখন তখন তেল গ্যাসের দাম বাড়ে। কবি বীরেন্দ্র চট্ট্যোপাধ্যায়ের কবিতার লাইন- "মানুষ যখনই চায় বস্ত্র ও খাদ্য / সীমান্তে বেজে ওঠে যুদ্ধের বাদ্য"।

সমাজতান্ত্রিক- সমাজতন্ত্র থেকে সমাজতান্ত্রিক কথাটা এসেছে। সমাজতন্ত্র হচ্ছে সাম্যবাদী সমাজের প্রথম পর্যায়। উৎপাদনের উপায়ে সমাজতান্ত্রিক মালিকানা হল এর অর্থনৈতিক ভিত্তি। সমাজতন্ত্র ব্যক্তিগত মালিকানার উৎখাত করে  মানুষে মানুষে শোষণ অর্থনৈতিক সংকট ও বেকারত্বের বিলোপ ঘটায়। সমাজের প্রতিটি মানুষের সার্বিক উন্নয়ন। সমাজে প্রত্যেকে কাজ করবে তার সামর্থ্য মতো এবং প্রত্যেকে গ্রহণ করবে তার প্রয়োজন অনুযায়ী। দেশের ভূমি, কলকারখানা যা কিছু সম্পদ সমাজের, প্রত্যেকেই এর মালিক। এই ভাবনা সমাজতান্ত্রিক ভাবনা। এর প্রচলন ছিল আদিম সমাজে। যখন একটা পশু মারা হলে দলবদ্ধ হয়ে সবাই ভাগ করে খেত, যখন ব্যক্তিগত সম্পদ সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, কলকারখানার বেসরকারিকরণ ঘটছে, এই করোনার সময়, যখন মানুষ খেতে পাচ্ছে না তবুও কিছু মানুষের সম্পদ ২০গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু আমাদের সংবিধান সমাজতান্ত্রিক ভাবনায় সমৃদ্ধ। 

ধর্মনিরপেক্ষ- ধর্ম নিরপেক্ষ বলতে, রাষ্ট্র ধর্ম সম্পর্কে উদাসীন থাকবে। অর্থাৎ, রাষ্ট্র এবং যে যার ব্যক্তিগত ধর্ম আলাদা। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান ইত্যাদি বিষয়ে রাষ্ট্রের কোন মাথাব্যথা নেই এবং বিজ্ঞানের প্রতি থাকবে আসক্তি। কিন্তু মানুষের যে ক্ষুদ্র গোষ্ঠী শাসন কার্য পরিচালনা করে, তারা যদি বিশেষ ধর্মের প্রতি আসক্ত হয়, কিংবা রাষ্ট্রপরিচালনার দাবিদাররা যদি কখনো মন্দিরে, মসজিদে গির্জায় গিয়ে উপস্থিত হয়, তবে তাদের পক্ষে কি সম্ভব ধর্ম সম্বন্ধে নিরপেক্ষ থাকা? ধর্মের ব্যাপারে উদাসীন থাকা? আমরা সংবিধানে উল্লেখ করছি ধর্মনিরপেক্ষ, কিন্তু এক ধর্মের মানুষকে আমরা বলছি সংখ্যাগুরু, আর অন্য ধর্মের মানুষদের বলছি সংখ্যা লঘু। কিন্তু আমাদের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ। যেমন বহু ইসলামিক দেশ আছে, যারা ঘোষিত ধর্মের দেশ। আমরা মুখে বলছি ধর্মনিরপেক্ষ, অথচ কোন ফর্মে বা দলিলে রাষ্ট্র বাধ্য করছে আমাদের ধর্ম কী? তা ঘোষণা করতে। এ নিয়ে অনেকক্ষণ বলা যেতে পারে কিন্তু এটা সে জায়গা নয়। 

