জ্বলদর্চি

আফ্রিকার প্রাচীন লোককথা /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প
রাজায় রাজায় যুদ্ধ-- আফ্রিকার প্রাচীন লোককথা

চিন্ময় দাশ

কথাগুলো কতকাল আগেকার কেউ জানে না। নাতি-নাতনিরা শুনেছে তাদের দাদু-ঠাকুমার কাছে। তাদেরকেও শুনিয়েছিল তাদের দাদু-ঠাকুমারা। সেই মানুষগুলোও শুনেছিল এইভাবেই। তাহলে, কী করে হিসাব করা যাবে, কত প্রাচীন কালের কথা! অতএব, সে হিসাব নিকাশ থাক। গল্পটাই শোনা যাক বরং। 
তখন আকাশ আর মাটি মিলে পৃথিবীতে মোট দুজনই ছিলে শক্তিধর। একজন হোল আকাশের দেবতা বরুণদেব। আর একজন হোল নীচের গজরাজ হাতি। দুজনেই ভাবে আমিই বড়। 
কেউ মানতে চায় না, অন্যজন তার চেয়ে বড়। কে বড়, তাই নিয়ে নিত্য বিবাদ লেগেই থাকে দুজনের। হাতি চিরকালের দাম্ভিক। একটাই ভাবনা তার, বরুণ ঠাকুর যেন বড় বলে মেনে নেয় তাকে। এদিকে, বরুণদেবও কম যায় না। সে ভাবে, আমি যে সত্যিই বড়, হতভাগা হাতিটা এ কথাটা বোঝে না কেন?
এই নিয়েই একদিন তর্ক চলছে দু’জনের। বরুণদেব  হাতিকে বলল—আচ্ছা বেকুব তো তুমি! কী করে বল, তোমার ক্ষমতা বেশি? আরে, বাপু! আমিই তো তোমাকে ভরণপোষণ করি। এ কথাটা ভুলে যাও কেন?
আগু-পিছু না ভেবে, দাম্ভিক গলায় হাতি জবাব দিল—তুমি কি আমার বাপ, না ঠাকুর্দা? তুমি আমার ভরণপোষণ করবে কী হে? নিজের পেট আমি নিজে চালাই। আমিই আমার প্রভু। 
শুনে ভারি রাগ হোল বরুণদেবের। ভাবল, তর্কাতর্কি অনেক হয়েছে। এবার একটু শিক্ষা দেওয়া দরকার হতভাগাটকে। জলদ গম্ভীর গলায় বলল—তাই না কি? নিজের পেট তুমি নিজেই ভরাও? ঠিক আছে, দেখা যাবে। আমি না থাকলে, তুমি আদৌ বেঁচে থাকবে তো? দেখা যাক একবার। এই বলে চলে গেল বরুণদেব।
বরুণদেবের চলে যাওয়া দেখে, সে কী বিরাট হাসি হাতির। মাঠ-ঘাট, পাহাড়-জঙ্গল সব কেঁপে উঠল হাসির শব্দে। নিজের মনে হাতি বলতে লাগল—হা হা। কী মজা। হেরে গিয়ে সরে পড়েছে ব্যাটা। এবার আমি একাই দুনিয়ার রাজা। 
সত্যি সত্যিই সরে পড়েছে বরুণদেব। এক মাস, দু’মাস করে কয়েক মাস কেটে গেল। এ পথ আর মাড়ায় না বরুণদেব। হাতির শাসনে চলছে বন পাহাড় জঙ্গল। সবই বেশ শান্তিতে চলছে। নিত্য দিন দুই মহারথীর বিবাদ থেকে রেহাই পেয়েছে সকলে। তারাও সুখী। 
এমনি করে দিন যায়। দেখতে দেখতে বর্ষাকাল এসে গেল। অনেক জীব-জন্তুরই নতুন শাবক জন্মের সময় হয়ে এল। নতুন ঘাস জন্মাবে মাঠে-ঘাটে। নতুন পাতায় ভরে উঠবে গাছগাছালি। ভরা গ্রীষ্মের রুখাশুখার পর, সবুজে ঝলমল করে উঠবে চার দিক। নদী-নালায় স্রোত বইবে আবার। পাখির কলকাকলীতে প্রাণের ছোঁয়া লাগবে সবার জীবনে।
কিন্তু বৃষ্টির দেখাই নাই। যেন উধাও হয়ে গিয়েছে কোথায়। ছিটেফোঁটা মেঘেরও দেখা নাই আকাশে। আকাশ ঝকঝকে নীল। সারাটা দিন গনগন করে জ্বলতে থাকে সূর্যটা। সবাই চেয়ে থাকে আকাশের দিকে। কখন একটা কালো মেঘ দেখা যাবে। কিন্তু ঐ চেয়ে থাকাই সার। মেঘ দেখাই যায় না আকাশে। 
মেঘ নাই, তাই বৃষ্টিও নাই। চার দিক শুকনো খটখটে।  খাবার কম পড়েছে সবার। উপোস দিতে হচ্ছে বাচ্চাদেরও। বড়দের তো একেবারে নাজেহাল অবস্থা।
সবাই দল বেঁধে হাতির কাছে এল দরবার করতে। সে-ই এখন মালিক সবার। -- কিছু একটা উপায় করো শিগগীর। নইলে যে মারা পড়তে হবে সক্কলকে। 
হাতির নিজের অবস্থাও খুব কাহিল। অত বড় একটা দেহ। খাবারও লাগে অনেক। কিন্তু জুটবে কোথা থেকে? গরমের চোটে চারদিক শুকিয়ে কাঠ।
হাতি শকুনিকে ডেকে বলল—যাও, যেভাবেই পারো, বৃষ্টির ব্যবস্থা কর। ধরে নিয়ে এসো মেঘকে।
শকুনি তো মহা ফ্যসাদে পড়ে গেল। সে হোল বরুণদেবের হুকুম-বরদার। ঠাকুরের এটা-ওটা ফাইফরমাস খাটা তার কাজ। সে কী করে হাতির হুকুমে গিয়ে বলবে,দেরী না করে বৃষ্টি নামাও। সে আবার হয় না কি? 
হাতি আর বরুণ দেবের বিবাদের কথা সে ভালোই জানে। মুখ কাঁচুমাচু করে শকুন বলল—মাফ করে দাও, মালিক। আমার কথায় কাজ হবে না। অন্য কাউকে বলো তুমি। 
হাতি তখন একটা দাঁড়কাককে ডেকে পাঠাল। পাখিদের ভেতর কাক হোল জ্ঞানী। হাতি তাকে বৃষ্টি নামাবার ব্যবস্থা করতে বলল। শুনে কাক ভারি খুশি। দারুণ ব্যাপার। কেরামতি দেখাবার এমন মওকা সব সময় জোটে না। পাড়ায় ফিরে, যেখানে যত দাঁড়কাক পাতিকাক ছিল, সবাইকে ডেকে জড়ো করল। কী করে কাজটা করে ওঠা যাবে, পরামর্শ চাইল সবার কাছে। 
তখন সে এক ভারি ফ্যাসাদ হোল। সবাই কথা বলতে চায়। সবাই আগে কথা বলতে চায়। কাউকেই থামানো যায় না। 
এতগুলো কাক একসাথে চেঁচাতে লাগলে, যা হওয়ার তাই হতে লাগল। সে এক পরিত্রাহী অবস্থা। কা-কা রবে সারা বন-পাহাড় তোলপাড়। কানে তালা পড়বার জোগাড় সকলের। 
হয়েছে কী, চেঁচামেচির আওয়াজটা বরুণদেবের কানে গিয়েও পৌঁছেছে। একটা মেঘের গায়ে হেলান দিয়ে ঝিমুচ্ছিল। এবছর বৃষ্টি ঝরাবার কাজ নাই। ভারি ভারি মেঘ নিয়ে ছুটে বেড়াতে হয় না আকাশের এমাথা ওমাথা। বেশ আয়েশে সময় কাটছে তার। হঠাৎ চিৎকারটা কানে যতে যেমন কৌতূহলী, তেমনই বিরক্তও। 
শকুনিকে ডেকে বলল—দেখে আয় তো, কাকগুলো খামোখা এমন চেঁচায় কেন? 
শকুনির তো সবই জানা। সে বলল—খামোখা নয়, ঠাকুর। হাতির হুকুম হয়েছে, বৃষ্টির ব্যবস্থা করতে হবে। দাঁড়কাকেদের মোড়লের উপর ভার পড়েছে কি না। তাই তার শলা করতে বসেছে। 
বরুণদেব তো হেসেই আকুল কথা শুনে। – আচ্ছা বেকুব তো। ও হতভাগা বললে বৃষ্টি হবে? বৃষ্টি হবে, যখন আমি বলব। 
একথা বলে, আবার মেঘের গায়ে হেলান দিয়ে, এলিয়ে রইল। একটা ঘুম দিয়ে নিলে হয়।
কিন্তু চাইলেই কি আর ঘুম আসে? না আসবার উপায় আছে ঘুমের। যা চেঁচাচ্ছে কাকের দল। 
মাথায় একটা ফন্দি এল শকুনের। এই সুযোগ। তার গলাখানা যেমন লম্বা, তেমনই তার কান দুটোও। মাথা ঝাঁকিয়ে, কানের লতি দুলিয়ে সে বলল—একটা কাজ করুণ ঠাকুর। কাকেরা সবচেয়ে ভয় পায় বৃষ্টি ফোঁটাকে। দিন বেশ করে ভিজিয়ে। চেঁচামেচি সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
কথাটা বেশ মনে ধরল বরুণদেবের। মেজাজটা খিঁচড়ে যেতে বসেছিল। একটা কালো মেঘকে ডেকে হুকুম করে দিল—যা তো, বেশ করে ভিজিয়ে দিয়ে আয় কাকগুলোকে।
অমনি মূষলধারে বৃষ্টি পড়তে লাগল আকাশ থেকে। 
ভোজবাজির মত কাজ হোল তাতে। কাকেদের গলা ফাটানো বন্ধ। যে যেদিকে পারল সরে পড়ল সভা ছেড়ে। 
ওপরে বরুণদেবও খুশি। বৃষ্টি ঝরানো বন্ধ করবার হুকুম দিয়ে, বিশ্রাম নিতে চলে গেল। 
এদিকে হোল কী, বৃষ্টি থেমে যেতেই, কাক হাতির কাছে গিয়ে হাজির। কাক যেমন জ্ঞানী, তেমনি মহা ধুরন্ধরও। হাতিকে বলল—হুকুম মতো কাজ করে দিয়েছি, মালিক। 
হাতিও পুলকিত—জানতাম, তোকে দিয়েই কাজটা করানো যাবে। 
কিন্তু বৃষ্টি আর হয়েছে কতটুকু। ছোটখাটো দু’একটা খানাডোবা সামান্য কিছু ভরেছে মাত্র। ক’টা দিন যেতেই আবার সব শুকিয়ে কাঠ। 
একটা ডোবায় সামান্য খানিকটা জল ছিল তখনও। হাতি সেটা তার নিজের বলে ঘোষণা করে দিল। একটা কচ্ছপকে বসাল পাহারায়—আমি যখন থাকব না, জলটা থাকবে তোর পাহারায়। কাউকে নামতে দিবি না। নইলে, তোর কিন্তু রক্ষে নাই। 
আবার সেই খরা। চারদিক ফুটিফাটা, খটখটে। সবুজের চিহ্নটুকুও নাই। কচ্ছপকে জলের দায়িত্ব দিয়ে, হাতি খাবারে খোঁজে বেরিয়ে গেল। 
খানিক বাদে এক জিরাফ এসে হাজির। -- কচ্ছপ ভাই, একটু জল দেবে? 
পাহারিদারির ভার পেয়ে, পুঁচকে কচ্ছপের এখন ভারি দেমাক। সে বলল—কেটে পড়ো এখান থেকে। জলে নামবে না কিন্তু। 
জিরাফ কাকুতি করে বলল—একটি পাও নামব না। উপর থেকেই গলা ডোবাব। বেশি না। এক ঢোঁক খেয়েই চলে যাব। কথা দিচ্ছি। 
--জানো না। এ জল হাতির জন্য বরাদ্দ। ভালোয় ভালোয় কেটে পড়ো দিকি। কচ্ছপ ধমকে দিল জিরাফকে। 
কী আর করে? জিরাফ ফিরে গেল হতাশ হয়ে। এর পর একে একে চিতা, ভালুক, জেব্রা আরও সব প্রাণীরা আসতে লাগল। কিন্তু লাভ হোল না কিছুই। কাউকেই জলে নামতে দিল না কচ্ছপ।
বিকেল হয়ে আসছে। এক সিংহ এসে হাজির। বনের রাজা সে। লেজটা আকাশে উঁচিয়ে, হেলতে দুলতে ডোবার পাড়ে এসে পৌঁছালো। জল না পেয়ে, একটা কাঠবেড়ালি ফিরে গিয়েছে এখান থেকে। সেই গিয়ে জলের খবরটা তুলে দিয়েছে রাজার কানে। 
কচ্ছপ কিন্তু ঘাবড়ে গেল না রাজাকে দেখে। গলা বের করে বলল—জলে নামা চলবে না। হাতির জন্য রাখা আছে এই জল। 
রাজামশাই একবার কটমট করে চাইল শুধু কচ্ছপের দিকে। গটগট করে নেমে, জল খেল পেট ভরে। ফিরে যাওয়ার সময়, ছোট্ট করে একটা লাথি কষালো কচ্ছপ্টাকে। ডোবাটার একেবারে মাঝখানে গিয়ে পড়ল বেচারা। 
খবর ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগল না। সবাই দল বেঁধে এসে জল খেয়ে যেতে লাগল। দেখতে না দেখতে সব শেষ, থকথকে কাদা ছাড়া আর কিছুই পড়ে রইল না। 
সূর্যদেব পাটে নামবে, হাতি ফিরে এল। ডোবার দিকে চেয়ে তার চোখ ছানাবড়া। এক ফোঁটা জল নাই কোথাও। কচ্ছপ পাঁক ছেড়ে উঠে এসে বসে আছে তখন। হাতি রাগে গরগর করতে করতে, কচ্ছপকে জানতে চাইল—তুই কোথায় ছিলি, হতভাগা?
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কচ্ছপ বলল—সবাই এসে ভিড় করল। আমি একা কী করব? তার উপর সিংহ এসেছিল। তাকেও মানা করেছিলাম আমি। সে তো এমন করে চাইল, যেন গিলেই ফেলবে আমাকে।
সিংহের নাম শুনে, আকাশে শুঁড় উঁচিয়ে, বিশাল এক গর্জন করে উঠল হাতি। বলল—সিংহ গিলে খায়নি তোকে। আমিই গিলে খাচ্ছি। হতভাগা কোথাকার। আজই তোর ভবলীলা শেষ। 
বলেই কচ্ছপটাকে মুখে পুরে, কপ করে গিলে ফেলল হাতি। 
পুঁচকে ছোট্ট একটুখানি হলে কী হবে, কচ্ছপ অত সহজে হার মানতে রাজি নয়। তাছাড়া এত বড় শাস্তি তো তার পাওনাই নয়। সে কী এমন দোষ করেছে? 
এদিকে হোল কী, হাতির পেট মানে বিরাট একটা জালা যেন। তার ভেতর এসে হাজির হয়েছে কচ্ছপ। দেদার ফাঁকা জায়গা এখানে। ঘুরে ফিরে দেখে নিয়ে, কচ্ছপ ভাবল, যে করেই হোক, বেরিয়ে যেতে হবে এখান থেকে। খাবার দাবার কিছু নাই এখানে। ভেতরে পড়ে থাকলে, বেশিদিক টিকে থাকা যাবে না। 
চার পা দিয়ে গর্ত খুঁড়তে শুরু করে দিল সে। গর্ত কাটতে পারলেই, বেরিয়ে যাওয়া যাবে। 
একটু পরেই যন্ত্রনায় ককিয়ে উঠল হাতি। ভয়াণক যন্ত্রণা শুরু হয়েছে পেটের ভিতরে। দাপাদাপি, ছফট করল খানিকক্ষণ। তারপর ধপাস করে পড়ে গেল নিথর দেহে। 
সুড় সুড় করে বাইরে বেরিয়ে এল কচ্ছপও। এদিক ওদিক চেয়ে, কোন রকমে সরে পড়ল সেখান থেকে। বড্ড জোর বাঁচা গেছে। আবার গিয়ে ডোবার পাঁকে সেঁধিয়ে গেল বেচারা। অনেক শিক্ষা হয়েছে। সেই থেকে আর বড়দের কারও সাতে পাঁচে থাকে না কচ্ছপেরা।  
এদিকে হয়েছে কী, উপর থেকে সবই দেখছিল বরুণদেব। হাতি যখন বিকট হুঙ্কার দিয়েছিল সিংহের নাম শুনে, ব্যাপারটা তখন থেকে চেয়ে চেয়ে দেখছিল বরুণদেব। হাতিকে চিৎপটাং হয়ে পড়তে দেখে, মুখে একটু কষ্টই হোল তার। লড়াই-ঝগড়া  করা যাবে, এমন কেউ আর রইল না যে! 
যাকগে, হাতি যখন গেছেই, অন্যদের বিপাকে ফেলা কেন? একজনের দোষে সবাইকে সাজা দেওয়া ঠিক নয়। 
মন নরম হোল বরুণদেবের। হুকুম করতেই চারদিক থেকে এসে ভীড় করল কালো মেঘের দল। ঝরঝরিয়ে বৃষ্টি নামল মুষলধারায়। নদী-নালা, মাঠ-ঘাট, পুকুর-ডোবা যেখানে যা ছিল, কানায় কানায় ভরে উঠল সব।
রুখা-শুখা মাটি সবুজ রঙ ধরল দুদিন না যেতেই। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচল সকলে।
বরুণ দেবতা বড় কি না-- এমন বেয়াড়া প্রশ্ন আর তোলে না কেউ সেদিন থেকে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments