জ্বলদর্চি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব পর্ব-১/তোষলা বা তুঁষ তুঁষলি /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব 
পর্ব-১

তোষলা বা তুঁষ তুঁষলি

ভাস্করব্রত পতি

"তুঁষ তুঁষলি তুমি কে?
তোমার পূজা করে যে-
ধনে ধানে বাড়ন্ত,
সুখে থাকে আদি অন্ত।।
তোষলা লো তুঁষকুন্তি!
ধনে ধানে গাঁয়ে গুন্তি,
ঘরে ঘরে গাই বিউন্তি।।"

এই ছড়া তোষলা ব্রতের স্তুতিগান। পৌষ মাসের শীতের সকালে শিশিরে ভিজে যাওয়া নরম ঘাস মাড়িয়ে গ্রামবাংলার রমণীকূল এলোচুলে মাটির নতুন সরায় বেগুন পাতা ঢাকা দিয়ে সারমাটি নিয়ে দল বেঁধে তোষলা ব্রত পালন করতে করতে এগিয়ে যায় ক্ষেতের দিকে। সরষে ফুল, মূলো ফুল, সিম ফুল দিয়ে শুরু হয় তোষলা ব্রতের অনুষ্ঠান। আর ব্রত উদযাপনের বর্ণনায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর উল্লেখ করেছেন এভাবে -

"গাইয়ের গোবর সরষের ফুল
আসনপিঁড়ি এলোচুল,
গেয়ের গোবরে সরষের ফুল, 
ঐ করে পূজি আমরা মা বাপের কূল।"

স্পষ্টতই এই লোক উৎসব তথা লৌকিক ব্রতটি ক্ষেতজমি উর্বর করে তোলার ব্রত‌। যেখানে ব্রতের মূল উপকরণ সারমাটি। 

'তোষলা ব্রত' কোথাও কোথাও 'তুঁষ তুঁষলী ব্রত' নামেও পরিচিত। দুই বঙ্গের গ্রাম গ্রামান্তরের মহিলাকূল এই ব্রত পালন করেন তাঁদের পিতৃকূল এবং শ্বশুরকূলের উন্নতিবিধানে। মাধুরী সরকার তাঁর 'ব্রত : সমাজ ও সংস্কৃতি' তে লিখেছেন, "স্পষ্টতই এই ব্রতে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির অভিক্ষেপ লক্ষিত হয়। ব্রাম্ভণের ঘরে জন্মাবার আকাঙ্খায় পাই বর্ণাশ্রম ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার স্পষ্ট চিত্র। বাণিজ্যকেন্দ্রিক সম্পদের সূত্রও এই ব্রতের ছড়ায় ব্যঞ্জিত। আদিম উর্বরতা কেন্দ্রিক ধর্মধারার ব্যঞ্জনাবাহী মায়ের কোলে নতুন ভাই আসার আকাঙ্খাও ব্যক্ত করতে ভোলেননা ব্রতিনীরা।" 

অগ্রহায়ণের সংক্রান্তি থেকে পৌষের সংক্রান্তি পর্যন্ত প্রতিদিন চলে এই ব্রতের আলাপন। প্রতিদিন সকালে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে নতুন ধানের তুঁষ (আলোচালের তুঁষ) এবং গোবর দিয়ে বড় বড় চারটা নাড়ু বা মণ্ড পাকাতে হয়। 'তুঁষ' অর্থে 'ধান্যত্বক' বা 'কুঁড়া'। এটি সংস্কৃত শব্দ। ঐ নাড়ুগুলো সরষে ফুল, মূলা ফুলের সাথে একসাথে ধরে তোষলা ব্রতের মন্ত্র উচ্চারণ করে -

"তুঁষ তুঁষলি কাঁধে ছাতি,
বাপ মার ধন যাচাযাচি!
স্বামীর ধন নিজ পতি,
পুত্রের ধনে বাঁধা হাতি!
ঘর করবো নগরে,
মরবো গিয়ে সাগরে!
জন্মাব উত্তম কুলীন বামুনের ঘরে।"

এরপর উচ্চারিত হয় --

"তুঁষলি গো রাঈ, তুঁষলি গো মাঈ
তোমায় পূজিয়া আমি কি বর পাই!
অমর গুরু বাপ চাই, ধন সাগুরে মা চাই
রাজ্যেশ্বরী স্বামী চাই, সভা আলো জামাই চাই,
সভা পণ্ডিত ভাই চাই, দরবার আলো বেটা চাই,
রূপ কৌটা ঝি চাই।
সিঁথের সিঁদুর দপ দপ করে, ঘটি বাটি ঝকমক করে,
আলনায় কাপড় ঝলমল করে, ঘটি বাটি ঝকমক করে,
সিঁথের সিঁদুর মড়াইয়ের ধান, সেই যুবতী এই বর চান!"

এই ছড়াটিই তোষলা ব্রতের উপচারে কোথাও কোথাও এভাবেও উচ্চারিত হতে শোনা যায়  -

"কোদাল কাটা ধন পাব,
গোহাল আলো গরু পাব,
দরবার আলো বেটা পাব,
সভা আলো জামাই পাব,
সেঁজ আলো ঝি পাব,
আড়ি মাপা সিঁদুর পাব।
ঘর করব নগরে,
মরব গিয়ে সাগরে,
জন্মাব উত্তম কূলে,
তোমার কাছে মাগি এই বর--
স্বামী পুত্র নিয়ে যেন সুখে করি ঘর।"

এবার ঐ নাড়ুগুলো রাখতে হয় কালো দাগবিহীন নতুন সরাতে বেগুন পাতা বিছিয়ে। প্রত্যেক নাড়ুতে সিঁদুরের ফোঁটা এবং পাঁচটি করে দূর্বা গুঁজে দেওয়া হয়। কোথাও কোথাও চারটি করে দূর্বা দেওয়ার চল পরিলক্ষিত হয়। মূলত দুই ২৪ পরগনা, নদীয়া, হাওড়া জেলাতে প্রচলিত আছে এই লৌকিক উৎসব - 'তুঁষ তুঁষলি'। এভাবেই চলে সারা পৌষ মাস। 

কিন্তু প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, এই তোষলা বা তুঁষ তুঁষুলি ব্রত আর টুসু পরব কি একই? সুধীর কুমার করণ লিখেছেন, "বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তোষ তোষলা, তোষলা বা তুষু নামক ব্রতের প্রচলন আছে। পূর্ববঙ্গে, পশ্চিমবঙ্গে -- দু জায়গাতেই কুমারী মেয়েরা এই ব্রত করে থাকে। তোষলা ব্রত উদযাপনের রীতি পদ্ধতি মূলতঃ মানভূম, ধলভূম, ঝাড়গ্রামের টুসু পূজারই অনুরূপ। বাঁকুড়া অঞ্চলে এই ব্রতেরই নাম তুষু!" ড. মধুপ দে'র মতে 'তুঁষ' শব্দ থেকেই 'টুসু'র উৎপত্তি। তবে লোকগবেষক তরুণ সিংহ মহাপাত্রের মতে, "তোষলা ব্রত আর টুসু পরবের মধ্যে গঠনগত পার্থক্য রয়েছে। দুটোই কৃষিভিত্তিক লোক উৎসব হলেও প্রথমটির ক্ষেত্রে কোনো মূর্তি থাকেনা। কিন্তু টুসু উৎসবে টুসুর মূর্তি পূজিতা হয়।" আরেক লোকগবেষক ও লেখক শান্তি সিংহের মতে, "তুষু বা তোষলা ব্রত সকালবেলায় মেয়েরা সুস্নান হয়ে করে -- একথা বলেছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অথচ টুসু সকালবেলার নয়, সন্ধ্যাবেলার ব্রত এবং সেখানে মেয়েদের পূজার অব্যবহিত পূর্বে স্নান করার ব্যাপারও নেই। তা দেখে অনেকে টুসু পূজাকে তোষলা ব্রত থেকে আলাদা বলে চিহ্নিত করেন।" যদিও এই মুহূর্তে এ ধরনের লৌকিক উৎসব ম্রিয়মান। বিলুপ্তির পথে। আজকালকার মহিলাদের কাছে ক্রমশঃ গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে তুঁষ তুঁষলি তথা তোষলা ব্রত পালন।

সংক্রান্তির দিন ছ'বুড়ি ছ'গণ্ডা অর্থাৎ ১৪৪ টি ( ৬×২০ = ১২০, ৬× ৪= ২৪, মোট - ১৪৪ ) ছোট ছোট ক্ষীরের নাড়ু ( এই সংখ্যাতেও ভিন্নতা দেখা যায় অঞ্চলভেদে ) এবং পায়েস রান্না করে খেতে হয়। সেসময় সরায় রাখা দূর্বা ও তুঁষ তুঁষলির নাড়ুগুলিতে আগুন দেওয়া হয়। এবং তা পেছন দিকে রাখতে হয়। খাওয়া শেষ হলে তা ভাসানের মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে স্নান করে ঘরে ফেরে। খাবার আগে তাঁদের মন্ত্রোচ্চারণ এরকম -
"তুঁষ তুঁষল সুখে ভাসালি, আখা জ্বলন্তী, পাখা চলন্তি
চন্দন কাঠে রন্ধন করে খাবার আগে তুঁষ পোড়ে
খরকের আগে ভোজন করে, প্রাণ সুখেতে নূতন বসতে,
কাল কাটাব আমি জন্ম এয়োতে।"

সূর্যোদয়ের আগেই মহিলারা ব্রত শেষ করে ঐ সরায় ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে সেগুলি মাথায় করে দল বেঁধে নিয়ে যায় নদীতে। তোষলা ভাসাতে। নদীতে তোষলার সরা ভাসিয়ে তোষলার সারমাটি ও সূর্য তথা চাষের দুই সহায়ককে শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মহিলারা ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীর শীতল জলে। মনের আর দেহের মধ্যে জমে থাকা যাবতীয় কষ্ট, রোগ, শোক, রাগ, অভিমান, দুঃখ ভেসে যায় শৈত্য অবগাহনে। আর অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত হয় --
"তোষলা গো রাঈ, তোমার দৌলতে আমরা ছ'বুড়ি পিঠে খাই,
ছ'বুড়ি ন'বুড়ি, গাঙ সিনানে যাই, গাঙের বালিগুলি দুহাতে মোড়াই,
গাঙের ভিতর লাড়ুকলা ডবডবাতে খাই।
তুষলি গো রাঈ, তুষলি গো ভাই,
তোমার ব্রতে কিবা পাই?
ছ'বুড়ি ছ'গণ্ডা গুলি খাই,
তোমাকে নিয়ে জলে যাই,
তুঁষ তুঁষলি গেল ভেসে, বাপ মার ধন এল হেসে,
তুঁষ তুঁষলি গেল ভেসে, আমার সোয়ামির ধন এল হেসে।"

যাবতীয় প্রার্থনা, চাওয়া তখন অন্তর্যামীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয় ঐ শীতল জলকে আলিঙ্গন করে। ইতিমধ্যে পূব গগনে উঠে গিয়েছে রক্তিম সূর্য। স্নান শেষ, ব্রতও শেষ। এবার সূর্যোদয়ের বর্ণনায় শোনা যায় -

"রায় উঠেছেন রায় উঠেছেন বড় গঙ্গার ঘাটে
কার হাতে রে তেল গামছা? দাওগো রেয়ের হাতে।
রায় উঠেছেন রায় উঠেছেন মেজো গঙ্গার ঘাটে,
কার হাতেরে শাঁখা সিঁদুর দাওগো রেয়ের হাতে।
রায় উঠেছেন রায় উঠেছেন ছোট গঙ্গার ঘাটে,
রায় উঠেছেন অন্নে, তামার হাঁড়ির বর্ণে,
তামার হাঁড়ি, তামার বেড়ি --"!

আসলে এই লোক উৎসবে ছুঁয়ে থাকে গ্রামের চিরন্তন বিশ্বাস, আকাঙ্খা এবং প্রকৃতির সাথে হার্দিক নিবিড়তা। সহজ সরল গেঁয়ো মানুষগুলো আবিলতাহীন মনে আরাধনা করে এই পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ আহরণের জন্য। আসলে তার মধ্যে রয়েছে ধর্মীয় মোড়ক। শাস্ত্রীয় সংমিশ্রণ। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, "তোষলা ব্রতের অনুষ্ঠান, এই শীতের প্রভাতের দৃশ্যপটগুলি, আর সদ্যঃস্নাত মেয়েদের মুখে সিন্দুর এবং মার্জিত তামার বর্ণ রক্তবাস সূর্যের উজ্জ্বল বর্ণনা -- আমাদের সহজেই সেইকালের মধ্যে নিয়ে যায় যেখানে দেখি মানুষে আর বিশ্বচরাচরের মধ্যে সরস একটি নিগূঢ় সম্বন্ধ রয়েছে; গড়াপেটা শাস্ত্রীয় ব্রতের এবং হিন্দুয়ানির আচার অনুষ্ঠানের চাপনে মানুষের মন যেখানে সব দিক দিয়ে অনুর্বর, নিরানন্দ এবং প্রাণহীন হয়ে পড়ে নি। এই তোষলা ব্রতের জীবন্ত দৃশ্যকাব্যটির সঙ্গে ছোট একটি শাস্ত্রীয় ব্রত মিলিয়ে দুয়ের মধ্যে কী নিয়ে যে পার্থক্য তা স্পষ্ট ধরা পড়বে।"
(ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

0 Comments