গণতান্ত্রিক- গণতন্ত্র থেকে এসেছে গণতান্ত্রিক শব্দটি। গণতন্ত্র বলতে বুঝি কোনও জাতিরাষ্ট্রের বা কোনও সংগঠনের এমন একটি শাসনব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে নীতিনির্ধারণ বা সরকারি প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিক বা সদস্যের সমান ভোটাধিকার। ইংরেজিতে 'Democracy' এই ইংরেজি শব্দটি আবার এসেছে গ্রিক 'দেমোক্রাতিয়া' শব্দ থেকে। এই শব্দটি আবার দেমোস ও ক্রাতিয়া দুটি শব্দ মিলে। দেমোস মানে বাংলায় জনগণ আর ক্রাতিয়া বলতে বোঝায় ক্ষমতা বা শাসন। অর্থাৎ জনগণের শাসন। সোজা কথায় জনগণ হচ্ছে সিংহাসনচ্যুত রাজা। রাজা কিন্তু সিংহাসন নেই। আমাদের ভোটে সরকার নির্বাচিত হয়। কিন্তু আমরা কি সবাই ভোট দিতে পারি? খবরের কাগজে, কথোপকথনে টিভিতে দেখেছি, ভোট দিতে যাওয়ার আগে ভোট পড়ে গেছে, লোডশেডিং করে ভোট কেন্দ্রে ছাপ্পা হচ্ছে, যারা এসব করছেন তারা গণতন্ত্র ধ্বংস করেছেন। তারা আবার আজকের দিনে গণতন্ত্রকে কিভাবে বাঁচানো যায়, তার পাঠ জনগণকে দেবেন। এসব হচ্ছে নেতাবাজি, এই নেতাবাজি গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে, নাগরিকতাকে নষ্ট করছে। যাতে আমরা এইসব নিয়ে না ভাবি, আমাদের ১০০ দিনের কাজ দেওয়া হচ্ছে, মেলা খেলা দেওয়া হচ্ছে, কারণ আমরা জনগণ নয়, সংখ্যা মাত্র। তাইতো ভোটবাক্সে আমাদের গোনা হয় এক, দুই, তিন। ভোটের ফলাফলে বলা হয়, উনি এত ভোটে জয়ী হয়েছেন। আমরা সরকারের কাছে ভিক্ষার পাত্র ধরতে অভ্যস্ত। কিন্তু আমরা ভাবি না, সরকারের তো উচিত আমাদের সামনে ভিক্ষাপাত্র ধরা। কারণ গণতন্ত্রে আসল ক্ষমতার অধিকারী জনগণ। আমাদের যত দুঃখের কারণ, আমরা সমগ্রকে ভালোবাসি না, ব্যক্তিকে ভালোবাসি! তার পূজা করি, আবার পা-ও চাটি। 

সাধারণতন্ত্র- সাধারণ+তন্ত্র মানে সাধারণতন্ত্র। সাধারণ মানে এখানে সাধারণ মানুষ। আর তন্ত্র শব্দটি 'তন্' ধাতু নিষ্পন্ন করে যার অর্থ বিস্তার। তন্ত্র সামগ্রিকভাবে জ্ঞানের বিস্তার করা ছাড়াও এর ব্যবহারকারীকে ত্রাণ বা রক্ষা করে থাকে। আমরা জনগণ তন্ত্রধারক, তন্ত্রধারক মানে- ক্রিয়া কর্মের পুঁথি দেখে যে ব্রাহ্মণ মন্ত্র পাঠ করে গৃহকর্তার কল্যাণের জন্য। আর আমাদের এই তন্ত্রধারক রাষ্ট্রপতি যিনি আমাদের সংবিধানের রক্ষকও বটে। 

আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতি পদটি একটি নির্বাচিত পদ। তবে আমাদের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয় জনগণের পরোক্ষ ভোটের দ্বারা। অনেকে আবার এই দিবসকে প্রজাতন্ত্র দিবস বলে। কিন্তু প্রজা শব্দ থাকলে, রাজা আছে বোঝায়। আমাদের দেশে রাজা নেই যেহেতু আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতি পরোক্ষভাবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়, তাই এই দিনটিকে সাধারণতন্ত্র দিবস বলা সবচেয়ে যুক্তিসংগত। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জনগণ প্রত্যক্ষ ভোট দেয় না। জনগণ দ্বারা নির্বাচিত এম.এল.এ ও সংসদ সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হয়। তাই যে দল কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করে সে বিশেষ  সুবিধা পায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে।

দিনের-পর-দিন সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে, কিভাবে জনগণের মৌলিক অধিকারকে খর্ব করা হচ্ছে, তার প্রমাণও আমরা পেয়েছি।

তবুও এই 26 শে জানুয়ারি দিনটিকে আমাদের মর্যাদা সহকারে পালন করতে হবে। 

কারণ সারা বছর ধরে স্বামী-স্ত্রী যে ঘাটে জল খাক না কেন, বিবাহ বার্ষিকী এলেই আত্মীয় বন্ধুবান্ধব পাড়া প্রতিবেশীর কাছে প্রমাণ দিতেই হবে- আমাদের স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন অটুট। তা না হলে যে লোক হাসির ভয় থাকে। এই দিনেই তো ভারতের জনগণের দায়িত্ব, সংবিধানের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। তাই এই দিন উদযাপন করে আমাদের প্রমাণ দিতেই হবে ভারতীয় সংবিধান আমাদের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments